নক্ষত্র-সন্ধ্যা

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ০৬/০৬/২০১৪ - ১২:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্টারপার্টি হবার কথা ছিলো এপ্রিলের শেষের দিকে, কোনো একটা সুন্দর সন্ধ্যায় যখন আকাশ স্বচ্ছ-নির্মল, একেবারে পরিষ্কার। কিন্তু কী কারণে যেন পাল্টানো হলো সময়, আসলে সেমেস্টার শেষ হবার মুখে ব্যস্ততা খুবই বেশী থাকে, সমস্ত ফাইনাল পরীক্ষা টরীক্ষা ফাইনাল-গ্রেডিং গ্র্যাজুয়েশান অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবই তো তখন! তখনের জন্য অপেক্ষা করলে হয়তো বাতিল হয়ে যেতে পারে, তাই ফেব্রুয়ারীতেই হলো স্টারপার্টি।

তরুণবয়সী ছাত্রছাত্রী সব, ওদের মধ্যে উৎসাহের কমতি একেবারেই নেই। ঘরবন্দী গাড়ীবন্দী শহরবাসী ছেলেমেয়ে এরা সব, এমন তারা দেখার সন্ধ্যা তেমনভাবে আসে কই ওদের? অ্যাস্ট্রোনোমির ক্লাসও তো ওরা করে ঘরের মধ্যে দিনের বেলা, কখনো কম্পুটারের সামনে সিমুলেশান, কখনো বা হাতে হাতে হিসেব করে করে গ্রাফের উপরে প্লট করা...ওরা কতবার জিজ্ঞাসা করতো বাইরে সত্যি সত্যি তারা দেখার কিছু সুযোগ আছে কিনা...এতদিনে এসেছে সেই সন্ধ্যা।

শহরে আলোক-দূষণ, বড়ো বড়ো পথবাতি আর বিজ্ঞাপণের আলো, বাড়ীর আলো, দোকানের আলো, গাড়ীর আলো হাজারো আলো আবিল করে রেখেছে সব। অপেক্ষাকৃত কম প্রভার তারাগুলোকে দেখতে দেয় না, নেবুলা আর গ্যালাক্সি তো দূরস্থান। তাই শহর ছাড়িয়ে দূরে চললাম আমরা। ছাত্রছাত্রীরা সব উৎসুক চোখ নরম মুখ আঠেরো/ উনিশ/ কুড়ির তরুণ-তরুণী---মেরী, জ্যাক, আমান্দা, অ্যাডাম, র‌্যান্ডাল, এলিজাবেথ, জো, সারা, ক্রিস, চার্লস, জেফ্রি আরো অনেকে ...তারা-চেনার সন্ধ্যায় ওরা কলকল করতে করতে চলেছিলো।

অ্যাস্ট্রোনমির প্রফেসরের নাম ক্রিস, ক্রিস্টোফার। উনি সুদূর উত্তরের রাজ্য উইসকনসিনের লোক, মৃদু দক্ষিণী শীত দেখে উনি খুব হাসেন, বলেন শীত মানে হলো বরফের সাদা কম্বলের তলায় পড়ে থাকবে পৃথিবী, মাসের পর মাস। তবে না শীত! এখানে তো তোমরা আছো চিরবসন্তের দেশে!

ওঁর গাড়ীটিকে অনুসরণ করে চলেছে সবকটা গাড়ী, নির্দিষ্ট জায়গায় থামা, তারপরে হাঁটুভর ঘাসপালা মাড়িয়ে দূরের দিকে চলা। প্রফেসর সেখানে একটি ফার্ম হাউসের ব্যাক-ইয়ার্ডে দূরবীন বসিয়ে গিয়েছেন বিকালেই। সূর্য ডুবে গেছে যদিও, তবু অল্প আলো এখনো পশ্চিমদিকচক্রে ছড়িয়ে আছে কোমল হয়ে। আরেকটুক্ষণ, তারপরেই অন্ধকারে ঢেকে যাবে সব। তারারা ফুটবে, গ্রহেরা এখনই দেখা দিতে শুরু করেছে।

মনে পড়ছিলো সেই ঘূর্ণীঝড় ক্যাট্রিনার পরের কথা, আগস্টের সেই ঘূর্ণীঝড়ের পরে যখন গোটা শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রইলো, তখনকার সেই কয়েকটি রাত্রি ছিলো অত্যন্ত বিরল সুযোগ, শহরের বুক থেকেই আলোকদূষণহীন ছায়াপথময় আকাশ দেখার। আলোর এত সূক্ষ্ম তারতম্য যে হতে পারে, রাত্রির আকাশের যে নিবিড় ঘননীল, তার মধ্যে মণিকণার মতন যে জ্বলে তারারা, হাওয়া-হাল্কা ওড়নার মতন যে নেবুলারা দেখা দেয়, দেখা দেয় গভীর মহাকাশের গ্যালাক্সি...ঐ নিবিড় রাত্রিনীল সকালের আলোয় কীভাবে দুধালো হয়ে ওঠে, তারারা মিলিয়ে যায়, গ্রহেরা থাকে, ঊষা জেগে ওঠে পুবে,সে আলোয় গ্রহেরা ডুবে যায়---সে কেবল তখন দেখতে পেয়েছিলাম।

আর একবার... জানুয়ারী মাসে শীতের সময় বনফায়ার হয়েছিলো শহর থেকে অনেক দূরে, এক বনাঞ্চলে---তখন দেখেছিলাম আকাশ ভরে তারায় তারায় ঠাসাঠাসি। দেখে দেখে মনে হতো ঐ যে স্পেস থেকে কি অপরূপই না দেখে ওরা! এখন অবশ্য স্পেস টেলিস্কোপ থেকে ছবি আসে, আমরাও দেখতে পারি, কিন্তু সে তো ইমেজ, মুখোমুখি দেখা তো নয়!

আর মনে পড়ে নিজের দেশে মাঠের ধারের বাড়ীটা আমাদের, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় লোডশেডিং হয়ে গেলে উঠানে বেরিয়ে রাত আকাশের তারা চেনা...ঐভাবেই তো চেনা হয়েছিলো চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, জ্যেষ্ঠাকে, চেনা হয়েছিলো সপ্তর্ষিমন্ডল, হেমন্তসন্ধ্যায় চেনা হয়েছিলো কালপুরুষ...সে কতকাল আগের কথা...

ক্যাট্রিনা ঝড়ের সেই কয়েক নিষ্প্রদীপ রাত্রির পরে আবার আজ। মাঝে শুধু চোখ ধাঁধানো আলো আর আলোয় আবিল হয়ে থাকা অর্ধচেতন রাত্রির মালা।

আমরা দূরবীনের কাছে পৌঁছাই আস্তে আস্তে, আকাশে শীত রাত্রির উজল প্রহরী ওরায়ন মানে কালপুরুষ। কালপুরুষের কাঁধের লাল তারা বেটেলগিউস (আর্দ্রা) দেখিয়ে প্রফেসর ব্যাখা করেন যে এটি এক বয়স্ক রেড জায়ান্ট তারা, কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সব ফুয়েল ফুরিয়ে ফেলে বাইরের শেলের বহির্মুখী চাপে বেলুনের মতন ফুলে উঠেছে এত। আমাদের সূর্যও নাকি আরো প্রা্য় পাঁচশো কোটি বছর পরে ঐরকম ফুলেফেঁপে বিরাট হয়ে যাবে, কাছের গ্রহট্রহগুলি সব গিলে নেবে।

ফোকাসে তারাটিকে আনার পরে সবাই এক এক করে আইপিসে চোখে দিয়ে দেখতে থাকে... তারপরে উনি ফোকাসে আনেন কালপুরুষের পায়ের কাছের আরেক কনস্টেলেশনের আরেক তারাকে। এটা রাত-আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা সিরিয়াস, আমরা লুব্ধক বলি যাকে, তাকে দেখাতে দেখাতে ব্যাখা করতে থাকেন প্রফেসর-কেমন করে লুব্ধকের সঙ্গী তারাটিকে দেখেই প্রথম বোঝা গেলো কেন্দ্রের ফুয়েল ফুরিয়ে ফেলা তারারা কীভাবে ঘন শ্বেতবামন তারায় পরিণত হয়...

এসব দূরের গভীর মহাকাশের গল্প ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে আমাদের সৌরমন্ডলে এসে পড়লেন তারপরে, গ্রহদের দেখতে দেখতে কথায় কথায় উঠে এলো এক্সট্রা-সোলার প্ল্যানেটদের কথা-আমাদের সূর্য ছাড়াও অন্যান্য নক্ষত্রের চারিপাশে গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, একটা দুটো নয়, অনেক অনেক তারার কাছে- কিন্তু ওরা প্রাণী-বসবাসের উপযোগী কিনা এখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না।

ঐ অসীম ঘননীল তারাময় আকাশের দিকে চেয়ে সকলে কল্পনাপ্রবণ হয়ে ওঠে, কোথাও কোনো ভিন্ন নক্ষত্রের গ্রহমন্ডলীতে হয়তো আছে প্রাণ, হয়তো আছে আমাদের মতন জীব, হয়তো এমনই সন্ধ্যায় ওদের কোনো ছোট্টো দল এমনি করেই জল্পনা কল্পনা করছে এই মহাবিশ্বে ওরা নিঃসঙ্গ কিনা তাই নিয়ে... এখানে আমরা, এতদূর থেকে কিছুতেই সাড়া দিয়ে উঠতে পারছি না...বন্ধু, আমরা আছি, আমরা আছি, আমরা আছি-ই-ই-ই-ই-...


মন্তব্য

নির্ঝর অলয় এর ছবি

আর মনে পড়ে নিজের দেশে মাঠের ধারের বাড়ীটা আমাদের, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় লোডশেডিং হয়ে গেলে উঠানে বেরিয়ে রাত আকাশের তারা চেনা...ঐভাবেই তো চেনা হয়েছিলো চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, জ্যেষ্ঠাকে, চেনা হয়েছিলো সপ্তর্ষিমন্ডল, হেমন্তসন্ধ্যায় চেনা হয়েছিলো কালপুরুষ...সে কতকাল আগের কথা...

ক্যাট্রিনা ঝড়ের সেই কয়েক নিষ্প্রদীপ রাত্রির পরে আবার আজ। মাঝে শুধু চোখ ধাঁধানো আলো আর আলোয় আবিল হয়ে থাকা অর্ধচেতন রাত্রির মালা

কী অপূর্ব গদ্য!
অসাধারণ!

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ নির্ঝর অলয়। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এক লহমা এর ছবি

চলুক
এরকম নক্ষত্র-সন্ধ্যা-র সভা আরো বসুক! হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা এর ছবি

খুব কমই বসতো নক্ষত্রসভা।
পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

অ্যাস্ট্রোনমির প্রফেসরের নাম ক্রিস, ক্রিস্টোফার। উনি সুদূর উত্তরের রাজ্য উইসকনসিনের লোক, মৃদু দক্ষিণী শীত দেখে উনি খুব হাসেন, বলেন শীত মানে হলো বরফের সাদা কম্বলের তলায় পড়ে থাকবে পৃথিবী, মাসের পর মাস। তবে না শীত! এখানে তো তোমরা আছো চিরবসন্তের দেশে!

একদম খাঁটি কথা। ছয়/সাত মাস বরফের পাহাড়ের নীচে ডুবে না থাকলে সেটা কে শীত বলে নাকি? আমিও সেই 'সুদূর উত্তরের রাজ্য' উইসকনসিনেরই লোক খাইছে

সোহেল লেহস

তুলিরেখা এর ছবি

তাই নাকি? শীত কেমন বুঝতেছেন? হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইরে, এবছর শীততো যায় না ওঁয়া ওঁয়া এই জুন মাসেও বাংলাদেশী স্টাইলের শীত পড়েছে মন খারাপ

সোহেল লেহস

তুলিরেখা এর ছবি

কিন্তু গ্রীষ্ম তো এখন এসে পড়বার কথা! চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

গ্রীষ্মতো এসে পড়ার কথা কিন্তু সে আসি আসি করেও আসছে না। আজকেও সোয়েটার পড়ে বাইরে বের হতে হল। এবছর সত্যিকারের গ্রীষ্মের দেখা পাব কিনা সংশয়ে আছি মন খারাপ

সোহেল লেহস

এক লহমা এর ছবি

সোয়েটার পরে! সে ত বড়ই করুণ অবস্থা! মন খারাপ

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা এর ছবি

এখনও সোয়েটার???? বলেন কী????

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

দুই দিন আগেও সোয়েটার পড়েছি। বাংলাদেশের শীতকালের মত ঠান্ডা পরেছিল। আজ একটু গরম পরেছে। উইসকনসিনের ওয়েদার এমনি।

সোহেল লেহস

তুলিরেখা এর ছবি

চিরশীতের রাজ্য তাহলে, তাই কি? চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকটা ওই রকমই বলতে পারেন। গ্রীষ্মে ৩ মাসের মতন গরম থাকে। বাকিটা সময় হাল্কা ঠান্ডা থেকে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা।

সোহেল লেহস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।