নদীটা এখনো একইরকম আছে, চুপ করে গিয়ে দাঁড়াই ওর কাছে। অদ্ভুত সুন্দর কলধ্বনি তুলে নদীর ধারা ছুটে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। স্রোতোধারা ছুঁয়ে যাচ্ছে পাড়ের পাথর, বালি, ঝুঁকে পড়া গাছের পাতা। চারিপাশের মাঠ পাহাড় গাছপালা সবই যেন ওর কাছে মুহূর্তের দেখা হওয়া বন্ধু। নিরাসক্ত ভালোবাসায় তাদের ছুঁয়ে বা না ছুঁয়ে নদী চলে যায় নিজের পথে। ও কি কারুকে মনে রাখে?
ওর কি মনে আছে সেই পঁচিশ বছর আগের দুটি বালিকাকে? তাদের মধ্যে একজন, আজকে জীবনের অসংখ্য তিক্তমধুর অভিজ্ঞতায় সেঁকা হয়ে হয়ে আবার তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, নদী কি চিনতে পারে তাকে? এই লবণমরিচ চুলের মধ্যে, এই বিনিদ্র রাতের কালিপড়া চোখের মধ্যে, এই শক্ত আর কঠোর হয়ে আসা ঠোঁটের কোণায় সে কি খুঁজে পায় সেই অমলীন বালিকাটিকে? যার ছিল কালো রেশমের মতন থোকা থোকা চুল, লাবণ্যময় মুখ, কোমল দুটি চোখ, করুণ দুটি ঠোঁট? নাহ, মনে হয় না নদী চিনতে পারবে। কিন্তু আমি তো ওকে সেই অতদিন আগের মতন একই দেখছি। আমার যে ওর কাছে একটা কথা বলার আছে। সেই যে আর একজন মেয়ে, যে আজ আসে নি, আসবে না, তার জন্য একটা কথা-
হঠাৎ দৃশ্য বদলে যায়। ফিরে আসে সেই পঁচিশ বছর আগের দুপুর। এইখানেই দাঁড়িয়েছিলাম সেদিন আমি। আমি ইমা।
"ইমা-আ-আ-আ---"
দূর থেকে ছুটে আসে ডাক, রিমা ডাকছে। নদীর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পিছনে থাকাই, দূরে মাঠের উপর দিয়ে পায়ে চলা পথ, দেখা যাচ্ছে রিমাকে, সে ছুটে আসছে।
রিমা আমার যমজ বোন, আমরা কয়েক মিনিটের ছোটো বড়। আমি আগে ধরাধামে অবতরণ করি আর আমার মিনিট পাঁচেক পরে ভূমিষ্ঠ হয় রিমা।
আমরা দেখতে কিন্তু আলাদা। আইডেন্টিকাল টুইন না। আমাদের চোখমুখ, গায়ের রঙ, স্বভাব---সবই বেশ আলাদা। অথচ, কোথায় যেন গভীর মিল। যেন এখনো কোথায় মিলে আছি আমরা, কোনো একটা রহস্যময় চেতনার গ্রন্থি আমাদের বেঁধে রেখেছে এক করে। রিমা আমায় ছাড়া থাকতে পারে না। আমিও ওকে ছাড়া থাকতে পারি না।
কেবল এই ক'দিন আগে আমার হঠাৎ একটা অদ্ভুত অনুভব হলো, তার পর থেকেই--
রিমা এসে গেছে, রীতিমতন হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতেই বললো, "ইমা, তুই একাই চলে এলি এখানে? আমায় একবার ডাকলি না?
আমি একটু হাসি, বলি, "সাঁতার কাটবি, রিমা?"
আমরা দু'জনেই সাঁতার জানি। পাড়ার সাঁতার শেখার ক্লাবে সাঁতার শিখেছি সেই সাত বছর বয়সেই। আমাদের এখন বয়স এগারো বছর, দুইজনেই প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে এই বছর ভর্তি হয়েছি হাইস্কুলে, ক্লাস ফাইভে। বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছি এখন।
আগে পাড়ায় খেলাধূলায় ছেলেরা মেয়েরা মিলে খেলা দৌড়াদৌড়ি মারামারি সবই করতাম দু'জনে। আস্তে আস্তে মেয়েদের দল আলাদা হয়ে যাচ্ছে ছেলেদের থেকে।
রিমা সামলে নিয়েছে দৌড়ে আসার হাঁপ। এখন আমার দিকে চেয়ে উৎসাহে দীপ্ত হয়ে বলে, "হ্যাঁ, আয়, নামি জলে।"
আমরা নদীতে নেমে পড়ি দু'জনেই। তারপরে সাঁতার শুরু করি। জলের মধ্যে মাছের মতন খেলা যেন।
ডুব দিলে যেন এক অন্য ভুবন। ভাসলে আরেক ভুবন। আমরা দুই বোন ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে সাঁতার কাটতে থাকি। কী যেন মনে পড়ে পড়ে পড়ে না! এই আমরা দু'জন, কোথায় ছিলাম, কোথা থেকে এলাম এখানে? এই দুনিয়ায় কেন এলাম এইভাবে হাতে হাত জড়িয়ে, যেখানে এত কঠোর সব বিভেদ আর বিচ্ছিন্নতা!
গতকালের ঐ ঘটনা কেন ঘটলো আমার জীবনে? তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে ফুলের মালা কেটে ফেলার মতন ঐ ঘটনা যেন ছিঁড়ে দিয়েছে আমাদের দুই বোনের মধ্যের সংযোগসূত্রটি। সহসা নিজের দিকে চোখ পড়েছে আমার। রিমা আর আমি একরকম দেখতে নই, রিমা টুকটুকে ফরসা আর আমি শ্যামবর্ণ। অথচ এতদিন সেকথা আমার মনেই হয় নি! কাল সন্ধ্যেবেলা তিন্নিমাসী আর মায়ের কথা শুনে না ফেললে এখনো মনে হতো না তো!
আমি ডুব সাঁতার দিয়ে ভুস করে ভেসে উঠি রিমার খুব কাছে, জলসিক্ত মুখে খিল খিল করে হাসি দু'জনেই।
এইটাই উপযুক্ত সময়। কিচ্ছু সন্দেহ করেনি রিমা। ওকে আরেকটু গভীরের দিকে নিয়ে যাই, তারপরে ডুবিয়ে ধরে - কতক্ষণ লাগবে?
সম্বিৎ ফিরে আসে রিমার উৎসাহী কন্ঠে, "ইমা দ্যাখ দ্যাখ, ঐ দ্যাখ কী যেন একটা ঘাই দিল ওখানে। যাহ ডুবে গেল, তুই দেখতে পেলি না।"
(চলছে)
মন্তব্য
প্রাইমারী থেকে হাইস্কুলে ভর্তি হলে ক্লাস সিক্স এ হবার কথা ,ফাইভে হবে কি? পর্বটা একটু ছোট হয়ে গেল৷ টুইস্ট রাখার জন্য কি এমনটা করলেন?
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন ক্লাস ফোর পর্যন্ত ছিলো প্রাইমারি, তারপর ক্লাস ফাইভ থেকে হাইস্কুল মানে সেকেন্ডারি। সেটা ছিল ক্লাস টেন পর্যন্ত। তারপর ইলেভেন-টুয়েলভ ছিল হায়ার সেকেন্ডারি।
এখন কি এই রীতি বদলে গেছে?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সাঁতার কাটি না আজ অনেক বছর।ভুলে যাচ্ছি না তো?দারুন হয়েছে গল্পটা...
-------------
রাধাকান্ত
সাঁতার আর সাইকেল একবার শিখলে শুনেছি আর ভোলে না।
লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তিন্নীমাসি আর মায়েরা যে আলাপ করে-তা যে কত ইমার অনুভূতি বদলে দিতে পারে! চলুক.......
দেবদ্যুতি
হ্যাঁ, সেটাই।
এর পরের পর্বেই তিন্নিমাসী আর মায়ের আলাপের কাহিনী।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ওহ তুলিদি, কতদিন পর তোমার সেই মায়াগন্ধী শব্দের খেলা!!
ভারী আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের জন্য।
পথ্থম মন্তব্যে আগে চিড়াটা মুড়িটা দিতে, এখন দিবে না কিছুমিছু
আমারও দমবন্ধ লাগছিল এতদিন লিখতে না পেরে। শেষে যা হয় হলো তাই দিলাম।
তোমার জন্য রইলো মোতিচুর আর নিমকি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি আপনার খুব বেশি লেখা পড়িনি। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো কবি এই গল্পের রূপকার। ভাল লাগা রইল। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
অনেক ধন্যবাদ সুলতানা সাদিয়া।
আপনার সিরিজটি আকুল হয়ে পড়ি, এমন লেখা পড়িনি বহুদিন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অনেক সাবলীল!
মন ছোঁয়া অনুভূতি!
অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
অনেক অনেক ধন্যবাদ দীপংকর।
আপনিও ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
পরের পর্বের অপেক্ষায়.....
স্বয়ম
ধন্যবাদ স্বয়ম। পরের পর্ব তুলে দিলাম।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তা বলেছেন , সাতার আর সাইকেল চালানো একবার শিখলে আর ভোলা যায় না । আবার এমন ঘটনা বা গল্প আছে যা সামনে ঘটলে বা একবার পড়লে ভোলা যায় না। তাই না?
----------
রাধাকান্ত
রাধাকান্ত, একদম ঠিক। সাইকেলের ব্যাপার আমি নিজেই চেক করে দেখেছি। সাঁতারটা দেখতে পারিনি, আসলে পাড়ার পুকুরে কলসী উপুড় করে ধরে সাঁতার কাটা শিখেছিলাম কিনা, তার পরের স্টেজে আর উঠতে পারিনি। ভবিষ্যতে একটা চেষ্টা করার ইচ্ছে আছে, সাঁতারের ইস্কুলে দেখি সুন্দর হাওয়াভরা ডানা বেঁধে দেয় দুই ড্যানায়।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমার বিয়েতে ছেলেপক্ষের (ছেলের নয়) প্রধান আপত্তি ছিল গায়ের রঙ। আমার মেয়েটা আমার মত রঙ পায়নি; সে পেয়েছে তার দাদির রঙ। এগুলো নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই তারপরও মনে হয়, মেয়েটা যদি আমার কালো হত, আমি খুশি হতাম।
অর্হণের মা
পড়ার জন্য আর কমেন্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, অর্হণের মা।
আসলে আমার চারিপাশে এই বর্ণবাদী মানসিকতা এত দেখেছি, এত দেখেছি যে আমি একেবারে তিতিবিরক্ত! এই নিয়ে ছোটো ছোটো মেয়েদের পর্যন্ত মানসিক চাপ দেখেছি। তারপরে বিয়ের পরে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ীতে নানা মানসিক অত্যাচারের সাথে সাথে এই "বৌ আনলাম বটে ! কালো কালিন্দী কলকল করতাছে য্যান, কী রূপের ধুচুনি আনলাম আমার সোনাচান পোলার লাইগা, কপাল আমার" এইসব কথা। দশকের পর দশক কেটে যাচ্ছে, দুনিয়া কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে, অথচ এই অন্ধকার দূর হয় না !!!!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমার ছোট ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখলাম। আমার মা বললো , "মেয়ে তো কালো/শ্যমলা" ! আমি আমার মাকে একটা তীর মারলাম এই বলে যে, "তোমার গায়ের রঙের দিকে তাকাও"। সমাজের মধ্যে এই ব্যাধির চিকিতসা আমাদের ই করতে হবে। মুরুব্বি গুলোরে না দাবড়ানি দিলে সোজা হবে না।
আর আমার সাইকেল চালানো শিখার পেছনে এক বিরাট ইতিহাস তাই ভুলোম না কোনদিন। বাকিটা বুঝে নিবেন। হা হা হা ।
-------------
রাধাকান্ত
এইসব সমাজের এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে যে দূর করা খুব কঠিন। এক সময় ভেবেছিলাম মেয়েরা চাকরি বাকরি করে নিজেরা উপার্জন করতে শিখলেই মনে হয় এসব দূর হবে। এখন দেখি তাও তো না! আরো ঘোরালো পথে ফিরে ফিরে আসে এইসব ঝামেলা।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এই যে আজ আমরা বুঝতে শিখেছি এটাকেই আস্তে আস্ত ছড়িয়ে দিতে হবে । সমাজের ঘুনে ধরা অংশ তো এই ধারনাগুলোই।আমাদের সমাজের নারীরা বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থাতে বড় হয়েছে তাই হুট করে হয়তো এগুলো দূর করা যাবে না। কিন্তু আমরা পারবোই এই দৃঢ়তা নিয়েই এগুতে হবে।
----------
রাধাকান্ত
যথারীতি সৌকর্যের ছাপ রেখে গেছেন।
একটা এ-কার বেশি ব্যবহৃত হলো না?
তৃতীয় ব্যক্তির কথন বলে ভ্রম হচ্ছে। 'আমাদের দুজনের' লিখলে অনেকটাই ভ্রমমুক্তি হয়।
তবুও আমার কাছে পাঁচ তারা পেল লেখাটি!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
অনেক ধন্যবাদ রোমেল। আপনার উল্লিখিত জায়গাগুলো বদলিয়ে দিলাম একটু। দেখুন তো এইবারে ঠিক হয়েছে কিনা।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন