নৈরঞ্জনা(৩)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ০১/০৬/২০১৮ - ১:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৩। ভোর ভোর গন্তব্যে পৌঁছল বাস। আমি শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার । হঠাৎ শুনি ঝাঁকুনি দিয়ে কে যেন ডাকছে, "আবীর, আবীর, ওঠো। পৌঁছে গিয়েছি আমরা।"
কুয়াশাজড়ানো স্বপ্নের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসি ঝাঁকুনি খেয়ে, কাশ্মীরা আমাকে ডাকছে। জেগে দেখি বাস পৌঁছে গিয়েছে। ঘুমভাঙা চোখে যাত্রীরা সব হাই তুলতে তুলতে চোখ ডলতে ডলতে জিনিসপত্র গুছিয়ে নামছিল। আমরাও।

ডক্টর আদিত্য নিজেই এসেছিলেন আমাদের রিসিভ করতে। আমাদের নিয়ে নিজের গাড়ীতে তুললেন। উনি নিজেই গাড়ী চালান বেশিরভাগ সময়, তবে আজ ড্রাইভার ছিল সঙ্গে। হাসতে হাসতে ডক্টর আদিত্য বলছিলেন, "আরে কাশ্মীরা প্রথম এলো এখানে,সব দেখাতে দেখাতে বলতে বলতে যাবো তো! গাড়ি চালানোতে মন পড়ে থাকলে কেমন করে সব দেখাবো?"
ভারী সুন্দর চওড়া মসৃণ রাস্তা, গাড়ী চললো হু হু করে। দু'ধারে খোলা মাঠ, শস্যক্ষেত, বড়ো বড়ো দিঘি, মস্ত মস্ত সব মহীরুহ, মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম। সকালের নরম রোদ্দুরে সব ঝকমক করছে। আকাশ ঝকঝকে নীল। তাপমাত্রা চমৎকার, না ঠান্ডা না গরম।

দূরে একটা নীলচে পাহাড়ের ঢেউ দেখা দিল, ডক্টর আদিত্য বললেন, "ঐ পাহাড় এখানের খুব পবিত্র জায়গা। ওর চূড়ার কাছে আছে দেবীমন্দির, খুবই জাগ্রত দেবী বলে মানে এখানের লোকেরা। ঐ মন্দিরের খুব কাছেই আছে একটা ঝর্ণা, সেই ঝর্ণা নিচে একটা লেক তৈরী করেছে। "
গাড়ী ততক্ষণে আরো কাছে এসে পড়েছে পাহাড়ের, তবে রাস্তা থেকে পাহাড় অনেক দূরে, চূড়ার মন্দির দৃশ্যমান হয় না আমাদের কাছে। গাড়ী আরো এগিয়ে চলে, এইবারে একটা ছোট্টো সেতুর উপর দিয়ে গিয়েছে রাস্তা,সেতুর নিচ দিয়ে বইছে এক নদী। নদী বলে প্রায় বোঝাই যায় না, শীর্ণ জলধারা তিরতির করে বইছে বিস্তীর্ণ নদীখাতের মাঝমধ্যিখান দিয়ে।

ডক্টর আদিত্য বললেন, "বর্ষায় এই নদীর চেহারা বদলে যায়, তখন পুরো নদীখাত ভরে যায় জলে। একবার গ্রাম ডুবিয়ে দিয়েছিল, সেতু ভেঙে দিয়েছিল। এখনকার ব্রীজটা নতুন করে তৈরী, বছর তিনেক আগে তৈরী।"
কাশ্মীরা বলে, "চমৎকার দেখতে কিন্তু নদীটা। কী নাম এই নদীর?"
ডক্টর আদিত্যের আগেই আমাদের ড্রাইভার বলে, "এর নাম ধারাই নদী। "
ডক্টর আদিত্য হেসে বলেন, "সম্ভবতঃ ধারাবতী শব্দ থেকে এসেছে। লোকের মুখে মুখে হয়ে গিয়েছে ধারাই। জানো, কিংবদন্তী আছে এই নদীর বালিতে নাকি সোনা পাওয়া যেত এককালে। তবে এখন অবশ্য সোনা টোনা কিছু পাওয়া যায় না। তবু এখনও গ্রামের লোকেরা কেউ কেউ চালুনি দিয়ে বালি ছাঁকে সময় পেলেই, যদি কিছু পাওয়া যায়। "

সেতু পার হয়ে আর মাইল খানেক গিয়েই মূল রাস্তা থেকে আমরা গিয়ে পড়ি ডানদিকের একটা রাস্তায়। ডক্টর আদিত্য বলেন, "এই রাস্তাটাই সোজা চলে গিয়েছে আদিত্যনগর। আর একটুখানি, এসেই গিয়েছি প্রায়।"

মস্ত বড়ো এক খোলা ফটক, তাতে আদিত্যনগর লেখা। গাড়ী সোজা ঢুকে গেল। একটু এগিয়ে একটা বড়ো বাড়ীর গেট গিয়ে ঢুকে বাগানের মোরাম বিছানো পথ দিয়ে একটু এগিয়ে গোল বারান্দার সামনে থামলো। ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে দিল।

ডক্টর আদিত্য নেমে আমাদের হাসিমুখে বললেন, "আদিত্যনগরে স্বাগত। এই পুরো পাড়াটাই আমাদের আত্মীয়স্বজনে ভর্তি, মোট পঞ্চান্নটি বাড়ী, সবাই আদিত্য পদবীর। পরে শুনো এই জায়গার ইন্টারেস্টিং ইতিহাস । এখন চলো হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নেবে চলো। তোমাদের ঘর ঠিক হয়েছে দোতলায়, পাশাপাশি ঘর। আশা করি কোনো অসুবিধে হবে না। "

দোতলায় পাশাপাশি দুই ঘর আমার আর কাশ্মীরার। একেবারে রুচিসম্মত আসবাবপত্রে সাজানো হোটেলরুমের মতন, সংলগ্ন স্নানঘরও আছে। অন্যান্যবার যখন এখানে এসেছি তখনও অবশ্য আলাদা ঘরই প্রত্যেকবার দিতেন ডক্টর আদিত্য, কিন্তু দোতলায় এই ঘরে আগে থাকিনি, আগেরবারগুলোতে একতলাতেই গেস্ট রুমে থেকেছি।

ডক্টর আদিত্য আমাদের পৌঁছে দিয়ে বললেন, "শোনো তোমরা আধঘন্টার মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। আবীর, তুমি তো ডাইনিং হল চেনোই। তোমরা দু'জনে ওখানে এসো। ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে তারপরে বেরোবো তোমাদের নিয়ে। "

জিনিসপত্র ঘরে নামিয়ে প্রথমেই স্নানঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপরে স্নান সেরে নতুন এক সেট পোশাক চাপিয়ে ড্রায়ার চালিয়ে চুল শুকিয়ে একেবারে রেডি। তখনো আধঘন্টা হতে মিনিট দশেক দেরি।

জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকালাম, দোতলার জানালা থেকে অন্যরকম লাগছে সব, যদিও ঐ বাগান, বাগানের মাঝখানের ঐ ফোয়ারাটা সবই আমার চেনা। কিন্তু আদিত্যনগরের রহস্য আমার কাছে কোনোদিন ফুরায় না। আগে যতবার এসেছি ততবারই নতুন লেগেছে। যদিও আমার নিজের জীবন নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় পূর্ণ, সেগুলো সবই সুখের অভিজ্ঞতা নয়, বরং বেশিটাই কষ্টের অভিজ্ঞতা। অবাক হওয়ার মতন পরিস্থিতিতে পড়েছি অনেকবার। তবু এখনো বিস্ময়বোধ আমাকে ছেড়ে যায় নি। কঠিন পৃথিবীর বারংবার আঘাতেও আজও টিঁকে আছে। অবশ্য এ না থাকলে তো পাথর হয়ে যেতাম, সে বেঁচে থাকার অর্থ কী? তাই হয়তো এইটুকু দয়া আমাকে করেছে জীবন।

আধঘন্টা হতেই দরজায় ঠকঠক। খুলে দেখি কাশ্মীরা, সদ্যস্নাত, ভেজা চুল পিঠে মেলে দেওয়া, পরেছে একটা হাল্কা সবুজ রঙের শাড়ী। চমৎকার লাগছিল ওকে। ওকে শাড়ী পরা অবস্থায় খুব কম দেখেছি আগে, প্রায় সবসময়ই হয় সালোয়ার কামিজ পরে নয়তো টিশার্ট জীনস। আজ শাড়ীতে দেখে ভারী সুন্দর লাগলো।

দু'জনে নেমে ডাইনিং হলে এলাম। বেশ ভালো ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা ছিল। চা কফি টোস্ট ডিমসেদ্ধ কলা এইসব পশ্চিমী কেতার খাবার তো ছিলই, দেশি প্রথার গরম লুচি আর কালোজিরে দেওয়া আলুর তরকারি আর সন্দেশও ছিল।

কাশ্মীরা দেখলাম লুচি তরকারি সন্দেশই টেনে নিল, সঙ্গে চা নিল। আমার তত খিদে ছিল না, একটা টোস্ট আর এককাপ কফি নিলাম। ডক্টর আদিত্যও কফি টোস্ট খাচ্ছিলেন, খেতে খেতে বললেন, "ব্রেকফাস্ট শেষ করেই তোমাদের নিয়ে যাবো এখানকার মিউজিয়ামে। এই আদিত্যনগরের প্রতিষ্ঠাতা বিষ্ণুযশ আদিত্যের বহু সংগৃহীত জিনিসপত্র ও পুঁথি ইত্যাদি সংরক্ষণ করা রয়েছে সেখানে।
পরবর্তীকালের আদিত্য বংশের কৃতী সন্তানদের কিছু কিছু কাজও রাখা আছে। আবীর, তুমি আগে দেখেছ কি? "

আমি দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে বলি, "না না, আগে মিউজিয়ামে যাই নি। তবে আপনার মুখ থেকে বিষ্ণুযশ আদিত্যের কথা মনে হয় এক দু'বার শুনেছি।"

খাওয়া শেষ হলেই বেরিয়ে পড়ি তিনজনে। ডক্টর আদিত্য আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই মিউজিয়াম পৌঁছে যাই। মিউজিয়ামটি চমৎকার। ছিমছাম দোতলা অট্টালিকা। চারিদিকে ছায়ামেলা বড়ো বড়ো গাছ। প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানপাশে ছোট্টো একটি অফিসঘর, মিউজিয়ামের কিউরেটর বসেন সেখানে। শনিবার হলেও মিউজিয়াম খোলা, সকাল নটায় খোলে। সপ্তাহে ছ'দিন খোলা থাকে, সকাল ন'টা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত। শুধু রবিবার বন্ধ।

( চলমান )


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

চলুক লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। উপন্যাসের গঠনের জন্যই হয়তো শুরুটায় বেশ গোছগাছের ব্যাপার থাকে এবং একটু ঢিমে লয়ে এগোতেই পারে, তবু একটু অধীর অধীর লাগছে আসল কাহিনির উত্তেজনার একটু স্বাদ পেতে। তুলিদি আপনার উপন্যাসটার কিস্তিতে আরো একটু বেশি অংশ যোগ করে দিলে বেশ হতো। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনি নিয়মিত পড়ছেন আর মন্তব্য করছেন বলেই ভরসা পাচ্ছি লেখা দিতে। এই উপন্যাসের গতি দ্রুত নয়, চলনও বেশ জটিল। বর্তমান থেকে অতীত, অতীত থেকে বর্তমান এইরকম সব রয়েছে। তাই অল্প অল্প করেই দিচ্ছি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সোহেল ইমাম এর ছবি

আপনার নিজের ছন্দেই লেখা চলুক। অনেকেই পড়েন লেখা, মন্তব্য করেন কম হারে, সুতরাং লেখা চালিয়ে যান। হারিয়ে যাওয়া নদীটার কাহিনি জানবার জন্য উৎসুক হয়ে আছি।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা এর ছবি

হ্যাঁ, হারিয়ে যাওয়া নদীটাই তো কাহিনির মূল ব্যাপার। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এক লহমা এর ছবি

তুলিদি, আরো খানিকটা করে দেওয়া যাবে কি?

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা এর ছবি

হাতি পোস্ট দিয়া লাভ কী? অল্প অল্প দিলেও লোকে পড়ে কি পড়ে না! চোখ টিপি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি এর ছবি

পড়ে নিলেম এ পর্বটাও। কাহিনি ঘন হতেছে ক্রমশ। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলেম। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

কাহিনি সত্যি করে ঘন হবে আরো পরে । এখন পরিচয়-পর্ব চলছে । হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।