চিঙ্গিজ আইৎমাতভের "পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান" প্রথম যখন পড়ি, তখন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তাম। এই বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটি ছিল "প্রথম শিক্ষক"। জানি না সেই বয়সে কতটা বুঝতে পেরেছিলাম কাহিনি, কিন্তু মুগ্ধ, আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম কির্গিজিয়ার পাহাড়ী গাঁয়ের সেই আশ্চর্য গল্পটি পড়ে। গল্পের সেই মেয়েটি, আলতিনাই, তার সঙ্গে যেন পা মিলিয়ে দৌড়ে চলেছিলাম চড়াই উৎরাই। পাঠিকা হিসেবে আমার যা বয়স তখন, গল্পের আলতিনাইয়ের বয়সও তার কাছাকাছি। আলতিনাই বছর দুই কি তিনের বড়। সেই জন্যই মনে হয় অমন করে মনকে টেনে ধরেছিল ওই কাহিনি।
গল্পটির পটভূমি কুর্কুরেউ গ্রাম। অজস্র ঝর্ণার কলমন্দ্রিত পর্বতের পায়ের কাছে সুবিস্তৃত এক মালভূমির উপরে গ্রামটি। গ্রামের নিচে সুবিশাল কাজাখ স্তেপ -হরিদ্রা উপত্যকা, যার এখানে ওখানে কালো কালো পাহাড় শিং উঁচিয়ে আছে, দূর দিগন্তে কালো রেললাইন, চলে গিয়েছে পশ্চিমে। গ্রামের উপরে, একটা বড়ো টিলায়, দুটো বিশালকায় পপলার গাছ, সবার আগে ওদের দিকে চোখ পড়ে গ্রাম থেকে, ওরা যেন দুটি আলোকস্তম্ভ।
গল্পের লেখক ছোট্টোবেলা থেকেই পপলার দুটি দেখেছে আর ভেবেছে কে বা কারা ওখানে গাছ দুটো লাগাল? নাকি আপনা আপনিই হয়েছে? পপলার দুটোকে খুব আশ্চর্য মনে হত সেই বালকবয়সী লেখকের। মনে হত হয়তো গাছদুটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোনো রূপকথার মতন কিছু। বড় হয়ে গাছদুটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সেই কাহিনি জানতে পরে লেখক, রূপকথার চেয়েও যা আশ্চর্য। মানুষের জীবনের আশা-নিরাশা, আলো-অন্ধকার , হারানো-প্রাপ্তি, চাওয়া-পাওয়ার গল্প। সেই গল্পের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী, আলতিনাই আর তাঁর প্রথম শিক্ষক, দিউইশেন। তাদের চারপাশে বিঘূর্ণিত হচ্ছে দেশ, সমাজ, রাজনীতি, বদলে যেতে থাকা সময়, ভালো ও মন্দ মানুষেরা। আবর্তিত হচ্ছে হিংস্র বরফঝড়ের রাত্রিতে ঘোড়া তাড়া করে ছুটে আসা ক্ষুধার্ত নেকড়েরা, আবার সেই রাত্রিও পার হয়ে নতুন সূর্যের সকাল দেখা। অজস্র আঘাত ও বেদনার যুদ্ধক্ষেত্র পার হতে হতে মনের মধ্যে ধরে রাখা একটুকরো আশার বাতি, "পার আছে, পার আছে পার আছে, এই অন্ধকারের পার আছে। "
মূল কাহিনি আলতিনাইয়ের জবানিতে। পিতৃমাতৃহীন সে। থাকতো তার চাচা আর চাচীর কাছে। ছোটোবেলা থেকেই চাচা চাচীর কাছে বকুনি আর মারধোর খেতে খেতেই বড় হচ্ছিল। সংসারের নানা কাজে উদয়াস্ত পরিশ্রম আর তার বিনিময়ে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় । উপরি পাওনা কিল চড় লাথি ঝাঁটা খাওয়া, অকথ্য গালাগাল শোনা - এইসবই স্বাভাবিক বলে জানত সে। এর বাইরে অন্যরকম কোনো জীবনের কথা সে ভাবতেও পারেনি তার চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত। লেখাপড়ার কথা তাদের কেউ কোনোদিন বলে নি, সেখানকার কেউ তার ধার ধারতো না। ঐ গ্রামসীমানার বাইরের পৃথিবী তাদের অধিকাংশের কাছে অজানা ছিল।
সেইখানে একদিন এসে হাজির হল দিউইশেন। তখন সে যুবক। গ্রামেরই ছেলে সে, বহুকাল গ্রামে ছিল না। বলল, কমসোমল থেকে সে লেখাপড়া শিখে এসেছে, এখন গ্রামের ছেলেমেয়েদের সে লেখাপড়া শেখাবে। টিলার উপরে এক পরিত্যক্ত আস্তাবলকে সারিয়ে সুরিয়ে নিয়ে পাঠশালা বসাবে সেখানে। গ্রামের নিরক্ষর মুরুব্বি মাতব্বররা প্রথমে আপত্তি করল, পুরুষানুক্রমে চাষবাস করে খাচ্ছে তারা, সুখেদুখে দিন তো কাটছে একরকম। তার মধ্যে এ আবার কি উৎপেতে ব্যাপার? না না ওসব পাগলের খেয়ালে কাজ নেই, শেষে কী থেকে কী হয়ে যায়! কিন্তু দিউইশেন ছাড়ল না, বলল, এই যে ক্ষেতখামার, এই যে জলসরবরাহ, এই যে স্বাধীনতা তাঁরা ভোগ করছেন, তা যেই সরকারের কাছ থেকে তাঁরা পেয়েছেন, সেই সোভিয়েত সরকার চান ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। তাতে বাধা দেওয়া মানে সরকারের কাজে বাধা দেওয়া। বিরুদ্ধে যাওয়া। কারা যাবেন বিরূদ্ধে?
তখন গ্রামের মুরুব্বি মাতব্বররা রাজি হয়ে গেল পাঠশালার ব্যাপারে। কিন্তু কেউ সাহায্য করবে না, তাদের অনেক কাজ কিনা! এসব ফালতু ব্যাপারে সময় নষ্ট করার অবস্থা নেই। সবই দিউইশেনকে একা একাই করতে হবে। তাই সই। একা হাতেই দেইউশেন লেগে পড়ে পরিত্যক্ত আস্তাবলটিকে সারিয়ে সুরিয়ে পাঠশালা তৈরী করতে।
আলতিনাইয়ের বয়স তখন চোদ্দো। সে গ্রামের অন্য অনেক ছোটো ছোটো মেয়েদের সঙ্গে মাঠে মাঠে শুকনো জ্বালানি কুড়োচ্ছিল। ঝুলি তাদের প্রায় ভরে উঠেছে। আলতিনাই ওদের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে বড়। সে বলল চল তো দেখে আসি পাঠশালা কীরকম! তো ওরা সবাই গেল, দিউইশেন তখন ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে। এই বালিকাদের দেখে খুশি হল সে, বলল এই পাঠশালা তাদের জন্যই হচ্ছে, গ্রামের ছোটো ছোটো সব ছেলেমেয়ে এখানে লেখাপড়া শিখবে। অনেককিছুর অভাব, সামনে শীত আসছে, জ্বালানি সংগ্রহ করে রাখতে হবে।
তখনই সেই মুহূর্তটা এল আলতিনাইয়ের জীবনে। মানুষের জীবনে যে মুহূর্তের আগে আর পরে আকাশপাতাল তফাৎ হয়ে যায়। অনেক অনেকদিন পরে সে বলেছিল সুখদুঃখভরা যে মনুষ্যজীবন, তা সেই মুহূর্তে শুরু হয়েছিল তার। তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে ছিল পরনির্দেশচালিত যন্ত্রমাত্র।
সে সঙ্গিনীদের বলল, "আয় আমরা আমাদের সংগ্রহ করা জ্বালানি দিয়ে যাই পাঠশালার জন্য।" অন্য মেয়েরা রাজি হল না, বাড়িতে বকবে। তারা দৌড়ে চলে গেল তাদের ঝোলা নিয়ে। কিন্তু আলতিনাই তার ঝুলি উপুড় করে সব দিয়ে দিল জ্বালানি রাখার জায়্গাটায়, "আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি ", তারপরে মহানন্দে পাখির মতন ডানা ছড়িয়ে মাঠের উপরে দৌড়োতে শুরু করল । চোদ্দো বছরের মেয়েটির সদ্যপ্রস্ফুটিত হৃদয় যেন সগর্বে বলছিল আকাশকে বাতাসকে সূর্যকে- "দ্যাখো দ্যাখো দ্যাখো, আমিও দিতে পারি। দেবার যে কিছু আছে আমার, সেই কথাটাই তো সবাই মিলে ভুলিয়ে রেখেছিল!" সে আবার শুরু করল নতুন করে কুড়োতে, কিন্তু ততক্ষণে বেলা পড়ে এসেছিল, বেশি কুড়োতে পারল না। বাড়ি ফিরে চাচীর কাছে বেদম মার খেল দিনভর এইটুকুমাত্র কুড়িয়েছে বলে। কিন্তু তাতে তার আর দুঃখ ছিল না, তার মনে হচ্ছিল একটা আলোর দরজা তার সামনে খুলে যাচ্ছে। সামনে উজ্জ্বল দিন।
হয়তো চাচা চাচী তাকে পড়তে দিতে রাজি হত না, কিন্তু দিউইশেনের চাপাচাপিতেই রাজি হতে হল। তারপর শুরু হল আলতিনাইয়ের পড়াশুনো। মনপ্রাণ ঢেলে সে পড়াশুনো করত। যেদিন দিউইশেন দূরের শহরে যেত, বলে যেত কবে ফিরবে। ফেরার জন্য উৎকন্ঠিত অপেক্ষায় প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতো আলতিনাই। তারপর একদিন, তখন শীত, রাত্রে নেকড়ের দল বের হয় । এক সন্ধ্যায় দিউইশেন ফেরে নি, ফেরার কথা ছিল, আলতিনাই গিয়ে হাজির হয় কার্তানবাই আর সাইকাল এর বাড়িতে। এই বৃদ্ধবৃদ্ধা দম্পতি আলতিনাইয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এদের বাড়িতেই থাকতো দিউইশেন। সমগ্র কাহিনির অসংখ্য ভালোমন্দ আলো-অন্ধকার মানুষের মধ্যে এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অপূর্ব দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল, যেন পুরানো যুগের করুণাময় দেবতা, যারা নিজেরা পুরানো নিয়ম থেকে বের হতে পারে না, কিন্তু নতুন নিয়মকে স্বাগত জানায় নতুন যুগের জন্য।
সেই রাত্রে নেকড়ের পাল্লায় পড়ে দিউইশেন, ঘোড়াটাকে ধরে ফেলে ওরা। দিউইশেন দৌড়ে এসে ওঠে কার্তানবাইয়ের বাড়িতে, রাইফেল চায়। একেবারে তীরে এসে তরী ডুবল বলে আফশোস করে ঘোড়াটার জন্য। ঘোড়াটা কার্তানবাইয়ের, কিন্তু সে বলে আরে ঘোড়াটাকে না দিলে তুমি প্রাণে বাঁচতে না, ও গিয়েছে গিয়েছে, তুমি যে বেঁচেছ এই বিরাট সৌভাগ্য। আগুনের পাশে চুপটি করে শুয়ে ছিল আলতিনাই, সে ভয়ানক কাঁদতে শুরু করে। এতক্ষণে দিউইশেন আলতিনাইয়ের অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন হয়, অবাক হয়, তারপরে জানতে পারে ও এসেছে সন্ধ্যেবেলা।
কিন্তু নাহ। এইভাবে লিখলে পুরো কাহিনিই লিখে দিতে হবে। আসলে পুরো কাহিনিটাই একটা আশ্চর্য সুরে বাঁধা গানের মতন, কোথাও করুণ, কোথাও মধুর, কোথাও সাহসী, শক্তিপূর্ণ আবার কোথাও বা ভীরু, দুর্বল। কিন্তু সতেজ আশাবাদ কোথাও পরাজিত হয় নি, পরাজয়ের অন্ধকারেও আশাবাদ জেগে থেকেছে। ওই পপলার দুটির মতন, যা দিউইশেন আর আলতিনাই মিলে লাগিয়েছিল ঐ টিলার পাঠ্শালার সামনে, তারা যখন থাকবে না তখনও ওই পপলার দু'টি থাকবে, নতুন যুগের মানুষকে আশার গল্প শোনাবে মর্মরে ।
পাঠশালা থেকে আলতিনাইকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার চাচা চাচী, বিক্রি করে দিয়েছিল এক ধনীর কাছে, তার দুই নম্বর বৌ হিসেবে। তার তাবুতে বন্দিনী ছিল আলতিনাই, পাশবিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়েছিল, তারপরেও মনে শক্তি সঞ্চয় করে সেখান থেকে পালাতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল । দিউইশেন রক্ষীবাহিনী নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে, অপরাধী লোকটিকে বন্দী করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর পরেই বড় শহরের আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আলতিনাইকে, সেখানে লেখাপড়া শিখে সে সত্যিই একদিন বিরাট বিখ্যাত হয়ে ওঠে, যেমনটা দিউইশেন স্বপ্ন দেখত। কিন্তু সারাজীবন আলতিনাই দিউইশেনকেই খুঁজেছে, তার জীবনের প্রথম অনুচ্চারিত ভালোবাসা ছিল তাঁর প্রতিই। খোঁজ পায় নি, যুদ্ধে গিয়েছিল দিউইশেন, যুদ্ধ থেকে ফিরে সে অন্য দেশে চলে যায় কাজ করতে। অবশেষে প্রৌঢ় বয়সে সে আবার আপন গ্রামে ফিরে আসে, তখন সব বদলে গিয়েছে সেখানে। ঝকঝকে নতুন স্কুল হচ্ছে, সেই স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই আলতিনাইকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়।
কিন্তু দেখা হয় না, অনুষ্ঠানের আগেই অন্যত্র চলে যায় দিউইশেন, মুখোমুখি হতে চায় নি আলতিনাইয়ের। আলতিনাই নিজেও তখন প্রৌঢ়া, তার সংসার আছে, স্বামী আছে,ছেলেমেয়ে আছে। হয়তো এত বছর দিউইশেন জানতো আলতিনাইয়ের খোঁজ, কিন্তু নিজে অজ্ঞাত হয়ে থেকেছে। নিজেকে ওর জীবনে আসতে দেয় নি, যোগ্য মনে করে নি। আর আলতিনাই খুঁজে খুঁজে ফিরেছে তার প্রথম ভালোবাসাকে ।
তারপর হয়তো কোথাও আবার তাদের দেখা হয়েছিল, যেখানে কোনো ব্যবধান নেই, কোনো বাধা নেই, কোনো কষ্ট নেই । দীর্ঘকায় পপলার দু'টি নীল আকাশে মাথা তুলে সেই জগতের কথাই বুঝি আজও গেয়ে যাচ্ছে তাদের অস্ফুট মর্মরে।
যেন তারা রক্তকরবীর বিশু আর নন্দিনী। বিশু গান গায়,
"যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে
সেই বুঝি মোর পথের ধারে রয়েছে বসে।
আজ কেন মোর পড়ে মনে কখন তারে চোখের কোণে
দেখেছিলেম অফুট প্রদোষে,
সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে।
আজ ওই চাঁদের বরণ হবে আলোর সঙ্গীতে
রাতের মুখের আঁধারখানি খুলবে ইঙ্গিতে।
শুক্ল রাতে সেই আলোকে দেখা হবে, এক পলকে
সব আবরণ যাবে যে খসে।
সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে। "
নন্দিনী বলে, "পাগল, তুমি যখন গান কর তখন কেবল আমার মনে হয়, অনেক তোমার পাওনা ছিল কিন্তু কিছু তোমাকে দিতে পারিনি।"
বিশু বলে, "তোর সেই কিছু-না-দেওয়া আমি ললাটে পরে চলে যাব। অল্প কিছু দেবার দামে আমার গান বিক্রি করবো না। "
অচিন দেশের হাওয়া এসে পপলারের পাতাগুলো কাঁপায়, তারা আবার একসঙ্গে গান করে। পাশে থেকেও অনন্ত বিরহের গান, দূরে থেকেও অনন্ত মিলনের গান।
মন্তব্য
আমি পড়েছি বোধকরি সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে। প্রথম দিককার পড়ায় দুটো ব্যাপার আমাকে ধাক্কা মেরেছিল। এক, আলতিনাই সুলাইমানভা খুব অবলীলায় নিজে ধর্ষিতা হবার কথা বলেছিল। ঐ বয়সে এটা হজম করতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। দুই, আলতিনাই দিউশেনকে ভালোবেসেছিল। এটা গল্পের কোথাও স্পষ্ট করে বলা ছিল না। তবু নিজে নিজেই যখন বুঝেছিলাম তখন অন্য আলোয় ভেসেছিলাম। লেনিনের মৃত্যুতে দিউশেনের শোক প্রকাশও মনে দাগ কেটেছিল।
আলোচনা চলুক। আরও কিছু বলার থাকলে সেখানে বলবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গল্পের আলতিনাই এই পুরো কাহিনী যখন লিখে জানিয়েছিল গল্পের মূল লেখককে, তখন সে প্রৌঢ়া। অনেক ঘাতপ্রতিঘাতে ঘাতসহ। সেইজন্যেই হয়তো অমন খোলাখুলি বলতে পেরেছিল বলাৎকৃতা হবার ব্যাপারটা। কিশোরী বয়সে যখন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল, তখন কি বলতে পারতো? ঐ পুরো ঘটনায় ওর মনে ক্ষোভদুঃখের চেয়ে ঘৃণা অনেক বেশি জোর নিয়ে এসেছিল, অপরাধী লোকটিকে(যার ছেলেমেয়েরাও বয়সে আলতিনাইয়ের চেয়ে বড় ছিল) তো বটেই, যে চাচাচাচী ওকে বিক্রি করে দিয়েছিল, তাদের প্রতিও অভিশাপ দিয়েছিল সে। হয়তো এটাও প্রতীকী। হয়তো নতুন যুগের আহ্বানে পুরনো অন্ধকারগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেবার সাহস ওভাবেই এসেছিল। চোদ্দো বছর বয়সে লেখাপড়া শিখতে আরম্ভ করার আগে পর্যন্ত তো সে অবশ্যম্ভাবী ঐ ভবিতব্যের জন্যই তৈরী হচ্ছিল। কপাল ভালো হলে কারুর প্রথম স্ত্রী হয়ে যাওয়া, কপাল মন্দ হলে দ্বিতীয় স্ত্রী। এর বাইরে অন্য জীবনের কথা তো জানাই ছিল না ওর! হয়তো তখন বলাৎকারের ধারণাই ছিল না ওর, বাধ্য পশুর মতন সব মেনে নিতে হলে আবার কন্সেন্ট দেওয়া বা না দেওয়ার প্রশ্ন আসে কী করে?
দিউইশেনের প্রতি ভালোবাসার কথাটা স্পষ্ট হয় ঐ চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে পাগলের মতন এক স্টেশনে নেমে পড়া, সেখানে দিউইশেনের মতন দেখতে একজন দাঁড়িয়েছিল, তাকে আলতিনাই সত্যি সত্যি দিউইশেন মনে করেছিল। পরে যখন জানতে পারল সে অন্য লোক, তখন যে দিশেহারা অবস্থাটার মধ্য দিয়ে গেল আলতিনাই, সেটাই যেন অঙ্গুলিনির্দেশ করে দেখিয়ে দেয়, সে খুঁজে চলেছে তার প্রিয়তমকে, গ্রাম থেকে বিদায়ের দিন যাকে সে শেষ দেখেছিল, তারপর আর দেখতে পায় নি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
যে বয়সে প্রথম পড়েছি সেই বয়সে তো কোন জ্ঞান ছিল না, অভিজ্ঞতা ছিল না। জীবনের নিষ্ঠুর, কঠিন আর নোংরা দিকগুলো দেখা হয়নি। তাই তখনকার প্রতিক্রিয়াগুলো ছিল অমন। আজ আপনি জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় ভর করে যে চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন তখন সেভাবে কেউ বললে হয়তো একটু একটু বুঝতে পারতাম।
আইৎমাতভের লেখার জাদুটা এখানে। এটা আলতিনাই সুলাইমানভার জীবনের গল্প, বেড়ে ওঠার গল্প, সংগ্রামের গল্প, অকথিত প্রেমের গল্প। একইসাথে এটা দিউইশেনের আদর্শিক সংগ্রামের গল্প, অকথিত প্রেমের গল্প। মহাশূন্যে চলমান দুটো সেলেস্টিয়াল বডি। আপাতদৃষ্টিতে তারা পাশাপাশি চলমান। তাদের এই চলার সরল পথ আসলে দুটো অতিকায় কার্ভ যেখানে একজন আরেকজনের কাছ থেকে কেবল দূরেই সরতে থাকে। দূরে, আরও দূরে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আইৎমাতভের লেখা সত্যিই জাদুময় । "জামিলা" আবার নতুন করে পড়ছি, কত নতুন নতুন বাঁক যে দেখা দিচ্ছে যা আগের পাঠে ধরতেই পারিনি ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
প্রিয় তুলিদিদি, এখন শুধু এইটুকু বলে যাই - ইচ্ছে হচ্ছিল পুরো গল্পটাই বলে দিতে যদি - কি ভালো যে লাগছিল পড়তে! রাশান এই গল্পগুলো-র অনুবাদ নির্দিষ্ট ছক মেনে চলত। এক স্তবক পড়লেই বোঝা যেত রাশান গল্পের অনুবাদ পড়ছি। গোগ্রাসে গল্প পড়ার ঝোঁকে তখন এটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। পরে সেই অভ্যাসটা কেটে যাওয়ায় অনুবাদের ঐ চলটা এখন শিকলের মত বাজতে থাকে।তোমার লিখনে শিকল নাই - নির্ভার কিন্তু গভীর, মমতা ভরা। খুব ভাল লাগছিল। কি আর করা যাবে, ঠিক জায়গাতেই থেমে গেছ যে!
সপ্তাহান্তে আরও বকবক করার ইচ্ছা আছে। এখন ঘুমাতে যাই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ঠিক বলেছেন একলহমাদা। ছোটোবেলা প্রথম পড়ার আনন্দে উদ্বেল তখন, তখন রাশিয়ান অনুবাদের ঐ ছক কানে ধরা পড়ত না। এখন ফিরে পড়তে গিয়ে ধরা পড়ে। আর পরিস্থিতিও কিছুটা দায়ী, তখন মায়াঞ্জন লেগে থাকতো কল্পনায়। তারপর সব ভেঙে গিয়ে যখন খড়মাটি বেরিয়ে পড়ল, তখন মায়াঞ্জনটুকুও মুছে গেল। তখন আরো বেশি করে খট খ্ট করে কানে আর মনে লাগতে থাকল ছকবাঁধা ব্যাপারগুলো।
আপনার সপ্তাহান্তিক বক্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
প্রগতি/রাদুগা/মীর/বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়ের বেশিরভাগ বাংলা অনুবাদ ননী ভৌমিক, অরুণ সোম, দ্বিজেন শর্মা ও হায়াৎ মামুদের করা। একই লেখকের করা বিভিন্ন প্রকার সাহিত্যকর্মের অনুবাদের ভাষা একই প্রকারের হবার কথা। তারওপর এই সকল অনুবাদকের মাথার ওপর থাকতেন রুশী কর্তারা। তারা আবার বেলাইনে চলে যাওয়া অনুবাদকে লাইনে নিয়ে আসার জন্য ছুরি-কলম চালাতেন। ফলাফল - সব অনুবাদ একই ঘানির খৈল-এ পরিণত।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
'বস্টন ক্র্যাব' এলার্ট!!!
=============================================
এদের সবার অনুবাদই পড়েছি। বিশেষ করে ক্লাসিকগুলি - আনা কারেনিনা, পুনরুজ্জীবন, টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, চেখভ, তুরগেনিভ, পুশকিন, লার্মন্তভ, গোগোল, গোর্কি ইত্যাদি। সে সময় আমার ননী ভৌমিকের করা অনুবাদ ভাল লাগত বেশি। কেন জানি না। বাংলায় পড়ার পর একই বই ইংরেজিতেও পড়েছি কোনো-কোনোটা। তবে প্রগতি/রাদুগা/মীর থেকে "ওয়ার এন্ড পীস"-এর বাংলা কখনো পাইনি বলে খুব দুঃখ ছিল তখন। দস্তয়েভস্কির "ব্রাদার্স কারামাজভ" বা শলোখভের "কোয়ায়েট ফ্লোজ দা ডন"ও বাংলায় পাইনি। প্রগতি/রাদুগা/মীর ইত্যাদি রাশান প্রকাশনী থেকে বা ননী ভৌমিক বা অরুন সোমদের হাত থেকে "ওয়ার এন্ড পীস"-এর বাংলা কখনো বেরিয়েছিল কিনা আপনার জানা আছে??
ইংরেজির ক্ষেত্রে আমার পছন্দ ছিল পেঙ্গুইন ও প্যান। অন্যান্যরাও ছিল। তবে রাশানদের বের করা ইংরেজি অনুবাদগুলি ভাল লাগত না কেন যেন। কেমন যেন শুষ্কং কাষ্ঠং, অমসৃন, অসুন্দর লাগত। জানি না এ বিষয়ে মনের ভিতর কোনো অযৌক্তিক বায়াস ছিল কিনা। এমনকি একই লেখকের একই বইয়ের একই অনুবাদকের করা অনুবাদ ধরুন পেঙ্গুইন থেকেও বেরিয়েছে আবার প্রগতি থেকেও বেরিয়েছে। তারপরও দেখা যেত দুইটার মধ্যে পার্থক্য আছে এবং পেঙ্গুইনেরটা অনেক ভাল / সুখপাঠ্য হয়েছে (আমার বিচারে)। একটা উদাহরণঃ মিখাইল শলোখভের "এ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দা ডন"-এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন স্টিফেন গ্যারি। আমার অসম্ভব প্রিয় একটি বই! পরে একদিন আবিষ্কার করি সোভিয়েত ইউনিওন থেকেও একটা ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়েছে এবং সেটাও স্টিফেন গ্যারির অনুবাদ। কিন্তু দুই অনুবাদে পার্থক্য আছে এবং পেঙ্গুইন থেকে বেরুনোটা পড়ে দুর্দান্ত লেগেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সোঃইউঃ থেকে বেরুনোটা কয়েক পাতা পড়ে ভাল লাগেনি। কেমন যেন রসকষহীণ লাগছিল!!
রুশ ক্লাসিকগুলি মধ্য-আশিতে ক্লাস নাইন/টেন-ইন্টারে থাকতে পড়া শুরু করি। মূলত বাংলায়। কিন্তু রাশানরা যেগুলি বাংলা করতো না সেগুলি ইংরেজিতে পড়তে চাইতাম। কিন্তু ওদের ইংরেজি অনুবাদ ভাল লাগতো না, অথচ বৃটিশ / আমেরিকান অনুবাদগুলির এত দাম হতো যে সেগুলি ঐ ছাত্রাবস্থায় আমার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ছিল। তারপরও মনে আছে অনেক কষ্ষ্টেসৃষ্টে টাকা জমিয়ে শেষমেশ কোলকাতা থেকে প্রকাশিত নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা এরকম কোনো নামের এক অনুবাদকের করা বালিশ সাইজের খণ্ডবিভক্ত গোটা টলস্টয় রচনাবলীটাই কিনে ফেললাম। কিনে, আনন্দের সাগরে ভাসতে ভাসতে নাচতে নাচতে উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরলাম। তারপরই ধড়াম করে আছড়ে পড়লাম মাটিতে। দুইভাবে - প্রথমে টানাটানির সংসারে এত টাকার বই কিনেছি দেখে আম্মার মুখটা প্রশ্রয়সূচক হাসি দিতে গিয়েও কেমন যেন ম্লান ও ক্লিষ্ট হয়ে গেল দেখে, আর তারপর পড়তে গিয়ে। এটা হলো আমার জীবনের সবচাইতে করুণ ট্রাজিক বই ক্রয়ের ঘটনা!!! জীবনে এত অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য রকম নিকৃষ্ট অনুবাদ আর কখনই আমি দেখিনি বা পড়িনি। আক্ষরিক অর্থেই এই সুবিশাল রচণাবলীর পুরো একটি পাতাও আমি কোনোদিন পড়ে উঠতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত উইপোকারাই রচণাবলীটা পড়েছে - কারন এটা তাদের পেটেই গেছে। পুরোটাই। রাগে-দুঃখে আমি আর আপত্তি করিনি, বরং উৎসাহ দিয়ে বলেছি - খা ব্যাটারা, খা!
এরপর থেকে রুশদেশ থেকে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদ ছাড়া আর কোনো বাংলা অনুবাদ কোনোদিন কিনব বা পড়বোও না বলে কান মলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।
তবে তারপরও কিনেছি। হা হা! তবে বৃটিশ ইংরেজি অনুবাদ। প্রথম যে দু'টি বই কিনেছিলাম, তা হলো- পেঙ্গুইন প্রকাশিত এবং রোজমেরি এডমণ্ডস অনুদিত "ওয়ার এন্ড পীস" আর হেনরি ট্রয়াটের লেখা (পেঙ্গুইন) টলস্টয় জীবনী। নিউ মার্কেটের তৎকালীণ নাক উঁচা জিনাত বুক্স থেকে। তবে নাক উঁচামির জন্য জিনাত বুক্স্কেও সেখানেই খুদাপেজ জানিয়েছি। এরপর পরিচয় হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড, ম্যারিয়েটা, হাক্কানী, রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র - ইত্যাদির সাথে। তবে সবচেয়ে ভালো সাপোর্ট পেয়েছি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে। ইন্টারের দুই বছরে বিসাকের ইংরেজি-বাংলা সব শেলফই সাবড়ে দিয়েছি মোটামুটি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ছিল বলেই রুশ সাহিত্যের বহু বই পড়া সম্ভব হয়েছে, এবং শুধু রুশই না - অন্যান্য ভাষার সাহিত্যও! তখন মাঝে-মাঝে মনে হতো ননী ভৌমিক বা অরুন সোমকে চিঠি লিখব "ওয়ার এন্ড পীস" অনুবাদ করার জন্য। কখনো হয়ে উঠেনি অবশ্য!
****************************************
সোভিয়েত বইগুলো আমি কিনতাম কমলাপুরের রেলওয়ে বুক ডিপো, জাতীয় স্টেডিয়ামের দোতলার হাক্কানী আর স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স থেকে — তবে সেসব কালেভদ্রে। বই সবচে’ বেশি কিনতাম আসলে ফুটপাথ থেকে — নীলক্ষেত, পুরানা পল্টন, বিজয়নগর, মালিবাগ, ফার্মগেট, প্যারী দাস রোড, হাজী ওসমান গণি রোড, বঙ্গবন্ধু রোড, মর্গ্যান স্কুল রোড ......... অনিঃশেষ সব সোর্স — ঢাকায়, নারায়ণগঞ্জে, চট্টগ্রামে ...... । সববয়সী শিশুদের জন্য লেখার ক্ষেত্রে ননী ভৌমিকের বাংলা অনুবাদগুলোর সুস্বাদু ছিল। ঐ একই বইয়ের সোভিয়েতকৃত ইংলিশ অনুবাদ পড়ে সেই মজাটা পাইনি। লেভ তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পীস’ বা ফিওদর দস্তয়ভস্কির ‘ব্রাদার্স কারমাযভ’-এর সোভিয়েতকৃত বঙ্গানুবাদ চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ছে না। মিখাইল শলোখভের ‘ধীরে বহে দন’-এর সোভিয়েতকৃত বঙ্গানুবাদ বা ইংলিশ অনুবাদ কখনো সব খণ্ড একত্রে পাইনি। এজন্য এটা আর পুরোপুরি পড়া হয়ে ওঠেনি। কয়েক বছর খোঁজাখুঁজিতে লেগে ছিলাম। এই বইটার জন্য নীলক্ষেতের বইবিক্রেতাদের কাছ থেকে বাঁকা কথাও শুনতে হয়েছে। তারপর একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। তবে এই মহাউপন্যাসের সোভিয়েতকৃত বঙ্গানুবাদ বা ইংলিশ অনুবাদ যতটুকু পড়েছি – আমার কাছে আড়ষ্ট লেগেছে।
ইংলিশ বইয়ের ক্ষেত্রে এই গরিবের উৎস ছিল প্রধানত নীলক্ষেত আর ব্রিটিশ কাউন্সিল। আজকের ব্রিটিশ কাউন্সিলের কোচিং সেন্টারটাইপ চেহারা দেখে আঁচ করা সম্ভব না আশি বা নব্বইয়ের দশকে সেটা বই-গান-চলচ্চিত্রের কি অপার ভাণ্ডার ছিল! লেডিবার্ড বা এনিড ব্লাইটনের বই থেকে শুরু, তারপর সব ক্লাসিকের এবরিজড্ ভার্সান। মোটা বই, মানে মূল বই, ধরার সাহস তখনও হয়নি। মাঝে মধ্যে নীলক্ষেতে কিছু ভারতীয় লেখকদের ইংলিশ বই পাওয়া যেতো। তার অল্প কিছু পড়েছি। ভাইকিং পেঙ্গুইনদের কাছে বিক্রি হয়ে যাবার আগের কিছু বই হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যেতো — জ্ঞানী মানুষের মুর্খ সন্তানের বদৌলতে। নব্বইয়ের দশকে হারপার কলিন্স এসে একটা ঢেউ তুললো। ততদিনে ব্রিটিশ কাউন্সিলের চরিত্র বদলে যেতে শুরু করেছে, ইউসিসের লাইব্রেরি দিলকুশার জীবন বীমা টাওয়ার থেকে বনানীতে চলে গেছে। চড়া দামের জন্য জিনাত বা মল্লিক থেকে কখনো ইংলিশ বই কিনতে পারিনি। জিনাত আর মল্লিক থেকে দুটি বহির্গামী লম্ব টানলে যে দোকানগুলোর কাছে পরস্পরকে ছেদ করবে সেখানকার দোকানগুলো থেকে একটু মলিন বই কিনতাম। ইংলিশ বইয়ের ক্ষেত্রে এইপ্রকার মাধুকরী করতে গিয়ে আমি আর কোন্ প্রকাশনীর কাজ কেমন সেই বিচার করতে পারিনি — ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া!
পশ্চিমবঙ্গের কিছু অনুবাদকের করা (তাদের নাম মনে নেই) এবং সেখান থেকে বের হওয়া কিছু বিদেশী বইয়ের বঙ্গানুবাদ পড়ার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। এতে কিছু টাকার দণ্ড দিতে হয়েছে, তাও খুব কম না। সেই থেকে আমি তাদের থেকে শত হস্ত দূরে থাকি। অনুবাদের ক্ষেত্রে আমার ভরসার জায়গা ছিল বাংলা একাডেমি আর সেবা প্রকাশনী। কিন্তু সেবা এভারেস্টকে কমাতে কমাতে চাঁদমারীর টিলা বানিয়ে ফেলে বলে এবং আগের অনুবাদকেরা এখন আর লেখেন না বলে একসময় সেবা’র অনুবাদ থেকে সরে এসেছি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অনুবাদ আমার কখনো ভালো লাগেনি। বেশ কয়েক বছর হয় পারতপক্ষে বঙ্গানুবাদ পড়ছি না।
বাংলা সাহিত্যের ইংলিশ অনুবাদ পড়েছেন কখনো? যে অতি অতি নগণ্য পরিমাণ পড়েছি সেগুলো পড়ে সশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্তির অনুভূতি হয়েছে।
২১ জুবোভস্কি বুলভার, মস্কো, সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য বইয়ের শেষে যে অনুরোধ থাকতো সেটাতে সাড়া দিতে খুব ইচ্ছে করতো, কিন্তু কেন যেন কখনো তা হয়ে ওঠেনি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
১। ইংলিশ/বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে আমারও উৎস ছিল প্রধানত নীলক্ষেত, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আর অনেক পরে বিসাকে। জিনাত থেকে ঐ দু'টা বইই আসলে কিনেছিলাম এবং কিনে প্রায় বিশ্বজয়ের অনুভূতি পেয়েছিলাম!
২। মিখাইল শলোখভের ‘ধীরে বহে দন’-এর পেঙ্গুইন প্রকাশিত স্টিফেন গ্যারিকৃত অসাধারণ (সম্ভবত সেরা) ইংরেজি অনুবাদটা - এ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দা ডন পেয়েছিলাম বিসাকেতে আম-পাব্লিকের জন্য উম্মুক্ত লাইব্রেরিটাতে। যদ্দুর মনে পড়ে পেঙ্গুইন এটাকে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস হিসেবেই প্রকাশ করেছিল - যার একটা সিকুয়েল ছিল আরেকটা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস - দা ডন ফ্লোজ টু দা সী। রুশরা আবার সিকুয়েল-ফিকুয়েলের ধার-ধারেনি, পেঙ্গুইন যেটাকে দুইটা উপন্যাসে বিভক্ত করেছিল সেটাকেই ৪ খণ্ডে বিভক্ত একটা একক উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করে (ইংরেজি)। পেঙ্গুইনের প্রথম পর্বটা পড়ার পর ২য় পর্বটা বহুদিন খোঁজাখুজি করেও না পেয়ে রুশদের ইংরেজি চারটি খণ্ডই একদিন পল্টন মোড়ে পেয়ে গেলাম। কিন্তু দু'চারটা পৃষ্ঠা উল্টাতেই মেজাজ এমন বিগড়ে গেল যে আর কেনা হলো না। একবার পেঙ্গুইনের অনুবাদ পড়ার পর রুশদের অনুবাদটা এত বাজে লেগেছিল যে তা কহতব্য নয়! অথচ জেনে আশ্চর্য হবেন যে রুশদের অনুবাদটাও ঐ একই পেঙ্গুইনের অনুবাদকেরই!!! দু'টিতেই অনুবাদক হিসেবে স্টিফেন গ্যারির নাম লেখা ছিল!!! এখন আমি জানি না অনুবাদের মানে এই পার্থক্যের জন্য কে দায়ী - স্টিফেন গ্যারিই পেঙ্গুইনকে ভালটা দিয়ে রুশদের একটা বাযে অনুবাদ দিয়েছিলেন, নাকি রুশরাই মাতব্বরি করে গ্যারির অনুবাদটার উপর সম্পাদনা ফলাতে গিয়ে অনুবাদের বারোটা বাজিয়েছে!
আরও অনেকদিন পরে অবশ্য "এ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দা ডন"-এর সিকুএলটা পেয়েছিলাম, তবে তা পেঙ্গুইন নয় - একটা মার্কিন পাব্লিশারের ছিল। পাশ্চাত্যের, যেমন স্টিফেন গ্যারিকৃত পেঙ্গুইনের অনুবাদ না পড়ে রুশি ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদ পড়লে এই বইয়ের অন্তত ৮০% সৌন্দর্যই মনে হয় পাঠক মিস করবেন। আপনার ভাষায় এই মহা-উপন্যাসের স্রেফ ভাষার মধ্যেই যে একটা প্রবল শক্তিমত্তা আর সৌন্দর্য্য আছে এমনকি পেঙ্গুইনের অনুবাদেও, তার কিছুই নাই বাংলায় বা রুসি অনুবাদে। এত কথা লিখলাম এই কারনে যে, এখনও সুযোগ পেলে এই বইয়ের পুরোটা কোনো ভাল পশ্চিমা অনুবাদে পড়ে নিয়েন।
৩। না, বাংলা সাহিত্যের ইংলিশ অনুবাদ পড়ি নাই। তবে অনুমান করতে পারি!
****************************************
১। গুলিস্তানের ওসমানী উদ্যানে একটা লাইব্রেরি ছিল 'মহানগর পাঠাগার'। যাতায়তের পথে পড়তো বলে সেটাতে যাওয়া হতো বেশ। এর কালেকশন ছোট হলেও ভালো ছিল। নানা প্রকার উন্নয়নের বলি হয়ে পাঠাগারটি নাই হয়ে গেছে। শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরির কালেকশন যেমনই হোক এককালে এখানে একটা বিশেষ সুবিধা ছিল - ২৪ ঘন্টা খোলা থাকতো। আমি নিজে রাতে বা খুব ভোরে সেখানে গিয়ে পড়েছি। কিছু ভবঘুরে সেখানে গিয়ে ঘুমাতো বলে পরে সেই সুবিধাটা বন্ধ করে দেয়া হয়। চোরের ভয়ে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো ব্যাপার।
২। 'দন' পড়ার সুপ্ত বাসনা আছে। কারণ, অনুবাদকদের ওপর ভরসা না থাকলেও শলোখভের ওপর আমার ভরসা আছে। শলোখভের ছোট গল্পগুলোর বেশিরভাগের উপর পার্টিজান সাহিত্যের ছাপ মারা সম্ভব হলেও তাঁর ভাষা, কাহিনী নির্মাণের দক্ষতা, গভীর মানবিকবোধ সেই সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে গেছে - অনেকটা নিকোলাই দুবোভের বা গিওর্গি কারাসলাভোভের মতো। তাঁর 'মানুষের ভাগ্য' নিয়ে সের্গেই বন্দারচুকের বানানো চলচ্চিত্র দেখে নিজের অজান্তে চোখে জল এসেছে। আমি বরং আপনার পরামর্শ মতো স্টিফেন গ্যারিকৃত পেঙ্গুইনের অনুবাদটাই যোগাড় করবো।
ভিন্ন প্রকাশনী থেকে গ্যারিকৃত অনুবাদের হেরফের প্রসঙ্গে আপনার তথ্যে একটা কবিতার কথা মনে পড়লো। দেখুনতো চেনেন কিনা -
ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি
হর্ রোজ আমি যেন নেক্ হয়ে চলি
হুকুম করেন যাহা মুরুব্বিয়ানে
তামিল করি আমি যেন পাক্ মনে
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
.
****************************************
কী কহিলেন? নাকি কিছুই কহিলেন না!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হা হা হা! কহিয়াও কহিলাম না!
তুলিদিদির পোস্টে এসে তার লেখা সম্পর্কে একটি কথাও না বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে গাদা গাদা কমেন্ট করে তার পোস্টটাকে একেবারে স্যাবোটাজ করে ফেলেছি মনে হলো। তাই এখানেই ক্ষ্যামা দিলাম!
শলোখভ ও তার উপন্যাস নিয়ে আরও অনেক নাটক আছে - জানেন কিনা জানি না। আপনি যদি নীড়পাতায় সন্দেশের পোস্টাটর প্রতিক্রি্যায় রুশ-সাহিত্য নিয়ে কোনো লেখা দেন, তাহলে সেখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
****************************************
শলোখভ -
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পপকর্ন মাঠে মারা যেতে পারে বস্!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই বছর সোভিয়েত প্রকাশনা যা কিছু পড়েছি তার সবই মূলতঃ শিশুতোষ সাহিত্য। সেসব নিয়ে পোস্ট দিলে সেখানকার আলোচনায় শলোখভকে আনতে গেলে গরুকে নদীর পাড়ে টেনে নিয়ে ঘাস খাওয়াতে হবে।
খোদ 'দন'-এর উৎস, নোবেল প্রাপ্তি ইত্যাদি নিয়েই তো এন্তার বিতর্ক আছে। এর বাইরে অন্য কিছু?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
না, দন-এর কথিত প্রকৃত উৎস (সমূহ), সেই উৎস থেকে কিভাবে শলোখভের হাত দিয়ে কতটুকু কিভাবে কখন বেরুলো, এর প্রকৃত দৈর্ঘ্য (যেমন সোভিয়েত সেন্সরশীপের কারনে মূল এবং গ্যারিসহ অন্যান্যদের অনুবাদে নাকি আসল পান্ডূলিপির ২৫%-ই বাদ পড়েছিল! মূল পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার ও তার উপর বিভিন্ন ধরণের গবেষণা, শলোখভের লেখকজীবন ও রাজনীতি, স্তালিনের সাথে তার নানারকম দেনদরবার, ইত্যাদি - এইসবই। তবে প্রচুর চমক ও নাটক আছে।
****************************************
আপনারা প্লীজ আলোচনা চালিয়ে যান । মূল পোস্টের সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা তা নিয়ে চিন্তার দরকার নেই। মূল পোস্ট উপলক্ষ্য মাত্র, আলোচনায় যা উঠে আসছে তা অনেক অনেক বেশি দামী ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকতো এমন লাইব্রেরীর কথা শুনে আমি একেবারে অবাক! আমাদের মফস্বল অঞ্চলে এইরকম ব্যাপার দেখিইনি। ছোটোখাটো যেসব লাইব্রেরী ছিল, সবই কয়েক ঘন্টার জন্য খোলা থাকতো মাত্র। কোনো কোনো লাইব্রেরী থেকে তো শুধুমাত্র বই ধার করে নিয়ে যাওয়াই চলতো, বসে বই পড়ার কোনো জায়্গা ছিল না।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আশির দশকে চট্টগ্রামের ফুটপাতে(আগ্রাবাদ এলাকায়) সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে সয়লাব থাকতো। কী নিদারুণ সস্তার দিন গেছে এখন ভাবতে প্রায় অবিশ্বাস্য লাগে। এত বই থেকেও, এত সুলভে বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও সেই সমুদ্রে অবগাহন করার সুযোগ খুব বেশী হয়নি। নব্বইয়ের শুরুর দিকে ইংরেজি অনুবাদের দিকে চোখ পড়ে এবং সাহস করে কিনতে শুরু করি। বাসভাড়া থেকে বাঁচানো বিশ ত্রিশ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করি চেখভের ছোট গল্প রচনাবলীর খণ্ডগুলো দিয়ে। চেখভের খণ্ডগুলো পড়ে নিদারুণ মুগ্ধ হয়ে হাত বাড়াই দস্তয়েভস্কির দিকে। দুঃসাহস নিয়ে প্রথমে পড়ে ফেলি গ্যাম্বলার। তারপর ক্রাইম এণ্ড পানিশমেন্ট। কী অসাধারণ অনুভূতির ঘোর। সেই সময়ে অন্য কোন ইংরেজি অনুবাদের দিকে হাত বাড়ানো সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেটা পড়েছি ওটাই সেরা। সেই থেকে রাশান বই সংগ্রহ শুরু করতে মনস্ত করে টলস্টয়, গোগোল পর্যন্ত সংগ্রহ করে উঠতে না উঠতে দেখা গেল সোভিয়েত বইয়ের চালান আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রের দালান ভেঙ্গে পড়ছিল বিশ্বব্যাপী। কিন্তু পরবর্তীতে যখন একই বইয়ের পশ্চিমা অনুবাদ, পেঙ্গুইন ইত্যাদির সাথে পরিচয় ঘটলো, তখন টের পেয়েছি অনুবাদের পার্থক্যটা বিপুল। আনা কারেনিনা ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সোভিয়েত অনুবাদ এবং পেঙ্গুইন অনুবাদের পার্থক্যটা প্রথম পাতা খুলতেই বোঝা যায়। তবু সোভিয়েত অনুবাদগুলোর কাছে আমাদের চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, কেননা ওই অনুবাদগুলো না আসলে, ছাত্রজীবনে অনেকগুলো বই পড়ার সুখ থেকে বঞ্চিত হতাম আমরা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ঘ্যাঁচাঙতোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দুই সচলের(আয়নামতি ও ষষ্ঠপাণ্ডব) বদান্যতায় আইৎমাতভের তিনটি গল্পের সাথে পরিচয় ঘটলো মাত্র কয়েকদিন আগে। তিন গল্পের মধ্যে প্রথম শিক্ষক আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। সেই প্রথম শিক্ষক গল্পটি নিয়ে আপনার আলোচনাটিও মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। মূল রাশান বইটি পড়ার সুযোগ নেই। তবু বাংলাটি পড়ার পর খুঁজে ইংরেজি অনুবাদটাও খানিক পড়লাম মূলের আরেকটু কাছাকাছি যাবার উদ্দেশ্যে।
বাংলা অনুবাদটি নিয়ে তুচ্ছ একটি সমস্যার কথা বলি। অন্যদেরও হয়তো সমস্যা লেগেছে। বাংলা অনুবাদটিতে আগাগোড়া ভালো লাগলেও শুধু একটি শব্দে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। শব্দটি হলো 'মাস্টার সাব'। মূল রাশান শব্দটি বোধহয় ছিল учитель (uchitel) যার ইংরেজি অনুবাদ ছিল teacher, বাংলায় যার যথাযথ প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে অনুবাদক 'মাস্টার সাব' দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় কোন ছাত্র তার প্রিয় শিক্ষককে 'মাস্টার সাব' বলে ডাকে না। এমনকি 'গুরুজি'' কিংবা 'টিচার' দিয়ে চালিয়ে দিলেও সেই ডাকের আবেগটা আরো ভালো করে ফুটতো।
আপনার চমৎকার আলোচনাটি বইটি পড়তে আরো অনেককে উৎসাহিত করবে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এই গল্পের অনুবাদক হায়াৎ মামুদ নিজেই একজন অধ্যাপক, যিনি প্রায় তিন দশক অধ্যাপনার সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবনে কোন শিক্ষার্থী কি তাঁকে কখনো 'মাস্টার সাব' বলে ডেকেছেন? আমার ধারণা, প্রগতির যেসব রুশ কর্তা অভিধান দেখে দেখে বাঙালী অনুবাদকের কর্মে কলম চালিয়েছিলেন এটা তাদের কারো কর্ম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এইরকম সেন্সরশিপের মধ্যে কাজ করা খুব কঠিন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
মূল কিরগিজে লেখাটির নাম Биринчи мугалим (বিরিঞ্চি মুগালিম)।যে গ্রামে যে সময়ে দিউইশেন শিক্ষকতা করতে এসে হাজির হয় সেখানে ঐ যুগে শিক্ষকতার কোন দাম-ই ছিল না। নেহাত সোভিয়েত সরকারের ছাপ্পার বিরুদ্ধতা করা যাবেনা, তাই সে টিঁকে যেতে পেরেছিল। ঐ পরিবেশে তার পক্ষে এমন সম্বোধন পাওয়া সম্ভব ছিলনা যাতে তাকে কোনরকম সম্মান দেওয়া হচ্ছে বলে বোঝা যাবে। আর মুরুব্বীরা যে নামে ডাকছে ছোটরাও সেই ডাকটাই তুলে নেবে। তারা তাদের সমীহ/ভালবাসার জায়গা থেকে ডাকবার সময় বড়জোর ঐ ডাকের মধ্য থেকে তুচ্ছতাটার সুরটা খসিয়ে দেবে। মুগালিম = উচিটেল = টিচার = মাস্টার ঠিক আছে। কিন্তু “সাব" যোগ করার কোন অর্থ হয়না। আর প্রিয়তা বোঝাতে শিক্ষক-কে মাস্টার-সাব বলে যিনি ডাকবেন তিনি বয়সে একটু বড় বা সামাজিক পদমর্যাদায় একটু এগিয়ে থাকা কোন ব্যক্তি হলেই মানানসই হয়। এই হিসাব-টা হায়াৎ মামুদ নিশ্চয়-ই জানতেন। কিন্তু, ঐ যে ষষ্ঠ পাণ্ডব যেমন বলেছেন - ছুরি-কলম চলেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
প্রথম পড়ার সময় প্রথম সমুদ্রস্নানের মতন অবস্থা, আবেশে ভরপুর, খুঁটিনাটি কিছুই খেয়াল করিনি। ফিরে পড়তে গিয়ে এই মাস্টারসাব নিয়ে আমারও কানে খটাশ খটাশ করে লেগেছে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
- সামিরা মাখমালবাফের 'তখ্তে সিয়াহ্' মুভিটা আগে দেখে না থাকলে দেখে ফেলেন বস্!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই মুভিটা আমিও দেখবো ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শীতকালে বরফঠান্ডা নদীর উপর দিয়ে পাথরে পাথরে পা রেখে বাচ্চাগুলো নদী পার হয়ে পাঠশালে যাচ্ছে, দিউইশেন নিজে একদম ছোটো বাচ্চাদের কাঁধে বা কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন, এইটা ছবির মতন দেখতে পাই। আর এই ছবিটা কেন জানি বারে বারে অফেরোর গল্প মনে করিয়ে দেয়। সেই যে অফেরো, "যাঁর কোনো ভয় নেই তাঁর কাছে কাজ করবো" বলে গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়ে এ রাজা ও রাজা র কাছে কাজ করতে করতে দ্যাখে সবার নানা ভয়, তারপরে কিছুদিন শয়তানের কাছেও কাজ করল, তারপর সেও যাকে ভয় পায় তার কাছে কাজ করতে এসে নদীর পারে থানা গাড়ল। সেখানে ডাক আসতো এক একজনের, সে পার হয়ে যেত। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো পারতো না, অফেরো তাদের ঘাড়ে তুলে নিয়ে পার করে দিত।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এককালে এমন শিক্ষক এই দেশের গ্রামে গ্রামে ছিলেন। একশ' বছরের বেশি আগে রোকেয়া ভাগলপুর আর কলকাতার বাড়ি বাড়ি হেঁটে তাঁর স্কুলের জন্য ছাত্রী যোগাড় করেছেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হুঁ, এখন তো স্কুলশিক্ষা ব্যাপারটাই কেমন যেন কমার্শিয়াল হয়ে গেছে, প্রাইভেট টুইশন হয়ে গেছে ফুল-স্কেল ইন্ডাস্ট্রি। সবটাই বেচাকেনায় দাঁড়িয়ে গেছে। মাঝখান থেকে যোগ্য ছেলেমেয়েরা হয়তো টাকা নেই বলেই হারিয়ে যাচ্ছে। আবার টাকা দিয়ে ভালো কেরিয়ার নিশ্চিত করিয়ে দিতে চেয়ে বড়লোক অভিভাবকরা নিজের সন্তানদের ঠেলে দিচ্ছেন চূড়ান্ত অবসাদ ও আত্মহননের পথে। একেবারে দু'মুখো আক্রমণের মাঝখানে পড়েছে আমাদের সমাজ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আহা কি পড়ালে মন ভরালে তুলিদি! যেমন পোস্ট, তেমন তার রেশ ধরে ওঠে আসা আলাপচারিতা। আমি আখাস্তা, আকাঠ, আবালাং তাবালাং বকে তার ছন্দপতন ঘটালেম না আর। তোমার-তোমাদের উদ্দেশ্যে তাই শুধু ভালোবাসা রেখে গেলেম।
***
অ:ট: "নীলাঞ্জনা" কে বলছি, ওঠো, জাগো, ও নীলাঞ্জনা...' এমন ভালোবাসার ডাকে সে কি সাড়া দেবে না না না না ...(ইকো হইতেই আছে)???
আয়নামতি, তোমার বিস্তারিত বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় আছি যে! সবটাই কিন্তু তোমার জন্য। তুমি জামিলা নিয়ে লিখলে বলেই না এতকিছু শুরু হল! চিঙ্গিজ আইৎমাতভ সম্পর্কে, তাঁর লেখালিখি সম্পর্কে এত কথা উঠে এল তো তোমার জন্যই!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দিদি, জামিলা বিষয়ক সকল কৃতিত্ব এই পোস্টের http://www.sachalayatan.com/albab/57271
এত দারুণ সব কথার ভীড়ে নতুন করে আর কিইবা বলি দিদি।
প্রথম শিক্ষক গল্পে দু'জন মানুষের 'লুকিয়ে ভালোবাসবো তারে জানতে দেবো না'র অনুভূতিতে নিদারুণভাবে কুপোকাত দিদি। যদিও প্রথম থেকে দিউইশেনের প্রতি আলতিনাইয়ের দুর্বলতাটা গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে পাখা মেলার বিষয়টা পাঠক প্রত্যক্ষ করেন( সভা থেকে প্রায় পালিয়ে যাওয়া আলতিনাইর পাঠানো পত্র মারফত)। কিন্তু দিউইশেন মুখে কুলুপ এঁটেই থাকলেন, একদম রা'টি কাড়লেন না শেষ পর্যন্ত। গ্রামে কৃতী মেয়ে আলতিনার ফিরা আসায় তড়িঘড়ি চিঠি বিলি করে উবে গিয়ে জানিয়ে গেলেন মেয়েটার প্রতি তার ভালোবাসার কথা। এই যে উচ্চারণ না করেও, উপস্হিত না থেকেও সমস্ত পরিবেশ জুড়ে দু'জন মানুষের ভালোবাসার অনুরণন..কী চমৎকার ভঙ্গিতেই না আইৎমাতভ প্রকাশ করেছেন। এধরনের গল্পগুলো চট করেই ভুলে যাবার নয়। দারুণ ভালোলাগার অভিজ্ঞতা, এমন কিছু পড়ে নেয়া। আর তার রেশ ধরে তোমার-লহমাদার লেখা, সে লেখা নিয়ে পাণ্ডবদা, মাঝিভাই, নীড়দা, একলহমাদা আর তুমি এমন প্রাণবন্ত আলোচনা করলে যা বাড়তি পাওনা হিসেবে দারুণ উপভোগ্য। সবাই কইলে শুনবে কেডায়। আর আমি যতবেশি মুখ বন্ধ রাখি ততই ভালু..হেহেহে নিজের জ্ঞানহীনতার পমাণ আর কত্ত রাখতে কও আমারে!
ও যে রক্তকরবীর বিশুপাগল! বিশু বলে, "কাছের পাওনাকে নিয়ে বাসনার যে দুঃখ তাই পশুর, দূরের পাওনাকে নিয়ে আকাঙ্ক্ষার যে দুঃখ তাই মানুষের। আমার সেই চিরদুঃখের দূরের আলোটি নন্দিনীর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। "
ও জানতো পাশে পেলেই ও তাকে হারিয়ে ফেলবে । তখন মাঝরাতে জেগে উঠে হাহাকার করে বলতে হবে," এ বিরহ ঘুচবে কেমন করে, আমার অনন্তের সঙ্গে তার অনন্তের বিরহ? " সেইজন্যেই না অমন পালিয়ে পালিয়ে রইল সে সারাজীবন!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ফরমায়েসি লেখার সাথে আইতমাতভের লেখার পার্থক্য হচ্ছে কি হতে পারে আর কি হওয়া সম্ভব নয়, সেই বিষয়ে আইতমাতভের প্রখর বাস্তববোধ এবং তাঁর লেখায় সেটা থেকে কখনো বিচ্যুত না হওয়া।
যুদ্ধশেষের পরে পরে যে আলতিনাই একদিন এক অজানা স্টেশানে প্রিয়তম মানুষটিকে দেখতে পেয়েছে ভেবে হ্যাঁচকা টানে চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে তার দিকে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, সে মেয়ে সেই দিন দিঊইশেন-কে পেলে তার সাথে ঘর বাঁধতে পারত। কিন্তু যে আলতিনাই বিদ্যালয় উদ্বোধন করতে এলেন, তিনি ত আর সেই মানুষটি নেই। ঝাপসা হয়ে যাওয়া অতীত-কে পিছনে ফেলে আসা, বিবাহিতা, ছেলেপুলে নিয়ে সুখে-শান্তিতে সংসারী এই মানুষটিকে নানাদিক সামলে চলতে হয়। প্রখর ধীমতী মানুষটির বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না ভালোবাসার মানুষটি কেন সামনে এলেন না। ঐ না আসাটাই যে তাঁর প্রেমের গভীরতম উপহার! সে প্রেমের মর্যাদা তিনি অবশ্যই রাখবেন। তাঁর স্রষ্টা যে চিঙ্গিস আইতমাতভ!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
(সতর্কীকরণ - হাতী মন্তব্য)
সন্ধ্যা নামলে রোজ কারাগিজ-আপাকে ঘিরে গল্প শুনতে বসে চিঙ্গিজ আর তার ভাই-বোনেরা। কির্গিজ মহাকব্যের গল্প,নানা উপকথার গল্প, কিংবা তার জীবনের গল্প।
কারাগিজ, চিঙ্গিজ-এর বাবার বোন। কেমন ছিল তার জীবনের গল্প?
কারাকিজ। দীর্ঘ আঁখি-পক্ষ্মে তার কির্গিজিয়ার সারল্য। ছয় বিনুনি বেঁধে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটার উপর নজর পড়েছে পাশের গাঁয়ের মিনবাইয়ের। এই মেয়েটাকে তার চাই-ই চাই। টাকা-পয়সার ত আর কোন অভাব নেই! অভাব ছেলে-মেয়ের। প্রথম বউটা কোন কাজের না; একটা বাচ্চাও দিতে পারেনি! এখন একটা তোকোল - দ্বিতীয় বৌ - না হলে আর চলছে না।
ব্যবসায় মার খেয়ে মেয়েটার বাপ কিম্বিলদিয়েভকে অন্য শহরে কাজ নিতে হয়েছে। সেখানেই থাকে সে। আহা, এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে! ঐ লোক সংস্কার মানে না। বহুবিবাহের ঘোর বিরোধী। কিছুতেই এ বিয়ে দিতে রাজী হত না। মেয়েটার কাকা বিরিমকুল একেবারে বিপরীত। নিজে একাধিক বিয়ে করেছে, চলে আসা সমাজের রীতি-নীতি মানে, প্রাচীনপন্থী। এই লোক-কে প্রয়োজনমত টাকা ধরিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। গেলও।
বিয়ের রাতে জিদ্দি মেয়েটা কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেছিল। প্রত্যেকবার বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা তাকে চেপে ধরে তিনগুণ বয়সে বড় বরের ঘরে ঠেলে ঠুলে ঢুকিয়ে দ্যায়। আর পারেনি মেয়েটা। ভোরবেলায় যখন বেরিয়ে এল দরজা খুলে, বিনুনী খুলে দিয়েছে সে - বিবাহ সুসম্পন্ন। স্বামীর ঘরে চলে গেল ‘তোকোল' কারাকিজ। বয়স তখন তার তের বছর!
তোকোল। আলতিনাইয়ের জবানীতে আইতমাতভ লিখছেন -“ ‘তোকোল’ - মানে দু’নম্বর বৌ। উহ্, কী ঘেন্নাই না করি এই শব্দটাকে! কে, কখন, কোন্ জঘন্য সময়ে যে আবিষ্কার করেছিল একে! দ্বিতীয় পত্নী হওয়ার পরাধীনতা, দেহে মনে ক্রীতদাস হওয়া - এর চেয়ে অপমানকর অবস্থা আর কী হতে পারে? হে হতভাগ্য নারীর দল, তোমরা তোমাদের কবর ছেড়ে উঠে এসো! উঠে এসো, অত্যাচারে নিহতা, ধর্ষিতা, মানুষের যাবতীয় অধিকারবঞ্চিতা নারীর হে প্রেতাত্মারা - তোমরা উঠে এসো! হে শহীদের দল, তোমরা উঠে এসো, ঐ অন্ধকার কালো জগৎ একবার কেঁপে উঠুক! আমি - তোমাদের দলের সর্বশেষ জন্ম, ঐ একই ললাটলিপি পার হয়ে এসেছে যে, সেই আমি ডাকছি তোমাদের! “ এই বিপ্লবাত্মক ডাক আইতমাতভ দিতে পেরেছিলেন কারণ ডাক শোনার পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল সেই সময়। সেই পরিকাঠামো - সোভিয়েত।
‘তোকোল' কারাকিজ যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যান, সনটা সে বছর - ১৯১৭! বলশেভিক বিপ্লব সে বছর উচ্ছেদ ঘটায় জারতন্ত্রের। বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। পাঁচ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মধ্য এশিয়ার গ্রামে গ্রামে নূতন শাসকেরা তৈরী করে সোভিয়েত - সন, ১৯২২। পৃথিবী শোনে নূতন মূল্যবোধের ডাক। আরো পাঁচ বছরের মাথায় কারাকিজ সিদ্ধান্ত নেন - নিকুচি করেছে বস্তাপচা রীতি-নীতির। শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করে চলে আসেন তার বাপের বাড়ি শেকের-এ। কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে করেন তার পছন্দের মানুষকে। তার পিঠোপিঠি দাদা তরেকুল তখন সোভিয়েত গড়ার অগ্রসৈনিকদের একজন।
এর কিছুদিনের মধ্যে তরেকুল নিজের বিপদ আশঙ্কা করে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের মস্কো থেকে শেকের-এ পাঠিতে দেন। সোভিয়েতের শত্রু অপবাদে গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তরেকুলকে আর কখনো দেখেননি চিঙ্গিজ। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার/নির্বাসিত/নিহত হয়ে যান চিঙ্গিজদের আশ্রয় দেওয়া দুই কাকাও। চিঙ্গিজ-এর বয়স তখন নয় বছর।
চিঙ্গিজ বড় হয়ে ওঠেন তিন মহিলার ছত্র-ছায়ায়। এক - মা নাগিমা, শিক্ষিত, আদ্যন্ত সোভিয়েত নারী। দুই - ঠাকুমা যিনি তাকে শিখিয়েছেন তাদের প্রাচীন মূল্যবোধ, চারণজীবনের রীতিনীতি। আর তিন - পিসী, কারাকিজ-আপা। দুই আদর্শের মধ্যে সেতুবন্ধ। প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এই নারী চিঙ্গিজকে কখনো ভুলতে দেননি তার বাবা দেশের শত্রু ছিলেন না। কিন্তু সেই সাথে নিজের জীবনের শিক্ষা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেন তার বাবা-মা সোভিয়েত আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
এই চিন্তাচেতনার ফসল - প্রথম শিক্ষক। আলতিনাই-য়ের চরিত্রে এইসব নারীরা ছায়া ফেলেছেন। এবং হয়ত বা দিউইশেন-এ ছায়া ফেলেছেন চিঙ্গিজ-এর এলাকার বিদ্যালয়টির সোভিয়েত-এর আদর্শে বিশ্বাসী সেই শিক্ষক যিনি খ্যাতিমান ছিলেন না কিন্তু চিঙ্গিজকে দিয়েছিলেন মাথা উঁচু করে চলার বীজমন্ত্র।
‘প্রথম শিক্ষক' তাই আইতমাতভ-এর সেই অভিজ্ঞান যে তিনি প্রখর সোভিয়েত। এবং সোভিয়েত-এর পথ-ই আগামীর রাজপথ।
আর, ‘পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান' সামগ্রিক ভাবে প্রমাণ রাখে যে চিঙ্গিজ আইতমাতভ একই সাথে প্রখর সোভিয়েত এবং প্রবল কির্গিজ।
(কারাকিজ -এর কাহিনীর উৎসঃ Have the Mountains Fallen?: Two Journeys of Loss and Redemption in the Cold War. লেখক - Jeffrey B Lilley)
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ওঃ, কী বলবো একলহমা, আপনার জন্যই এতকিছু জানা হচ্ছে। চিঙ্গিজের বাবা তরেকুল, পিসি কারাকিজ, মা নাগিমা, ঠাকুমা, কাকারা এইসব বাস্তব মানুষেরাই মহাকাব্যের চরিত্র হয়ে উঠছে আমার কাছে। আসলে তো তাই ই হয়, পৃথিবীর মানুষের হৃৎস্পন্দনই তো ধ্বনিত হয় মহাকাব্যের পরিসরে। এমনকি ঐ আদিগন্তবিস্তৃত স্তেপ, ঐ দূরের পর্বতমালা ---ওরাও যেন কথা বলছে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এই মন্তব্যটা একটা আলাদা পোস্ট হবার গুরুত্ব রাখে। একজন সাহিত্যিক ভূঁইফোঁড় কেউ নন্। নিজের জীবন থেকে, পরিপার্শ্ব থেকে, ইতিহাস থেকে, সমাজ-রাষ্ট্রের গতিপ্রবাহ থেকে, পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে প্রতিনিয়ত বিন্দু বিন্দু শিক্ষা-অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি গড়ে ওঠেন। তাই তার রচনাকর্মতে সেসবের প্রতিফলন ফুটে ওঠে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আইতমাতভ সম্পর্কে বলা হত - লেখার টেবলের ঐ পাশটা থেকে তিনি কখনো মিথ্যা বলতে পারতেননা। আমি এই ধারণার সাথে সহমত। একজন যথার্থ সাহিত্যিক। সম্ভবতঃ সেইটাই ওনার চূড়ান্ত পরিচয়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হ্যাঁ, আমিও একমত। আপনার এই মন্তব্যে যা বলেছেন সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছা হয়। স্বতন্ত্র পোস্ট দিন এই নিয়ে। বিশেষ করে এই কারাকিজ নামের মেয়েটির কথা, তার জীবন, তার সংগ্রাম এইসব জানতে ইচ্ছে হয়।
আচ্ছা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "বৌ চন্ডীর মাঠ" গল্পটা পড়েছেন কি?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নাঃ, "বৌ চন্ডীর মাঠ" পড়া হয় নি। পড়াবে না কি?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এই এখানে আছে ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ঘ্যাচাং
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গল্পটা পড়লাম। আগে পড়া ছিল না। মূল কারণটা তো তিনি প্রকাশই করলেন না। আমরা, আজকের পাঠকেরা, কারণটা যতটা বুঝতে পারলাম আজ থেকে চল্লিশ/পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের মতো সাধারণ পাঠকেরা সেটা কি সেই মাত্রায় বুঝতে পারতেন? আমার সন্দেহ আছে।
পরিবারের সদস্য বা নিকটাত্মীয়দের দ্বারা শিশুকালে যৌন নির্যাতন ও হয়রানীর ইতিহাস সম্ভবত পরিবারের বয়সের সমান। একটা পর্যায়ে নারী শিশুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে পরিবারের সামান্য সচেতনতা থাকলেও পুরুষ শিশুর নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা একেবারেই অচেতন থাকে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমিও পড়লাম। মূল কারণটা একেবারেই উল্লেখ না করায় আমি নিশ্চিত কারণতটা তিনি ভালোই বুঝেছিলেন কিন্তু এই নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। সেটার একটা কারণ হতে পারে যেটা তুমি বলেছ, উনি ভেবে থাকতে পারেন যে সেই সময়ে পাঠক মন ঐ ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর একটা হতে পারে লেখক নিজেই এই নিয়ে কথা বলতে তৈরী ছিলেন না।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ম্যারিটাল রেপ এর কোনো ধারণাই আমাদের সমাজে ছিল না এই মাত্র পঁচিশ/ত্রিশ বছর আগেও। সত্যি কথা বলতে কী, এখনও অনেকে এই ধারণাকে অযৌক্তিক বলে মনে করেন। বলেন, আরে বিবাহ যখন হয়েই গিয়েছে তখন আর রাজি /অরাজি কীসের? বিবাহের মন্ত্রে/শপথেই তো বাকী জীবনের জন্য সম্মতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমি আমার চারপাশের দুনিয়ার কথা বলতে পারি। সেখানে বিষয়টিকে সত্য বলে মানা, অপরাধ বলে স্বীকার করা মানুষের সংখ্যা ০.০০১% জন হবে কিনা সন্দেহ। গরিষ্ঠ জনের কাছে স্ত্রীর অসম্মতি, ভালো না লাগা, অসন্তুষ্টি, না মানা ইত্যাদি বিষয়গুলো পুরোই অবান্তর মনে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কারাকিজ আপার কাহিনি শুনতে শুনতে এই তৃতীয়পক্ষের বৌটির গল্প মনে পড়ল। বিভূতিভূষণের কলমে সব সময়েই কোমলতা আর মায়া, কিন্তু একটুখানি গভীরে গেলেই বোঝা যায়, আমাদের সমাজও মাত্র বছর আশি কি একশো বছর আগেও কী সাংঘাতিক সমাজ ছিল! মানে এতটাই সাংঘাতিক যে ব্যাপারগুলোকে সাংঘাতিক মনেই করা হত না! যেন এই তো হয়, এই তো হয়ে থাকে, এই তো হয়ে আসছে!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গল্পটা পড়ানোর জন্য অনে-এ-এ-এ-ক ধন্যবাদ তুলিদিদি!
"এতটাই সাংঘাতিক যে ব্যাপারগুলোকে সাংঘাতিক মনেই করা হত না!" - পূর্ণ সহমত। অতটুকু গল্পটাতে একাধিক মর্মান্তিক বেদনার কথা রয়েছে - বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, নাবালিকাবিবাহ এইসব ত আছেই। যেটা প্রায় নিরুচ্চারে বলা হল - উপরে ষষ্ঠ পাণ্ডব যেটার কথা বলেছেন, সেটা অনেক পরিবারেই হয়ত আজও চলছে ।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বিভূতিভূষণ হয়তো ব্যক্তিগতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যায় মনে করেছিলেন, এমনকি ধর্ষিতা সপ্তদশী বউটি দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, এটাও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু সামাজিকভাবে তো ব্যাপারটা মান্যতা পেত না। সাতপাক ঘুরিয়ে বিয়ে করে আনা স্ত্রী স্বামীসহবাসে অসম্মত হবে, ভয় পাবে, অন্য মহিলা সদস্যদের কাছে মিনতি করে সুরক্ষা চাইবে যে সে স্বামীর কাছে যাবে না( সে স্বামী পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়ই হোক আর যাই হোক), এই ব্যাপারটাই তো তখনকার সমাজে উদ্ভট। তার উপরে সেই সমাজে দশ-এগারো বছরে মেয়েদের বিয়ে হত, সেই তুলনায় এই লোক তো সতেরো বছরের কনে বেছে বিয়ে করেছেন, লোকে নির্ঘাৎ ধন্য ধন্য করেছে, আহা এত বড় মেয়ে অরক্ষণীয়া হয়ে যাচ্ছিল তাঁকে বিবাহ করে উদ্ধার করলেন, কত বড় সদাশয় ব্যক্তি উনি।
তবুও, সমাজের কালেকটিভ কনশাসনেস না কী যেন বলে, সেই সম্মিলিত চেতনা কিন্তু সাড়া দিয়েছিল মেয়েটির বেদনায় ও মুক্তি-আকাঙ্খায়। তাই তাকে রহস্যময়ী এক দেবী হিসেবে উন্নীত করেছে, তাকে করে দিয়েছে বউ-চন্ডী, যিনি নানা বিপদে-আপদে গ্রামের মেয়েদের সাহায্য করেন, অসুখ সারিয়ে দেন, সুখবর এনে দেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার মন্তব্যের প্রথম অনুচ্ছেদের সাথে প্রবলভাবে সহমত। কিন্তু দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ শেষের দুই বাক্যের সাথে দ্বিমত।
মহিমা আরোপ করে সত্যকে ধামাচাপা দেয়া বা বিদ্রোহ ঠেকানোর ইতিহাস এদেশে বেশ পুরনো। এখানকার ব্যাপারটাও তাই। এটা এক প্রকার কালেকটিভ ক্রাইম। এই প্রকার মহিমা আরোপ করে শ্রীচৈতন্যদেবকে হত্যা করাও ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
একেবারে ঠিক বলেছেন। মহিমা আরোপ করে, রহস্যময়তার আড়াল দিয়ে আমাদের সমাজে বহু বিদ্রোহ, বহু ন্যায্য প্রশ্নকে মুছে দেওয়া হয়েছে, এখনও হয়। বুদ্ধকে পর্যন্ত অবতার বানিয়ে তাঁর মতবাদকে তন্ত্র মন্ত্র এ দেবতা সে দেবতা ঢুকিয়ে একেবারে আসল উদ্দেশ্যটাই নষ্ট করে দিয়েছে। চৈতন্যকে গুমখুন করে দিয়ে অবতার বানিয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মসমাজ এর অস্তিত্বই প্রায় খুঁজে পাওয়া যায় না আজ, রামমোহনের প্রস্তাবিত সেই যুক্তিতর্ক ইত্যাদির উপরে প্রতিষ্ঠিত মতবাদটি তো গোড়াতেই শেষ। তবুও আশা ছাড়তে পারি না, তবুও মনে হয় মানুষ ছোটো ছোটো দলে হলেও, এগোনো পেছোনো রাস্তায় হলেও কোনো না কোনোভাবে এগোচ্ছেই। প্রশ্নগুলো উঠছেই কোথাও না কোথাও।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
বৌ চন্ডী' লইয়া ধন্যবাদজ্ঞাপন করিয়া আপাতত সটকে পড়লেম। মন্তব্যগুলো সময় নিয়ে পড়বার জন্য পোস্টে আবার হানা দেবো। চমৎকার আড্ডালোচনা!
'বৌ চণ্ডী' পড়লাম। বৌ'টার সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়ে বিন্দুমাত্র উল্লেখ না থাকলেও পাণ্ডবদার কথা মত এখনকার পাঠক সমাজ ঠিকই দেখতে পাবেন অর্ন্তরালের অন্ধকার। একলহমাদার কথা হয়ত ঠিক। সময় বা লেখক তৈরি ছিলেন না। সঠিক ব্যাপারটা অজানা। লেখা দিয়ে পাঠকের মন তৈরির সুযোগ বিভূতিভূষণের মত একজন লেখক এড়িয়ে গেছেন, ব্যাপারটা মানতে কষ্টই হচ্ছে।তখনকার জন্য প্রায় অসম্ভব ভাবনার বীজ এই মানুষটিই তো তাঁর চাঁদের পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে পাঠক মনে বুনে দিয়েছিলেন। বৌটা যে শুধুমাত্র তার স্বামীকেই ভয় পাচ্ছে তা তো না। পুরুষদের নিয়েই তার মধ্যে আতংক। তার মানে নিজের পরিবারেও তাকে কোনো পুরুষের বিকৃতির স্বীকার হতে হয়েছিল। সরবতাহীন # মী টু' তখনও ছিল, আজকেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রীর আক্ষেপটাই যেন সত্যি, 'হায় ভগোমান পিথিমিতে মেয়ে মানুষ কেন জন্মায়!'
এই যে মেয়েটি পুরুষদের কাছ ঘেঁষতে চায় না দেখে তার উপরে কোনো পুরুষের দ্বারা অত্যাচার আগে অত্যাচার হয়েছিল আমরা ধরে নিচ্ছি, এও তো পিতৃতন্ত্রের চাপ। এই মেয়েটির হয়তো স্বভাবের মধ্যেই ছিল পুরুষদের পছন্দ না করা, সঙ্গী হিসেবে নারীদের পছন্দ করা, হয়তো লেসবিয়ান ছিল সে। অথবা হয়তো অন্য কোনো ওরিয়েন্টেশন ছিল তার। এটা এখনও আমরা গ্রহণ করতে পারছি না, কারণ সঙ্গী নির্বাচনে এই "স্বাধীনতা" পিতৃতন্ত্রের গোড়া ঘেঁষে কোপ লাগায়। ভাতে কাপড়ে কোনোভাবেই তাকে ডিপেন্ডেন্ট করা না গেলে শেষ অস্ত্র যৌনতাড়নায় ফাঁদে ফেলা। সেক্ষেত্রেও যদি সে পুরুষকে পাত্তা না দেয়, তাহলে সত্যি সত্যিই পিতৃতন্ত্রের হাতে থাকে পেন্সিল। সেইজন্যেই এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বিরুদ্ধতা এখনও।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার এই বিশ্লেষণটি কোন বড় গল্প বা উপন্যাসের মাধ্যমে ধরে রাখুন। ছোট গল্পে এটা আঁটালে অস্পষ্ট থেকে যাবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই বিষয়বস্তুতে যদি কোনো বড়গল্প বা উপন্যাস লিখেও ফেলি, সেটা সমাজের লোকের কাছে পৌঁছবে সেই উপায়টুকুও কি থাকবে? গ্রহণ করা না করা তো পরের কথা। সাহিত্যজগতের "বড়দা"রা তো লেখা নির্বাচিতই করবেন না জাস্ট ওঁদের "ব্যবসা" র ক্ষতি হবার আশঙ্কায়। আর "বড়দা" রা না বার করলে খুব ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছবে মাত্র, যে গোষ্ঠীতে হয়তো ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে একাধিক লেখা হয়ে গিয়েছে, যাঁরা লিখেছেন তাঁরাই পড়েছেন(ছোটো ছোটো লিখনগোষ্ঠীতে সাধারনতঃ যাঁরা লেখেন তাঁরাই পড়েন, বাইরের লোক খুব একটা পড়েন না লেখাগুলো ), এবং হয়তো ভুলেও গিয়েছেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনি তো লেখক। আপনার কাজ সাহিত্যের ভাষায় লিপিবদ্ধ করা, সৃষ্টি করা। সুতরাং আপনি লিখে যাবেন - উপন্যাস বা গল্প। বাজার নিয়ন্ত্রক প্রকাশক সেটা ছাপতে রাজী হলেন কিনা বা সমাজের গরিষ্ঠ অংশের কাছে তা পৌঁছালো কিনা সেটা নিয়ে ভাববেন না। সাহিত্য তো আপনার জীবন; সেটা তো আপনার জীবিকা নয়! তাই নামী প্রকাশক না ছাপলে নিজেই ইবুক আকারে ছাপিয়ে কোন বই বিক্রির হাটে তুলে দিন। কায়েমী স্বার্থচক্রের জাল ছিন্ন করার অনেক উপায়ই এখন আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কী আর বলবো বলুন! আজকাল এইরকম ইবুক ও হাজারে হাজারে বের হচ্ছে। যে পারছে বই লিখে ছেপে বের করে ফেলছে। একেবারে মর্জিনা কেস দাঁড়িয়েছে, সবার দেয়ালেই মার্ক করে দিয়েছে, এবারে আলির বাড়ি খুঁজে বার করুক চল্লিশ চোর। এই হাজারে হাজারে যেনতেনপ্রকারেণ বই বার হওয়া দেখে আজকাল মর্জিনার কথাই মনে পড়ে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
"মর্জিনা কেস" - হাঃ হাঃ হাঃ! পুরাই!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আগে লিখুন। ছাপাছাপির ব্যাপারে পরে ভাববেন। একটা না একটা উপায় বের হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই এতকাল পরে "প্রথম শিক্ষক" পুনরায় পাঠ করে মনে হল সত্যিকার আলতিনাইয়ের কাহিনি লিখতে হয়তো কোনো "আইৎমাতভা"কে লাগতো। লেখক এখানে আলতিনাইয়ের জবানিতে কাহিনি লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু সেভাবে কি ভেতরের কথা, অনুভব, রাগ, দুঃখ, সাহস, শক্তি, সবটা বলতে পেরেছেন যেভাবে বলতে পারতেন কারাকিজ আপা?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন