এই পর্বের কাহিনী আমাদেরকে কারিতাতের বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তার এনলাইটেনমেন্টের যুক্তি-তর্কের কাছে নিয়ে যাবে। আমারা দেখব কেন কারিতাত সত্যান্বেষনে বেরুল। দেখব কিভাবে কান্টের সাথে বোঝাপরা করে অস্থির কারিতাত থিতু হয়।
আগের পোস্ট
সত্যের খোঁজে কারিতাত - পোস্ট ১
সত্যের খোঁজে কারিতাত - পোস্ট ২
-পর্ব ২ -
কারিতাতের কারাজীবন
(দ্বিতীয় খন্ড)
হতবিহবল এক মুহুর্তে কারিতাতের ইচ্ছে হল বাঁধন খুলে দেয়ার জন্য প্রহরীকে ধন্যবাদ দেয়। কিন্তু প্রহরীর বিভৎস মুখের উপর চোখ পড়ায় সম্বিত ফিরে পেল সে। বিদঘুটে খলের সব চিহ্নই সেখানে রয়েছে – বাজুতে উল্কি, চিবুকের কাছে গভির কাটা দাগ, বাঁকা হাসি আর তকতকে ফাঁকা চাঁদি - ভয়ে কলজে শুকিয়ে দেবার মত এমন জুৎসই চেহারা আর হতে পারেনা। বন্দির মুখে পিস্তল চেপে ধরে সে মনে করিয়ে দিল - এখানে পড়া, লেখা বা কথা বলা নিষেধ। একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে ‘চিন্তা করা যাবে ত?’ – পরে এই পন্ডিতি খেকে নিরস্ত হল কারিতাত।
‘শুনলাম তুমি নাকি প্রফেসারি কর’ – চাদিছিলা বলল – ‘তাবলে আমাদের বোকা বানানর চেষ্টা কোরোনা, ধরা খাবে’। প্রহরী চলে গেলে কারিতাত চিন্তায় ডুবে গেল। এই ঘোর দিনে মানব সমাজের ভবিষ্যত নিরাশায় ছেয়ে আছে; আর তার নিজের জীবন? তাওত এক কুঠুরির অন্ধকারে ডুবে আছে। এই ভাবনার মাঝে হঠাৎ একাকিত্বের বোধ চেপে ধরল তাকে। পরিবারের মধুর সান্নিধ্য, বন্ধু-সহকর্মীদের সুখকর সঙ্গ সব কেড়ে নিল এই জান্তা। সুজানার মৃত্যুর পর তার পরিবারের বাকিরা একে অন্যের আরো কাছে চলে আসে। যুক্তিহীন নৈরাজ্যের মাঝে থেকেও নিজেদের মত করে যে যার যুক্তিকে সাজিয়ে নিয়েছিল সুজানা, মার্কাস, এলিজা আর কারিতাত। চিকিৎসা ব্যবস্থার গাফেলতিতে সুজানার মৃত্যর সময়ে কোন প্রতিবাদেই কিছু হলনা; নৈরাজ্য আর অব্যবস্থায় একটু একটু করে দানা বাঁধছিল। সুজানার রক্তশুন্য, কষ্টে নীল চেহারাটা আজো চোখের সামনে ভাসছে কারিতাতের, তার অধ্যাপকসুলভ পলায়নপরতাকে ব্যংগ করছে যেন। সুজানার ভালবাসা ছিল ধারালো, প্রবল। ভালবাসার এই প্রচন্ড টানেই কারিতাতকে কাছে টেনে নিইয়েছিল সে; এরপর ছবির রঙ আর গানের সুরে শুরু হল তাদের সংসার; বাচ্চাকাচ্চার হাসিতে মুখর হয়ে উঠল। অবশ্য এলিজার জন্মের আগে থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার দরুন বেশ একটু আশংকা আর অনিশ্চয়তা তাদের জীবনে ভর করেছিল। সুজানার চেনা প্রচন্ড ভালবাসা তখন প্রচন্ড উদবেগের রূপ নিল। ঝড়ের ঝাপ্টা থেকে নীড়টিকে বাচিয়ে রাখাই তটস্থ পাখিটির রাত দিনের ভাবনার বিষয় তখন। তাই সুজানার মতে সাবধানি হওয়াই যৌক্তিক আচরন।
আর মার্কাসের কাছে যৌক্তিকতার মানে হচ্ছে সমস্যা ধরে ধরে সমাধান করা। ছেলেবেলা থেকেই পৃথিবীর জটিলতা তাকে অস্থির করে তুলত। কোন সমস্যাকে সমাধানের যোগ্য মনে হলে সে তার খুটিনাটি নিয়ে মেতে থাকত; আর যেগুলো দুর্বোধ্য বা সমাধানের অযোগ্য মনে হত সেগুলোকে সযত্নে এড়িয়ে যেত। সামাজিক সমস্যাগুলো ছিল তাই তার অপছন্দের। কৈশরে সে প্রায়ই পৃথিবীর মানচিত্র নিয়ে বসে ভাবত –পৃথিবীর দেশগুলোকে কোন ভাবে এক সুতায় গাঁথা যায় কিনা। এটা সে পরিষ্কার বুঝেছিল যে ধর্ম এক্ষেত্রে কোন কাজেই আসবে না। তার মনে হল ধর্মের মূল কথা হচ্ছে ‘কঠিন’ প্রশ্ন গুলোকে রহস্যের আধারে অসম্ভব হিসাবে প্রতিভাত করা; অথচ এই রহস্য ব্যপারটি তার বরাবরই অপছন্দ। ছেলের যুক্তিবাদি মানসিকতায় অবশ্য কারিতাত গর্বই বোধ করত। তাই খাবার টেবিলে বসে স্কুলছাত্র মার্কাস তখন পাদ্রিদের কার্যকলাপের উপর অনাস্থা প্রকাশ করল - তার মতে এই পাদ্রিরা সাধারন লোকেদের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে মুলত জান্তার তাবেদারি করে বেড়াচ্ছে। তবে পরবর্তি সময়ের কথা মনে করে কারিতাতের মন কিছুটা ভারি হয়ে আসল। কারন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পর মার্কাস বিদ্রোহী শিবিরে নাম লেখাল। স্পষ্টতই কারিতাতের কারাবাসের অন্যতম কারন এটা।
অন্যদিকে এলিজার কাছে যৌক্তিকতার মানে হচ্ছে কিছু নীতি মেনে চলা। সে মনে করে কোন লক্ষ্য পূরনে কাউকে ব্যবহার করা আন্যায়, এমনকি তা কোনো বৃহৎ সামষ্টিক উদ্দেশ্য হলেও। তার এই জীবনবোধ কান্ট বা অন্য কোন দার্শনিকের কাছ থেকে শেখা নয়, বরং নিজের অভিজ্ঞতা, আর অন্যের প্রতি সহানুভুতি থেকেই সে নিজের দর্শন তৈরি করেছে। মায়ের মতই তার হালকা গড়ন আর শুকনো চেহারা, আর অনুভতিও একই রকম তীব্র। তবে এর সাথে ভাই মার্কাসের স্পষ্টবাদিতা আর বাবার সত্যান্বেষি আদর্শ পৃথিবীর অন্বেষাও রয়েছে তার মধ্যে। তবে বাবার মত তার অন্বেষা কোন রূপকল্প বা তত্ত্বের ধার ধারেনা; অসুন্দরকে হটিয়ে সত্য সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয় সে। তাই উদবেগ সত্বেও মার্কাসের বিদ্রোহী শিবিরে যোগ দেয়ায় বাঁধা দেয়নি এলিজা। তবে ভাইকে সে সাবধান করে দিয়েছিল যেন সে বিদ্রোহি শিবিরের হাতের গুটি হয়ে না পড়ে। শক্তি, সমাজ কাঠামো আর প্রক্রিয়া নিয়ে এই শিবিরের তাত্ত্বিক আলোচনা তার সবসময় সুবিধার ঠেকত না। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে অত্যাচারিতের সেবায় নিজেকে নিবেদন করেছে। তাই এই শোষিতদের জন্য সে শক্তি আর সাহসের উৎস্য হয়ে উঠল। এই ধারায় নিখোঁজ সন্তানের মায়েদের সে সংগঠিত করল, বিপদাপন্নদেরকে পালানর পথ করে দিল, এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ের নিপিড়নের ঘটনাগুলোকে জগতের সামনে তুলে ধরতে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগও বাড়িয়ে দিল। অবশ্য মিলিটারিয়াতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে নিজের বিপদ আঁচ করে এলিজা খুবই গোপনে তার কাজ করে যেতে থাকল।
তার নিজের জীবনবোধ কি যৌক্তিক ছিল?- কারিতাত ভাবে। তার পরিবারে কেবল এলিজাই হয়ত তাকে কিছুটা বুঝত। তাদের চোখে সে একজন পলায়নপর ব্যক্তি যে বিপদের মুখে চোখ বুজে থাকতে পছন্দ করে। “সবসময় যদি বইতেই মুখ গুজে থাক তবে পৃথিবীর স্পন্দন শুনবে কি করে?”- কারিতাতের ব্যপারে এটা তাদের আভিন্ন অভিযোগ । মার্কাস ছিল তাঁর ব্যপারে সবচেয়ে হতাশ। সে ভাবত মিলিটারিয়ার এই অবস্থায় বিদ্রোহিদের অবস্থান আর ভুমিকা না বোঝাটা কি কারিতাতের ইচ্ছাকৃত? এক্ষনে এলিজার কথা তার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে; সে বলত তাঁর বাবা একজন এবস্ট্রাক্ট ভাবনার মানুষ, হালের সমস্যা নিয়ে বাস্তব কিছু না করে পুরানো ভাবনার সাথে বচসাই ছিল তার আচার। কারিতাতের যুক্তি - ভবিষ্যতের জন্য বাস্তবিক এবং যৌক্তিক কোন উত্তর পাবার জন্য অতিতে যারা একই সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন তাদের সাথে কথা না বললে কি চলে? মানুষের জন্য বাস্তবিক একটি ব্যবাস্থা ঠিক কি নীতিতে গড়ে উঠতে পারে? তার এই ভাবনাকে কেন বাকিরা যৌক্তিক বলে ভাবে না এটা কারিতাত ঠিক বু্ঝে উঠতে পারে না।
এরকম নানামুখি ভাবনার মধ্যে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় কেটে গেল। এক সময় প্রহরী এসে তাকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেল; বড়সর এই ঘরের মাঝখানটায় ঝোলান বাতি থেকে মৃদু আলো চুয়ে পড়ছে। এই প্রায় অন্ধকার ঘরের কোনায় দু’জন লোকের উপস্থিতি টের পেল সে। তাকে দেখে বায়ের লোকটি বসতে বলল। চশমা বিধুর চোখে এই আন্ধকার ঘরে লোকদুটিকে দেখে কিছু ঠাহর করতে পারলনা সে; কেবল একটি গভীর আশাহিনতার ছাপ তার মনে চেপে বসল।
‘আপনার চশমার ব্যপারে আমরা দুঃখিত। অবশ্য আমরা মনে করি আপনাকে অযথা পেরেশানি করা হচ্ছে না।” বা’দিকে বসা লোকটা বলল। ‘অযথা নয়?’ – এই মন্তব্যের কি উত্তর দেবে সে? - ‘না না এমন তো হতেই পারে’ অথবা ‘অসুবিধা নেই ওগুলো ছাড়াই চলতে পারব আমি।” এদের ভাবে মনে হচ্ছে বলার মত অসুবিধা বলতে কেবল এই চশমা ভাঙ্গার ব্যপারটাই ঘটেছে।
প্রথমজন বলতে থাকে, ‘অবশ্য আমাদের সহযোগীতা করলে শিগগির আপনার কষ্ট দূর হবে’। এবার দ্বিতীয়জন কিছুটা শ্রদ্ধার স্বরে বলতে লাগল, ‘দেখুন অধ্যাপক সাহেব! আপনার সহযোগীতা এই দেশের অপরিমেয় উপকারে আসবে; এই দুঃসময়ে আপনার আস্থা আর সহযোগিতার ভীষন প্রয়োজন’। এরপর কারিতাত আবার জিজ্ঞেস করল ‘আমাকে কেন গ্রেফতার করা হল?’ আগের মত করেই তারা বলল ‘আপনাকে তো গ্রেফতার করিনি’। ‘তবে আমি এখানে কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করল সে। ‘দেখুন অধ্যাপক সাহেব!’ দ্বিতীয় জন বলল ‘আপনি একজন বুদ্ধিজীবি। এই মিলিটারিয়াতে আপনি আপনার বুদ্ধির জন্য সমাদৃত। আপনার চিন্তাশক্তিই এর মূল উৎস। আর বাস্তবে এই শক্তিকে আপনি কোন গুরুত্বই দিচ্ছেন না’।
‘কিন্তু আমিত একজন শিক্ষাবিদ, এনলাইটেনমেন্ট নিয়ে আমার নাড়াচাড়া’ বলল কারিতাত।
দ্বিতীয় প্রশ্নকারি এবার বলল, ‘ আগুন ছাড়াত আলো হয়না প্রফেসর। এখন যুদ্ধাবস্থা, বিপ্লবী আশাবাদের চাপে এই সমাযে ভয়াবহ দুর্দিন উপস্থিত। এই সময়ে আপনি দেশের শত্রুদের সাহায্য করছেন!’
‘কিন্তু আমি একজন শিক্ষাবিদ – আদর্শিক নেতা নই’ কারিতাত ক্ষেদের সাথে বলল।
এবার প্রথমজন বলল, ‘আমরা জানি আপনার শিক্ষাকে বিপ্লবীরা মাথায় করে রাখছে। তাদের প্রশিক্ষন শিবিরে আপনার লেখা পাওয়া যায়। তাছাড়া তাদের নিয়মিত পাঠ্যতালিকাতেও আপনার লেখা অন্তর্ভুক্ত’। দ্বিতীয় জন যোগ করল ‘আপনি নিজে গুরুত্ব না দিলেও আমরা এবং বিপ্লবীরা আপনার লেখাকে গভীর গুরুত্ব দিয়ে দেখি’।
‘আমার কাছে কি চান আপনারা?’
কারিতাতের প্রশ্নের উত্তরে প্রথম প্রহরী বলল, ‘প্রথমত আমাদের কাছে খবর আছে, আপনি আপন বিপ্লবিদের সাথে অনেক গোপন বৈঠক করেছেন; এসব বৈঠকে যারা আসত তাদের সবার নাম আমাদের বলুন। দ্বিতীয়ত, যেসব আশা সঞ্চারি মতবাদ প্রচার আর সমর্থন করতেন সেগূলোকে লিখিতভাবে ত্যাগ করুন, আর যারা এইসব ধারনায় বিশ্বাস করে তাদেরকেও আনুষ্ঠানিক ভাবে অস্বিকার। তৃতীয়ত, আপনি আর কখনো এইসব মতবাদকে বিস্তার করবেন না বা এদের অনুসারিদের কোন রকম সহযোগীতা করবেন না এই মর্মে লিখিত অঙ্গিকার দিন’।
‘আমি যদি এই সব শর্তে রাজি হই তবে?’ কারিতাত প্রশ্ন রাখল। সে ভাবছে এদের প্রতি কিছুটা সহযোগীতার আচরন প্রদর্শনের কৌশল নেবে।
দ্বিতিয়জন উত্তরে বলল, ‘আমরা আপনাকে কোন স্পষ্ট আশার কথা বলতে পারছিনা’। প্রথম জন বলল, ‘অবশ্য আমরা আপনার চষমা মেরামতের ব্যবস্থা করে দিতে পারি’।
কেবল একজোড়া চশমার কাঁচের জন্য সে এনলাইটেনমেন্টের আদর্শের সাথে বেঈমানি করব? এভাবে চুপচাপ অনেকটা সময় কেটে গেলে প্রথমজন বলল, ‘তাহলে অধ্যাপক সাহেব! আমাদের আতিথেয়তায় বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ভেবে দেখুন’। এরপর প্রশ্নকর্তাদের ইশারায় ষন্ডামার্কা প্রহরীটি এসে কারিতাতকে তার কুঠুরীতে নিয়ে গেল। অধ্যাপক মহাশয়ের জন্য অপমানের পরের ধাপ আসন্ন বোঝা যাচ্ছে।
ভোতামুখো তার হাতে খসখসে টয়লেট পেপার ধরিয়ে দিয়ে কুঠুরীর কোনার দিকের গামলার দিকে ইঙ্গিত করে প্রাকৃতিক চাপ লাঘব করে নিতে বলল। তার হাতব্যাগটি আশেপাশে দেখা না গেলেও এক বালতি ঠান্ডা পানি, ছোট এক টুকরা সাবান আর একটা খসখসে তোয়ালে তার হাত মুখ ধোয়ার সরঞ্জাম হিসাবে রেখে দিল। তার জন্য খাবারের যে আয়োজন তা আরো হতাশাব্যঞ্জক। ছাতাপড়া পাওরুটি, ঘ্রাণবিহীন আলুভর্তা, কাষ্ঠকঠিন চিজের টুকরা আর ততোখিক শক্ত এক টুকরা মাংস; অবশ্য এক বোতল পানিও ছিল। এই নিয়ে তার বাকি দিন কাটবে – এই নিরালা জানালাহীন কুঠুরিতে – মানুষের মুত্রের দুর্গন্ধ হটিয়ে নিজের আর মনব জাতির ভবিষ্যত ভেবে ভেবে।
চশমা ভেঙ্গে দিয়ে জান্তা বস্তুজগতের উপর কারিতাতের অনুভুতিকে অসার করে দিয়েছিল। আর এই অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রেখে তারা তার দিনক্ষনের বোধও কেড়ে নিয়েছে। কাজেই জঘন্য হলেও তাকে যে খাবার দেয়া হল তাকে রাতের খাবার মনে করে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল সে। হয়ত তার কারাবাসের প্রথম দিন শেষের পথে।
রাতের খাবার খেয়ে ইমানুয়েল কান্টের সাথে কাল্পনিক বিতন্ডায় লেগে গেল কারিতাত। ‘এনলাইটেনমেন্ট কি জিনিস?’ কান্টকে জিজ্ঞেস করল কারিতাত। ভাবলেষহীন ভঙ্গিতে কান্ট বলল, ‘এর মানে হচ্ছে নিজেকে নিয়ে, নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে ভাবা। নিজেদের আরোপিত অপরিপক্কতার গর্ত থেকে উঠে আসা। এর মূলকথা হচ্ছে আপনার নিজের বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করার সাহস বুকে ধরা’। কারিতাত বলল, ‘ভাল কথা, কিন্তু সেটাত সহজ কাজ নয়’।
‘অবশ্যই নয়’ একটু বিরক্ত দার্শনিক কান্ট সাহেব ‘আলসেমি আর ভীরুতার জন্য অনেকেই অপরিপক্ক্বতা আর অন্ধত্বকে হাসিমুখে মেনে নেয়। অপরিপক্ক্ব থাকাইত সুবিধা। তোমার কিছু জানার ইচ্ছা হল তো বই পড়ে নিলে, আধ্যাত্মিক জ্ঞান দরকার গুরুর কাছ থেকে জেনে নিলে, ডাক্তার ঠিক করে দিচ্ছে তুমি কি খাবে না খাবে ইত্যাদি ইত্যাদি...। তোমাকে কোন ভাবনাই ভাবতে হল না। যতক্ষন তোমার কাছে টাকা আছে অন্য কেউ তোমার হয়ে ভেবে দিচ্ছে।’
‘তুমি খুব উচুদরের আদর্শের কথা বলছ’ কারিতাত বলে, ‘কিন্তু মানব সম্প্রদায়ের পক্ষে কি এটা অর্জন করা সম্ভব? তুমি অলোকিত মানুষের কথা বলছ যারা সম্পূর্ন স্বাধীন ভাবে প্রজাতন্ত্রের ছত্রছায়াতে একই আইনের অধিনে বাস করবে? হয়ত রুশোর কথাই ঠিক। এটা কেবল দেবতা দের ক্ষেত্রেই সম্ভব।’
‘আমি জানি রুশো তেমনই বলে। কিনতু সে খুব নিরাশাবাদি। সে এটা লক্ষ্য করেনি যে সতর্কভাবে বিধান তৈরি করতে পারলে খরগহস্ত না হয়েও মানুষের দুর্বলতাকে কাটিয়ে তোলা সম্ভব । রুশোর ধারনা স্বার্থতাড়িত মানুষ এরকম গভীর আদর্শ নির্ভর বিধান মেনে বেশীদিন চলতে পারবে না। অথচ লক্ষ্য কর প্রকৃতি বরাবর মানুষের সাধারন ইচ্ছারই সহায়ক। কতই না চমৎকার প্রকৃতির এই আচরন, কিন্তু দেখ স্বার্থতাড়িত আচরন কাজে লাগিয়েই কিন্তু এই ব্যবস্থা কাজ করছে। কাজেই রাষ্ট্রের জন্য যথার্থ একটা সংগঠন কাঠামো ঠিক করতে হবে যা স্বার্থতাড়িত আচরনকে কাজে লাগাবে এমন ভাবে যাতে করে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ গূলো একে অন্যকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এতে করে ফল এমন দাঁড়াবে যে কোন স্বার্থতাড়িত প্রবনতাই যেন ছিল না। কাজেই মানুষ স্বভাবগত ভাবে নীতিবর্জিত হলেও আদর্শ নাগরিকের মত জীবন যাপন করবে সে। শুনলে ব্যপারটাকে কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু শয়তানের দেশেও এইরকম একটা ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব যদি তাদের মধ্যে যুক্তিবোধ থাকে। এমনকি শয়তানের দেশেও ন্যায়বিচার আর শান্তির কোন বিকল্প নেই।’
‘মিলিটারিয়াতেও এটা সম্ভব!’
‘মিলিটারিয়াত সবচেয়ে সেরা। মিলিটারিয়া এই ধারনাকে বাস্তবে পরিনত করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। যুদ্ধই বল আর নির্মম সামরিক আয়োজনই বল সব জাতিকেই এই ধাপের মধ্যদিয়ে যেতে হয়। এমনকি যুদ্ধ না থাকলেও প্রকৃতির নিয়মেই জাতিগূলো এইসব ভুল ব্যবস্থা প্রয়োগ করে এবং হাজারো ঘাত-প্রতিঘাত, উত্তেজনা আর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যুক্তিচালিত হয়ে আদর্শ ব্যবস্থার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই একদিন তৈরি হবে সত্যিকারের ‘মানুষের রাষ্ট্র’।
‘কিন্তু!’ নিকোলাস আপত্তি জানায়,‘এমন ভাবাত স্বাভাবিক যে এহেন অবাস্তব লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার গো ধরলে তা অপুর্ণই থেকে যাবে। তার চেয়ে বরং সমাজের বিদ্যমান অন্যায় মোকাবেলা করা, যুদ্ধের প্রয়োজন কমিয়ে আনা, আপোষ আর বোঝাপরার মধ্য দিয়ে চলাই কি বেশি বাস্তব সম্মত নয়?’ কান্ট বলে,‘দেখ ন্যায়বিচার আর শান্তির পথে কিন্তু আপোষ চলে না। এমনকি মিলিটারিয়ার দুঃশাষনের অধিপতিরাও কিন্তু এই ন্যায়বিচার আর শান্তির দোহাই দিয়েই তাদের অন্যায় জারি রাখে। কাজেই সব চেষ্টা আর মুখোশের আড়ালে কিন্তু এই আদর্শ ব্যবস্থার ধারনাই লুকিয়ে আছে। এর উদ্দেশ্য কপট হোক বা খাঁটি সেই আদর্শ ব্যবস্থার দিকে যাবার চেষ্টাতেই সব আয়োজন।’
‘মনে হয় তুমি ঠিকই বলছ’ – এবার কাণ্টের যুক্তি কারিতাতকে বেশ সাহস যোগাল। শক্ত বিছানার ওপর কম্বল বিছিয়ে এবার ঘুমাতে গেল সে, গভীর ঘুম।
মন্তব্য
দ্বিতীয় খন্ড এখানে শেষ। তৃতীয় খন্ডের কাজ চলছে।
নতুন মন্তব্য করুন