চলমান ১| ফিরে আসুক সোনালি আঁশের সোনালি দিন

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি
লিখেছেন রিয়াজ উদ্দীন (তারিখ: শুক্র, ০১/০১/২০১০ - ৩:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম আলোর রিপোর্ট থেকে জানা গেল বংলাদেশে পাটের বাজারে হঠাৎ মূল্য বৃদ্ধি জনিত অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সোনালি আঁশ পাটের বাজার ঘুরে দাড়াতে যাচ্ছে এমন একটা সম্ভাবনার কথা শুনলে আনন্দে মন লাফিয়ে উঠবে না এমন বংলাদেশি বোধকরি পাওয়া যাবে না। তবে এই অবস্থায় অর্থনৈতিক কৌশলগত দিকগুলোও যাচাই করে দেখা দরকার। এটা পাটের ভবিষ্যতের জন্য একটা ক্রান্তিকাল। সেক্ষেত্রে 'কি করিলে কি হইবে' জাতীয় বিবেচনা বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। এই পোস্টে এই ধরনের কিছু ধারনা নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা।

খবর পড়ে যেটা মনে হল অস্থিরতার কারন এরকমঃ

  • আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা বাড়ছে। তবে এই চাহিদা বৃদ্ধির ব্যপারটা হয়ত আকস্মিক নয়। সম্ভবত ধাপে ধাপে একটু একটু করে বেড়েছে এই চাহিদা। এই চাহিদার ট্রেন্ড বিষয়ে উপাত্ত ছাড়া তেমন কিছু বলা সম্ভব নয়।
  • আভ্যন্তরিন বাজারে পাটজাত পন্যের চাহিদা বাড়ায় কাচামাল হিসাবে পাটের চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশে এই চাহিদা বাড়ার বিষয়টি বেশ আগ্রহ জাগায়। স্থানীয় বাজারে যদি পাটের ব্যবহার বাড়ে আর কিছু না হোক বিদেশি পন্যের উপর নির্ভরতা কমার একটা আভাস এখানে পাওয়া যায়।
  • এ বছর পাটের উৎপাদন কম হয়েছে। এটাকে আকস্মিক ব্যপার বলেই মনে হচ্ছে। হয়ত আবহাওয়া অথবা সার-বীজের যোগান নিয়ে কোন সমস্যার কারনে এমনটা হয়ে থাকতে পারে।

তৃতীয় কারনটি যদি প্রধান হয় তবে বুঝতে হবে আহ্লাদিত হবার কারন খুব বেশি নয়। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সবগুলো কারনই জোরদার। পাটের চাহিদা আসলেই বেড়েছে। সেজন্যই চাহিদা যোগানে ঘাটতি। কিন্তু খাত হিসাবে পাটের ভবিষ্যত নিয়ে করার আছে অনেক কিছুই। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা (বিশেষ করে Ricardo Hausmann এবং Dani Rodrik ) সেলফ-ডিসকভারি বলে একটা ধারনার কথা বলেন। অনেকটা নিজেকে আবিষ্কার করার মতই একটা ব্যপার। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই ধারনার সাথে অনেকটাই একমত। একটা দেশের শিল্পখাতকে খুঁজে বেড় করতে হবে তারা কোন কাজটা ভাল পারে। তারপর সেটার দিকে মনযোগ দিতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তাকে সব ধরনের পন্য উৎপাদনে পারদর্শী হতে হবে এমন ভাবা ভুল। দেশে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, স্থানীয় বাজারের প্রকৃতি সব মিলিয়ে বিশেষ বিশেষ শিল্প কোন একটা দেশের জন্য উপযোগী। কিন্তু এটাকে গানিতিক সমীকরন হিসাব দিয়ে বেড় করা যাবে এমন নয়। এর জন্য ঝুকি নেয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোকে সবার আগে গুরুত্ব দেয়া দরকার।

বাংলাদেশের আবহাওয়া পাটের জন্য ভাল, অন্তত ইতিহাস তাই বলে। কাজেই কাচা পাট হোক আর পাটজাত পন্য হোক দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনা মূলক সুবিধা (comparative advantage) থাকার কথা। কিন্তু আন্তর্জাতিক আর স্থানীয় বাজারে বিদ্যমান চাহিদার গতিপ্রকৃতির বিষয়েও সতর্ক হওয়া দরকার। এখন দেখা যাক আমাদের মন্ত্রনালয় কি ভাবছে? তারা সাধারনত শিলোন্নয়নের জন্য কি ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করেন?

সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা হিসাবে পাট রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। আবার সেটা তুলে নেবার কথাও ভাবা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মন্ত্রনালয় এক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদনকারি আর আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছ থেকে চাপের মুখে আছে। আর দোটানার দরুন কিছুটা সিদ্ধান্থীনতাও স্পষ্ট। এই টানাপোড়েনের বাইরে সরাকারের কি কি করার আছে তা নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া দরকার। তবে বাজারে হস্তক্ষেপ কম করাই বোধ হয় সমিচীন হবে। এতে অস্থিরতা আরো বাড়বে। কোন ক্ষেত্রে কিছু করতে হবে আর কোন ক্ষেত্রে কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হবে সে ব্যপারে নীতিনির্ধারকেরা ঠিক ভাবে বিবেচনাবোধ কাজে লাগাবেন আশা করি। খবরের কাগজে 'কিছু করা হচ্ছে' জাতিয় আমেজ তৈরির চেয়ে ফলাফল মুখি কৌশল নেয়াটাই আগে দরকার। কাজেই সমালোচনার ক্ষেত্রেও কেবল কিছু করা হচ্ছে কিনা এটা না দেখে কি এবং কেন করা হচ্ছে সেটা লক্ষ্য করা বেশি দরকার। কেবল নিষেধাজ্ঞা, কর, ভুর্তকি এসব ছাড়াও শিল্পে প্রনোদনার অন্যান্য প্রয়োগ করার রীতি চালু করতে হবে। বিশ্ব অর্থনিতিক ফোরামের গবেষনায় বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের অবস্থা তেমন সুবিধার নয় যেগুলো নিয়ে সরকারের ভাবা দরকার।

এই অবস্থাগুলো দেখে কিছু ভাবনা এসেছে মনে। এর সব যে কেবল পাটশিল্পের উপর প্রযোজ্য এমন নয়। কৌশলগুলোর কিছু কিছু দেশের সামগ্রিক শিল্পোন্নয়নের জন্যেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।

  • পাট রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা দ্রুত তুলে নেয়া দরকার। কারন আন্তর্জাতিক ক্রেতারা যদি বিকল্প বিক্রেতা পেয়ে যায় সেটা বাংলাদেশের জন্য ভাল হবে না। এর মধ্যে ভারতের পাট শিল্পে ধর্মঘট জনিত কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের পাটের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। অবশ্যই আমাদের পাটের বাজার সম্প্রসারন ভারতের মাথাব্যথা নয় কিছু আমাদের পাটের বাজার সম্প্রসারনের জন্য আমাদেরই মনযোগি হওয়া দরকার। আবার ভারতের কৃষকদের মধ্যেও পাট উৎপাদনের আগ্রহ কমছে।একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় যাচ্ছে। এই সময়ে বড় কোন কৌশলগত ভুল করা এড়িয়ে চলা দরকার। আর এটাও মনে রাখা দরকার অনেক সময় কিছু না করাটাই সর্বোত্তম কৌশল হয়ে ওঠে। পাটের মূল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি মন্ত্রনালয়ের মনে রাখা জরুরী।
  • পাটের বাজারে এই সাময়িক অস্থিরতাকে পাট শিপ্লে বিপ্লব হিসাবে মনে করার সময় এখনো বোধহয় আসেনি। কারন আমার মনে হচ্ছে এই অস্থিরতার প্রথম কারন এই বছর আশানুরুপ উৎপাদন না হওয়া। এখন এই খবরে যদি কৃষকের অতি উৎসাহে খুব বেশি জমি পাট উৎপাদনের নামে আগামি বছর পাটের দাম আশাতীতভাবে পড়ে যাবে।
  • দেশের বাইরে যারা বাংলাদেশের পাট কেনেন তারা সেই পাট দিয়ে কি করেন সেটা দেখা দরকার। সেটা যদি পাটজাত পন্য তৈরির শিল্প হয় বাংলাদেশে সেই ধরনের শিল্পের বিকাশে সরকারের মনযোগি হওয়া দরকার। এজন্য দুটি বিকপ্ল রাস্তা আছে। এক- বাংলাদেশে পাটশিল্পের উদ্যোক্তাদেরকে সরকারি ভাবে প্রনোদনা দিয়ে সেসব দেশে প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো। দুই- বিদেশি উদ্যোক্তাদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য প্রনোদনা দেয়া। পাট শিল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গুলো নেয়া দরকার বলে মনে করছি। দেশে পাটনির্ভর শিল্প বিস্তৃত হলে এই শিল্পে নতুন উদ্ভাবন আর বিনিয়োগ কারিদের এই শিল্পে দক্ষতা বৃদ্ধি নিজে থেকেই হবে। কিন্তু শুরুতে বিশেষ করে ঝুকি ব্যবস্থাপনায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পাটজাত শিল্পের ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। কাচা পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনো এক নম্বরে (উৎপাদনে দ্বিতীয়)। এটাকে কাজে লাগিয়ে যদি বাংলাদেশ পাটজাত শিল্পেও উন্নতি ঘটাতে পারে সেটা বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে অনেক বড় মাপের ভূমিকা রাখতে পারবে। কিন্তু ঝুকি ব্যবস্থাপনায় সরকারি সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
  • পাটের চেয়ে পাটজাত পন্য রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়ান বেশি দরকার এটা মাথায় রেখে পাট জাত পন্যের বিপননের ক্ষেত্রে আরো পেশাদারিত্ব আার আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে বংলাদেশের। এ ব্যপারে সরকার আর ব্যবসায়িদের একসাথে কাজ করা দরকার। বিশেষ করে পাটজাত পন্য যে বিকল্প পন্যের চেয়ে অনেক পরিবেশ বান্ধব এই ধারনাটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাইম লাইটে নিয়ে আসতে হবে। কিছুটা অগ্রগতি হয়ত হচ্ছে। তবে আরো আগান দরকার। প্রচারনামূলক বিপননের ফলে পাটের চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগান চাই।

অন্তর্জাল ঘেটে জানলাম বাংলাদেশ কাচা (raw) পাট উৎপাদনে ভারতের পেছনে। এই অঞ্চলে পাটের ইতিহাস দেখে অন্তত আমাদের একটু গায়ে লাগা উচিত এই খবর। যদি পরিবেশবান্ধব পন্য হিসাবে পাটজাত পন্যের চাহিদা বাড়ে তবে তার বৃহত্তম অংশের যোগান বাংলাদেশেরই দেয়া উচিত। কিন্তু পাট নির্ভর শিল্প আমাদের দেশে মনে হয় পাটের ব্যগ আর দড়ি এরকমের সাধারন সামগ্রী উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে কৃষি প্রযুক্তি, শিল্পোন্নয়ন, আর পিপিপির ক্ষেত্রগুলোতে সাবধানে এগিয়ে যাওয়া দরকার। আর শিল্পোণ্নয়নের জন্য সবার আগে দরকার নতুন প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের যে ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয় তার ব্যবস্থাপনা। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে কঙ্কালসার হলেও পোস্ট দিলাম, বেশ একটু বিরতির পর। আশা করি সোনালি আঁশের সোনালি দিন ফিরে আসবে সদর্পে। কৃষক আর শ্রমিকের মুখে হাসি নিয়ে। সবাইক নতুন বছরের শুভেচ্ছা।


মন্তব্য

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

একটা ব্যপারে অবস্থান পাল্টাচ্ছি; আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় বাজারে চাহিদা সম্পর্কে অন্তর্জালে যা দেখছি সেখান থেকে মনে হচ্ছে কৃষকেরা উৎপাদন বারালে হয়ত অসুবিধা হবে না। তবে উৎপাদন কতটা বাড়বে সেটার উপর বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। কৃষি প্রযুক্তি আর উৎপাদন ব্যবস্থাপনার দিকে সেক্ষেত্রে আরো বেশি সজাগ দৃষ্টি দেয়া দরকার পড়বে।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

পাট নিয়ে গবেষণা করে এমন সেল কি আছে? পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে তা জানি, তারা কি ড্যাটা নিয়ে কিছু করে নাকি শুধু পাটের ফলন বা এধরনের জিনিস নিয়ে কাজ করে?

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

হ্যা বিজেআরআই এর একটা ওয়েবসাইট ও দেখা যায় আছে। তাদের কাজের স্কোপ সাইট দেখে মনে হচ্ছে পাটের কৃষি আর শিল্প দুইটি বিষয় নিয়েই এরা দায়িত্ব প্রাপ্ত। এখন এদের কাজের ক্ষেত্রে এবং মান কেমন হবে সেটা দেখা যাক। বিগত কয়েক বছরে হয়ত তেমন কাজের চাপ ছিল না। এখন কি হয় সেটাই দেখার বিষয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দরকারী পোস্ট। ধন্যবাদ রিয়াজ।

যারা আমাদের কাছ থেকে পাট কেনে তারা সেটা দিয়ে কী করে সেটা জানা জরুরী। তাহলেই পাট দিয়ে আমরা কী করতে পারি তা আরো স্পষ্ট হবে। পাটশিল্পটাকে নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের চিন্তাভাবনাতে একটু দেশপ্রেম যুক্ত হলেই পাটশিল্প আমাদের প্রধান শিল্প হতে পারবে। দেশে বহু অদরকারী খাতে থোক টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সেসব না করে পাট ক্রয়ে কয়েক বৎসর ভর্তুকী দেয়া যেতে পারে। এতে এর উৎপাদন চাঙা হবে।

পাটের আঁশ ছাড়ানো, জাগ দেয়া, সোনালী রঙ ফেরানো, জাগ দেয়ার সময় কমানোতে ইদানিংকালে কিছু স্থানীয় প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোকে জনপ্রিয় করা এবং এই ব্যাপারে আরো গবেষণাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা দরকার।

আমার ভুল না হয়ে থাকলে পাটের আঁশের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এতে লিগনিনের অত্যধিক উপস্থিতি। যার দরুণ এটি অপেক্ষাকৃত অনমনীয় ও ভঙ্গুর হয়। এই এতগুলো বৎসরে পাটের আঁশ থেকে লিগনিন কমানোর কোন কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কার করা গেল না, আফসোস্‌। মিক্সড ফাইবার হিসাবেও পাটের ব্যবহার খোদ দেশেও জনপ্রিয় করা গেল না, আবারো আফসোস্‌।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

তথ্যপূর্ণ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ পাণ্ডব্দা। আমার মনে হয় এতদিন পাটের ঝিমিয়ে পড়া বৈশ্বিক চাহিদার নিরিখে এই বিষয়ে আমাদের দেশের উৎপাদনকারিদের জ্ঞান একটা নির্দিষ্ট যায়গায় এসে থেমে ছিল। এখন দরকার সবার চেষ্টাকে আর আগ্রহকে একত্রিত করা। একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদের ভাষায় (নামটা মনে পড়ছে না) এখানে বলা দরকার carrot এর stick এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা/সমন্বয়টই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। যেটুকে বুঝেছি, ভারতে পাট থেকে এখন ভালমানের শাল তৈরির প্রযুক্তিও উদ্ভাবিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে একজন উদ্যোক্তা এরকমের একটা পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতের নেবার ঝুঁকি নেবার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার সেটা কি রয়েছে? আমার উত্তর হচ্ছেঃ না। সরকার যদি পাটশিল্প নিয়ে কিছু করতে চায় তবে সেক্ষেত্রেই বেশি মনযোগ দেয়া দরকার। কাচাপাটের মজুতদারি ঠেকান বা কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ এসব কৌশলে বাজারে ভিতি সঞ্চার করা যায়, কিন্তু একটা খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ান যায় না। দক্ষতা বাড়ান যায় না। কিন্তু আমাদের সবার আগে দরকার উৎপাদনশীলতা আর দক্ষতা।

আমার মতে বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের (পাট বা অন্য যেকোন) জন্য যেটা এখন সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা হচ্ছে উপযূক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা। নিওক্লাসিকাল অর্থনীতি আমাদের শেখায় বাজারে হস্তক্ষেপ কম করার কথা। মার্কেট ফেইলিওর না থাকলে তাতে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মার্কেট ফেইলিওর থাকে। সেক্ষেত্রে কেইনসিয়ান অর্থনীতি আমাদের শেখায় কর বা ভুর্তকি দেয়ার মাধ্যমে এক্সটারনালিটির ব্যবস্থাপনা করার কথা। কিন্তু অর্থনীতিতে এখন আরেকটি ধারা আছে সেটা হল প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি (Institutional Economics). এই ক্ষেত্রের দিকে এখন উন্নয়ন গবেষকদের মনযোগ অনেক বেশি। আর আমার পর্যবেক্ষনে বাংলাদেশের উন্নয়নের নিরিখে এখন এই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা। এই বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন উইলিয়ামসন এবং অস্ট্রম। এরা দুজনই এই ঘরানার। এরা ছাড়াও এই ঘরানায় আরো অনেক অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। রোনালড কোস বা কেনেথ এরো এদের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। মজার ব্যপার হচ্ছে সমাজ বিজ্ঞানের প্রায় সকল বিভাগেই এখন এই প্রাতিষ্ঠানিকতার একটা করে স্রোত রয়েছে। এই ধারনা নব্য-প্রাতিষ্ঠানিকতা (new-institutionalism) নামে পরিচিত। এটা সমাজ বিজ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে অন্টোলজিকাল পার্থক্য সত্ত্বেও পারস্পরিক যোগাযোগ সহজ করে দিয়েছে অনেক।

আপনি পাটের ক্ষেত্রে বেশ কিছু মৌলিক সমস্যার কথা বললেন। আমার বিশ্বাস সরকার আর ব্যবসায়ি এবং পাটচাষিরা মিলে যদি উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে পারেন তবেই এই সব সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি অর্থবহ সমাধান সম্ভব। তাছাড়া আরেকটা ভাবনার বিষয় হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। আমি যেমন বুঝতে পারছি। পাট উৎপাদনে যদি কৃষকদের আগ্রহ বাড়ে (যা পাটশিল্পের জন্য দরকার), তবে তার মানে হচ্ছে চালের উৎপাদন কমে যাওয়া। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও যুক্ত হয়ে যায়। যেহেতু বাংলাদেশে কৃষি উপযোগী জমি আর তেমন অব্যবহৃত নেই কেবল দুটি রাস্তায় এই সমস্যার সমাধান ভাবা যায়। এক- উৎপাদনশিলতা বাড়ান দুই- উৎপাদনের ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। প্রথম ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি (ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে) হলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এখনো আমাদের অনেক দূর যাবার আছে।

এসএফকে৫৫৫ [অতিথি] এর ছবি

পাটের বিকল্প কৃত্রিম পণ্য ব্যবহার রোধে পরিবেশবাদীদের এগিয়ে আসতে হবে।
তবেই পাটশিল্পের সম্প্র্রসারণের সম্ভাবনা আশা করা যেতে পারে।

এসএফকে৫৫৫

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য; মনে হচ্ছে দেশের ভবিষ্যত এখন পাটের ভবিষ্যতের অনেকটাই নির্ভর করছে। নীতি আর ব্যবস্থাপনার ভুল এড়িয়ে চলতে পারলেই হয়।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাটের চাহিদা বাড়বে। আশার কথা হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা এই বিষয়ে সচেতন আছেন বলেই জানি। আমি বেশ কিছু বিনিয়োগকারীদেরকে চিনি যারা পাট শিল্প নিয়ে ভাবা শুরু করেছে।
গার্মেন্টস শিল্পের স্বর্ণযুগ চলে যাচ্ছে, পাট সেখানে আমাদেরকে আশা দিচ্ছে।

সমস্যা হচ্ছে ২০ কোটী প্রায় মানুষের ভাত জোগান দিতেই নাভিশ্বাস, পাট ফলাবে কোথায় ?

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

আপনার মন্তব্য পাবার আশা করছিলাম আরিফ ভাই। বিনিয়োগ সম্পর্কে যেটা বললেন সেটা জেনে ভাল লাগল। তবে কৃষি উৎপাদনের ব্যপারটা আসলেই ভাবনার বিষয়। পাট যদি আবার স্বর্ণযুগে ফিরে যায় আমার ধারনা বাংলাদেশের কৃষিখাতের জন্য সেটা ভাল খবর বয়ে আনবে। কিন্তু ধান আর পাটের মধ্যে একটা প্রতিযোগীতা হবে। আর দরুন আবাদ যোগ্য জমির ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে বলে আশা করছি। আমি যতটুকু বুঝি দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জমির বাৎসরিক উৎপাদনশীলতা অনেকটাই বাড়ান সম্ভব। তবে মধ্য মেয়াদে চালের দাম বাড়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। পাটের সাথে সাথে যদি পাটজাত পন্যের শিল্পের উন্নতি না ঘটে তা অর্থনীতির জন্য ভাল নাও হতে পারে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সমস্যা হল, জমি ব্যবহারে আমাদের স্বাধীনতা কম। জমির ব্যবহার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধান উৎপাদের জন্য করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, কৃষিতে জমির ব্যবহার "হরাইজন্টাল" যেখানে শিল্পে সেটা "ভার্টিকেল"। সেজন্য শিল্পে মনোযোগ দিতে গিয়ে পাটের উপর থেকে আমাদের দৃষ্টি সরে যায়। সে ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।

এখন আবার আমরা পাটে মনোযোগ ফেরাতে চাই। শুধু কৃষিজ উৎপাদনে পাটকে সীমাবদ্ধ রাখলে আমরা ভালো করতে পারব না। পাটজাত পণ্য উৎপাদন শিল্পকেও পুরোপুরি বিকশিত করতে হবে। পাটজাত পণ্য বলতে কেবল চটের বস্তা আর দড়ি বুঝালে চলবে না (বাংলাদেশে পাটকল গুলোতে তাই হয়)। আরো নতুন নতুন শিল্প গড়ে তুলতে হবে।

পাট থেকে কি কাপড়ের সুতা তৈরি করা সম্ভব?

ধন্যবাদ।

রিয়াজ এর ছবি

আসলে জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জমির মালিকের স্বাধীনতা কম বেশি থাকে। জমি ব্যবহার কি হবে সেটা সাধারনত বাজারে চাহিদার উপরেই নির্ভর করবে। পাটের উৎপাদনে ঘাটতির মূল কারন ছিল সম্ভবত বিশ্ববাজারে পাটজাত পন্যের ব্যবহার কমে যাওয়া। সেটার কারন মূলত সিনথেটিক বিকল্পের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং উৎপাদন বাড়া। এখন পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার দরুন আস্তে আস্তে পাটের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে পাট চাষের ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহারের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে ধানের উৎপাদন।
শিল্পের ব্যপারে আপনার সাথে একমত। পাটজাত শিল্পে আমাদের অবস্থা এখনো তেমন উন্নত নয়। এখানে অনেক চেষ্টার দরকার।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।