ভারাটে গুন্ডা হিসাবে পার্কিন্স সাহেবের ক্রিয়াকলাপের সাথে জেমস বন্ডের গল্পের মিল রয়েছে। এতে আছে ষড়যন্ত্র, সম্রাজ্যবাদি কুটবুদ্ধি, আর আছে নারীর সংশ্রব। জেমস বন্ডের প্রতিটি গল্পের মত এখানেও নারী চরিত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তবে এখানে নারী চরিত্রের কাছে পার্কিন্স সাহেব অনেকটা ভেড়া বনে বসে আছেন। আগের পর্বে একটু আভাস দিয়েছিলাম এখানে আরো কিছু বলার চেষ্টা থাকবে।
এই কিস্তিতে আলোচ্য নিচে বুলেট আকারে দিচ্ছিঃ
ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে অভাগু হয়ে ওঠেন পার্কিন্স
পার্কিন্স সাহেব তার গল্প শুরু করেন ছোটবেলা থেকে। মনে হতে পারে ধান ভানতে শিবের গীত কেন? আদতে তার ছেলেবেলা পরবর্তিতে তার অভাগু হিসাবে নির্বাচনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বাবা মায়ের সাথে তেমন বনিবনা হতনা তার। তাদের পরিবার যেই লোক থাকত সেখানে তাদের মত কিছু পরিবার ছাড়া বাকিরা ছিল তাঁর বাবার ভাষায় 'চাষাভুষা'। স্কুলে তার বান্ধবীরা তার বাবার মতে 'স্লাট' কারন তারা সেই চাষাভুষাদের মেয়ে। তাই মেয়েদের সাথে ইচ্ছা হলেও তেমন মেশার সুযোগ ছিল না, কিন্তু এই স্লাট শব্দটির দরুন মেয়েদের ব্যপারে তার মধ্যে যুগপৎ হতাশা আর কৌতুহল দানা বাঁধে। তিনি যে মেয়েদের ব্যাপারে বারাবারি রকমের দুর্বল ছিলেন এটা তিনি অকপটে স্বিকার করেন। এরপর তিনি একটা ভাল স্কলারশিপ পান যাতে লেখাপড়ায় এবং খেলাধুলায় তাঁর স্বপন সফল হবার সুযোগ তৈরি হয়। সবাইকে ওপরে ওঠার স্বপ্ন পুরন হতে যাচ্ছে এই ভেবে সে আহ্লাদিত হলেও দূরের স্কুলে যেতে হবে বলে বাবার আপত্তি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলত জীবনে বড় কিছু হবার বা সবাইকে ছাড়িয়ে যাবার আশাটা তার অবদমিতই থেকে গেল।
এক পর্যায়ে ফরহাদ নামের এক ইরানি ছেলের সাথে পার্কিন্স সাহেবের বন্ধুত্ব হয়। ফরহাদের বাবা ছিলেন একজন জেনারেল, যে ইরানের শাহের দেহরক্ষী হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। এই ফরহাদ নাকি মেয়েদের চুম্বকের মত আকর্ষন করত। ঠিক এখানেই পার্কিন্স হীনমন্যতায় ভুগত। তার শারিরীক গঠন, এথলেটিক নৈপুন্য সব দিক বিবেচনা করে অনেক কাঠখর পুড়িয়ে ফরহাদের সাথে বন্ধুত্ব করে পার্কিন্স। ফরহাদের সংশ্রবে এসে সে পড়াশোনা লাটে তুলতে আর বাবা-মাকে অগ্রাহ্য করতে শেখে। একবার এক কৃষকের বউকে উত্যক্ত করার দায়ে সেই কৃষকের হাতে ধরা পরে ব্যপক মার খায় পার্কিন্স; তখন তাকে কৃষকের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে ফরহাদ। পরের দিন ক্যাম্পাস পুলিশের জেরার মুখে পার্কিন্স সব অস্বিকার করে। ফরহাদকে বাচানোর জন্য মিথ্যা কথা বলতে সে সংকোচ বোধ করে নি।
এক পর্যায়ে পার্কিন্সের এক মেয়েবন্ধু জোটে, নাম এন। এনের বাবা ছিলেন নৌবাহিনীর অফিসার। তার সুবাদে 'আংকেল ফ্রাংক' নামে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের একজন অফিসারের সাথে পরিচয় ঘটে পার্কিন্স সাহেবের। পার্কিন্সের মতে এই এনএসএ আমেরিকার সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা সংস্থা যদিও এটার কথা তেমন প্রচার হয় না। সেই অফিসারের সুবাদে সেনাবাহিনীর চাকরির সম্ভাবনা তৈরি হয় পার্কিন্স সাহেবের। কিন্তু সেই সময়ে চাকরি পাবার মানে হচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়া। এটাকে তিনি ঠিক মন থেকে মানতে পারছিলেননা। এরপর আংকেল ফ্র্যাঙ্কের মাধ্যমে তিনি এনএসএ তে সাক্ষাতকার দেবার সুযোগ পান। সেখানে তার ফাইল ঘেটে তারা উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো জানতে পারেন। তার মতে দেশের প্রতি তার আনুগত্যের চেয়ে - বাবা মার প্রতি তার বিরক্তি, নারিপ্রীতি, সবাইকে ছাড়িয়ে যাবার অদম্য বাসনা, বিদেশিদের সাথে বন্ধুত্ব করার গুন, পুলিশের সামনে অকপট মিথ্যা বলার ক্ষমতা - তার যোগ্যতা হিসাবেই বিবেচিত হল।
রহস্যময়ী ক্লডিনের অধীনে খলনায়ক পার্কিন্সের প্রশিক্ষন
পার্কিন্স সাহেব অভাগু হলেও তিনি কাগজে কলমে মেইন নামের একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। এখানে তার যে কেতাবি খেতাব আর দায়িত্ব সেটা তার গোপন অভাগু দায়িত্বের পরিপুরকই ছিল বলা যায়। মেইনের সাথে কাজের সুবাদে তার পরিচয় ঘটে রহস্যময়ী ক্লডিনের সাথে। আগেই আমরা জেনেছি নারীঘটিত ব্যপারে তার অবস্থা কি! পানের সাথে ওষুধ যেমন করে খাওয়ান হয় এই দক্ষ ক্লডিনের মাধ্যমে পার্কিন্স সাহেবকে কাবু করার ফন্দি করে তাদের সত্যিকারের নিয়োগ দাতা। ক্লডিনের কাছে এনএসএর ফাইলে রক্ষিত কোন তথ্যই গোপন ছিল না। পার্কিন্সকে বশ করার জন্য একজন নট-সো-চরিত্রবান পুরুষকে মোহাবিষ্ট করা দুর্লভ ক্ষমতা, বাক চাতুর্য বা ব্যক্তিত্বের বান সবই প্রয়োগ করেছিল ক্লডিন। এই ক্লডিনের কাছেই আমাদের (খল)নায়ক জানতে পারেন যে তাকে অভাগু হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই দায়িত্ব পালন করা না করার চয়েস অবশ্য তাকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্লডিনের ফাঁদে গলে বেড়িয়ে যেতে পারেনি পার্কিন্স। ক্লডীনের সাথে তার সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল সেটার জন্য একটা তথ্যই যথেষ্ট- ক্লডিনকে কেন্দ্র করে পার্কিন্স সাহব আর তার স্ত্রী বিচ্ছেদের দিকে পা বাড়ায়। ভুল বুঝতে পেরে এখন তিই বই লিখে, বক্তব্য দিয়ে দুনিয়াময় পাড়া করে বেড়াচ্ছেন "নায়ক নেহি...... খলনায়ক হু মে..."।
যাহোক ক্লডিন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তার মূল দায়িত্ব কি হবে। যেমনঃ
১
তাকে আগড়ুম বাগড়ুম যুক্তি দিয়ে দেখাতে হবে যে কপাল-খারাপ দেশটাকে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা ঋন নিতে হবে। এটা নেহাত হাউকাউ করে নয়, কাগজে কলমে অর্থনৈতিক প্রাক্কলন করে দেখিয়ে দিতে হবে দাতাগোষ্ঠীকে আর কপাল-খারাপ দেশের সরকারকে (বলা উচিত সরকারের মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে)। বলা বাহুল্য এই টাকার বিরাট অংশ আমেরিকার পরামর্শক বা প্রকৌশলি বা নির্মান সংস্থার পকেটেই যেত।
২
এই বৈদেশিক ঋন নিয়ে দেশগুলো যাতে দেউলিয়া হয়ে যায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। মানে কি দাড়াল? ঐ- যেই অর্থনৈতিক প্রজেকশন দেখান হবে তাতে ভুল থাকবে। বেশি বেশি করে বলা হবে। বলতে হবে সেই প্রকল্পগুলো নেয়া হলে দেশ উন্নতির জোয়ারে ভেসে যাবে। কিন্তু প্রকল্পগুলোর সত্যিকারের ফল যা হত তা হল দারিদ্র এবং দেনা বেড়ে যাওয়া এবং এজাতীয় নানাবিধ সমস্যা তৈরি হওয়া। দেনার দায়ে পড়ে দেশ গুলো বাধ্য হয়ে আমেরিকার কাছে বাঁধা পড়ে যেত। তাদের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য পুরনের ক্রীড়ানকে পরিনত হত। সেমন ইকুয়েডরের সরকার বাধ্য হয়ে এমাজনের একটা অংশ আমেরিকার তেল কম্পনির হাতে তুলে দেয় যাতে সেখানে বসবাস রত আদিবাসিদের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্যোগ আর পরিবেশ হয়ে পড়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। আগের পর্বে কিছুটা বলেছি এই বিষয়ে।
উদাহরন দিয়ে পার্কিন্স বলছেন "ধরা যাক কোন দেশকে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে হাত না মেলানোর শর্তে ১ বিলিয়ন ডলার ঘুষ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। এখানে পার্কিন্স সাহেবের কাজ হল কিছু হিসাব নিকাশ করে একটা খাতে এই টাকা দেয়াকে যেনতেন ভাবে যুক্তিযুক্ত করে দেখানো।" বলে রাখা ভাল তিনি এমন কিছু সুপ্রশিক্ষিত অর্থনীতি বিদ ছিলেন না। হয়ত সেটাও তার একটা যোগ্যতা ছিল এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। কারন এই সব প্রকল্পের দেশগুলোতে তার প্রাক্কলনকে চ্যালেঞ্জ করার মত তেমন সম্ভাবনা ছিলনা অথবা থাকলেও তাদেরকে হাত করা সহজ ছিল। এই হল দারিদ্রের দূষ্টচক্র। একটা উন্নত দেশে যেখানে মিডিয়া উন্নত, গনতন্ত্রের সুবাদের প্রশ্নতোলার পরিবেশ অনুকূল সেখানে এধরনের অভাগুদের পক্ষে আগান হয়ত সহজ নয়। গনতন্ত্রের বিপক্ষে যত যুক্তিই থাকুক এই একটা বিষয় অবশ্যই গনতন্ত্রের সুবিধাজনক দিক।
পার্কিন্সে হিসাবে মূল লক্ষ্য থাকত স্থানীয় উৎপাদনে (বা জ়িডিপি) তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রভাব বড় করে দেখান। তারা নিজেরাও এই জিডিপির শূভঙ্করের ফাঁকি জানতেন [টীকা ১] এবং নানাসময়ে আলোচনা করতেন। তবে মেইনের বেশির ভাগ কর্মচারি কর্মকর্তা আর আমেরিকার জনসাধারন বিশ্বাস করে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার সাহায্য দেশগুলোর জন্য অনেক সুবিধা বয়ে আনছে। তাই যখনই কোন দেশে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, দুতাবাস ঘেরাও বা পতাকা পোড়ানর মত ঘটনা ঘটে তখন আমেরিকার অনেকেই বলেন আমেরিকা কেন সেই দেশ থেকে তাদের সাহায্যকাজ গুটিয়ে আনছে না। কিন্তু পার্কিন্স জানে যে এই সাহায্য দেবার মূল কারন হচ্ছে সম্রাজ্যবাদ বিস্তার।
ইরানে অভাগু প্রকল্পের বীজ বপন হয়? ফল কি? [মোসাদ্দেগ-->শাহ -->খোমেনি]
ইরানের মাধ্যমেই সম্রাজ্যবাদ বিস্তারে অভাগু প্রকল্পমূখী চিন্তাধারা তৈরি হয়। ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ তেল কম্পানীর (বর্তমান বিপি) তৎপরতা নস্যাত করে দিয়ে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগ সব স্থাপনাকে জাতীয়করন করে। এতে ক্ষেপে গিয়ে ইংল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের মিত্র আমেরিকার শরনাপন্ন হয়। আমেরিকা সিয়াইএর কিম রুসভেল্টকে (থিওডোর রুসভেল্টের নাতি) পাঠায় স্নায়ু যুদ্ধের কারনে সরাসরি রাশিয়াকে জানান না দিয়ে সিয়াইয়ের মাধ্যমে কাজ হাসিলের পথ ধরে আমেরিকা। কিম কিছু রজনৈতিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে হাত করে, রাস্তায় বিক্ষোভ ঘটায় আর জনগনকে নানাভাবে ক্ষেপিয়ে তোলে। মোসাদ্দেগকে নামিয়ে রেজা শাহকে বসান হয় মসনদে। এ থেকে আমেরিকা বুঝতে পারে সরাসরি সামরিক অভিজানের চেয়ে এরকম বাঁকাপথে আগানটাই অনেক নিরাপদ এবং ফলপ্রসু। বিশেষ করে গোয়েন্দারা ধরা পরলেতো বিপদ। রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তির জন্য সেটা হুমকি স্বরূপ। কাজেই ভাবমূর্তি ঠিক রেখে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অভাগুদেরকে পাঠান বেশ অনেকটাই নিরাপদ। ধরা পড়লে এইসব বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে দিলেই হয়। এভাবেই আমেরিকা বুঝতে পারে এই অভাগু পদ্ধতির অনন্য সুবিধার দিকগুলো। সরকার, বহুজাতিক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সুবিধার জের ধরে গড়ে ওঠে এই অভূতপূর্ব কৌশল।
১৯৭৮ সালে ইরানে থাকাকালীন পার্কিন্স সাহেবের দেখা হয় তার ছেলেবেলার বন্ধু ফরহাদের সাথে। আপনাদের হয়ত মনে আছে ফরহাদের বাবা ছিলেন শাহ-এর দেহরক্ষী। এই পরিবারের সাথে খাবার টেবিলে কথা বলতে গিয়ে ফরহাদের বাবার দৃষ্টিভঙ্গী জেনে অবাক হন পার্কিন্স। তখন শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বেধেছে। ফরহাদের বাবা বলছেন "তোমরা মোসাদ্দেগকে সরিয়ে এই বিদ্রোহের বীজ বুনেছ। হয়ত ভেবেছিলে বেশ একটা বুদ্ধিমানের কাজ হল। কিন্তু এই ঘটনার জের এখন আমেরিকা আর ইরান দু'দেশকেই টানতে হবে।" অর্থাৎ শাহের পতন অনিবার্য আর সেটা হবে একটা বড় ধরনের দুর্যোগের সুচনা। দুদিন পরেই ঘটে শাহের পতন আর খোমেনির উত্থান। পলাতক শাহকে ফিরিয়ে দেবার দাবীতে ১৯৭৯ সালে একদল উগ্রপন্থী আমেরিকার দুতাবাস দখল করে ৫৩ জনকে জিম্মি করে রাখে টানা ৪৪৪ দিন। আলোচনা ব্যর্থ হলে কার্টার ব্যার্থ সামরিক অভিজানের মাধ্যমে নিজের পতন নিশ্চিত করেন। আর অন্যদিকে পার্কিন্সের কোম্পানি মেইন ইরানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়ে। আর এখন ইরানযে আমেরিকার জন্য আস্তে আস্তে হুমকিতে পরিনত হয়েছে সেটাও বোধকরি বোঝা কঠিন নয়। কাজেই ইরানে আমেরিকার কটনীতি হয়ত বুমেরাং হয়ে গেছে আমেরিকার জন্য।
ইন্দোনেশিয়ায় তিন মাস
ভিয়েতনামের পর আমেরিকার সম্রাজ্যবাদিতার কামান তাক হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার দিকে। সেখানে পার্কিন্সের কাজ ছিল বিদ্যুত উৎপাদন অবকাঠামো সম্প্রসারনের পেছনে যৌক্তিকতা উপস্থাপন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা কম সেখানে অবকাঠামো বিস্তার করা অর্থনীতির দিক থেকে কাংখিত নয় যদি না স্বল্প বা মধ্যমেয়াদে চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই পার্কিন্স বুঝেছিলেন যে তাকে প্রাক্কলন করে দেখাতে হবে কয়েকবছরের মধ্যেই দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি এমন এক পর্যায়ে পৌছাবে, যে বিদ্যুতের চাহিদা লাগামহীন ভাবে বেড়ে যাবে। কাজেই ইন্দোনেশিয়াকে বিদ্যুতে ব্যপক বিনিয়োগ করতে হবে এই খাতে। আর সে জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋন নিতে হবে। আবার সেই একই চক্কর! সেই একই কায়দায় অভাগুপনা।
ইন্দোনেশিয়ায় যাবার আগে পার্কিন্স সাহেবকে ইন্দোনেশিয়ার ওপর বিস্তর পড়াশোনা করে নিতে হয়েছিল। কারন ইতিহাস আর প্রেক্ষাপট জানা থাকা জরুরি। সেই কলম্বাসের সময় থেকে তার বর্ণনা শুরু হয় বইতে। তবে দরকারি অংশ হচ্ছে শুরু হয় ৬০ এর দশকে। ১৯৬৩ সালে সুকর্ণ ক্ষমতায় আসে। কিন্তু কমিউনিস্ট প্রভাবে দুই বছরের মাথায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দানা বাঁধে । পট পরিবর্তন হয়, ক্ষমতায় আসে সুহার্তো। এসময়ে অনেক ব্যক্তিকে কমিউনিস্ট বিরোধী অভিজানে হত্যা করা হয়। এভাবে ১৯৬৮ সালে ক্ষমতায় আসে সুকর্ণ। তারপরো সেখানে কমিউনিস্টদের প্রভাব শেষ হয়ে যায়নি। ফলে ১৯৭১ সালের দিকে ইন্দোনেশিয়াকে কমুউনিজমের হাত থেকে বাঁচাতে (?) অভাগুদের সাহায্যে শক্তিখাতে ঋন নেবার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই কায়দায় অভাগুরা সফল হয়। তবে একটা পর্যবেক্ষন উঠে এসেছে পার্কিন্সের লেখায়। ইন্দোনেশিয়ার যেখানেই সে যেত তাকে আসলে অবিশ্বাস আর সন্দেহের চোখেই দেখা হত। সে এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে ইন্দোনেশিয়ার সম্রাজ্য বিস্তারের মুখপাত্র সেটা অনেকেই আন্দাজ করতে পারত বলে তার মন হত (চোরের মন পুলিশ পুলিশ?)।
আপাতত যবনিকা? [টিকা ২]
যাহোক এভাবে একে একে পৃথিবীর নানাদেশে সম্রাজ্যবিস্তারের গল্প নিয়ে বইটি লেখা হয়েছে। সুলিখিত না হলেও বইটিতে স্বিকারোক্তির একটা ব্যপার আছে আর সম্রাজ্যবাদ বোঝার জন্য আর অনুন্নত দেশগুলোর জন্য সাবধান হবার অনেক কারন বইটা পড়লে উপলব্ধি করা যায়। এটা ঠিক যে বইটিকে অতিরঞ্জন থাকতে পারে এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর অনেক ক্ষেত্রেই লেখক যেন কিছুটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে বলছেন। সব ঘটনাকে একটা ব্যখ্যার দিকেই নিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হয়েছে। সবকিছুর ভেতরেই তিনি একই গন্ধ খুজে পাচ্ছেন তিনি। তবে একথা বলা যায় তিনি যে তত্ত্ব প্রস্তাব করেছেন তা যদি শতভাগ ঠিক নাও হয়, আদতে হোক আর কাকতাল হোক বাস্তব ইতিহাস তার বক্তব্যের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি দেশের খনিজ সম্পদে বিদেশি কোম্পানিগুলো অনেক বাড়িয়ে দেখানর চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে নীতিগ্রহনে ঋনের সাথে সাথে অনেক শর্তও জুড়ে দেয় দুর্নীতি অব্যবস্থার অজুহাতে। তার মানে এই নয় যে আমাদের দেশের দুর্নীতি অব্যস্থা নেই। কিন্তু এটা দেখা যায় এগুলোকে স্বার্থান্বেষী বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো নিজেদের বা তাদের বন্ধুপ্রতিমদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহার করে থাকে। সেক্ষেত্রে যেকোন বিদেশি ঋন বা সাহায্য নেবার ক্ষেত্রে আমাদেরকে নিজেদের স্বার্থ মাথায় রেখে নেগোশিয়েট করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে অল্প কিছু লোককে কিনে নিলেই যাতে দেশের স্বার্থ লু্ণ্ঠিত না হয় সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতাকে শতভাগে উঠিয়ে আনতে হবে। রাস্তায় রোদে দাঁড়িয়ে মিছিল করা আর পুলিশের লাঠিপেটা আমাদেরকে অনেক বিপদের হাত থেকে বাচিয়েছে কিন্তু তা আমাদের দেশের ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট নয়। বাইরের শক্তি যতই বড় হোক রাষ্টকে আর গনতন্ত্রকে শক্তিশালি করতে পারলে বাইরের শক্তি কিছুই করতে পারবে না। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। দলভিত্তিক সন্দেহবাতিক থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। কেবল মাত্র একটা স্বাধীন দেশ আছে আমাদের হাতে সেটাই যথেষ্ট নয়। একে রাষ্ট্রে পরিনত করতে হবে। শক্তিশালি রাষ্ট্রে। যাতে নানাগোষ্ঠীর যুক্তিবুদ্ধি আর শক্তিকে একত্রিত করা যায়। মত পার্থক্যকে পাথরচাপা না দিয়ে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। কি পরিমান শক্তি রাস্তায় পুলিশের লাঠির তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে? অথবা কেবল মারামারি গালাগালি আর হিংসা তৈরিতে নষ্ট হচ্ছে! কোন মানে হয় না! একেবারেই না।
এখন পার্কিন্স সাহেবের সাক্ষাতকার আবার শুনে দেখতে পারেন তাতে না বলা অংশটুকুর কিছুটা উঠে আসতে পারে।
টীকাঃ
১। বলে রাখা ভাল এখানে শুভংকরের ফাঁকি বলা হলেও আসলে এই নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কাজেই জিডিপিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি বিবেচনা ব্যপারটাকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে উপস্থাপন করার ব্যপারে পাঠক সহমত না হলে সেটা বোধগম্য অবশ্যই। মোটামুট প্রচলিত মত হচ্ছে একটা অনুন্নত দেশের প্রথমে জিডিপির দিকেই বেশি মনযোগ দেয়া দরকার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লে দারিদ্র আস্তে আস্তে কমে আসবে।
২। বইটির আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বলা হয় নি এখানে। পরে সময় হলে লেখার চেষ্টা করব। বিশেষ করে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিস্তারে রজনৈতিক ব্যাখ্যা আর বিদেশি সাহায্যের অর্থনৈতিক পরিনতি বা খুটিনাটি নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা আছে। তখন আনার এই বইয়ের প্রসংগে ফিরে আসব হয়ত।
মন্তব্য
এই বইটা এভাবে সংক্ষিপ্ত করা খুব কঠিন কাজ বলে আমার মনে হয়। আপনে যে করতেসেন, সে জন্য সাধুবাদ।
তবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ব্লগে একটির বেশি থিম নিয়ে আলোচনা করলে সাধারন পাঠক অনেক ক্ষেত্রে খেই হারিয়ে ফেলে। সুতরাং আপনি ছোট ছোট কয়েকটি পোস্টে একটা একটা করে থিম, সঙ্গে আপনার পর্যবেক্ষণ দিতে পারেন।
তোমার কথার সাথে আমি একশ ভাগ সহমত। তবে এই বইটার আসল সামারি প্রথম কিস্তিতে ছিল। এইটাতে আরেকটু দিলাম। কিন্তু মোটের ওপর বইটা পড়তে তেমন ভাল্লাগেনাই। তার পরেও এই চিত্রটা এইখানে রেখে দি্লাম যদি ভবিষ্যতে কাজে লাগে সেটা ভেবে। এই বইটা আপাতত আর পড়বনা।
নতুন মন্তব্য করুন