আমার শৈশব অথবা কৈশোরকালের স্মৃতিতে 'বর্ষবরণ' বলে কিছু নেই। এ ধরনের কোন আনুষ্ঠানিকতার কথাও তখন জানতাম না। সে সময়ের স্মৃতিতে যা আছে সেটা হলো, পহেলা বৈশাখের আগে-পরে কয়েকদিন ধরে 'চৈত-সংক্রান্তি'র মেলা ও 'বৈশাখী' মেলা বসতো। আমার শৈশবে বড় ভাই-বোনদের হাত ধরে মেলায় যেতাম। মেলায় পৌঁছে দেখতাম তাদের আনন্দ-উল্লাস। তারা বন্ধু-বান্ধবদের পেয়ে তাদের সাথে আনন্দে মেতে উঠতো। আমার কথা তারা ভুলেই যেত।
আমাকে তারা মেলায় নিতে চাইতো না। আমার কান্নাকাটি আর মায়ের তাগিদেই তারা আমায় সাথে নিত। মেলায় যখন তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত আমি তখন ছিঁচ-কাদুনের মতো কান্না জুড়ে দিতাম। নানা রকম বায়না করতাম। বেশিরভাগ সময় তারা আমার হাতে দু-পয়সার একটা কাঠি-লজেন্স ধরিয়ে দিত। আমিও সেটা চুষতে গিয়ে (এখনকার সেন্টারফ্রেসের এ্যাডের মতো মুখ বন্ধ) আমার কান্না বন্ধ।
আমি কাঠি লজেন্স চুষতে চুষতে বড় ভাই-বোনদের পিছে পিছে ঘুরতাম। তারা তখন নানা ধরনের খেলনা, পুতুল ইত্যাদি দেখায় ব্যস্ত। কেউ দেখছে মাটির তৈরি পুতুল, খেলনা হাড়িপাতিল আবার কেউবা বাঘ-ভাল্লুক, হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি। বড় বোনেরা মেলা থেকে কাঁচের চুড়ি, রূপোর মল ইত্যাদি কিনতো। আর বড় ভাইয়েরা কিছু কিনুক বা না কিনুক ঘুড়ি অবশ্যই কিনতো।
তারপর একটু বড় বেলায় অর্থাৎ আমার কৈশোরে আর বড় ভাই-বোনদের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়নি। তখন নিজেই একশো। তাছাড়া তখন আমারও দু-চারজন স্কুলের বন্ধু হয়েছে। সবাই মিলেই মেলায় আমরা আনন্দ করতাম। তখন আর কাঠি-লজেন্স না, দু-পয়সা দামের লাল অথবা এক-আনা দামের সাদা আইসক্রিম। তেলেভাজা বা চিনি-মিসরির তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবারতো ছিলই। খাদ্য-খাবার বাদে আর যা ছিল, তা হলো বায়োস্কোপ, চরকা, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি। আর মেলা থেকে প্রতিদিন দু-চারটে ঘুড়ি কেনাতো বটেই।
তখনকার দিনে আর যেটা হতো, আমাদের পারিবারিক পরিচিত দোকানগুলোতে, এই যেমন মুদিখানা, শাড়ীকাপড়ের দোকান, গহনার দোকান, দর্জির দোকান ইত্যাদি, আমরা ভাই-বোনেরা মিলে 'হালখাতা'র নেমন্তন্ন খেতে যেতাম। এক-একটি দোকানে দু-পাঁচ টাকা জমা দিয়ে ভরপেট লুচি-মিষ্টি খেয়ে আসতাম। কোন কোন দোকানদার আবার বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের অর্থাৎ আব্বা-আম্মা বা অন্য কারও জন্যও ঠোঙায় করে লুচি-মিষ্টি দিয়ে দিতো।
তখনকার সময়ে প্রায় প্রত্যেক সচ্ছল পরিবারেরই এই সব পণ্যের বাঁধা দোকান থাকতো এবং তাঁরা সারা বছরই কখনও নগদে কখনও বা বাকিতে ঐ বাঁধা দোকান থেকেই সদাই-পাতি কিনতেন। এই ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা সহজ-সরল সম্পর্ক বিরাজ করতো যেটা আজ এই কর্পোরেট যুগে কল্পনারও অতীত। তবে পুরোন ঢাকার কোথাও কোথাও এখনও 'হালখাতা'র চল আছে তবে সম্পর্কের বিষয়টা জানা নেই।
তখনকার দিনে বাংলা বছরের প্রথম দিনটি আনন্দময় ও সরগরম থাকতো 'হালখাতা' অনুষ্ঠানের জন্য। 'হালখাতা' হচ্ছে, বিগত বছরের দেনা-পাওনা চুকিয়ে নতুন বছরে নতুন করে কেনাকাটার শুরু। পুরনো বাকির খাতা হালনাগাদ করে নতুন ভাবে শুরু করা।
'হালখাতা'র দিনে বাজারের সব দোকানপাট ধুয়ে মুছে সাফ-সুতরো করে লাল-নীল, হলুদ-সবুজ ইত্যাদি নানা রঙের কাগজ ব্যবহার করে সুন্দর করে সাজানো হতো। সারাটা দিন শহর-বাজার সরগরম থাকতো দোকানপাটে লোকজনের আনাগোনায়। শুধুমাত্র 'হালখাতা'র কারনেই এ দিনটি উৎসবমুখর হয়ে উঠতো। অন্য কোন ধরনের উৎসবের কথা স্মরণ করতে পারিনা। অবশ্য আমার এ অভিজ্ঞতা ছোট ছোট মফস্বল শহরের।
আর নিজেদের বাড়িতে আম্মা সেদিন খেজুরের গুড় আর নারকেলের দুধ দিয়ে ক্ষীর রাঁধতেন। কয়েক প্রকার পিঠাও তৈরি করতেন। আমাদের খাবারের মেনুতেও একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন থাকতো। তবে কোনদিন ঘটা করে পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়েছে বলে মনে করতে পারিনা।
এত বছরের পরিক্রমায় আমার এই প্রৌঢ়বেলায় ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের উদযাপন অনেক রঙিন। ব্যয়বহুলও বটে। বৈশাখের প্রথম ভোরে রমনার বটমূলে 'বর্ষবরণ' উৎসবের মধ্য দিয়ে শুরু। তারপর ঘটা করে মাটির শানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার পর্ব। অবশ্য কিছুকাল হলো অনুষ্ঠানস্থলে এ ব্যাবস্থাটি বন্ধ করা হয়েছে। এরপর বহু মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহনে বিশাল রঙিন মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই 'বর্ষবরণ' অনুষ্ঠানমালা বাঙালি সংস্কৃতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে আপামর বাঙালির প্রাণের অনুষ্ঠানে পরিনত হয়েছে এই 'বর্ষবরণ' উৎসব। এটিই সম্ভবত বাংলাদেশে একমাত্র সার্বজনীন সেক্যুলার উৎসব।
দিন পনের আগে থেকেই বৈশাখের আগমনী ঢেড়া পড়ে যায়। বিশেষ করে পোশাকের দোকানগুলোতে নারী-পুরুষের ভীড় চোখে পড়ার মতো। যে যার সামর্থ অনুযায়ী কেউবা হকার্স মার্কেটে, কেউ নিউ মার্কেটে বা গাওছিয়ায়, কেউবা বসুন্ধরা সিটি মার্কেটে, সমাজের আরেক শ্রেণী অভিজাত পাড়ার দোকানগুলিতে কেনাকাটায় ব্যস্ত। শেষ বেলায় অনেকেই নিজেদের কেনাকাটা সেরে বিভিন্ন দোকান ঘুরে আপনজনের জন্য উপহার সমগ্রী কিনছেন। সেগুলোকে আবার সুন্দরভাবে উপস্থাপন যোগ্য করার জন্য মোড়কজাত করা হচ্ছে। ১ বৈশাখের আগের সন্ধ্যায় ফুলের দোকানগুলোতেও প্রচুর ভীড়। সামর্থ অনুযায়ী বাহারী ফুলের বিকিকিনি চলছে। মহিলারা অন্য কোন ফুল কিনুন বা না কিনুন, খোঁপায় গোঁজার জন্য বেলী ফুলের গোড় অবশ্যই কিনছেন।
বিউটি পার্লার ও পুরুষদের সেলুনগুলোর কথা আলাদা ভাবে না বললেই নয়। বিউটি পার্লার গুলোতে অনেকেই আগেভাগেই বুকিং দিয়ে রেখেছেন। পহেলা বৈশাখের এক-দুদিন আগে সম্ভবত কোন পার্লারেই আর সুযোগ নেই। তাঁরা, এই দিনটিকে সামনে রেখে ফেসিয়াল, পেডিকিউর, মেনিকিউর, ভ্রু প্লাক ইত্যাদি নিশ্চয় করাবেন। পুরুষেরাও আর আজকাল সৌন্দর্য চর্চায় পিছিয়ে নেই। তাঁদের জন্যও অনেক সেলুনেই ফেসিয়াল করা বা চুল লাল-কালো-সাদা করার ব্যবস্থা আছে এবং অনেকে তা করছেনও।
ইদানিং কালে বছরের প্রথম দিনটিতে প্রত্যেক পরিবারেই, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, উন্নত খাবারের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। আর থাকতে হবে সকালে বিভিন্ন ভর্তার সাথে পান্তা-ইলিশের ব্যবস্থা। তো, আমার বাড়িতেও সেই ব্যবস্থা। এবারে বউ-ছেলের আর শাড়ী-পাঞ্জাবীর বিশেষ বায়না ছিলনা। বায়না তাদের তেমনটি অবশ্য কোন কালেই ছিলনা। তবে খাবার মেনুটা অবশ্যই ভাল হওয়া চাই। কিন্তু ইলিশ মাছের দাম শুনেতো টাসকি খেয়েছি। বাড়িতে বললাম, ইলিশ কি পহেলা বৈশাখে আবশ্যিক খাদ্য ? তাদের এক কথা এক দাবী, ইলিশ না থাকলে পান্তা খাব কি দিয়ে, ইলিশতো থাকতেই হবে।
আমার অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর কোন কিছু খাবার সাধ আছে কি না ? উত্তরে বললেন, না বাবা, তোমরা যা খাও তাই খাব।
এই সুযোগে সবাইকে জানাই, বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
মন্তব্য
ঝরঝরে লেখার গুণে চলে গিয়েছিলাম আপনার শৈশবে----
facebook
ধন্যবাদ, আমার শৈশব শেয়ার করবার জন্য।
শুভ নববর্ষ।
ধন্যবাদ।
বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ।
বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আমি আমার বড় দাদার কাছে শুনেছি কিভাবে উনারা তামিল নববর্ষ উদযাপনের করেছেন, বাবা-মার কাছে শুনেছি ষাট-সত্তর দশকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কথা। বেশ রোমাঞ্চকর সে সব দিন, ঘটনা।
বাবা বলেন, পরবটি একই আছে কিন্তু পালনে ব্যাতীক্রম।
সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন তো আসবেই।
সবাইকে বাংলা ও তামিল নববর্ষের শুভেচ্ছা রইল।
সবার নতুন বছর সুন্দর কাটুক।
শুভ নববর্ষ।
পোথান্ডু ভাসতুকাল।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ, তথ্যমূলক মন্তব্যের জন্য। ব্যতিক্রমগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করুন না।
আপনাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ।।
আপনাকে শুভেচ্ছা।
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ধন্যবাদ।
শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪১৯
ভালো থাকুন।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
ধন্যবাদ। ভাল থাকুন আপনিও।
ভালো লাগলো।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা আপনাকে।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ, ভালোলাগা জানাবার জন্য।
অনেক ভাল লাগল লেখাটা, প্রৌঢ়দা! নববর্ষের শুভেচ্ছা!
ধন্যবাদ কাজি সাহেব, ভাল থাকবেন।
খুব ভালো লাগলো।
শুভ নববর্ষ!!!
ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন।
ভালো লাগলো।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ দিদিভাই, ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ দিদিভাই, ভালোলাগা জানাবার জন্য।
নববর্ষের শুভেচ্ছা। তো ভাইজান আমাদের সেই পাঁঠা... আহেম! খাসী খাওয়ার কী হলো?
ধন্যবাদ, ভাল থাকুন। ডাক্তারের বারন আছে যে !
ওসব বদলুকের কথায় কান দিতে নেই। আমাদের রাঁধুনিই বা কই?
খুঁজছি।
নববর্ষের শুভেচ্ছা আপনাকে।
লেখা পড়ে সদ্য শেষ করে আসা আমার কৈশোর বেলাকে খুব করে দেখলাম।
কেমন করে কাঠিয়েছি আজও মনের ভেতর আরশির মত।
পাপলু বাঙ্গালী
ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা দাদা। অনেক অনেক অনেক ভালো থাকুন।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন।
শুভ নববর্ষ।
চমৎকার লেখা!
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
জী, ধন্যবাদ। ভাল আছেন নিশ্চয়। আবারও বাংলায় লেখা শুরু করুন।
শুভ নববর্ষ
ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
নতুন মন্তব্য করুন