ডিসেম্বর - অকপট কথন

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি
লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১২/১২/২০১২ - ৯:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডিসেম্বর হচ্ছে বিজয়ের মাস, আবেগের মাস, বেদনার মাস, অহঙ্কারের মাস, ইতিহাস সৃষ্টির মাস।

আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে। যদিও বলা হতো বাংলার কথা তবে এতে পূর্ব বাংলার কথাই বোঝানো হতো অর্থাৎ তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুও সভা-সমাবেশে 'বাংলা' শব্দটিই উচ্চারণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি যেমন বলেছেন, "২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমুর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতাহাস। ঐ ভাষণেই আবার বলেছেন, "আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা।" "আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে-আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।" সম্ভবত এটি একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ! পশ্চিম বাংলার মানুষের সমর্থন লাভের একটা কৌশলমাত্র। এই ভাষণে তিনি আবার বলেছেন, "শুধু পূর্ব বাংলার আদান-প্রদানের ব্যাংকগুলো দু-ঘন্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবেনা।"

যাহোক, মূল কথায় ফিরে আসি, বলছিলাম, আমরা যে মুক্তি চেয়েছিলাম তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক মুক্তি ছিলোনা বা একটি স্বাধীন ভূখন্ড ও পতাকার জন্যমাত্র ছিলোনা। সে মুক্তির উদ্দেশ্য ছিলো বাংলার (অবশ্যই পূর্ব বাংলা বা তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান) আপামর জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি, সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণহীন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এবং এটাকেই আমরা 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' হিসাবে হৃদয়ে ধারণ করেছি।

তারও পূর্বে ১৯৬৫ সালে ফিল্ড মার্শাল আগা মোহাম্মদ আইয়ুব খাঁন প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিপক্ষে ফাতিমা জিন্নাহ্ নির্বাচন করেছিলেন। মৌলিক গণতন্ত্রে কেবলমাত্র ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরাই প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ভোট দিতে পারতেন, আপামর জনগণ নয়। ফাতিমা জিন্নাহ ছিলেন, পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন। তদানিন্তন পাকিস্তানের সব আইয়ুব বিরোধী দলগুলো ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিলো। পূর্ব বাংলার বিরোধী দলগুলোও ফাতিমা জিন্নাহকেই সমর্থন দিয়েছিলো। আমরা তখন ফাতিমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী মিছিল করেছি। ফাতিমা জিন্নাহর পক্ষে ভোট চেয়েছি।

৬৬তে শেখ মুজিবর রহমান কতৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পেশকৃত ৬ দফা আন্দোলনে মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহন করেছি। ৬৯রে 'সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'আহুত ১১ দফা আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছি। তারপর সেই ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনী সভা-সমাবেশ-মিছিল এবং ৭১রে মুক্তিযুদ্ধ।

আমি ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। এখন এই ছাত্রলীগের কর্মকান্ড দেখে আমি লজ্জিত, যারপর নাই দুঃখিত। শুধু ছাত্রলীগ নয়, ছাত্র রাজনীতির অবস্থা দেখে আমি মর্মাহত। তৎকালে ছাত্র রাজনীতি ছিল আপন মহিমায় ভাস্বর।

স্বাধীনতা উত্তরকালে আওয়ামী লীগ-জাসদের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। অবশ্য কোন কালেই আমি নেতা ছিলাম না। ছিলাম সামান্য কর্মীমাত্র।

৯০ এর স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি, রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে নয়, একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে। নূর হোসেন, ডাঃ মিলন, দেলোয়ার এবং আরও অনেকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচার হঠিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আকাঙ্খায় মহাজোটের প্রার্থী সেই স্বৈরাচারী হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকেই ভোট দেই। হায় রাজনীতি ! ধরনী দ্বিধা হও। হে নূর হোসেন, তোমরা আমায় ক্ষমা করো। আমি এ দেশের একজন সামান্য নাগরিকমাত্র।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আমাদের প্রজন্ম পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ড ও পতাকা নিশ্চিত করেছে বটে কিন্তু কাঙ্খিত মুক্তি আনতে পারেনি।

যে প্রজন্ম একাত্তরে জাতির মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলো সেই তারাই স্বাধীনতা উত্তর কালে অধঃপতিত হতে হতে বর্তমান সময়ে একেবারেই নিম্নতম ধাপে এসে পৌঁচেছে। (দু-চারটি ব্যাতিক্রম ধর্তব্য নয়)। সেই প্রজন্ম এখন সত্যিকার অর্থেই নষ্ট প্রজন্ম এবং আমিও এর দায়ভাগী।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস, এই বাঙালি জাতির ত্যাগ, নৈতিকতা, সততা, আতিথ্য, পরোপকার ইত্যাকার মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষ, ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর হয়ে থাকবে।

আমরা অবশ্য আপনাদের অর্থাৎ এই প্রজন্মের চাপে পড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য্য শুরু করেছি। কিন্তু তারপরও বলি মূল কাজটি কিন্তু আপনাদেরকেই করতে হবে।যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে।

এই প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আমার প্রাণের মাঝে এক ধরনের আশা সঞ্চারিত হয়। আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে ইতিবাচক মত প্রকাশ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্নেও আপনারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ বনাম ওয়েষ্ট ইন্ডিজ এক দিবসীয় সিরিজের বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জয়টিকে তাঁরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উৎসর্গ করেছেন। এটা এদেশের অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বিরাট প্রাপ্তি।

পরিশেষে বলি, আমরা গণমানুষের সর্বাত্মক মুক্তি যাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা হয়েছে, বাংলার মানুষকে দিতে পারিনি। আপনারা নয়তো আপনাদের পরের প্রজন্ম প্রয়োজনে আরেকটি যুদ্ধ করে গণমানুষের সেই কাঙ্খিত মুক্তি প্রতিষ্ঠিত করবেন।

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের প্রয়াত বুদ্ধিজীবিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

আপনাদের মঙ্গল হোক।


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

চলুক

৪৭, ৭১ এর মধ্যবর্তী ও পরবর্তী একটা বিশাল সময়ের সাক্ষী আপনি। ঐ সময়ের কথাগুলি লিপিবদ্ধ করুন, আমরা শুনতে চাই

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের প্রয়াত বুদ্ধিজীবিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা।

ফারাসাত

তারেক অণু এর ছবি

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।