ভাবের বৈরাগ্য

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি
লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৩/০৭/২০১৩ - ৩:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইদানিং মনে হচ্ছে যেন চারিদিকে আত্মহননের মচ্ছব লেগেছে। বেশ কদিন ধরেই পত্র-পত্রিকায় দেখছি, এখানে সেখানে আত্মহত্যার খবর। একি সুখে থাকতে ভুতের কিল, নাকি ভুতের কিল অসহনীয় হওয়ায় এই পন্থা অবলম্বন !

আমার মনের মাঝেও এক ধরনের বৈরাগ্যভাব জাগ্রত হয়েছে। তবে হ্যাঁ, এ বৈরাগ্যভাব কিন্তু লোটা-কম্বল সম্বল করে কপনি এঁটে সংসার ত্যাগ করার বিষয় না। সে আমার কম্ম নয়। এই সংসারটাকে আমি যে বড্ড ভালবাসিগো। বয়স হয়েছে। মাঝে-মধ্যে শরীরটা তা জানানও দিচ্ছে। 'মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে...' । আমার চাওয়া না চাওয়ায় কী এসে যায়। এর মাঝেইতো ধ্বনিত হয় জীবনের এক অলঙ্ঘনীয় বিধি। মনে করিয়ে দেয়, ক্ষয়, লয়, মৃত্যু অনিবার্য।

বিষ্ণুপুরাণের ধরনীগীতায় পরাশর মুনি উক্তি করেছেন, 'যে পুরুষপ্রধানগণ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে অনেক বর্ষ যাবৎ তপ আচরণ করেছিলেন, অতি বীর্যশালী যে বলবান ব্যক্তিগণ যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন, কাল তাঁদের সকলকেই কথাবশেষ
করেছেন।' (দুঃখিত, অনুবাদকের নাম জানা নেই)।

একটা ধন্দ কখনো সখনো আমাকে পেয়ে বসে। মনে হয়, দীর্ঘদিনতো পারিবারিক প্রয়োজনে পরিবারের অন্যদের ইচ্ছা মতই বেঁচেছি, এবার বাকি জীবনটুকু না হয় নিজের মত করেই বাঁচি।

কথার খেই হারিয়ে ফেললাম নাকি ? না বলছিলাম, এই ইট-কাঠের ঢাকা শহর থেকে নিয়মের নিগড় ভেঙ্গে কটা দিন একটু অন্য ভাবে কাটাতে বড্ড ইচ্ছে করছে। হ্যাঁ ভাবছি, কিন্তু যাবটা কোথায় ! অনেক অনেকদূর যাবার মত ট্যাঁকের জোরতো আমার নেই। মনটা উড়াল দিয়েছে। তা, মনের মাঝে কাঁপন যতই লাগুক পাখিরা যেমন পাতাবিহীন গাছপালা আর বরফের দেশ ছেড়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় চিরবসন্তের দেশে। তেমনটিতো আর আমি উড়ে যেতে পারবোনাগো। দূর-দূরান্তরের ভ্রমণ আমার কপালে নেই। ফুঁকো ট্যাঁকে তো আর তারেক অনুর মত ভ্রমণ হয়না !

আমারতো গতি সেই বাস, ট্রেন নয়তো লঞ্চ। সেখানেও টিকিটবাবুরা হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর সবার মুখে একই বুলি, 'ফ্যাল কড়ি মাখ তেল, তুমি যে আমার বড্ড আপন গো !'

মনের মাঝে ডাক শুনছি। বাহিরের ডাক। ঐযে! যেতে যে আমায় হবেই গো ! বেশ, তা সে দূরে নাহোক কাছেপিঠেই কোথাও। আমার ভ্রমণের ধরন আবার পরিবারের বা পরিচিতজনদের পছন্দ নয়। তাই একাই সই। এ সেই ঝোলাকাঁধে বেরিয়ে পড়া। তা ঝোলার ব্যবহার তো আর এখন নেই বললেই চলে, তাই একটা সাইডব্যাগ আরকি। এই বয়সে ব্যাকপ্যাক আবার ঠিক মানানসই না।

আমার বাড়ির পাশেই হাইওয়ে। ট্রেন স্টেশনও আছে হাঁটা দূরত্বেই। ব্যাগ ঘাড়ে উঠে পড়লেই হয়, যাতে খুশি। এই কাছেপিঠেই কোথাও, আরিচা ঘাটের পথে ষোলঘরই সই। সেখানে পাবো পোড়ামাটির শিল্পী কারিগরদের। তাদের উঠোনে দেখা যাবে একধারে রয়েছে তাল তাল কাদা মাখানো। অপর পাশে পুজোর জন্য ফরমায়েসি মুর্তির কাঠামো তৈরি হচ্ছে খড় দিয়ে। পরে ঐসব তাল তাল কাদা খড়ের উপর চাপিয়ে সুন্দর সব দুর্গা-স্বরস্বতির মুর্তি তৈরি হবে। আরও আছে বিভিন্ন মেলার জন্য কাদামাটি দিয়ে তৈরি নানা ধরনের মাটির পুতুল। পায়রা-টিয়া, বাঘ-সিংহ, হাতি-ঘোড়া, বাঁদর-হনুমান। আরও আছে গেরস্থালির প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী।

নয়তো চলে যাও আরিচা ঘাটের কাছে যমুনাতীরের কোন গাঁয়ে। অথবা কাছেপিঠেই গারোপাহাড়ের দেশে গারোদের গাঁয়ে।
গ্রামের বাজারে চায়ের দোকানে বসে গ্রামবাসীদের সাথে রাজনীতি অথবা শফী হুজুরের সাম্প্রতিক তেঁতুল থিয়োরি নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলা। বাজারের সস্তা দামের খাবার হোটেলে ডাল-তরকারি-গোমাংস সহযোগে আহার সারা। আর আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থা থাকলে সস্তা দরে সেখানে রাত-যাপনের ব্যবস্থা করা, নিদেনপক্ষে গ্রামের মেম্বর অথবা অবস্থাপন্ন কোন গেরস্থের বাড়িতে রাত কাটানোর ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করা।

সন্ধ্যার পর এইখানকারই এই সময়ের মধ্যে পরিচিত পছন্দের ব্যক্তিটিকে সাথে নিয়ে জোসনা রাতে নদীতে নৌকা করে চলে যাও দুর-দুরান্তের অধর দিগন্তের পানে। অথবা গারোদের কোন অনুষ্ঠনে যোগ দিয়ে ওদের সাথে নাচ-গানে সাথী হয়ে উপভোগ করো নির্মল আনন্দ। বেনসন না পাওয়া গেলে নেভী অথবা ষ্টার সিগারেটই সই। ফুরিয়ে গেলে আকিজ বিড়িতে ফুঁক ফুঁক করে দুটো টান দিতে পারলেও চলবে।

অনেককাল আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। মহল্লার এক দাদার সাথে গিয়েছি এক গাঁয়ে। দাদা বেশ পন্ডিত মানুষ। এক হিন্দু বর্ধিষ্ণু পরিবারের বিয়ের নেমন্তন্নে। তিন দিনের জন্য। অনুষ্ঠানের হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে দ্বিতীয় দিনে দাদা বললেন,'যাবি নাকি মেলা দেখতে, পাশের গাঁয়ে মেলা বসেছে।' আমি এক কথায় রাজি। দাদার সাথে মেলায় ঘুরছি। এক লোকের কাছে দেখলাম, খাঁচায় পুরে অনেক পাখি এনেছে, বেঁচবে বলে। দাদাকে বললাম, পাখি কিনব। দাদা কিছুক্ষণ পাখিদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপর দরদাম করে পাখিগুলো কিনে নিলেন। একটুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর খাঁচার মুখ খুলে সব পাখিগুলোকে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে পাখিগুলো সব আকাশে হারিয়ে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আর দাদা হাসি হাসি মুখ করে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'এটাই সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থারে।' আস্তে আস্তে আমার মাঝেও হাসি হাসি ভাবটুকু সঞ্চারিত হলো।

আজ এই বয়সে যখন স্মৃতিটা মনে পড়ে, ভাবি, সেটাওতো এক প্রকার ভ্রমণগো, আনন্দ ভ্রমণ, অন্য কোন ভুবনে !

যাহোক, অনেক কথাই তো হলো, এবার বিদায়ের পালা। বিদায়বেলায় এক রসিকজনের বলা কথাটাই নাহয় আপনাদের বলি।

পুজোর সময়। কৃষ্ণযাত্রার পালা চলছে। পালায়, বিরহিনী রাধার কাছ থেকে কৃষ্ণ বিদায় নেবেন। কিন্তু বিদায় নেবার ইচ্ছে নেই। মানভঞ্জনটা শেষ হয়েছে। রাধার দুই সখী দু'পাশে।
কৃষ্ণ বললেন, ' এবার তবে যাই।' বলে পা বাড়ালেন।
সখী বললেন, 'যাই না আসি।'
কৃষ্ণ ফিরে এসে দড়ালেন, রাধা এবং সখীরা অবাক, কী হলো !
কৃষ্ণ বললেন, 'তোমরাইতো বললে যাই না আসি, তাই এলাম।'
সখী হেসে বললেন, 'যাই বলতে নেই, যাবার বেলায় আসি বলতে হয়।'
কৃষ্ণ বললেন, 'তাই বুঝি ? এবার তাহলে আসি।' যাবার জন্য পা বাড়ালেন।
সখী বললেন, 'এসো।'
কৃষ্ণ আবার ফিরে এলেন। রাধা আর সখীরা আবারও অবাক !
কৃষ্ণ বললেন, 'এসো বললে, তাই এলাম।'
রাধার বিরহ কাতরতা বাড়ে।সখীরা হাসেন।
কৃষ্ণযাত্রার কেষ্টঠাকুরটি বরাবরই চতুর রসিকলাল। আর আমাদের ক্ষেত্রে বিটলেমি।
ঠিক বুঝতে পারছিনা, আমাকেও সেই বিটলেমিতে পেল কী না।

যাহোক, আপনারা যা ই বলেন, আজ যাচ্ছি বটে তবে আবারও আসবো কিন্তু।


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আসুন, আসুন, বারে বারে আসুন। একেবারে ৬ মাসের গ্যাপ দিয়ে এবারে এসেছেন - পরের বার তাড়াতাড়ি আসুন এটাই কামনা। আর আপনি তো বলতে গেলে আমার এক রকম প্রতিবেশীই - আমার দেশের বাড়ি রাজশাহীতে যাবার দাওয়াত দিয়ে রাখলাম - চলুন বেরিয়ে পড়ি।

rasel zaman  এর ছবি

অনেক ভালো লাগলো। বেশী বেশী লেখেন তাহলে আপনার পৌড় ভাবনা আমরা এই বয়সেই শিখে নিব.....
রাসেল জামান

আয়নামতি এর ছবি

এই বয়সে ব্যাকপ্যাক আবার ঠিক মানানসই না।

মানান সই না আবার কী কথা! রেগে টং
আপনি যেটায় সুবিধাবোধ করবেন সেটাই নিবেন। লোকের কথায় এত পাত্তা দেয়া কেন বাপু।
লোক আপনার বোঝার ভার বইবে? এদিকে হলে নইলে কথা ছিল। এখানে এখন ব্যাগপ্যাক বেশ একটা
সন্দেহের বস্তু যেন রেগে টং যাইহোক, এক খিলি পান মুখে পুরে বেরিয়ে পড়ুন জলদি। ফিরে এসে জম্পেশ একটা
পোস্ট দিয়ে দিন। শুভকামনা জানবেন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

তাড়াতাড়ি আসুন হাসি পিজি হাসপাতালের "প্রৌঢ় দূর্ভাবনা" টাকে ঝুলিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

যাঁরা মন্তব্য করেছেন এবং যাঁরা পড়েছেন, সকলকেই অনেক অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হাল নাগাদ করা হয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ লেখা চলুক

ফাহিমা দিলশাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।