বঙ্গবন্ধুর একত্তরের ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষ মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল কোন একটি যুদ্ধের। যদিও তার প্রকৃতি ও প্রাবল্য সম্পর্কে সাধারন মানুষের কোন প্রকার ধারনা ছিলোনা। তবে তাদের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্খা জাগ্রত হয়েছে প্রবলভাবে। ছাত্রনেতাদের এবং বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তৃতা থেকে বাংলার মানুষ 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' হৃদয়ে ধারণ করেছে। এর রূপ সম্পর্কেও জেনেছে।
তারপরেই এলো সেই ২৫ মার্চের কাল রাত। শুরু হলো বাঙালি নিধনযজ্ঞ। এরই পরিক্রমায় লণ্ডভণ্ড হলো হাজার হাজার পরিবার। প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী হলো।
রাজনীতিকদের প্রচেষ্টায় জনগণের কাছে যুদ্ধের বারতা পৌঁছে যায়। গণমানুষের মুক্তির জন্যে যুদ্ধ, 'মুক্তিযুদ্ধ।'
বাংলার এই অঞ্চলের সমস্ত মানুষ একটিমাত্র সূত্রে গ্রথিত হয়েছে, নিজেদের জন্য নিজেদের মতো করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য। এ অঞ্চলের মানুষ যুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধ করেনিতো বটেই।
সেই সব মানুষেরাই আজ একাট্টা হয়েছে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করার নিমিত্তে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে। দুবলা-পটকা হীনশক্তির ভেতো বাঙালির কন্ঠে আজ রণহুঙ্কার, 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।' 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।' 'জয় বাংলা।' দরীদ্র কৃশকায় কৃষকটিও আজ প্রতিরোধে দুর্বার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রত্যয়ী, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য শপথদীপ্ত। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, পুরুষ সকল সাধারনজন আজ একসূত্রে গাঁথা। বাংলার হতদরীদ্র মানুষের এই প্রবল রূপ দেখে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক-সেনাটিও সভয়ে সঙ্গোপনে প্রশ্ন করে, 'ইধার কোই মুক্তি হ্যায় ?' এই হচ্ছে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম, এই-ই মুক্তিযুদ্ধ - যা এই অঞ্চলে অদৃষ্টপৃর্ব, অভূতপূর্ব। একাত্তরের আগে নিকট অতীতে এ অঞ্চলের মানুষের এমন একাত্মতার ঘটনা ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায়না।
এসবের বিপরীতে ছোট একটি অংশ ছিলো যারা মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। আর ছিলো জামায়াতে ইসলামী নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দল আর কিছু অবাঙালি (বিহারি) মুসলমান, যারা দেশ বিভাগের সময় ভারত ছেড়ে এ অঞ্চলে চলে এসেছিলো। এরাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এ ছাড়াও ছিলো একদল অতিবিপ্লবী বামপন্থী। আর ছিলো চীনপন্থী কমিউনিস্টরা। এরা আওয়ামীলীগের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। তবে অতিবিপ্লবী বামপন্থীরা বা চীনপন্থী কমিউনিস্টরা সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করেনি। এদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিল। মুসলিম লীগার এবং অবাঙালিরা মিলে শান্তিকমিটি গঠন করেছিলো, পাকিস্তানের পক্ষাবলমম্বন করে। আর জামায়েতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি সংগঠন তৈরি করে পাক বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসাবে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলো।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করি। সেদিনকার সে বিজয়ে ছিল আনন্দ আবেগের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একদিকে মহান বিজয় অর্জনের বাঁধভাঙা আনন্দ, অপর দিকে স্বজন হারানোর বেদনা। এই বিয়াল্লিশ বছরে সে স্মৃতি অনেটাই ধুসর। হৃদয়ে আছে শুধু স্বজন হারানোর কিছু স্মৃতি।
বিজয়ের মাধ্যমে আমরা পেলাম, 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' যার মূল ভিত্তি ছিলো, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মর্নিরপেক্ষতা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হলো এ রাষ্ট্রের মালিক এ দেশের জনগণ।
এত বছরে পর্যায়ক্রমিক শাসনক্ষমতায় থাকা দলগুলো সংকীর্ন দলীয় ও ব্যক্তি সার্থের কারনে একটি কোটারী গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেছে, যারা আসলে এই দেশটার সিংহভাগ সম্পদ এবং সর্বময় ক্ষমতার মালিক।
বিজয়ের মাসে সাধারণ মানুষের মাঝে আমি বিজয়ের রূপটি খুঁজি। কিন্তু আমার চোখে পড়ে কায়েমী স্বার্থবাদের বিজয়।
একাত্তরে মানুষ যে বিজয় দেখতে চেয়েছিলো তার মূলমন্ত্র ছিল, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' অর্থাৎ আপামর জনসাধারণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণহীন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা। শুধুমাত্র একটি স্বাধীন ভূখন্ড ও একটি পতাকামাত্র নয়। বাংলাদেশের সকল নাগরিকের আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হবে। হবে সবার জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা।
হায়, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ! এতদিনে হয়তো এ শব্দযুগলের অর্থই পাল্টে গেছে।
আমি এই বিজয়ের মাসে দেখি মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির আস্ফালন। ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলোর স্খলন। দেশের ক্ষমতাদন্ড বা শাসনক্ষমতা পাওয়ার নেশায় সেই সব চিহ্নিত নরপশুদের সাথে সহাবস্থান।
বিজয়ের মাসে দেখি গলিত, পতিত, স্খলিত এক ধরনের রাজনীতির কালোছায়া যা আমার দেশের সকল শুভকে গ্রাস করতে উদ্যত।
স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরের মাথায় এসে দেখছি একটি প্রজন্ম আবারও 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র রঙে নিজেদেরকে রাঙিয়ে নিয়েছে। তারা বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলেছে, 'রাজাকারের ফাঁসি চাই', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা','জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো',
'জয় বাংলা' ইত্যাদি, যে সকল শ্লোগানের অধিকাংশই আমরা একাত্তরে দিয়েছি, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' হৃদয়ে ধারণ করে।
আমি শাহবাগের 'প্রজন্ম চত্তরে' আবারও বিজয়ের আশা খুঁজে পাই।
হ্যাঁ, নতুন করে আবারও বিজয়ের শুরুটা হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ ইং তারিখে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে বিজয়ের শুরু। এই ঘটনাটি এবারের বিজয় দিবস উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মূল বিজয় এখনও বাকি।
হে ২০১৩ সালের আন্দোলনরত প্রজন্ম, তোমাদেরকে বলি এ যুদ্ধে জিততে হবে তা না হলে বাংলাদেশ থেকে সমস্ত 'শুভ' বিলীন হবে।
এ যুদ্ধ জিততেই হবে।
'জয় বাংলা'।
মন্তব্য
কথা একটাই,
জয় বাংলা
হ্যাঁ, কথা একটাই।
____________________________
হ্যাঁ, জিততেই হবে।
কথা একটাই এ যুদ্ধে জিততেই হবে।
হ্যা, কথা একটাই।
এ যুদ্ধ জিততেই হবে...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হ্যাঁ, জিততেই হবে।
এ যুদ্ধ জিততেই হবে । জয় বাংলা
মাসুদ সজীব
হ্যাঁ, এ যুদ্ধ জিততেই হবে।
‘এ যুদ্ধে জিততেই হবে’ এর সাথে বরং বলি এ যুদ্ধে জিতবই।
স্বয়ম
এ যুদ্ধ জিততেই হবে। জয় বাংলা
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হ্যাঁ, এ যুদ্ধ জিততেই হবে।
হ্যাঁ, অবশ্যই।
এ যুদ্ধে জিততেই হবে -
না, আমরা এ যুদ্ধে জিতবই। কোন অপশক্তি আমাদের রূখতে পারবে না।
____________________________
এ যুদ্ধ জিতবই। এ আমার প্রত্যয়দীপ্ত শপথ।
নতুন মন্তব্য করুন