সেদিন গিয়েছিলাম এক আত্মীয়কে দেখতে। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। অনেকদিন ধরেই শয্যাশায়ী। ডাক্তার আগেই জবাব দিয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম তাঁর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্তিম সময় উপস্থিত।
যানজট এড়াবার জন্য অফিস ছুটির আগেই গিয়েছিলাম।
ওঁকে রাখা হয়েছে বাড়ির কোনার দিকের একটা ঘরে। ঘরটা একটু অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন, একটু ভ্যাপসা দুর্গন্ধময়ও বটে। ফিনাইল অথবা স্যাভলন, এই জাতীয় একটা মৃদু গন্ধও যেন পাওয়া যাচ্ছিলো। ঘরে ঢুকেই মনে হয়েছিল, মৃত্যু যেন ঘরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। দেখাশোনার জন্য একজন অভিজ্ঞ আয়া রাখা হয়েছে। আর বাসার কাজের লোকেরাতো আছেই।
ড্রইংরুম ভর্তি লোকজন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই-ই উপস্থিত। দিন দুয়েক আগে লন্ডন থেকে ছোট মেয়ে এসেছেন এক ছেলে সাথে করে। আর বড় ছেলেটা থাকেন আমেরিকার শিকাগো শহরে। কাজের চাপহেতু আসতে পারেন নি। তবে বৌমা টেলিফোনে অহরহই খোঁজখবর নিচ্ছেন।
নাতিপুতিরাও অনেকেই এসেছেন দাদাকে শেষবারের মত দেখতে। দাদা যখন সুস্থ ছিলেন তখন এঁদের নিয়ে কত ঘুরেছেন! কেএফসি, পিজ্জাহাট, শিশুপার্ক, সংসদ ভবন আরও কত কত জায়গায় ঘুরিয়েছেন! কত কিছু খাইয়েছেন! সকলকেই অনেক অনেক উপহার দিয়েছেন। আদর দিয়েছেন। তারপর একটা সময়ে প্রয়োজনে প্রেম, বিয়ে, মানভঞ্জন ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতাও করেছেন।
সেই দাদা এখন মৃত্যুপথযাত্রী। অবশ্য নাতিপুতিরাও এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। প্রায় সবারই সংসার হয়েছে। কেউ কেউ বাবা-মা ও হয়েছেন। দাদার সাথে আগের সেই উষ্ণ সম্পর্কটিও এখন আর নেই। এখন তা অনেকটাই শিথিল। তাঁরা একবার দাদাকে দর্শন করে ড্রইংরুমে অথবা অন্দরে বিভিন্ন ঘরে অবস্থান নিয়েছেন। অপেক্ষা করছেন, দাদার মৃত্যু সংবাদের। অবশ্য শুধু ওঁরাই নন অভ্যাগতদের প্রায় সবাই-ই এই সংবাদেরই অপেক্ষা করছেন। আমিও ব্যতিক্রম নই।
এরই মধ্যে বাড়ির বৌ-ঝি'রা বাইরে থেকে ফিরে হুড়মুড় করে বসার ঘরে ঢুকলেন। অন্দরে যাবার ব্যবস্থা ঐ বসার ঘর হয়েই। তাঁরা গিয়েছিলেন ঈদের বাজার করতে। বাজার থেকে ফিরলেন।
হাজার হোক, জীবনতো আর থেমে থাকেনা!
প্রবীণদের কেউ কেউ এটাকে ভাল চোখে দেখলেন না। বাড়ির কর্তা একটু বিব্রত হলেন। বাইরে থেকে যেসব মহিলারা রুগী দেখতে এসেছিলেন, তাঁরাও বাড়ির ভিতর বৌ-ঝি'দের ঈদের কেনাকাটা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বসার ঘর থেকে বাড়ির ভিতরের বেশ একটা উচ্ছাসের ভাবের আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল। বসার ঘরেও বিভিন্ন জনের মাঝে বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি। আমিও বসার ঘরে বসে বাড়ির ভিতরের উচ্ছাস না এই ঘরের বিমর্ষ ভাবের সাথে একাত্ম হবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
অর্থ, আরাম, বিলাস ও ব্যসন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করে। আত্মীয়তার বন্ধন সেখানে শিথিল। ধনীর বাড়িতে শোকের তেমন প্রাবল্য থাকেনা।
বেশ কিছু সময় কাটিয়েও যখন কোন খবর হলোনা তখন একে একে অনেকেই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমিও একটু পরে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ড্রাইভারকে বললাম, 'গুলশান ক্লাব'।
গাড়ির ভিতর নিরালায় বসে মনেরমাঝে একটা বিমর্ষ ভাবের উদয় হলো। মনটা বিষণ্ণতায় ডুবে গেল। মনে হলো আমিও ঐ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছি। আমার অন্তিম সময়েও হয়তো নিজেকে বড্ড অসহায় ও একা মনে হবে! বার্ধক্যজনিত রোগশয্যায় এবং মৃত্যুতে মানুষ বড্ড একা!
মন্তব্য
হৈ মিয়া,
আপনার ওইদিকে যাওয়া দেরী আছে। আমরা কি অনাপত্তি পত্র দিছি?
কী কী লেখা জানি বকেয়া আছে, ঐডি লিখ্যা শ্যাষ করেন আগে।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বেশ কয়েকটা লেখা অল্পস্বল্প তৈরি হয়েছে। লেখাগুলো কেন জানি আমার নিজেরই মনপুত হচ্ছেনা। আরেকটু কাটাছেড়া করেনি। দিবনে। তা লেখাগুলো শেয হলেইতো কম্ম শেষ!
ভাল থাকুন। আনন্দে থাকুন।
কেন? এই লেখাগুলো শেষ হলে আরও নতুন নতুন লেখা তৈরি করবেন। কিছুকাল আগেও এই পর্যায়ে এসে মানুষ(পুরুষমানুষ) কচি দেখে একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে আনতো। এখন তার উপায় নেই, প্রয়োজনও নাই। এখন বিগত জীবনের যে অর্জন, তারই আলোকে জীবনচর্চা। অর্জন যদি সন্তোষজনক হয়ে থাকে তাহলে আর সমস্যা কি? সেটা না থাকলে ধর্মাচারনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই হল।
ভাল থাকবেন।
ধর্মালোচনায় আগ্রহ আছে কিন্তু ধর্মাচরনে আগ্রহ নেইযে।
এত অল্পে ছাইড়া দিমু ক্যাডায় কইল?
এইডা ল্যাখেন আগে, তারপর নয়া আবদার লয়া আমু নে।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনার এর আগের লেখাটাও জীবন নিয়েই ছিল। আজকাল আপনার মাথায় বুঝি শুধু এইসব চিন্তাই ঘোরে ? আমিও সত্যানন্দ দার সাথে একমত, দয়া করে এগুলো ভাবা বাদ দিয়ে লেখায় মন দিন। আপনি আমার বাবার বয়সিই হয়ত হবেন তাই একটু মেয়ের মত শাসন করলাম । কিছু মনে করবেন না যেন
ফাহিমা দিলশাদ
নাহ্, কিছু মনে করিনি। ভালই লেগেছে। জেনেছি মেয়েরাই নাকি বাবাকে শাসন করে, আমারতো মেয়ে নেই!
ভাল থেক। আনন্দে থেক।
কোন এক বিশেষ কারণে আমি যাদের শ্রদ্ধা করি এবং যারা আমাকে স্নেহ করেন তাদের অধিকাংশেরই মেয়ে নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় যে ভালই হয়েছে ওনাদের মেয়ে নেই, মেয়ে থাকলে হয়ত এখন যতটা স্নেহ পাই ততটা পেতাম না । যাই হোক অনেক ভালো থাকুন এই কামনা করি ।
ফাহিমা দিলশাদ
মানুষ চিরকালই একা...
(বেশ কয়েকটা টাইপো খুব চোখে লাগছে, একটু ঠিক করে দিন দয়া করে)
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
"মনের মানুষ মেলেনা, সংসারে মানুষ তাই সঙ্গীহীন। আসলে আমরা সবাই একা। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন হয় বাইরের প্রয়োজনে-- বন্ধুত্বের প্রয়োজনে, স্বার্থের প্রয়োজনে, সৃষ্টির প্রয়োজনে।" প্রবোধ কুমার স্যান্যাল
"নিজের চোখের সামনে ধরা আপন বদ্ধমুষ্ঠীও দূরের হিমালয়কে আড়াল করে ফেলে।" নিজের ভুলতো দেখতেই পাাইনে!
ধন্যবাদ, নজরুল। এতগুলো টাইপো ছিল! জানিনা আরও দু-চারটে থেকে গেল কিনা! নাহ্, বুঝতে পারছি, দিনে দিনৈ বড্ড অধৈর্য হয়ে পড়ছি।
সহমত।
অঃ টঃ - বার্তা দেখার অনুরোধ রইল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
তা, সহমত কি টাইপোতে! হা হা হা।
বেশতো, মনে করলাম।
প্রৌঢ়-কালের ভাবনা নিয়ে আপনার লেখার সাথে সহমত ছিলাম, এই আর কি!
( টাইপো নিয়ে সহমত-এর ঘোষণা দিতে হইলে হয়ত সেই নিয়ে করা মন্তব্যর সাথে জুড়তাম। )
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সতয় কঠিন, অনেক কিছুর মাঝেও মাূষ জীবনটাকে চালিয়ে নিয়ে চলে,
মাঝে মাঝে অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই, বাকিটা সময় স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা
শুভেচ্ছা
উর্দুতে একটা শায়েরী আছে, 'হর কই ইয়ে জিন্দেগীছে রেহাহ্ চাহতে হায়, ফিরভি সব কই রেহাহ্ হনেছে ডরতা হ্যায়'।
যেমন বৃদ্ধজনেরা বলেন, রাধেগো ব্রজসুন্দরী (হরি), পার কর, পার কর। বা আল্লাহ, হাপিয়ে উঠেছি এ জীবন আর বইতে পারিনা, উঠায়ে নাও।
মাথা থেকে ঐ চিন্তা দূর করেন দেখি ভাবনা ভাই। এখনো কত কিছু করার বাকি আছে - সেগুলো করেন আগে। তারপর দেখা যাবে। আমাদেরকেই তো আপনার এখনো কতকিছু দেয়ার বাকি, সেগুলো বাকি থেকেই যাবে, তা তো হবে না!!
____________________________
আমি হাই প্রেসারের রুগী। ডাক্তার বলেন, 'কোন ধরনের টেনশন করবেন না'। তা বলে কি দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা যায়!
ধন্যবাদ, শুভকামনার জন্য।
এই দৃশ্যের সাথে আমি খুব পরিচিত। এই সত্য অনিবার্য!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
হ্যাঁ, অপ্রিয় হলেও ইহাই সত্য।
মন খারাপ করা লেখা। তবে কঠিন সত্য সত্যি সত্যি।
আমাদেরও গন্তব্য পাড়ি দিতে হবে, আপনি একা নন।
তবে একটা বিখ্যাত কথা আছে না যে, লাইফ ইজ আ জার্নি, নট আ ডেস্টিনিশন !
ভাল থাকুন।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
হ্যাঁ, যাত্রাটাই গুরুত্বপূর্ণ, গন্তব্য নয়।
ভারতবর্ষের সাধক মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "এ জগত হচ্ছে পুস্পাচ্ছাদিত একটি শবদেহ। আর এর যাত্রাপথ হচ্ছে, সুতিকাগার থেকে শ্মশানঘাট।"
।
আরে , এইসব কি কথা! জীবনের এইতো সবে শুরু...
****************************************
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আজ আমার এক নাতনীর জন্ম হয়েছে, তবে এ-ই প্রথম নয়। জীবনতো শুরুই বটে!
মানুষের মৃত্যুক্ষণ এমনি একটা সময়, যখন সকল সান্ত্বনা অচল।গালিবের একটা শের মনে পড়ে গেল,
The prison of life and the bondage of grief are one and the same
Before the onset of death, how can man expect to be free of grief?
আপনার লেখা পড়ে সেই দীর্ঘশ্বাস আরো দীর্ঘতর হলো।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
তা, দীর্ঘদিন পরে! আর তাতেই আপনার দীর্ঘশ্বাসকে দীর্ঘতর করে দিলাম!
কিঞ্চিৎ বয়স হয়েছে বলে ভেগে যাবার চিন্তা ভর করেছে, এটা আর কিছুনা আপনার ভীমরতি।
নাহলে বলেনতো বয়স্ক ছাড়া কি কেউ চলে যায় না ?!!! আমি বা আমরা বয়স কম বলে যে আরো অনেক পরে যাব তার কি নিশ্চয়তা আছে? এইগুলা বাদ দেন, আমাদের মুরুব্বির দরকার আছে।
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
আমার বন্ধু-বান্ধবেরা অনেকেই চলে গেছে কিনা! আবার অনেকেই যাবার জন্য খাবি খাচ্ছে। তাদের সাথে দেখা হলেই মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়, আসলে ওরা জীবন্মৃত। আপনারাওতো আমার বন্ধু! আপনাদের সাথে থাকারই মনস্থ করেছি।
কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি যেয়ে অসুখের সাথে সমঝোতা করে বেঁচে আছি। বাঁচবার লোভ তবু যায় না। শেষটায়
জেনে ভাল লাগছে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আপনাদের সাথেই থাকতে চাই।
নতুন মন্তব্য করুন