সমাগতপ্রায়, মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ-উল-আযহা এবং চলমান সনাতন ধর্মীয় শাক্ত সম্প্রদায়ের মহোৎসব দুর্গাপূজা। এ বিষয়ে এই অর্বাচীনের দু-একটি কথা। যৎসামান্য স্মৃতিচারণও বটে।
উৎসব-অনুষ্ঠান সবই মানুষের জন্য। সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণীর মানুষেরই জন্য। নির্দিষ্ট কোন ধর্মমতেরতো নয়-ই, নির্দিষ্ঠ কোন গোষ্ঠীরও নয়। তা, সে ধর্মানুষ্ঠান, পূজানুষ্ঠান, বর্ষবরণ আর নাট্য বা সংগিতানুষ্ঠান, যা-ই হোক না কেন! দোয়া-দরুদ, মন্ত্রপাঠ এবং আচারিক বিষয়াদি নির্দিষ্ট ধর্মাচরণের অংশ বটে, তবে এই অংশটুকু ছাড়া এগুলোকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই বলা চলে এবং এটাই আমাদের এতদঞ্চলের বৈশিষ্ট্যই বটে।
বহুল প্রচলিত ধর্মমতগুলোর বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে (দৃষ্টি দিলে) দেখা যাবে, ঈদ (ইসলামধর্ম), বড়দিন (খ্রীষ্টধর্ম), পূজা, দোল, দীপাবলী, রথযাত্রা (সনাতন বা হিন্দু ধর্ম), গুরুপরব (শিখধর্ম), বৌদ্ধপূর্নিমা (বৌদ্ধধর্ম), দিওয়ালী (হিন্দু, জৈন, শিখ) ইত্যাকার অনুষ্ঠানগুলোতে, পঞ্চাশ, ষাট এমনকি সত্তরের দশকেও সকল ধর্মমতের লোকেরা শামিল হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন। এবং এই সকল উৎসব-পরবে অন্য
ধর্মালম্বীদের যোগ দেওয়াতেও কোন বিধিনিষেধ ছিলো বলে আমার জানা নেই।
তবে হ্যাঁ, এটা স্বীকার করতেই হয় যে, শারদীয় দুর্গোৎসব যে ভাবে সার্বজনীনতা পেয়েছে তা অন্য কোন উৎসব তেমনটি পায়নি। এর একটি কারণ হিসাবে জানা যায়, তিরিশের দশকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন ইত্যাদির কারণে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ক্লাব গড়ে ওঠে। আর ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সব ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষকে একই ছত্রের নিচে জড় করার নিমিত্তে সব ধরণের মানুষের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে এই সব ক্লাবের মাধ্যমে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান সার্বজনীন হয়ে ওঠে। এবং সেই সময়ে সব ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণীর মানুষের এই আনন্দোৎসবে শামিল হওয়াটা ছিল স্বতস্ফুর্ত!
ধর্মবিষয়ে বাঙালি সব সময়ই মধ্যপন্থী। আর মূল কথাটাতো, বাঙালিমাত্রই ভীষণ আনন্দপ্রিয়। হুল্লোড়ে মাতার কোন একটা ছলছুতো পেলেই হুলো। আর দেখতে হবেনা!
ধারনা করা হয়, এতদঞ্চলে আধুনিক পদ্ধতিতে দুর্গাপুজার প্রচলন করেছিলেন, তদানিন্তন তাহিরপুর (নাটোর) এর রাজা 'কংসনায়ায়ণ'। সময়কালটা ধরা হয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগ। আর এই পূজানুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করেছিলেন তদানিন্তন যাদবপুর নিবাসী পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। সমসাময়িক কালে তিনি বাংলা-বিহারের মধ্যে সর্বপ্রধান পণ্ডিত হিসাবে গণ্য ছিলেন। এ পূজানুষ্ঠান তৎকালে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করে। অদ্যাবধি পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী প্রণীত পদ্ধতিতেই দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান হয়ে আসছে।
এই আমার বালকবেলায়, কৈশোরে, যৌবনে, হিন্দুদের (সনাতন ধর্মীয়দের) দুর্গাপূজার দিনগুোতে পরিচিতজনদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে পাঁঠার মাংস সহযোগে অন্নগ্রহণ করেছি। অন্যান্য পুজা-পার্বণেও লুচি-তরকারি, মণ্ডা-মিঠাই ও খেয়েছি বটে তাতে আমার ধর্মভ্রষ্ট হওয়ার কথা অবশ্য কেউ বলেনি। বড়দিনের অনুষ্ঠানে বন্ধুর বাড়িতে আলোকসজ্জিত খ্রীসমাস ট্রি ও সুন্দর করে সাজানো ঘরে বসে কেক-পেস্ট্রি, ছানা-সন্দেশও খেয়েছি।
আমার শৈশবে আমাদের বাড়ির পাশে একটি জৈন পরিবার থাকতেন, তাঁরাও উৎসব-পরবে আমায় তাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে রুমালি রুটিতে ঘি মাখিয়ে তরকারি, চাটনি দিয়ে পরম আদরেই আমাকে খাওয়াতেন । এ বিষয়ে কখনই আমার বা তাঁদের পরিবারের কেউই কোন প্রশ্ন তোলেননি।
আবার অপরদিকে, ঈদের দিনে আমাদের বাড়িতে নানা ধর্মের, শ্রেণীর মানুষের আনাগোনার ধুম পড়ে যেত। বিশেষ করে কুরবানীর ঈদে। আমার হিন্দু বন্ধুরাতো ছিলোই, আমার ভাই-বোনের বন্ধুরাও এমনকি আব্বার চাকরি সুবাদে পরিচিত হিন্ধু-খ্রীস্টান পরিবারের সদস্যরাও আসতেন। খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব করতেন। তবে ঐ জৈন পরিবারটি অবশ্য আমাদের বাড়িতে জলগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না। সে বিষয়ে অবশ্য তাঁরা বহুবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
শুধু খাওয়াদাওয়ার কথাইবা বলি কেন! দুর্গাপূজার সময় আমরা পিঠোপিঠি ভাইবোনেরা মিলে হিন্দু বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন পূজমণ্ডপে ঘুরে ঘুরে দেবীমুর্তির সাঁজগোজ দেখতাম। ছুটোছুটি করে আনন্দ করতাম। খোলা দোকান থেকে ছ-পয়সা, দু-আনার খাবার কিনে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেতাম। রথযাত্রা, দীপাবলী, দোলের রঙ খেলায়ও তাদের সাথে হুল্লোড়ে মাতামাতি করেছি।
হিন্দু বন্ধুরাও মহররমের দিনে আমাদের সাথে পটকা ফোটানো, আতশবাজি, তারাবাজি জ্বালানোতেও অংশ নিতো। আনন্দ করতো। কোন কোন হিন্দু বন্ধুতো ঈদের দিনে আমাদের সাথে বিভিন্ন মুসলমান বাড়িতেও যেত। খাওয়াদাওয়া আনন্দফুর্তি করতো।
অবশ্য একটা কথা বলতেই হয়, সে সময়কার গোঁড়া হিন্দুরা কিন্তু ছোঁয়া-ছুঁয়ি বাঁচিয়ে বাছ-বিচার করেই চলতেন। তাঁদের বসার ঘরে যদিবা আমাদের(ম্লেচ্ছ) প্রবেশাধিকার ছিলো তবে হেঁসেলে নৈব নৈব চ!
ইদানিং মুসলমান বা বিজাতীয়ের বাড়িতে বা তাদের হাতে জল খেলে আর হিন্দুর জাত যায়না (তেমন করে) বা হিন্দুর বাড়িতে ভাত খেলেও মুসলমানও ধর্মভ্রষ্ট হয়না। (উভয় ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম আছে বৈকি!)
এখনও পূজা-পার্বণে, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব-আয়োজনে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অংশগ্রহণ আছে বটে তবে তা সেই সব দিনের মতো স্বতস্ফুর্ত নয় বোধহয়। আর বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিশেষ এক শ্রেণীর একে অপরের প্রতি যে ধর্মবিদ্বেষ, যে অবিশ্বাস এবং তার প্রকাশ সেটাতো মাঝে মধ্যে অমানবিক, অমানুষিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। যেটা সে কালে একেবারেই ছিলোনা বললেই চলে। এক সময়ে বর্ণবিদ্বেষ ছিলো পৃথিবীর বিরাট একটা অংশ জুড়ে। এই কিছুকাল আগেও এ অঞ্চলের মানুষেরা ছিলো, 'ডার্টি নেটিভ'। আর এখন, ন্যাড়া, মালাউন ইত্যাদি। বিদ্বেষ এখনও আছে, ধরণ পাল্টেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধর্ম বিদ্বেষকে উসকে দেওয়া হচ্ছে, পরিকল্পিত ভাবে। নিশ্চয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই। যেভাবে ধর্মরক্ষার নামে নাশকতা, নৃশংসতা, হত্যাযজ্ঞ চলছে, তাকে কোনভাবেই সমর্থন করা যায়না। তবে কেন এই বিদ্বেষ, হত্যাযজ্ঞ! সে আরেক গবেষণার বিষয় বটে। আমি আদার ব্যাপারী...।
এটাকে কি সভ্যতার ক্রমবিকাশ বলা চলে! আমি বলি, প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে বটে, হয়েছে, সভ্যতার অবনমন!
আমাদের শৈশবে, কৈশোরে ঈদ, কুরবানী ঈদে আনন্দের ঘটা ছিল বটে তবে এখনকার মতো প্রতিযোগিতা ছিলোনা। কে কটা নতুন পোশাক কিনলো বা কাদের কুরবানীর গরুটা বিশাল, এ ধরনের চিন্তা, মনমানসিকতা তখন কিন্তু একেবারেই ছিলোনা বাপু। একটা নতুন পোশাক পেলেই সবাই বর্তে যেত!
সেদিন কথা হচ্ছিলো এক বাহ্মণ পুরুতের সাথে। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, "আগের কালে দুর্গাপূজায় মন্ডপের সাজসজ্জা, আলোকসজ্জা, দেবীমায়ের গড়ন, শাড়ীগয়না ইত্যাদির এত বাহার ছিলোনা। মাইক বাজিয়ে উচ্চ ভলিউমে হিন্দিগান, বাজনা, জাঁকজমকও ছিলোনা। তখন ঢাঁকে কাঠি পড়লেই সবাই আনন্দে মাতোয়ারা! ঢাঁক, ঢোল, কাঁসর এসবই ছিলো তখন পূজোর বাদ্য-বাজনা। এখনতো রীতিমতো এ পাড়ায় ও পাড়ায়
প্রতিযোগতা! কাদের মন্ডপ কতো জাকজমকপূর্ণ হয়েছে ইত্যাদি, ইত্যাদি!
জাঁকজমক, আনন্দ উদযাপন এসবের মাত্রা অনেক বেড়েছে বটে। তবে প্রথমত একটি বিষয় যেটা এখন হচ্ছে, এই আনন্দফুর্তির মধ্যেও আমরা বর্ষিয়ানরা এক ধরণের শঙ্কার মধ্য দিয়েই পূজোর দিনগুলো পার করছি। সব সময় আতঙ্কে থাকি, কখন না জানি আমরা কোন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হই! ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় গভীর রাতে কিছু উন্মত্ত মানুষ মন্ডপে আক্রমণ চালিয়ে আমাদের মুর্তিগুলোকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়!
তিনি বলে চললেন, "হ্যাঁ, এতো গেল একটা দিক, আর পূজোর বিষয়ে বললে বলতে হয়, বাহ্যিক আচারিক ক্রিয়াকর্মে ত্রুটি হচ্ছেনা বটে তবে মায়ের প্রতি আন্তরিকতাপূর্ণ ভক্তি তথা আধ্যাত্মিকতাটা অনেকাংশেই অনুপস্থিত।এ যেন ঠিক মায়ের পূজো নয় বিরাট এক আনন্দযজ্ঞ।
আর দেখুন না, বিজয়া দশমীর দিনে মায়ের বিদায় বেলায়, মায়ের বিদায়েতো আমরা শোকাভিভূত, ম্রিয়মান থাকবো, এটাই স্বাভাবিক। তা না, ঢাক-ঢোল, বাদ্য-বাজনা, মাইকে হিন্দি গান বাজিয়ে মিছিল সহযোগে ধেই ধেই করে নেচে-গেয়ে মাকে বিদায় করতে যাচ্ছি। ভাবটা এমন, বাব্বা কটা দিন ম্যালা ঝামেলা গেল এখন ভালোয় ভালোয় বিদেয়টা হলে বাঁচি!"
তা, রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ হিসাবে ওঁর মনোপীড়া থাকতেই পারে। আমি বললুম, "আধ্যাত্মিক ভাব বজায় রেখে ভক্তি সহকারে তো প্রায় হিন্দু বাড়িতেই যার যার ঘরে প্রতিষ্ঠিত প্রতিমার নিত্য পূজো তো হয়েই থাকে। এই শারদীয় দুর্গোৎসবতো এখন বারোয়ারী অর্থাৎ সার্বজনীন একটা উৎসবেই পরিণত হয়েছে। সব ধর্ম, বর্ণের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করছেন। মায়ের প্রসাদ পাচ্ছেন।"
যাহোক, সকলকে ঈদ ও দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা।
আসছে বছর আবার হবে। আমি/আপনি থাকবো কিনা সেটাই অনিশ্চিত!
মন্তব্য
সবার উৎসব, সবার আনন্দ।
আনন্দ ভাগ করে নিলে কখনই কমে না -এটা সবার মাথায় থাকুক।
ঈদ মোবারক ও শুভ বিজয়া দশমী!
হ্যাঁ, শুনেছি বটে, 'দুঃখ বাটলে কমে, আনন্দ বাটলে বাড়ে!
শুভেচ্ছা, আপনাকে এবং আপনার পরিবারের প্রতিও বটে।
ভাল লাগল। অনেক শুভেচ্ছা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা আপনাকে ও আপনার পরিবারের প্রতিও।
বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
ধন্যবাদ। এই সম্প্রীতি যেন অটুট থাকে।
আপনার নাম বা নিকটা জানা হলোনা।
আহা,
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
তখনকার দিনে আনন্দ করতে পয়সা লাগতোনা।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দিনগুলো প্রতিদিন ঘিরে থাকুক আমাদের
শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
ধন্যবাদ। শুভকামনা আপনার এবং আপনার পরিবারের প্রতিও।
[ ণুড়া এই লেখা না দেখলেই হয় ]
আমি না থাকলে নেই, আপনাকে থাকতেই হবে... খেলাপী হতে বসা লেখার কথা ভুলিনি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ, শুভাকাঙ্খার জন্য।
খেলাপী কই? এইতো লিখলাম!
পরের লেখায় আবার খেলাপীত্ব নবায়ন কইরা দিমুনি,
ইট'স অ্যান ইনফানাইট প্যারাডক্স ট্যু গো থ্রু
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দারুণ একটা লেখা কিন্তু ঈদের আগে পড়তে পারিনি সচলায়তনের কিছু হয়ত সমস্যা ছিল কারণ আমি পাতাটা সঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। যাই হোক দেরীতে হলেও "ঈদ মোবারক" আর "দুর্গা পূজার" শুভেচ্ছা।
ফাহিমা দিলশাদ
তোমাকে আর লক্ষ্মী মেয়েটার পরিবারের প্রতিও শুভেচ্ছা। ভাল থেক।
নতুন মন্তব্য করুন