নাস্তিকতা বিষয়ক... পর্ব -১

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি
লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/০১/২০১৬ - ১২:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এ মানব মন বড়ই বিচিত্র! বড্ড অনুসন্ধিৎসু। সেই আদিকাল থেকে মানব মনে প্রশ্ন, এই মানব জন্মের রহস্য কি, উদ্দেশ্যই বা কি, এ জগত, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির কারণ কি, কতকাল পূর্বে এই বিশ্ব-জগতের উদ্ভব, কতকালই বা তার স্থিতি,ইত্যাকার নানাবিধ প্রশ্ন। মানব মনে নানা বিস্ময়, কৌতুহল।

অধিকাংশ মানুষই এই সব প্রশ্ন নিয়ে দ্বারস্থ হয় তার নিজস্ব ধর্মের কাছে। এক পর্যায়ে ধর্ম তাকে চোখ রাঙায়, ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়, 'ধর্ম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করিওনা।' বা 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।' সে নিবৃত্ত হয় বটে কিন্তু মানব মনের কৌতুহলের কারণে সে সন্তুষ্ট হয়না। সে অলক্ষ্যে হাত বাড়ায়, দর্শন ও বিজ্ঞানের দিকে। দর্শন তাকে ধীরে ধীরে অনেকদূর পৌঁছে দেয় পরে বিজ্ঞান তাকে দাঁড় করায় নতুন এক অভিজ্ঞতার সামনে। সে বিস্মিত হয়। তবে অধিকাংশ মানুষই আবার ফিরে যায় বংশানুক্রমে তার মানসে লালিত তারই ধর্মীয় বিশ্বাসের বলয়ে। কিছু মানুষ দোদুল্যমনতায় ভোগে, কিছু মানুষ স্থির চিত্তে বিজ্ঞানের সত্যকেই গ্রহণ করে।

'নাস্তিক' কি বা কে...
নাস্তিকতা বিষয়ে জানতে হলে প্রথমে জানা দরকার, 'নাস্তিক' কি বা কে!
বর্তমানে প্রচলিত অর্থে যে ব্যক্তি সৃষ্টাকর্তা এবং প্রত্যাদেশে অর্থাৎ ধর্মে বিশ্বাসী নন, তাকেই 'নাস্তিক' বলা হচ্ছে।

নাস্তিক শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। এটি ঋণাত্বক বা না-বোধক শব্দও বটে। ‘ন অস্তি’ যার অর্থ ‘নাই’। এ থেকেই নাস্তিক।

আমাদের এতদঞ্চলে প্রাচীন বৈদিক যুগে, প্রাচীন বৈদিক বুগ বলতে ত্রিবেদ বা ত্রয়ী যুগকালকেই বোঝাতে চাইছি। তৈত্তিরিয় ব্রাহ্মণে বেদকে 'ত্রয়ী' বলা হয়েছে। এই ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত বেদ হিসাবে ঋক, সাম ও যজুর্বেদের উল্লেখ পাই। অথর্ববেদ সেখানে অনুপস্থিত।

প্রাচীনতম উপনিষদ, ছান্দোগ্য ও বৃহদারন্যক উপনিষদে বেদকে ত্রয়ী হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদের ১ম অধ্যায়ের ৪র্থ খন্ডের ২য় ও ৩য় ব্রাহ্মণে বলা হচ্ছে,
"দেবা বৈ মৃত্যোর্বিভ্যতস্ত্রয়ীং বিদ্যাং প্রাবিশন্।" অর্থাৎ "মৃত্যু হতে ভয় পেয়ে দেবতারা ত্রয়ী বিদ্যায় প্রবেশ করলেন।" (১৷৷৪৷৷২)।
"তে তু বিত্ত্বোর্ধ্বা ঋচঃ সাম্নো যজুষঃ স্বরমেব প্রাবিশন্।" অর্থাৎ, "তাঁরা ঋক, সাম ও যজুর স্বরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।" (১৷৷৪৷৷৩)।

বৃহদারন্যক উপনিষদের ১ম অধ্যায়ের ৫ম ব্রাহ্মণে আছে,
"ত্রয়ো বেদা এত এব বাগেব ঋগবেদঃ মনো যজুর্বেদঃ প্রাণঃ সামবেদঃ।" অর্থাৎ, "তিনটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ বাক্যের সঙ্গে তুলনীয়, সামবেদ প্রাণের সঙ্গে তুলনীয় এবং যজুর্বেদ মনের সঙ্গে তুলনীয়।" (১৷৷৫৷৷৫)
এ দুটি প্রাচীন উপনিষদে তিনটি বেদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

এই ত্রয়ী যুগে সনাতনধর্মে সৃষ্টিকর্তা বা একেশ্বরের ধারণা ছিলনা। ঋগ্বেদে আমরা ৩৩ জন দেবতার উল্লেখ পাই। তৎকালে এই সকল দেব-দেবীরই আরাধনা করা হতো। ঋগ্বেদে, ইন্দ্রের উদ্দেশ্যেই সর্বাধিক প্রশস্তীগীত (ঋক) রচিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বেদের বিজ্ঞ ব্যাখ্যাকারগণের অনেকের মতেই ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল এবং অষ্টম মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ৮০ ঋক নিয়ে ১১ টি সুক্তকে বালখিল্য সুক্ত বলা হয়। সায়ণাচার্য এগুলিকে ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করেন না। তাই এগুলিকে মনে করা হয় প্রক্ষিপ্ত অর্থাৎ পরবর্তীকালে সংযোজিত।

তৎসময়ে সৃষ্টিকর্তা বা একেশ্বরে অবিশ্বাসীদের নাস্তিক বলা হয়নি।(সৃষ্টিকর্তা বা একেশ্বরের ধারণাই ছিলনা।) সর্বপ্রথম 'নাস্তিক' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল লোকায়তিকদের (চার্বাক দর্শন বা লোকায়ত দর্শনের অনুসারী) প্রতি। নির্দিষ্ট করে বললে, যাঁরা বেদের ক্রিয়া-কাণ্ড, যাগ-যজ্ঞাদিকে অনর্থক বলেছেন, বেদকে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে স্বীকার করেননি এবং পরলোকে অবিশ্বাসী, তাঁদের প্রতিই বলা চলে। আরও.........এই ভাবসম্পন্ন ব্যক্তিকে নাস্তিক বলা হয়েছে।

সনাতনধর্মীয় মনুসংহিতা নাস্তিকের উপমায় জানাচ্ছে,
"যোহবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশ্রয়াদ্দ্বিজঃ ৷
স সাধুভির্বহিষ্কার্য্যো নাস্তিকো বেদনিন্দুকঃ ৷৷" (মনুসংহিতা:২/১১)
অর্থাৎ,
'যে ব্যক্তি প্রতিকূল তর্ক দ্বারা মূলস্বরূপ শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে অবমাননা করে, সাধু লোকেরা সেই বেদনিন্দক নাস্তিককে দ্বিজের কর্ত্তব্য কর্ম্ম অধ্যয়নাদি সকল অনুষ্ঠান হইতে বহিস্কৃত করিবেন।'

বিশিষ্ট বৈয়াকরণিক পাণিনির ব্যাখ্যামতে যে ব্যক্তি পরলোকে কর্মফলে বিশ্বাস করেনা, সেই নাস্তিক।

অতএব, প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালে নিরীশ্বরবাদী নয় বরং পরলোকে অবিশ্বাসী, বেদ অস্বীকারকারী এবং বেদনিন্দুককেই নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আর এই দর্শনই হচ্ছে, 'নাস্তিকতা।'

নিরীশ্বরবাদীগণকে পাশ্চাত্যে, নির্দিষ্ট করে বললে, ইংরেজিতে বলা হচ্ছে, 'Atheist' এবং এই দর্শনকে বলা হচ্ছে, 'Atheism'।

Jullian Baggini(British philosopher) explains in Atheism: A Very Short Introduction the meaning of an atheist's commitment to naturalism:
'What most atheists do believe is that although there is only one kind of stuff, in the universe and it is physical, out of this stuff come minds, beauty, emotions, moral values --- in short the full gamut of phenomena that gives richness to human life.'

চলবে।


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

দুনিয়ায় কি ফুল-পাখি-লতা-পাতা'র আকাল পড়ছে, বাহে? চিন্তিত [ পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম ]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

তা বটে, তা বটে।

দেবদ্যুতি এর ছবি

দুনিয়ায় কি ফুল-পাখি-লতা-পাতা'র আকাল পড়ছে, বাহে?

তারপরও সুপারলাইক, আশা করি অন্যান্য ধর্ম এ সম্পর্কে কী বলছে জানতে পারব শিগগির...

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

না, অন্যান্য ধর্মমতের ব্যাখ্যায় যাবনা। 'নাস্তিক' শব্দটি সংস্কৃত। বাংলায় এর ব্যাবহার সম্পর্কিত বিষয়টি তুলে ধরবার জন্যই সনাতন ধর্মমতের বিশেষ বিষয়ের উল্লেখ।

দুনিয়ায় কি ফুল-পাখি-লতা-পাতা'র আকাল পড়ছে, বাহে?

তা বটে, তা বটে।

এক লহমা এর ছবি

কঠিন বিষয়। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

তা বটে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ইসলামী মৌলবাদীরা এইবার কি করিবেন?? দেখা যাচ্ছে নাস্তিক একটি মালাউন প্রসূত শব্দ" নাস্তিক,গায়ক,কবি,নারীবাদ,এবং অতি অবশ্যই মালাউন বিদ্বেষী এই এক্সট্রিমিস্ট্রা এই শব্দ নিয়া কি করিবেন ভাবার বিষয়!

#নিটোল_আরন্যক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সত্যিই, ভাবনার বিষয়ই বটে।

সোহেল ইমাম এর ছবি

পরের পর্ব গুলো পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।