'মহাভারত' আমাদের প্রায় সকলেরই অল্প-বিস্তর পঠিত। আর মহাভারতের চরিত্রগুলো নিয়ে নানামুখি বিশ্লেষণ আছে।
আজ তাই অন্য দৃষ্টিতে শকুনি চরিত্র সম্পর্কে যৎসামান্য বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা।
শকুনি:
ভারত ও পাকিস্তানের উত্তরে বর্তমানে ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ যেই দেশ আফগানিস্তান, অতি প্রাচীনকালে সেখানেই অবস্থিত ছিল গান্ধার নামে এক সম্বৃদ্ধ দেশ। সেই দেশের অতি রূপবতী রাজকন্যা গান্ধারী এবং তাঁর ভ্রাতা শকুনি, ভারতকথা মহাভারতে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছেন। কারণ হিসেবে বলা যায়, গান্ধারী ছিলেন কুরু রাজবংশের কুলমহিষী এবং তাঁর ভ্রাতা শকুনি ছিলেন কৌরবদের মাতুল ও রাজা দুর্য্যোধনের মন্ত্রণাদাতা।
আমরা, মহাভারতের পাঠক মাত্রই জানি, প্রচলিত মহাভারতের ব্যাখ্যানুসারে যারাই পান্ডবদের বিপক্ষে, তারাই অধার্মিক, ক্রূঢ় ও শঠ! শকুনিকে তো আগাগোড়া ভিলেন হিসেবেই দেখানো হয়েছে! শকুনি ছিলেন অতি ধূর্ত, কুট, হীন চরিত্রের এখজন মানুষ। তিনি সর্বদাই দুর্য্যোধনকে অন্যায় কর্মে প্ররোচিত করতেন। বিশেষভাবে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে দুর্য্যোধনের কানে সর্বক্ষণই কুমন্ত্রণা দিতেন।
এক্ষণে এই কাহিনীর সময়কাল থেকে আমরা কিছুটা পিছিয়ে যাই। অতীতের কিছু ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হই। ভীষ্ম ও বিচিত্রবীর্যের পিতা রাজা শান্তনু বা তারও আগের আমল থেকে হস্তিনাপুর
ও গান্ধার রাজ্যের মধ্যে বৈরীভাব বিদ্যমান ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহও হতো বটে। ভীষ্ম ও পাণ্ডুর আমলে যুদ্ধে গান্ধার পরাজিত হয় এবং গান্ধারের রাজা সুভালা নিহত হন। সমস্ত রাজপুরুষদিগকে বন্দী
করা হয়। শকুনিও এই সময়ে বন্দী হয়েছিলেন। গান্ধার রাজ্য অধর্মানুযায়ী চলছে এবং রাজাসহ সকলেই অধার্মিক এই অপবাদ দিয়েই গান্ধার রাজ্য অধিকার করা হয়েছিলো। বলা হয়ে থাকে এ
সবই দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার।
বন্দীদশায় শাস্তি মওকুবের জন্য শকুনির পিতা রাজা সুবল হাঁটু গেড়ে পদতলে বসে তাদের ত্রুটি স্বীকার করে নেন এবং হস্তিনাপুরের বশ্যতা স্বীকার করেন।
মহামতি ভীষ্মের প্রস্তাবে (বাহুবলের দাপটে) অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাথে রূপবতী-গুণবতী রাজকন্যা গান্ধারীর বিয়ে হয়। শকুনি তার ভগ্নীর এ বিয়ে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। স্বামীর অন্ধত্বের অছিলায় গান্ধারী যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের চোখ পট্ট বস্ত্রখনণ্ড দ্বারা আবৃত করে নিজেকে অন্ধ স্বামীর অনুগামী হিসেবে মানিয়ে নেন তখন শকুনির ক্ষোভ ও ক্রোধের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়।
অমানবিকভাবে তাদেরকে রাজ্যচ্যুত করা, কারাগারে নিক্ষেপ করা এবং পরবর্তীতে পিতার এই নতজানু হয়ে কৃপা প্রার্থনা করা, সবই শকুনির কাছে বড্ড অপমানকর মনে হয়েছিল।
একজন রাজপুরুষ হিসেবে এই অপমানের প্রতিশোধস্পৃহা থেকে তিনি ভীষ্মের এই দম্ভ চুর্ণ করার অভিপ্রায়ে হস্তিনাপুর রাজবংশের অধপাতের প্রতিজ্ঞা করেন এবং তিনি আর গান্ধারে ফিরে না গিয়ে এখানে থেকেই তাঁর কুটচালের মাধ্যমে হস্তিনাপুরের পতনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। তিনি গান্ধারে ফিরে গিয়ে রাজপুত্রের মতো ভোগবিলাসে জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু আমৃত্যু তিনি ভোগ-বিলাসী জীবন ত্যাগ করে এই লক্ষ্যে অনড় থাকেন।
শকুনি চরিত্র বিশ্লেষণে কেউ কেউ এমনটাও বলেছেন যে, তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ গণিতজ্ঞ। গণিতের প্রবাবিলিটি (গেম থিয়োরি) বিচারে তিনি ছিলেন মহাজ্ঞানী। এই জ্ঞানই তাঁকে দ্যূতক্রিড়ায় বিশেষ পারদর্শী করে তোলে। মহাভারতের পাঠকেরা নিশ্চিতভাবেই জানেন যে, এই দ্যূতক্রিড়া থেকেই পাণ্ডব-কৌরবদের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত এবং এর ফলশ্রুতিতেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আর এসবের পিছনে নিয়ামকের ভুমিকাটি পালন করেছেন সেই শকুনিমামা।
শকুনির প্রতিজ্ঞা ছিল ভীষ্মের দর্প চুর্ণ করা, কুরুকুলের বিনাশ সাধন, তা হোকনা সে কৌরব অথবা পাণ্ডব।
ব্যাখ্যাকারগণের অনেকেই এই মত প্রকাশ করেছেন যে, শকুনি একজন রাজপরিবারের সন্তান। ক্ষমতার দর্পে দর্পিত কোন রাজা দ্বারা অন্যায়ভাবে নিগৃহীত ও অপমানিত হলে একজন ক্ষত্রিয় বীরের ধর্ম হচ্ছে তার প্রতিশোধ নেওয়া, সেই হিসেবে তিনি একজন রাজপুরুষের কর্তব্য পালন করেছেন।
মহাভারতের কোন কোন ব্যাখ্যাকারের মতে পান্ডবদের রাজ্যের দাবীকে অযৌক্তিক বলা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ ধৃতরাস্ট্রের সন্তান হিসাবে হস্তিনাপুর দুর্যোধনেরই প্রাপ্য হয়! যুধিষ্ঠির নিজের ইচ্ছেয়, তার রাজ্য, ধনসম্পত্তি, তার পত্নীকে জুয়ায় বাজি রাখেন, ফলে হেরে গেলে তার জন্য যুধিষ্ঠিরকেই দায়ী করা উচিত। দুর্যোধন তার ক্ষত্রিয় ধর্মই পালন করেছে। কিন্তু, ধর্মযুদ্ধের নামে পান্ডবরা যা কিছু করেছে, তা যুদ্ধের নিয়মে আসলে অধর্ম!
মহাভারতকথায় শকুনিকে যতই শঠ ও হীন চরিত্রের মানুষ হিসেবে দেখানো হোক না কেন, তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা ও কর্মের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন, যা তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তারই পরিচায়ক।
(সংক্ষেপিত)
মন্তব্য
আগ্রহোদ্দীপক একটা বিষয়, পড়ে ভালো লাগলো। লেখায় আরো একটু বিস্তৃতি থাকলে বেশ হতো। সংক্ষেপিত লিখেছেন, লেখাটার বিস্তৃত একটা সংস্করণ আছে কি?
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
বিস্তৃত অংশ বলতে কিছুটা নিচের মন্তব্যে ষষ্ঠ পাণ্ডবের দেয় লিঙ্কটিতে পাবেন এবং এ রকম আর কিছু। সেগুলোকে বাহুল্য বিবেচনায় বর্জন করেছি।
হিমুর এই পোস্টটিতে শকুনি সংক্রান্ত কিছু কথাবার্তা আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ, আপনার দেয় লিঙ্কে হিমুর লেখাটি আবারো পড়বার সুযোগ হলো।
পড়লাম। লিঙ্কটার জন্য ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নিজের জন্য মাস দুয়েক একেবারেই নিজের মতো সময় পেয়েছিলাম। সে সময় ভারতের 'মহাভারত' টিভি সিরিয়ালটা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলাম। তখন থেকেই শকুনি আর দুর্যোধনকে অন্যরকম লাগতে শুরু করেছিল। সেই আগ্রহ থেকেই 'মহাভারত', 'অভাজনের মহাভারত' দুটো বইই কিনেছি কিন্তু পড়তে পারছি না কিছুই। আপনার লেখাটা যথার্থ হয়েছে, ভালো লেগেছে। আরও বিস্তারিত হলে ভালো লাগতো বেশি।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
বড় লেখা এখন আর কেউ পড়তে চায়না, অবশ্য এটি আমার ধারণা। যাহোক, ষষ্ঠ পাণ্ডব এর দেওয়া লিঙ্কে আরও কিছু তথ্য পাবেন। লেখাটাকে সংক্ষিপ্ত করতে শুধুমাত্র চুম্বক অংশটি লিখেছি। অন্যান্য বিষয় বাহুল্য বিবেচনায় বর্জন করেছি। ধন্যবাদ দিদিভাই।
নতুন মন্তব্য করুন