ত্যাগ
রমজান আলীর মনটা একটু খারাপ।
একটু না, ভালই খারাপ।
সিয়াম সাধনার মাসের এমন একটা বিকালে মন খারাপ থাকার কোন কারন নেই।
কথাটা ঠিক নয় – আসলে যথেষ্টই কারন আছে। রমজান আলী চোখে অন্ধকার দেখছে। নিজের মনেই বলে ওঠে – “ব্যাটা ত্যাগের মাস, একটু ধৈর্য্য ধর্।’’
এখনকার মন খারাপের কারন অবশ্য বেশ বড়সড়। আজকে তেল কেনার সময় কিছু সরানোর সুযোগ ছিল না... কুত্তার বাচ্চাটা সাথেই ছিল। একদম শকুনের দৃষ্টি। শালা এত পয়সা দিয়ে করবেটা কি? দশ-বিশ টাকাও ছাড়তে রাজি নয়। টাকা সাথে নিয়ে কি কবরে যাবে নাকি?
ঘড়িতে প্রায় সোয়া চারটা বাজে। যাবার সময় হয়েছে।
অফিসের এ.সি.টা বৃদ্ধ হয়ে গেছে, টাইয়ের নট্ টা ঠিক করতে করতে রমজান সাহেব ভাবলেন, পাল্টাতে হবে – আগের মতন আর ঠান্ডা হয় না। এবার গরমটাও ভাল পড়েছে।
নিচে নামার পরে বোধহয় আলস্য বশঃতই ড্রাইভার রমজান আলীর সালামের জবাবে মাথাও ঝাঁকালেন না। অথবা হয়ত খেয়ালই করেন নি।
গাড়িতে উঠে রমজান সাহেব বললেন “ হেলভেশিয়াতে থামিস তো, ইফতারের জন্য কিছু নিয়ে যাই। ’’
হেলভেশিয়াতে থামার পর রমজান সাহেব “কিছু” কেনাকাটা করলেন। তার ছোট মেয়েটা হেলভেশিয়ার ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকটা খুব পছন্দ করে। এরা দামটা ডাকাতের মত রাখলেও খাবার নেহায়েত খারাপ না।একটু কাবাব, কাচ্চি বিরিয়ানী আর কি কি নেবার পরে বিল হল সাড়ে পাঁচশ’ টাকা। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার দুইটা চকচকা নোট বের করে বিলটা মিটিয়ে দিলেন তিনি।
আজকে রমজান সাহেবের মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। বিরাট একটা দাঁও মারা গেছে।এরকম আর কয়েকটা পেলেই বারিধারায় পছন্দের নতুন বাড়িটা কিনে ফেলা যাবে। এই অ্যাপার্টমেন্ট এ থাকতে আর ভাল লাগে না। এক গাট্টি পয়সা দিয়ে ফ্ল্যাট টা কিনলেও নিজেদের কোন প্রাইভেসি নেই। নিচের ফ্ল্যাটে থাকে এক বদ্ধ মাতাল লোক, মাঝরাতে অসহ্য রকমের চেঁচামেচি করে মাঝে মাঝেই। ধুর্ দেশটার যে কি হচ্ছে, ভাবতেই মেজাজ খিঁচড়ে যায়।
আয়েশ করে বিলাসবহুল গাড়ির গদিতে হেলান দিয়ে রমজান সাহেব ভাবলেন – আবার সামনে ঈদ আসছে। শালার একগাদা পয়সা বের হয়ে যাবে আবার।ইফতার পার্টিগুলোতে যোগ দেবার জন্য বউয়ের লাগবে নতুন কিছু পোশাক, মা মেয়েতে পার্লারে গিয়ে কি কি জানি করবে, তাতেই লাগবে হাজার বিশেক টাকা। টাকা লাগে লাগুক, শখ হয়েছে ওদের, পয়সা দিয়ে কি হবে, কবরে তো আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। ছেলেটা আবার বায়না ধরেছে নতুন মোবাইল ফোন লাগবে। ব্লু টুথ না কি জানি একটা থাকলে আজকাল মোবাইল বন্ধুদের সামনে বেরই করা যায়না। ছেলের পছন্দ আছে মাশাল্লাহ্। সেটের দাম একটু বেশি, ৬৫ হাজার টাকা। অবশ্য ঈদের গিফট বলে কথা। তাছাড়া স্ট্যাটাসেরও তো একটা ব্যাপার আছে।
বাসায় পৌঁছে ড্রাইভারকে বিদায় করে দিলেন রমজান সাহেব। লিফটে উঠতেই কারেন্ট চলে গেল। জেনারেটরের মৃদু গুঞ্জনের নিচেই গলা রেখে কারেন্টের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করলেন রমজান সাহেব।কেউ কান পেতে থাকলে শুনতে পেত- দেশ রসাতলে যাবার ব্যাপারে রমজান সাহেব ভীষণ উদ্বিগ্ন। এই দেশে মানুষ বাস করে! যত্তসব আজাইরা।
রমজান মিয়া গাড়ি রেখে বের হয়ে আসল। বুকটা চিনচিন করছে। তার প্রায় এক সপ্তাহ বেতনের টাকা লোকটা পাঁচ মিনিটে খরচ করে ফেললো। রোজার মাসে একটু খেজুর থাবার মতন সাধ্য তার অবশিষ্ট নেই। কালকে কুত্তার বাচ্চাটা কি জানি একটা বিদেশী খেজুর কিনল চারশ’ টাকা দিয়ে। এদিকে সে মুড়ি খেতেই হিমশিম খাচ্ছে। বড় মেয়েটা সামনের বছর এইচ. এস. সি পরীক্ষা দেবে। তার জন্য একটা খরচ আছে। দেশী মুড়ির কেজি বাষট্টি টাকা। আর ইউরিয়া মেশানো মুড়ির দাম আটত্রিশ টাকা। সে ইউরিয়া মেশানো মুড়িই কিনেছে। ভাতের চেয়েও খরচ বেশী পড়ে যাচ্ছে। কি আর করার, ত্যাগের মাস... সহ্য তো একটু করতেই হবে।
দশ টাকার ছোলা, দশ টাকার বেগুনী আর আধা কেজি জিলাপী কিনে বাসে উঠলো রমজান মিয়া। এই সময়েও বাসে ভীড় একটুও কম নেই। শালার এত্ত মানুষ পয়দা হয় কৈত্থেকে ! লাল বাতিতে বাস থামলে রমজান মিয়া বাইরে তাকালো। দুইটা বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে ফুটপাথে বসে আজকের রোজগার গুনছে। তার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল।
ছোট মেয়েটা এবার ঈদের জন্য আব্দার করেছিল একটা নতুন জামা। রমজান মিয়া ভেবেছিল কোনভাবে সিস্টেম করতে পারলে কিনে দেবে। এখন আর সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
কাল রাতে মেয়েকে কোলে বসিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় উপদেশের সুরে বলেছে- “ মা শোন, রমজান মাস হল ত্যাগের মাস। রোজা রাখাটা বড় ব্যাপার না। বড় ব্যাপার হল ত্যাগ। তোমার মনে যদি খুব পছন্দের কিছু থাকে, এ মাসে সেটা ত্যাগ করতে হয়। এইটাই সোয়াব হয়। তুমি কি পারবা মা তোমার কোন শখ ত্যাগ করতে?”
তার ছোট মেয়েটার থুব বুদ্ধি। সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল বাবা কি বলতে চাইছে। অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল মেয়েটা। বড় বড় ঐ দুই চোখের দিকে তাকিয়ে রমজান মিয়ার ইচ্ছে করছিল নিজের গলা টিপে ধরে। মেয়েটা তবু বাবাকে বিব্রত করেনি। কান্না চেপে মেকি হাসি দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল – “পারব বাবা”।
মেয়েটি কাল কান্না চাপতে পারলেও রমজান মিয়া আজ পারল না। বাসের মধ্যে বসেই তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। সূর্য ডোবার সময় হল এর মধ্যেই। বাস থামলো। সবাই নামলো রোজা ভাঙতে। রমজান আলী আযানের ধ্বণি শুনলো বাসে বসেই, ভেজা চোখে। তার আর নামতে ইচ্ছা করছিল না।
খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে আযানের করূণ ধ্বণির মাঝে তার কানে কানে কেউ বলছে –
“ ব্যাটা ত্যাগের মাস, ধৈর্য্য ধর, একটু ধৈর্য্য ধর”।
মন্তব্য
রমজান মাস ত্যাগের মাস থিমটা ভালো।
কিন্ত ড্রাইভার আর মালিকের নামও রমজান
মাসের নামও রমজান একটু বেশী মনোযোগ আকর্ষনের
চেষ্টা মনে হয়েছে।
আর হ্যালভেশিয়ায় 'কিছু' কেনকাটা টাইপ ব্যাপারগুলো
এতো পয়েন্টিং না হলেও চলতো।
বেশী বলে ফেললাম বোধহয়।
কিছু মনে করবেন না
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
রমজান মাস ত্যাগের মাস থিমটা ভালো।
শেষটাও ভালো লেগেছে খুব
ড্রাইভার আর মালিকের নাম রমজান
আবার মাসের নামও রমজান।
একটু বেশী মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা মনে হয়েছে।
আর হ্যালভেশিয়াতে 'কিছু' বাজার করা ব্যাপারটা
এতো পয়েন্টিং না হলেও চলতো।
বেশী বলে ফেললাম বোধহয়।
কিচু মনে করবেননা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ভালৈছে। কিছু কিছু আরোপিত অনুভূতি বাদ দিলে ভালো।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আরেকটু কাটছাট করলে আরো ভাল লাগত। এমনিতে গল্পের প্লটটা চমৎকার।
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
একমত।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
তুলনাটা ভাল লাগল ।
নিবিড়
গঠনমূলক সমালোচনার জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ ।
I think , therefore i am - Descartes
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
নতুন মন্তব্য করুন