××× বিশুদ্ধ শৈল্পিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিখ্যাত দুষ্টু ছবি থাকার সম্ভাবনা ব্যাপক। সুতরাং ঢোকার আগে সাধু সাবধান।×××
আগেরটা এইখানে।
আগের লেখায় আপাত দর্শণ ও বাস্তবতা নিয়ে কিছু চিত্রের উল্লেখ করতে শুরু করেছিলাম। এইখানে আরেকটা একটু ভিন্ন উদাহরণ দিয়ে চলে যাব পরের বিষয়ে,
ছবিটি বাক্কাসের... না ভাই ফারুকীর ফার্স্ট ডেটের বাক্কাস কোর্সের সাথে কোনো সম্পর্ক নাই। (নাটকটা না দেখে থাকলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করুন। দুই ঘণ্টা বাঁচিয়েছেন।
নাম হল "Bacchus" - ও্য়াইন বা মদের দেবতা।
এই ছবিতে তাইলে ইসপিশাল কি হইলো? ছবিতে একটু সমকামী গন্ধ আছে। কিন্তু সেটা আলোচ্য বিষয় না। মাথার মুকুটটা আঙুর লতার তৈরী। ছবিটা যে বাক্কাসেরই হওয়ার কথা, সে বিষয় স্পষ্ট। কিন্তু একী, তার পোশাক এত ময়লা কেন? মাথার চুলও তো আসল মনে হচ্ছে না (খুব খিয়াল কইরা কাছ থেকে দেখলে), এদিকে মুখে প্রসাধনের পরিমান দেখে তো মনে হচ্ছে কাউকে সাজানো হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে বাক্কাস মনে হলেও বাস্তবে এ কে?
আন্দ্রেয়া পোজোর একটা ছবি হল -The Glorification of St. Ignatius । রোমের এক ক্যাথিড্রালের ছাদে। সাধু ইগনেশিয়াসের স্বর্গারোহনের ছবি। দেখে মনে হবে ঘটনাটা সত্যি নিচ থেকে দেখা হচ্ছে এবং ঘটনাটা আসলেই ঘটছে। কি আশ্চর্য ভ্রম।
ব্যালাসকাজের " The Forge of Vulcan" ছবিটা আগের বার দেবার চেষ্টা করেছিলাম, আসেনি। আবার দিচ্ছি -
ছবি বিশ্লেষণের আগে বিষয়গুলো আবার ঝালিয়ে নেই -
১) সময়
২) স্থান
৩) আলোক এবং
৪) গতির ব্যবহার।
ভালকান হচ্ছে অস্ত্র নির্মাতা। তাঁর অস্ত্রশালায় কাজ করে একচোখা সব দানবের দল - ইংরেজীতে যাকে বলে সাইক্লপ্স। ভালকানের স্ত্রী হচ্ছেন ভেনাস। এই দুষ্টু রমনী নাকি সম্প্রতি মারসের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছেন। এই খবর নিয়ে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন আলোর দেবতা অ্যাপোলো।
ভ্রম এবং অ্যাপিয়ারেন্স ভার্সাস রিয়েলিটি এই ছবিতে তবে কোথায়? দেখুন একচোখা দানবদের সবাইকে কিন্তু দেখে মানুষ মনে হচ্ছে। খুব সাধারণ দৈন্দিন জীবনের একদল কর্মঠ কামার। ভালকানের পাশে তিন কামার- একটু খেয়াল করে গুনে দেখুন তো তাদের কয়টা করে চোখ দৃশ্যমান? মানুষরূপী দানব না দানবরূপী মানুষ?
গতির ব্যবহার ছবিতে স্পষ্ট। গতিকে ধারণ করা হয় ক্রিয়ার মাধ্যমে। বেশিরভাগ ছবিতেই দেখা যাবে কোনো একটা কাজ করার অবস্থায় দৃশ্যটিকে ধারণ করা হয়েছে। যে বিষয়টা রেনেসাঁ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সাধারণত একটা "পোজ" কে বেছে নিয়ে রেনেসাঁ শিল্পীরা ছবি আঁকতেন। বারোক শিল্পীরা এঁকেছেন বাস্তব কর্মব্যস্ততা। সময়ের থেকে একটা মুহূর্তকে (ভাই মুখে ফেনা তুলে মুখস্ত করসিলাম এই বানান, তাও ভুল হলে দু:খিত) তুলে ধরেছেন তারা। ছবির বিষয়দের এমনভাবে তুলে ধরেছেন যেন তাঁরা আর স্বর্গীয় নয়, যেন খুব পরিচিত বাস্তবের মানুষ। বাস্তব কর্মব্যস্ত রক্তমাংসের পরিচিত মানুষজন। পুরাতন সময়কে তাঁরা টেনে বর্তমানের সাথে মিলিয়ে একাকার করে ফেলেছেন।
আলোর ব্যবহারে নতুন বিবর্তন। রেনেসাঁ শিল্পী দ্য ভিঞ্চির দুটো ছবি দেখি - খুব পরিচিত দ্য লাস্ট সাপার -
এবং রাফায়েলের "Deposition of Christ" -
আলোর ব্যবহার লক্ষ্য করুন- কোথাও থেকে আলো আসছে ধরে নিয়ে ছবিগুলো আঁকা। তাই সমগ্র ছবিকেই আলোকিত করে তোলা হয়েছে।
এর সাথে তুলনা করুন উপরের বারোক ছবিটি, বা একই বিষয় নিয়ে আঁকা রুবেন্সের "The Elevation of the Cross"
আলোর একটি স্থির উৎসের অবস্থান ধরে খুব সাবধানে আলোকিত করা হয়েছে ছবির বিষয়দের। আলো-আঁধারির মায়ায় ধরা পড়ছে সময়ের একটি মুহূর্ত। লোকগুলো কেমন মাংসল - অনুভুতিকে নাড়া দিয়ে যায়। রাফায়েলের ছবির তুলনায় অনেক বেশি বাস্তব।
ভার্মিইরের একটা অসাধারণ ছবি "View of Delft" দিয়ে আজকে শেষ করি। বাকিটা কাল্কে দিমুনে।
রং আর আলোর ব্যবহার যত দেখি তত টাষ্কি খাই! পুরা জীবন্ত!
মন্তব্য
আপনার এই সিরিজটি খিয়াল কইরা পড়ছি। তোফা হচ্ছে। চালিয়ে যান। কারাভাজ্জো (Caravaggio) আর ফেরমিয়ার (Vermeer) দুজনেরই আমি বিরাটা পাঙখা। তাই দুটি কথা বলার দুঃসাহস করছি।
বাক্কুস এর ছবিটির মজার ব্যাপারটি হল যে এতে দেখানো সুন্দর গঠনের প্রমোদ বালকের পাশেই রেকাবিরে রাখা কিছু পচে যাওয়া ফল। যেন বলতে চাইছে, যা মজা আজকেই করে নাও, কালকে তো এসব আর থাকবে না। ছবির মডেল মারিও মিনিতি (Minniti)র সাথে কারাভাজ্জোর কি সম্পর্ক ছিল, অথবা কার্ডিনাল দেল-মনতে (Del Monte, পরে পোপ তৃতীয় জুলিয়াস) এর মত পরহেজগার লোক কেন এমন ছবির ফরমায়েস করবেন, এইসব বিশ্লেষন আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আপাতত এটা পড়তে পারেন। মদের কারাফ/বোতলটিতে কারাভাজ্জোর নিজের হালকা একটি প্রতিফলন (এখানে দেখা যাচ্ছে না, তবে ফ্লোরেন্সের উফিজি তে ঝোলানো আসল ছবিটিতে আছে), এটিকে আসল বারোক করে দিয়েছে। সন্দেহ করা হয়, যে এই ছবিটি কামারা অবস্কুরা দিয়ে তৈরী।
ফেরমিয়েরও ছবি আঁকতে লেন্স ব্যবহার করতেন। কামারা অবস্কুরা বা গ্যালিলীয় টেলেস্কোপ কোনটাই তিনি বাদ দেননি। তবে এটাই তো তাকে বারোক করে দিয়েছে। শুধু হাত, আর হৃদয় নয়, শিল্পীর যে মাথাও থাকতে হয়। দেলেফ্ত্ এর এই ছবিটি (ঝোলানো আছে হেগ এর মাওরিত্স্হাউসে) তিনি এঁকেছেন স্খী নদীর এপারের একটি বাসা থেকে, জানালায় টেলিস্কোপ বসিয়ে ঘরের ভেতরে রাখা ক্যানভাসে তার ছায়া ফেলে। তবে ছবিতে তিনি বেছে বেছে নিজের পছন্দের জিনিসগুলি এঁকেছেন। পুরো শহরের সবগুলো মিনার, যেগুলো তার সময় ছিল, তা এই ছবিতে নেই। এদিকটায় যদি আপনার কখনো আসা হয়, তাহলে ঘুরিয়ে আনা যাবে এই জায়গাগুলোয়। নিমন্ত্রন রইল।
আবারও সুন্দর সিরিজের জন্য অভিনন্দন।
অসংখ্য ধন্যবাদ এই অসামান্য পোস্টের জন্য। অনেক কিছু জানলাম। ফলের ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনাদের মতন পাঠক পেয়ে আমি ধন্য। এই রকম দুই একটা পোস্টেই সচলায়তনে আসা সার্থক হয়ে ওঠে।
আবারো কৃতজ্ঞতা।
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
কারাভাজ্জোর অনেক ছবিতেই এই বালকের বিভিন্ন বয়সের চেহারার ছাপ দেখা যায়, এ মূহুর্তে মনে পড়ছে লিউট প্লেয়ার, বয় উইথ এ বাস্কেট অফ ফ্রুট এর নাম।
.................
পোপ তৃতীয় জুলিয়াস (জিওভান্নি দেল মন্তে) এক বালকের সাথে বিছানা শেয়ার করতেন একথা খুব প্রচলিত। তিনি যখন পোপ হন তখন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা সেই বালক সাচ্চি দেল মন্তেকে কার্ডিনালের পদ দিয়েছিলেন। পোপ তৃতীয় জুলিয়াসের তিরোধানের পর সাচ্চি দেল মন্তের সুদিন শেষ হয় এবন তার মৃত্যুর পর কোন শেষকৃত্যও অনুষ্ঠিত হয়নি।
..............
ইতালীয়ান শিল্পচর্চা সবসময় পোপদের আনুকুল্য পেয়েছে এবং ওরা রোম এবং গ্রীক দেব দেবীর ভাস্কর্য তৈরীতেও আনুকুল্য দেখাতেন, এ আনুকুল্য দেখানোর পেছনের কারন কী জানতে ইচ্ছে করে।
...........................
Every Picture Tells a Story
এখানে ঢুকলাম দুবার, আর দুবারই লেখা পড়লাম কিন্তু ছবি দেখতে পারছিনা। হায়রে আমার নেট স্পীড।
কালকে আবার আসবো অফিস থেকে। লিখতে থাকেন।
...........................
Every Picture Tells a Story
এত কষ্ট করে পড়ছেন, অসংখ্য ধন্যবাদ।
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
লেখা দুর্দান্ত আর দুর্দান্তের মন্তব্যও দুর্দান্ত! প্রতিটি ছবি নিয়ে আরেকটু বিশদে লিখলে আরো ভালো লাগতো।
স্থান-কাল-পাত্র নিয়ে যা বলতে চাইছিলাম বোঝাতে পারি নি। আমার বক্তব্য ছিলো এই শিল্পধারা কোন সময়ে ঘটেছে (সালতারিখের একটা রেঞ্জ), কোন দেশে, এবং কারা মূল হোতা, সেই তথ্যগুলো নিয়ে। তবে অবশ্যই নিরস ইতিহাসের তথ্যের চেয়ে বেশি আকর্ষক জিনিস আপনি কাভার করছেন, এবং খুব উপভোগ করছি, তাই আরেকটু বেশি বেশি করে ডিটেইলস চাই, এমনকি ছবির বিষয় ও গল্প নিয়েও। আপনি লিখুন, আমরা রসিয়ে রসিয়ে পড়ি।
প্রতিটি ছবি নিয়ে আরেকটু বিষদে লিখতে পারলে আমারও ভালো লাগতো , কিন্তু লিখতে বসেছি তো সীমিত জ্ঞান নিয়ে , দুর্দান্তের মতন আরও দুয়েকটা এমন পোস্ট আসলেই কিন্তু আমার সে ব্যর্থতা একটু হলেও ঘুচবে।
আর স্থান কাল পাত্রের ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি ঠিক, দু:খিত। প্রথম ভূমিকায় হালকা ভাবে বলেছিলাম কিছু
বারোক শিল্প-সাহিত্যের স্থায়িত্বকাল মোটামুটি ১৬০০-১৮০০ সাল পর্যন্ত। মূল হোতা ইয়োরপীয়রা, ইতালি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, স্পেনে ব্যাপক কদর ছিল। পয়সা পাতির দিকটায় কাথলিক চার্চের একটা বিশাল ভূমিকা আছে।
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
নতুন মন্তব্য করুন