শুক্রবার না হলেও সেদিন স্কুল ছুটি ছিল, এটুকু মনে আছে। ছুটিটা কীসের তা অনেক চেষ্টা করেও আজ আর মনে করতে পারছি না। স্মৃতির পর্দায় সময়ের ধুলো জমেছে ঢের। বর্ষাকাল হলেও সকালটা ছিল বেশ স্বচ্ছ। টানা বৃষ্টিতে ঢাকাবাসীর যার পর নাই কষ্ট হয়, তার উপর আমাদের মত যারা শান্তিনগরের ধারেকাছে থাকতাম, তাদের দূর্ভোগের কথা অন্যেরা বুঝবে কেমন করে?
শুক্রবার না হলেও সেদিন স্কুল ছুটি ছিল, এটুকু মনে আছে। ছুটিটা কীসের তা অনেক চেষ্টা করেও আজ আর মনে করতে পারছি না। স্মৃতির পর্দায় সময়ের ধুলো জমেছে ঢের। বর্ষাকাল হলেও সকালটা ছিল বেশ স্বচ্ছ। টানা বৃষ্টিতে ঢাকাবাসীর যার পর নাই কষ্ট হয়, তার উপর আমাদের মত যারা শান্তিনগরের ধারেকাছে থাকতাম, তাদের দূর্ভোগের কথা অন্যেরা বুঝবে কেমন করে? ঢাকাবাসীর জন্যে বর্ষাকালে স্বচ্ছ রোদেলা একটি দিন তাই দারুণ একটি প্রাপ্তি।
তবে বিধিবাম; বলা নেই কওয়া নেই, দুপুর বারোটা নাগাদ কোনোরকম আগমনী বার্তা ছাড়াই মনিপুরী নয়, কত্থকও নয় একেবারে প্রলয়নাচনে মেতে উঠলো আকাশ ভাঙ্গা জল। বিদ্যূত চমকানো বা বাজ পড়ার দামামা-দুন্দুভি না বাজিয়েই শুরু হয়ে গেল কুরু-পান্ডব যুদ্ধ। ঢাকাবাসীর বাড়া ভাতে ছাই পড়লেও আমার তখন যে বয়েস তাতে এমন অকস্মাত বৃষ্টি অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত, অর্থাৎ আমার বিধি ডান।
কাউকে কিছু জানাতে হলো না, ডাকতে হলো না; হাফপ্যান্ট পরে আর ফুটবল নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। ঝুম বৃষ্টিতে ফুটবল খেলার মজাই আলাদা। সম-অসম বয়েসী কলোনীর অনেক ছেলেরাই চলে এলো মাঠে। কোনো দলবল নেই, যার পায়ে বল সে’ই ছুটছে গোল করতে আর বাকীরা তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিচ্ছে কাদাজলে। এমনদিন আমাদের কলোনী পাড়ার জীবনে অসংখ্যবার এসেছে, তবু ঐ বিশেষ দিনটি অনেক মৃয়মান নক্ষত্রের মাঝে যেন লুব্ধক হয়ে জ্বলে। সেদিন ঘটেছিল জীবনে প্রথমবারের মত ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা।
মাত্র আধঘন্টা খেলাতেই বেশ কয়েকজন হাপিয়ে উঠলো। ছেটেছুটে মাঠে তখন আমরা এগারোজন। ছ’জন ছ’জন দু’দলে ভাগ হয়ে যাবো তার উপায় নেই। একজন কম পড়ছে। বারো-তেরো বছরের ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের একটি ছেলে এসে বললো- "হামাক লিবি?" ছেলেটিকে প্রায়ই দেখি, কলোনীর বাইরের ফুটপাতে ঘুমায়। পরণে সহস্রছিন্ন একটি লুঙ্গি, শরীরে কাপড় বলতে অতটুকুই, বুকের হাড়গুলো চেয়ে থাকে, তবে পেটটি ঢোলের মত ফোলা। বললাম- "কি নাম তোর?" - "হোসেন।" সে যাত্রা হোসেনকে দিয়ে শূণ্যস্থান পূরণ হলো না। আমাদের অর্থাৎ মধ্যবিত্তদের নাক কখনো কখনো অত্যধিক উঁচু। ফুটপাতের এক ভিখিরি ছেলে আমাদের সঙ্গে খেললে আমাদের জাত থাকে কোথায়! আমরা দু’একজন তাও শুধুমাত্র খেলার খাতিরে নিমরাজি থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হলো। একদলে পাঁচ অন্যদলে ছয় এভাবে খেলা চললো আরো প্রায় আধঘন্টা। ফলাফল গোলশূণ্য ড্র। এত ছুটোছুটি করেও কেউই গোলের দেখা পেলাম না, যা কিছু প্রাপ্তি তা নির্মল আনন্দ আর সর্বাঙ্গময় কাদা।
খেলা শেষে আড্ডা চললো খানিকটা। আমার বন্ধু তৈমুরের বাবা পুলিশের বড় অফিসার। বাবা থানায়, সেই সুযোগে তৈমুর বাসা থেকে লুকিয়ে নিয়ে এলো বাবার শৌখিন পাইপখানা, সঙ্গে সুগন্ধী তামাকের গুড়ো। সে’ই আমাদের ধুমপানের প্রথম দীক্ষা, তাও আবার সাহেবী ঢঙে- প্রথমেই পাইপ। তখন আমরা দশম শ্রেণীর ছাত্র। কাশির দমকে তামাকের ধক ব্রমহোতালু স্পর্শ করলো একেকজনের; প্রথম তো! এরপর যা ঘটলো সেটাও প্রথম।
বাসায় ফেরার সময় দেখি সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে আছে মিনু। অন্ধকার আকাশে বিদ্যূত রেখার মত। মিনু আমাদের কলোনীর সবচেয়ে সুন্দরী, অন্তত আমার চোখে। বাইরে তখনো বৃষ্টির তালে মৃদু ঝংকার। আমার হাতে একটা বৃন্তসমেত কদমফুল আর গালে একটা বেদম চিমটি কেটে দৌড়ে পালালো মিনু। আমার তখন ষোল, মিনুর চোদ্দ-পনেরো হবে। কোনো মেয়ের হাত থেকে সে’ই আমার প্রথম ফুল পাওয়া, কোনো মেয়ের কাছ থেকে সে’ই আমার প্রথম চিমটি খাওয়া। মা-বোন-খালা-কাকীরা অবশ্য এই ’কোনো মেয়ে’-র দলে পড়ে না।
নোংরা কাদা নিয়ে ঘরে ঢোকার কারণে প্রথমে মা’র হাতে দুটো চড় আর তিনটে কিল খেলাম। এরপর গোসল সেরে মা’র হাতের ভূবনবিজয়ী খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা গিললাম। বৃষ্টি কমছে, বাড়ছে তবে থামবার কোনো লক্ষন নেই। কলোনীর মাঠে ও রাস্তায় এরই মাঝে গোড়ালি অবধি পানি জমে গেছে। ঘরের জানলা থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। কদমফুলটি নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকার মত ভাবুক মনটা ঐ বয়েসে তখনো গড়ে ওঠেনি। বারবার জানলায় উঁকি দিয়ে দেখছি পানি কতটা বাড়লো।
অনেকগুলো দৃশ্যের মাঝে একটি অতিসাধারণ দৃশ্য আমার দৃষ্টিকে সম্মোহনের যাদুতে আটকে ফেললো। হোসেন, মানে সেই ছেলেটি যে আমাদের সঙ্গে খেলতে চেয়েছিল, বলেছিল- "হামাক লিবি?" সেই হোসেন এবং সঙ্গে সম্ভবত ওর মা ও বাবা ফুটপাতের নরদমার পাশে একটি বড় কচু-পাতার নীচে গুটিসুটি মেরে বসে আছে; কাকভেজা ভিজছে তিনটি মানুষ, আমার মতই মানুষ। আমি তখনো ইল্শে ঢেক তুলছি, ওদের বুঝি তখনো খাওয়া হয়ে ওঠেনি; আমার মাথার উপরে ছাদ, পায়ের তলায় মেঝে, ওদের উপরে-তলে জল আর জল; আজ ওরা ঘুমোবে কোথায়? গৃহহীন শব্দের অর্থ সেদিনই আমি প্রথম বুঝেছিলাম। সেই থেকে আমার বুকে বর্শার ফলার মত বিধে আছে হোসেনের কন্ঠনিঃসৃত দুটো শব্দ- "হামাক লিবি?"
এখন আমি মধ্য-ত্রিশ, প্রবাসী। যে দেশটায় থাকি তার বৃষ্টির ধারা ভদ্রগোছের। রাস্তাঘাটে কখনো জল জমে না। তবু বৃষ্টি হলেই আমার কৈশরের সেই দিনটির কথা খুব মনে পড়ে। না, মিনুর দেয়া বাদল দিনের প্রথম কদমফুল নয়, পুলিশ অফিসারের শৌখিন পাইপখানাও নয়; আমার কানে শুধু বাজে ঐ ধ্বণিটুকু- ’হামাক লিবি’?
আমরা বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজি শখে আর ওরা বাধ্য হয়ে। সেদিন আমরা ওকে খেলায় নিইনি, আজও কেউ নেয়না, আমাদের সমাজে ওদের ঠাই হয়না। ওরা নরদমার পাশে অনাদরে টিকে থাকা কচুপাতার মতই। মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গের কোনো ডানপিটে ছেলে ছিল হয়তোবা হোসেন। অভাব আর সর্বগ্রাসী খিদে ওদের তাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল ঢাকা শহরের ফুটপাতে। এখনও প্রতিদিন শত-সহস্র হোসেন শুধুমাত্র দুমুঠো ভাতের আশায় নোঙর ভিড়াচ্ছে তিলোত্তমা ঢাকা শহরে আর শহরবাসী ভদ্রলোকদের কাছে তাদের আকুল আর্তি- ’হামাক লিবি’?
বর্তমানে গোটা বিশ্বে ওরা একটা গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট, ওদের নাম- ’ক্লাইমেট রিফিউজি’; ওদের ভারে শহরবাসীরা ন্যুজ, তবু ওরা আসছে, বাধ্য হয়ে আসছে, অভাব ওদের তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। ঢাকা শহরের আকাশে নিত্য ধ্বণিত হচ্ছে- ’হামাক লিবি’? ’হামাক লিবি’? আমরা কি করে নেবো ওদের? আমি কখনই রবীন্দ্রনাথের মত রোমান্টিক হতে পারিনি, নইলে বৃষ্টি হলে মিনুর কথা যদিওবা মনে পড়ে কিন্তু তা আমাকে ততটা ভাবায় না কেন? কেন আমার ভাবনার পালে হাওয়া লাগায় রুগ্ন-শীর্ণ এক ক্লাইমেট রিফিউজি- হোসেন?
--- ঈয়াসীন
মন্তব্য
সচলে স্বাগতম দীপু ভাই !
লিখে যান হাত খুলে
facebook
ভালো লাগল।
আচ্ছা, মিনু আপা কই এখন????
ভালো থাকবেন।
ভালো লাগল।
আচ্ছা, মিনু আপা কই এখন????
ভালো থাকবেন।
মিনু আপা (সত্যি নামটা সাহস করে দিতে পারলাম না) এখন অন্য কোনো পরগনায়। যে বৃষ্টিতে আমি ভিজি সে বৃষ্টির জল তাকে আর ভেজায় না। ধন্যবাদ পড়বার এবং মন্তব্য প্রদানের জন্য।
"যে বৃষ্টিতে আমি ভিজি সে বৃষ্টির জল তাকে আর ভেজায় না।"
অসাধারণ একটা লাইন।
জটিল
facebook
"যে বৃষ্টিতে আমি ভিজি সে বৃষ্টির জল তাকে আর ভেজায় না।"
লাইনটির তুলনা হয় না.....
যান, আপনাকে লিয়ে লিলাম।
সচলে স্বাগতম।
শুরু তো ভালই হলো, এখন চালিয়ে যান।
হোসেনরা কি আসলেই ক্লাইমেট রিফিউজি?
লেখা ভাল লেগেছে। সচলে স্বাগতম।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
লেখা ভালো লেগেছে। সচলে স্বাগতম (কে কারে স্বাগতম জানায় )।
খুব সুন্দর।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
সচলে স্বাগতম
লিখে যান প্রাণ খুলে
লেখা ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সবাই তো সবকিছু বলেই দিয়েছে, তবু ও আবার ও বলি লেখা বেশ হয়েছে। তবে আপনি মেলা আনরোমান্টীক, একটা মেয়ে আপ্নারে কদঁমফুল দিলো আর আপনার কোন অনুভূতিই নাই ।
লেখা ভাল লাগলো। সচলে স্বাগতম।
কলোনীতে থাকাকালে কলোনীর মাঠের আরেক প্রান্তে তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কোয়ার্টার ছিলো। আমরা ছেলেরা খেলার সময়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতাম। তাদের অবস্থা হয়ত হোসেনের চেয়ে ভালো ছিল - এখন সেইসব বন্ধুরা কে কোথায় কিভাবে আছে কিছুই জানিনা ঃ(
আসলেই চমৎকার একটি লেখা। এই 'হামাক লিবি'- কথাটা মনে দাগ কেটে যায়।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সমস্যার জন্যে ক্লাইমেট চেঞ্জের তুলনায় আমরা মানুষেরা অনেক বেশী দায়ী। যুগ যুগ ধরে পানিসম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার বা অপব্যবহারের ফলে সেখানে আজ খরার প্রকোপ। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে লক্ষ লক্ষ হোসেনের জন্ম ঘটবে, এই দায় আমাদেরই।
এখানে ক্লাইমেট রিফিউজি থেকে ক্লাইমেট মাইগ্র্যান্ট কথাটা মনে হয় বেশিমাত্রায় সঠিক।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
লেখাটা পড়ে কিছুক্ষন থম মেরে বসে থাকলাম। 'হামাক লিবি' ধ্বনি অনুরনিত হচ্ছিল চারপাশে। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম রুগ্ন-শীর্ণ, ঘোর কৃষ্ণবর্ণের একটি ছেলেকে যে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতির পাতা থেকে বের হয়ে কঠোর ঝাঁকুনি দিয়ে গেল আমাদের নাগরিক শৌর্য-বীর্য-দম্ভকে, খুলে ফেলল সুবিধাবাদী শ্রেনী চেতনার মুখোস! এমনই আপনার ভাষা আর বর্ণনাভঙ্গি!
নাগরিক নগ্নতা নিখুঁতভাবে উন্মোচিত হয়েছে নীচের লাইনগুলোতেঃ
অসাধারণ আপনার মন্তব্য।
ঈয়াসীন
সবাইকে ধন্যবাদ এমন উৎসাহ জনক মন্তব্য প্রদানের জন্য।
ঈয়াসীন
ভালো লাগল, বিবেককে নাড়া দিয়ে গেল।
সুন্দর একটা লেখা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সচলে এটি আমার প্রথম লেখা। দেখতে দেখতে চার বছর পেরিয়ে গেল। ধন্যবাদ আপনাকে
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
এই চাবুক-এর মত গল্প নিয়ে আপনি সচলে এসেছিলেন, আপনাকে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন