সুনীল

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/১১/২০১২ - ৬:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুদ্ধিটা একটু পক্ক হতেই মনের মাঝে এক ঝাক না হলেও গুটিকয় স্বপ্ন এসে ঘর বেঁধেছিল। সময় গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে রঙ এবং ধরনও পালটাচ্ছিলো তাদের। স্বপ্নগুলোর ধাঁচ খানিকটা অন্যধারার। না, বাগান সমেত বাংলো বাড়ী, ঝকঝকে ফেরারী, নিতম্ব কিবা বক্ষ প্রধানা নারী; এমন সাধারন স্বপ্নে কখনই বিভোর ছিলাম না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, মাস্টার এমনকি রোদ্দুর হতেও মন চায়নি কখনো।

প্রধান চারটি স্বপ্নের মধ্যে দুটো কোনো ভাবেই সার্থক হবার নয়। একটি মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে কোনো পাকিস্তানি সেনাকে পায়ের নীচে চেপে ধরে গুলি করার ঠিক আগ মুহূর্তে নির্ঘাত মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে ‘মানুষ’ শব্দটির অর্থ শেখানো আর দ্বিতীয়টি ইতিহাসের বিস্ময়পুত্র রবিঠাকুরের চরনের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা।

মানুসের জন্ম আকস্মিক, আমরা সকলেই আকস্মিকতার ফসল আর আমার ক্ষেত্রে আকস্মিক সেই ক্ষণটি এসেছিল মুক্তিযুদ্ধেরও পরে, যে বছর দেশ জুরে ঘোর দুর্ভিক্ষ। আমি ছিলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আমার মা কে সদা ধর্ম পালনে মগ্ন দেখেছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও তাহাজ্জত, যত ধরনের নফল, রোজা কোনো কিছুই বাদ যেত না। মায়ের ইচ্ছে ছিল হজে যাবার, তখন সঙ্গতি ছিল না। আমার স্বপ্ন ছিল মায়ের সেই ইচ্ছেটি একদিন পুরন করবার। সেও হয়ে ওঠেনি; সঙ্গতি হতে না হতেই মা ওপারে চলে গেলেন। রইলো বাকী এক, আর এ স্বপ্নটি সাম্প্রতিক। বছর পাঁচেক আগের।

একটানা সুনীল, নীললোহিত গিলতে গিলতে কখন যেন লেখকটিকে নিজের অজান্তেই বুকের খুব কাছের করে নিয়েছি। তাঁর লেখায় দেশ ভ্রমনের নেশা স্পষ্ট। আর আমি এমন এক দেশে থাকি যে দেশে এখনও আসা হয়ে ওঠেনি। নতুন দেশে তাঁর আগ্রহ থাকবে নিশ্চয়ই, আর তাছাড়া কাউকে আমন্ত্রন জানিয়ে সপ্তাহ দু’তিন আতিথ্য প্রদানের একটা সঙ্গতি এখন আমাতে আছে বৈকি। পরিকল্পনা হলো, চিঠিও পাঠানো হলো। চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছুল কিনা জানিনা; জবাব এলো না। কি করা যায়, যোগাযোগের সেতুটা কি করে গড়া যায়? হঠাৎ অন্ধকার আকাশে আলোর ঝলকানির মত একটা পথ পেয়ে গেলাম। ২০১০ সালের নভেম্বরে দেশে গিয়েছিলাম বেড়াতে। গিয়েই বন্ধু শ্যামলকে ধরলাম ওর বড়মামার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবার জন্যে। ওর মামা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্যতম কাছের বন্ধু কবি বেলাল চৌধুরী। দেখা হলো, উদ্দেশ্যও জানালাম। কবি বেলাল চৌধুরী বেশ আশার আলো দেখালেন; বললেন, দাদা(সুনীল) কখনো ফিনল্যান্ড যায়নি, তবে দেশটির প্রতি তাঁর আগ্রহ আছে। দু’এক বার সে সম্পর্কে আলাপও করেছেন। সহস্র হ্রদের দেশটির কথা শুনলে দাদা এক অথবা বিনা বাক্যে রাজী হবেন। এমন আশ্বাস নিয়ে ফিনল্যান্ড এ ফিরে এলাম। এরপর কেন জানি আর সময় হয়ে ওঠেনি, গত দু গ্রীস্মেই পরিকল্পনা করতে করতেও তাঁকে আর আনা হলো না।

সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবে নেট খুলেছি। এক বন্ধুর ফেসবুক স্ট্যাটাস এ দেখলাম সুনীল আর নেই। কি জানি কি হলো, বুকটা কেমন জানি খালি খালি হয়ে গেল। পরিচিত কারো মৃত্যুতে কষ্ট হয়, আর নিজ পরিবারের কাউকে যখন হারাই তখন বুকটা খা খা করে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রয়াণে বুকটা খা খা করছিল। অথচ মানুষটিকে কখনো দেখিনি। লেখক পাঠকের সম্পর্কটা-এতটাই আত্মিক! সুনীল কি আমার এতটাই কাছের! চোখে জল এলো না, তবু বুকের ভেতরে বিষণ্ণ কে যেন অনিবার কেঁদেই চললো। আমার চতুর্থ স্বপ্নটাও খাঁচা ভাঙ্গা পাখির মত উড়ে চলে গেল।

অন্যান্য দিনের মতই যন্ত্রের ন্যায় কাটলো সারাটি দিন। রাতে ঘরে ফিরে সেলফ থেকে সুনীলের যে কটা বই ছিল (গল্প, কবিতা, উপন্যাস মিলে গোটা বিশেক হবে), ছড়িয়ে নিয়ে বসলাম কার্পেটের প’রে। বৌ ঘুমিয়ে পরেছে পাশের ঘরে। একটা কবিতার বই নিয়ে নীচু স্বরে পড়া শুরু করলাম। খানিকবাদে আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারালাম। কখন কোন বইটি হাতে তুলে নিচ্ছি, কোন পাতা খুলে কি পড়ে যাচ্ছি, স্বর সপ্তম ছাড়িয়ে কোন অসীম উচ্চে ধেয়ে উঠছে, আমি জানিনা; আমার সম্মুখে ক্রম প্রতিস্থাপিত সেলুলয়েডের মতন দৃশ্য পাল্টাচ্ছে। নিজেকে দেখতে পাচ্ছি ভিন্ন ভিন্ন রূপে।

আমি যেন কখনো সঙ্কল্পে অটল সূর্য, যেন এই মুহূর্তে বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া প্রবাসী অতীন আবার কখনো অলির কাল্পনিক পুরুষ শৌনক যে কখনো ছেড়ে যাবে না অলির মত একটি ভাল মেয়েকে, আমি যেন রহস্যময় দাম্ভিক তরুন নবীনকুমার, কখনো আমি দীর্ঘ পথের ক্লান্তি শেষে দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে থাকা ভরত যার হাতের মাঝে ভুমিসুতার হাত- নীড়ের সন্ধান। আমার শরীর অনবরত কাঁপছে, আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না। মাথাটা যেন সাত আসমান ঘুরে ঘুরে আসছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চৌধুরী বাড়ীর অনুল্লঙ্ঘ্য লৌহকপাট, যার ওপারে ফর্সা রমনী, লাঠি লজেন্স, সুবর্ণ চুড়ি। পর্বতচূড়ায় দণ্ডায়মান আমি দশদিককে উদ্দেশ্য করে বলছি- পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ অহংকারী। অবশেষে সব কিছু ছাপিয়ে আমি যেন স্বয়ং সুনীল; আমার হাতের তালু ছিঁড়ে যাচ্ছে ধারাল ধানের পাতায়, আমার সম্মুখে মাইজপাড়া, আমগাঁয়ের সবুজ ক্যানভাস। সরস্বতী পুজোর রাতে প্যান্ডেলের নীচে দেবীর সমুখে আমি একা; আমার তরুন উৎসুকী ঠোট ছুঁয়ে গেল দেবীর রক্তিম ওষ্ঠাধর, আমার নিয়ন্ত্রনহীন করতলে দেবীর স্তন, আমার প্রথম চুম্বন। ততক্ষণে বৌ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে এলো। আমি তাঁকে জরিয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে বললাম, বৈষ্ণবী এত দিনে তোমার অন্তরাটুকু শোনাতে এলে? নাদের আলীর মিথ্যে আশ্বাসে পদ্মফুলের মাথার প’রে সাপ আর ভ্রমরের যুগল ক্রীড়া আর দেখা হল না। বৌ সবটা বুঝে আমায় ঘুমুতে নিয়ে গেল।

পরদিন সকালে আমি বিস্মৃতপ্রায়, বৌ এর কাছে আগের রাতের ঘটনা শুনে অবাক হলাম; অনেকক্ষণ ধরেই সে আমার এলোমেলো অবস্থা অবলোকন করছিল।

লেখনীর এত শক্তি! লেখক-পাঠকের সম্পর্ক বুঝি কখনো কখনো রক্ত সম্পর্ককেও ছাড়িয়ে যায়!

ভারাক্রান্ত মন শান্ত হতে সময় লাগলো না। কেননা কিছু কিছু মানুষের শুধু জন্ম আছে, মৃত্যু নেই। দুর্বল দেবতাদের মত অমৃতের সন্ধানে তাদের সাগর মন্থন করতে হয় না; অমৃত নিজে এসে তাদের চরনে মাথা কুটে।

সুনীল তেমনি একজন চিরজীবি মানুষ।

......ঈয়াসীন

সচলায়তনের আগে প্রকাশিত লেখাঃ হামাক লিবি


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

কেননা কিছু কিছু মানুষের শুধু জন্ম আছে, মৃত্যু নেই। দুর্বল দেবতাদের মত অমৃতের সন্ধানে তাদের সাগর মন্থন করতে হয় না; অমৃত নিজে এসে তাদের চরনে মাথা কুটে। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা এলোমেলো হলো বোধহয়। গোছানোর কথা ছিল, গোছানো হলো না।
ঈয়াসীন

তারেক অণু এর ছবি

লিখতে থাকেন হাত খুলে, গোছানো এমনিতেই হয়ে যাবে

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হ্যাঁ, নিয়মিত লিখুন।

পদব্রজী এর ছবি

আমার কি চলে গেছে সুনীলদার মৃত্যুতে সেটা কাউকে বলবার নয়, অনেক বিশিষ্টদের প্রয়ানে কথা বলেছি তাদের নিয়ে, কিন্তু সুনীলের প্রয়ানে শুধুই শূণ্যতা---- আপনার লেখায় আমার সেই আবেগটাকে দেখতে পেলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
ঈয়াসীন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।