ঐ আসে ঐ

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৫/২০১৩ - ১:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলার পল্লী গাঁয়ে সিঁদেল চোরদের নাম বেশ শোনা যায়। রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সিঁদকাটি (এক ধরনের ছোট শাবল বিশেষ) দিয়ে মাটি কেটে গর্ত করে ঘরে ঢুকে সব সাবার করে দেয় এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ঘরের মানুষজন কেউ কিছুই টের পায় না। এ এক কঠিন শিল্প বটে! গাঁয়ে আবার মাঝে মাঝে ডাকাতও পড়ে। কখনো হারেরেরেরেরে বলে একদল সসস্ত্র ডাকাত হুরমুরিয়ে গাঁয়ে ঢুকে কুপিয়ে, গুলি চালিয়ে বাড়ীর পর বাড়ী লুঠ করে নিয়ে যায়; আবার কখনো বলে কয়ে চিঠি পাঠিয়ে কোনো সম্পন্ন গেরস্ত বাড়ীতে ডাকাতি করবার মাঝেও একটা দাম্ভিক আর্ট রয়েছে বৈকি। চোর কিংবা ডাকাত যে ঘরানারই হোক, তাদের শিল্প উঁচুনিচু যে দরেরই হোক, আর তাদের কর্ম পদ্ধতি যে বৈশিষ্টেরই হোক না কেন; উদ্দেশ্যতো একটাই- আপনাকে আমাকে সর্বস্বান্ত করা। তা হ্যাঁ, শুরুতে যে এই শিল্পীদের আগমনের ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল এর উপর আলোকপাত করছিলাম, সে বিষয়ে আরেকবার আসা যাক। কেউ মাটি কেটে সুরঙ্গ তৈরী করে আসে, কেই জানালার শিক কেটে ঘরে ঢোকে, কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসে, জলপ্রধান অঞ্চলে কেউবা নৌকা নিয়ে; ফলাফল একটাই- গ্রামবাসী তার সর্বস্ব হারায়, এমনকি গাঁয়ের মোড়ল, ব্যাপারীরা কিয়ৎ বেশীই হারায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই গাঁয়ে চোর-ডাকাতের আগমন মোড়ল ব্যাপারী আর সাধারণ- কারুর জন্যেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

এবার আমাদের গাঁয়ে একদল ডাকাত আসি আসি করছে, বলে কয়েই। এদের আগমনের স্টাইলটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অভিনব। এরা দিনকয়েক বাদে বাদে গাঁয়ে এসে ঢুঁ মেরে যায়, ডাকাতির খসড়া রচনা করতে। এরা কখনো পদাতিক, কখনো হাজার খানেক চার চাকার যন্ত্রচালিত রথ ভাড়া করে, কখনো পকেটে লাল-হলুদ কার্ড নিয়ে রেফারীর বেশে আসে, কখনোবা আসে উড়ন্ত রথে চড়ে। এই ডাকাত বাহিনির অভিনবত্বের সবচেয়ে উল্লেখ্য দিকটি হচ্ছে এদের রথের সারথি স্বয়ং আমাদের গাঁয়ের মোড়ল ব্যাপারীরা। দূরদূরান্ত থেকে আসা এইসব লুটেরাদের পথক্লান্তি নিবারনার্থে পথে পথে জলখাবারের ব্যাবস্থা থাকে, ব্যায়বহুল যাতায়াতে অর্থের যোগান থাকে। অমোঘ ক্ষতির সম্ভাবনা স্বত্বেও এই দস্যুদলের প্রতি গ্রাম প্রধান, গ্রাম রক্ষাবাহিনী আর পঞ্চায়েতের ঔদাসীন্যও থাকে। মোড়ল ব্যাপারী আর গ্রাম প্রধানেরা পারস্পরিক বিদ্বেষের কারণে যে যার স্বার্থ রক্ষায় নিজেদেরকে বিকিয়ে দিয়েছে এই লুটেরাদের চরণে, কেননা তাদের সম্পদ বা সম্পত্তি লুণ্ঠনে এদের রুচি নেই; এই ডাকুদের মূল টার্গেট আমরা অর্থাৎ সাধারণ গ্রামবাসী।

এই ডাকাতবাহিনী সশস্ত্র এবং সাঙ্ঘাতিক। এদের অস্ত্র একটিই এবং সেটিই ব্রহ্মাস্ত্র, যার নাম- ধর্ম। এরা গ্রামে এলে হয়তো আপাত দৃষ্টিতে আমাদের বৈষয়িক ধন সম্পদ হারাবার ভয় নেই, হয়তো গনিমতের মালের আওতায় পড়বে না আমাদের মা-বোনেরা; এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। এরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে চায় আমার আত্মার শুদ্ধতা, আমার সংস্কৃতি, আমার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আমার ঐতিহ্য, আমার স্বাধীনতা। এ কেমন ডাকাত গো বাবা! আমার আত্মার অর্ঘে নাকি এরা পেটের পূজা সারে!

এই ধর্মের ধ্বজাধারী দস্যুদলটি যদি শেষমেশ আমাদের এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা গ্রামটিতে এসেই পড়ে, তবে আমরা কি আমাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান- সবই হারাবো? না, তার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। তবে, সর্বস্ব হারানোর ভয়টা কি অমূলক? আমি ক্ষুদ্র গ্রামবাসী, আমার জ্ঞানের পরিধি আর কতটুকুই বা? কি হলে কি হবে, কি না হলে কি হবে না, ততটা পর্যবেক্ষণ শক্তি কি আর আমাতে আছে? আমি শুধু জানি এই ডাকাতেরা হরণ করবে আমার কণ্ঠ, আমার রুচি, আমার মুক্ত পদচারনা। এই যে আমাদের এই ছোট্ট গাঁয়ে কাঁসর ঘণ্টা আর মাগরিবের আযান পাশাপাশি স্নিগ্ধতা ছড়ায় সেই স্নিগ্ধতা কেড়ে নেবে ওরা, ওরা আমায় গাইতে দেবে না আমার পছন্দের সুর। আমার পোষাকে, আমার চুলের সিঁথিতে, আমার শ্মশ্রুতে, আমার গোঁফে, আমার পাজামার মাপে, আমার পাঠ্যপুস্তকে পড়বে ওদের খবরদারির থাবা। আমার পাশের বাড়ীর মেয়েটি- জমিলা; ওর পোষা ছাগল ছানাটি আমাদের উঠোনে দৌড়ে এলে, ফিরিয়ে নেবার সময় চকিতে যে আমার দিকে চেয়ে ফিক করে অযথাই হেসে ওঠে, সেই কোটি টাকার হাসি আর আমি দেখতে পাবো না। মাধব কাকার মেয়ে সন্ধ্যাদি কি সকাল হলে পাড়ার ছেলেমেয়ে গুলোকে এক করে দেবদারু গাছটির তলায় বসে আর গাইতে পারবে- “আয় তব সহচরী, হাতে হাত ধরি ধরি”; আমি দুর্গা পূজায় নাড়ু খেতে পারবো না, আমার সহপাঠী অরুণ ঈদের দিন আমাদের বাড়ী এসে পায়েস খেতে পারবে না। ক্লাসঘরের পাশের বেঞ্চিতে কুসুম, আমিনা, মালতী, অনামিকা বড়ুয়াদের আর দেখতে পাবো না কখনো। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে না থাকলেও শহর থেকে আসা সরোয়ার স্যার ক্লাসে আমাদের বিবর্তনের ধারা বোঝান, এই বন্ধুপ্রতিম স্যারটিকে আমরা বুঝি আর পাবো না। আমাদের গাঁয়ের খালেক ভাই পত্রিকায় কি যেন সব লেখালেখি করেন, জিজ্ঞেস করলে বলেন- মুক্তচিন্তা; খালেক ভাই বলেছে ডাকাতরা তার কলম কেড়ে নেবে, তাকে আর লিখতে দেয়া হবে না। আমাদের কলেজ মাঠের মুক্তিযোদ্ধার আদলে গড়া ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফেলা হবে, বাজারের মোড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নীচে ছোট্ট শহীদ মিনারটিও ভেঙ্গে ফেলা হবে। পূর্ণিমার রাতে আমরা বন্ধুরা ঘাসের বিছানায় শুয়ে চাঁদ দেখি, সেথায় মাঝে মাঝে আমি জমিলার মুখশ্রী ভেসে উঠতে দেখি; জমিলা, হ্যা সেই ছাগল নিতে এসে চকিতে চেয়ে ফিক করে হাসা মেয়েটি। সেই চাঁদে আর আমি জমিলাকে খুঁজে পাবো না, সেথায় দৃশ্যমান না হলেও জোর করে দেখানো হবে কোনো আলেমের মুখচ্ছবি।

নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার, নেমে আসবে কখনো ভোর না হওয়া রাত্রি। আমি ভরপেট খেয়ে, শূন্য মস্তিস্ক নিয়ে এই আঁধারের জীবন কাটাতে চাই না। তাই সর্বস্ব হারানোর ভয়, কি করে অমূলক হয়? দস্যু যে রুপেই আসুক, যে পন্থাতেই আসুক তার উদ্দেশ্য একটিই- আমাদের সর্বস্বান্ত করা।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চলুক

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

তারেক অণু এর ছবি
স্যাম এর ছবি

চলুক

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।