একবার আমাদের গ্রামের ইস্কুলের এক মাস্টার মশাই নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে মেয়েদের ইস্কুলে পাঠানোর জন্যে বাড়ী বাড়ী ধরনা দিলেন। ইস্কুলটি যদিও শুধু মাত্র ছেলেদের শিক্ষা দানের জন্যে নয়, তবু ইস্কুলের সর্বমোট ১৪১ জন ছাত্রের মাঝে কোনো লিঙ্গ বৈষম্য ছিল না। ঘরে ঘরে গিয়ে ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী হবার ক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে বুঝাতে মাস্টার মশাইয়ের সবেধন নীলমণি এক জোড়া চটির তলা ক্ষয়ে যেতে আরম্ভ করলো। মাস্টার মশাই এই গ্রামের সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন; কারো বাড়ীর ডিমটা, কারো বাড়ীর লাউটা, কারো পুকুরের মাছটা- প্রায়ই গুরুদক্ষিণা রুপে পেতেন মাস্টার মশাই। দু’চারজন তাঁর কথার মর্ম অনুধাবন করলেন এবং মেয়েদের ইস্কুলে পাঠাতে রাজী হলেন। তবে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ফল এলো। যে বাড়ী থেকে মাস্টারমশাই সদা আপ্যায়িত হয়েছেন উঠোনের গাছের ডাবে, সেদ্ধ ডিমে; আজ সেইসব বাড়ীর অনেকেই তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ঝাঁটা হাতে দূর দূর করে দিচ্ছেন। অনেকের ধারণা মাস্টারের বৌ বয়স্কা, বুড়ো বয়েসে তাই ব্যাটার ভীমরতিতে ধরেছে, গাঁয়ের ছোট ছোট মেয়েগুলোর দৈনিক সংস্পর্শ পেতেই মাস্টারের এই উদ্যোগ। অবস্থা ধীরে ধীরে নয়, বরং মুহূর্তেই বেগতিক হলো। গাঁয়ে রব উঠলো- ব্যাটা ইহুদী নাছারা নাস্তিক বদচরিত্রের মাস্টার আমাদের ঘরের মেয়েগুলোকে বেপর্দা করতে চায়, তারে এক্ষুনি খ্যাদা। মাস্টারের এই গাঁয়ে থাকাটা হুমকির মুখে পড়লো। গাঁয়ের মোড়ল অতটা সেকেলে নন, দু’চারজন মুরুব্বীদের সঙ্গে আলাপ করে তিনি সালিশ ডাকলেন। সালিশে আজ উপচে পড়া ভিড়, এই বিষয়ের একটা দফারফা সকলেরই কাম্য। দীর্ঘ জেরাজেরি, পালটাপালটি আলোচনার পর মোড়ল একটি গঠনমূলক এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন। উপস্থিত সকলকে নিয়ে তিনি হা-না ভোটের আয়োজন করলেন। মোড়ল জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা কারা কারা চাও না যে মাস্টার এই গাঁও ছাইড়া চইলা যাক। করিম সহ আরো ছ’সাত জন হাত উঠালো। এত ভিড়ে ঐ কয়েকখানা হাত সনাক্ত করা বড্ড কঠিন। মোড়ল সাহেব তাই বললেন- আরে মিয়ারা হাত তো দেখা যায় না, একটু আওয়াজ তুলো; তোমরা কি চাও মাস্টর এই গেরামেই থাকুক, মাইয়ারা ইস্কুলে যাক? মিনমিন করে কয়েকটি ধ্বনি শোনা গেল- হ, হ। সমাবেশে হাসির রোল উঠলো। যদিও করিম ছোকরাটি বেশ জোরেই বলে উঠেছিল ‘হ্যা’; তবু শত শত তাচ্ছিল্যের হাসির শব্দে তা কোন অতলে ডুবে গেল! চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো করিমের। মোড়ল সাহেব সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন- এইবার হাত উঠাইয়া কওতো, তোমরা কি চাও মাস্টাররে আইজকাই খেদাইয়া দেই? কারা কারা চাও হাত উঠাও জলদি। সে এক দেখার মত দৃশ্য, শত শত উদ্যত হস্তে যেন ঢেকে পড়ে সূর্যের আলো। যদিও ফলাফল পরিস্কার, তবু ব্যাপারটিকে আরেকটু প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষে মোড়ল সাহেব আবারো গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন- আমাগো মাইয়ারা কি ইস্কুলে যাইব? সমবেত জনতার উত্তর- ‘না’; মাস্টার কি এই গেরামে আর থাকবো? পূর্বাপেক্ষা তীব্রতর শব্দে উত্তর এলো- না না না। ভ্রান্তবিশ্বাসে আর নেতিবাচকতায় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল একটি স্বপ্ন।
মাষ্টারমশাইয়ের চোখের জলে গাল ভিজে উঠেছে। তিনি দুচোখে ঝাপসা দেখছেন, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। বুকের বাম পাশটায় খামছে ধরা ব্যাথা। তিনি ছাড়া আরেকজনের চোখেও জল, সে করিম। করিম এ গাঁয়েরই ছেলে। জেলাশহরের কলেজে পড়ে। এই মাষ্টারমশাইয়ের কাছেই তার শিক্ষার হাতেখড়ি। মাষ্টারমশাইয়ের কাছ থেকে গল্পের বই ধার করে পড়ে সে। মাস্টারমশাই বলেছে- ইস্কুল, কলেজের বইয়ের পাতাই যথেষ্ট নয়; পৃথিবীটাকে জানতে হলে, জীবনটাকে বুঝতে হলে তাকে আরো অনেক বই পড়তে হবে। জীবের জন্ম রহস্য জানতে হবে, দেশের রাজনীতি বুঝতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, ধর্মব্যাবসায়ীদের হাত থেকে দেশ বাঁচানোর জ্ঞান অর্জন করতে হবে, ভুল শিক্ষানীতির প্রভাবে একই দেশে তিনটি ভিন্ন জাতি তৈরি হচ্ছে- বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম আর মাদ্রাসা; এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে, প্রতিকারের পথ খুঁজে বের করতে হবে। একটা মাত্র জীবন আমাদের, সে জীবনকে আলোকিত করতে হবে। করিম দৌড়ে গিয়ে মাষ্টারমশাইকে জাপটে ধরলো।
সমবেত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে মোড়ল সাহেব বললেন- সবাই মন দিয়া শোনেন, আমরা একটা গণতান্ত্রিক দেশে থাকি, তাই আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। যদিও আমি মাস্টরের জ্ঞানের কদর করি, তবু পাল্লা যেইদিকে ভারী হেইদিকেই আমারে যাইতে হইব। মাস্টর, তুমিও মনে কিছু নিও না। আমারতো করনের কিছু নাই। জরিপে কি দাঁড়াইল তাতো তুমি নিজ চক্ষেই দেখলা। তাইলে সিদ্ধান্ত হইল যে, আমাগো ঘরের মাইয়ারা কোনোদিন ইস্কুলে পড়বো না, আর মাষ্টর তুমি আইজকাই গাঁও ছাইড়া চইলা যাইবা। হাজার হোক, জরিপ বইলা কথা। জরিপতো আর হ্যালাফ্যালা করতে পারি না।
করিমের চোয়াল আরেকটু শক্ত হল, গলা খাঁকারি দিয়ে সে বললো- আপনেগো জরিপের আমি ‘গুয়াও’ মারিনা।
পুনশ্চঃ এরপর করিমের কপালে কি ঘটেছিল তা সকলেরই অনুমিত। বেধড়ক মার খেতে হয়েছিল তাকে, মাষ্টারমশাইকে সে রাতেই গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। করিম সারারাত ব্যাথায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠেছে আর মনে মনে শপথ করেছে এই অন্ধকার গাঁয়ে একদিন সে প্রদীপ জ্বালাবেই।
পুনঃ পুনশ্চঃ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা অধুনা এক জরিপ চালিয়েছে। তাতে গণজাগরণ মঞ্চের বিপক্ষে এবং জামাত-শিবির এর রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে ব্যাপক ভোট পরেছে। তো? এই সমাজে ইসলামী ব্যাংক এর বিজ্ঞাপন সম্বলিত পত্রিকা এবং তাতে বিষ্ঠাতুল্য জরিপ যেমন থাকে, তেমনি এই সমাজে করিমের মত অনেক স্বপ্নাতুর যুবকও থাকে, যারা এইসব ফালতু জরিপের প্রত্যুত্তরে করিমের মানসিকতায় সহমত পোষণ করে ।
মন্তব্য
জরিপ করে সত্য মেলে না, কিছু লোকের মতামত মেলে । এমন জরিপের উপর তরল ফেলা ছাড়া কী করার আছে
facebook
শুরুতে যেটা বললেন সেটা সত্যি ঘটনা?
না, কল্পনা।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
না।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
অপ্রয়োজনে এত বাজে ভাষা ব্যবহার করলে দরকারি সময়ে এর ধার থাকেনা। এরকম ইড়্যাশনাল হওয়ার কি দরকার আছে? কেন এভাবে তুলনা দিলেন তা যদি আবেগকে পাশে রেখে যুক্তি দিয়ে প্রকাশ করতেন সেটা মনে হয় সচলায়তনের পাঠককুলের জন্য এবং ওভারল সচলায়তনের জন্য বেশী ভালো হতো। এরকম একগুয়ে মতপ্রকাশের ধরনটি প্রতিক্রিয়াশীলদের কার্যক্রমের সাথে মিলে গেল।
আপনার মতামত গ্রহন করলাম, শেষ লাইনটি এখন সম্পাদিত। তবে মোড়লকে করিম যা বলেছিল তা আর সম্পাদনা করলাম না, কেননা সেটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
আপনার পরামর্শ ভবিষ্যতে মাথায় থাকবে। ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
যারা যুক্তি বোঝে না তাদের কিভাবে বোঝাই? সময়োপযোগী গল্প।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
এখানে তো মোড়ল সাহেব গনতন্ত্র চর্চা করেছেন। করিমের বলা উচিত ছিল “গনতন্ত্রের **** মারি”। যে দেশে শিক্ষিতের হার খুব কম সেই দেশে গনতন্ত্র চর্চা করলে এই রকমই হবার কথা।
নতুন মন্তব্য করুন