পর্ব ৩: লোকির শাস্তি
আগের পর্বগুলো পেতে ক্লিক করুন -
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
যার কারণে দেব দম্পতি অডিন ও ফ্রিগা সুতদ্বয়কে হারালো তাকে সহজে ছেড়ে দেয়া কখনই ন্যায্য নয়। অ্যাসগার্ডে অ্যাসিরদের বিশাল সভা বসলো। তাঁরা সকলেই শপথ নিলেন, দুশ্চরিত্র ভণ্ড লোকি যেখানেই যে বেশেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, নয়টি পৃথিবীর প্রতিটি কোনা কোনা তল্লাশি করে তাকে খুঁজে বের করা হবে আর তার জন্যে ধার্য করা হল এমন এক শাস্তি যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ধূর্ত, কারসাজিতে কেতাদুরস্ত লোকি নিজেও জানতো যে দেবতারা তাকে কোনোরকম ছাড় দেবে না। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস তাকে খুঁজে পাওয়া শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, বরং অসম্ভব। দানবী থোক-এর রুপে ঘুরে বেড়ানো আর নিরাপদ নয়, কেননা বালডার হারানোর ব্যথায় ক্রন্দনে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে দেবতারা আঁচ করতে পেরেছে থোকই লোকি। ভেবেচিন্তে চতুর্দিকে পর্বতবেষ্টিত এক নির্জন উপত্যকায় সে এক ঘর বানালো। এই ঘরের চারদিকে চারটি দরজা; চতুর্দিকে দৃষ্টি রাখা এবং প্রয়োজনে পালানোর সুবিধার্থে। যতই জনবিচ্ছিন্ন আর নির্জন এলাকা হোক না কেন, দেবতাদের তো দিব্যদৃষ্টি; তাই অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনার্থে লোকি দিনের বেলা ঘরে থাকা নিরাপদ বোধ করেনা। দিনের বেলায় তাই স্যামন মাছের রুপ ধরে পাশেরই ফ্রানানগুসফর্স নামক এক নির্জন হ্রদে ভেসে বেড়ায় সে। এই ফ্রানানগুসফর্স-এর আভিধানিক একটি শব্দার্থ আছে, এটি মূলত তিনটি শব্দ সহযোগে তৈরী; এর অর্থ দাড়ায় মুক্ত সতন্ত্র জলের ধারা। অর্থাৎ লোকি তার নিজ নিরাপত্তা বজায় রাখতে যথার্থ একটি স্থান বেছে নিয়েছে। জলে সন্তরণাবস্থায় সে এও ভেবে নিল, যদি বিচক্ষন দেবতারা তার মৎস্যরুপ ধারনের চালাকি ধরে ফেলে তবে তা থেকে নিস্তারের কি উপায়। দেবতারা নিশ্চয়ই তখন জাল ছড়িয়ে তাকে ধরবার চেষ্টা করবে; সেক্ষেত্রে সেই জাল থেকে কি করে নিজেকে মুক্ত করা যায় সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়। বাস্তব অনুশীলন হেতু সে নিজেই বিভিন্ন ধরনের কঠিন থেকে কঠিনতর জাল বুনতে লাগলো, নিজেকে সে জালে অবগুণ্ঠিত করে আবার তা থেকে মুক্ত হয়ে কৌশল রপ্ত করতে থাকলো। সে এক সাধনা বটে!
একদিন হালকা শীতের সকালে লোকি তার উঠোনে আগুন জ্বেলে বসে আছে। তার হাতে কিছু শন ও সুতো। তা দিয়ে সে নিত্যদিনের অনুশীলনের তাগিদে জাল বুননে ব্যস্ত। সহসা সে টের পেল দেবতারা তার আশেপাশেই আছে, হয়তো ক্রোশখানেকের দূরত্বে মাত্র। সে বুঝে নিল, দেবশ্রেষ্ঠ অডিন তার দেবশক্তি সম্পন্ন সর্বোচ্চ আসনে আসীন হয়ে তার অবস্থান সম্পর্কে জেনে ফেলেছে।
সেই দেবাসনটি অনেক উঁচু, একেবারে আকাশছোঁয়া, তার নাম হ্লিডসকিয়াল্ফ; একমাত্র অডিনই তাতে বসবার যোগ্যতা রাখেন এবং তাতে বসে নয় পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সবই অবলোকন করা যায়।
যাইহোক, লোকি বসা থেকে তড়িৎ লাফিয়ে উঠলো, প্রমান নিশ্চিহ্ন করনার্থে জালটি সম্মুখে জ্বলতে থাকা আগুনে ছুড়ে ফেলে স্যমনের রুপ ধরে জলে ঝাপিয়ে পড়লো। প্রথমেই উঠোনে পা রাখলেন দেবতা কাভাশর, যিনি তথ্যানুসন্ধানে অত্যন্ত বিজ্ঞ। উঠোনে পা রাখা মাত্রই তার নাকে পোড়া গন্ধ এলো এবং তিনি আগুনের পাশে ভস্মীভূত জালের কিছু অংশ আবিস্কার করলেন। দেবতাদের মস্তিস্কের প্রক্রিয়াকরণ এবং সিদ্ধান্তগ্রহন শক্তি দ্রুততম; খুব সহজেই তাঁরা লোকির মৎস্যরুপ ধারণ, গতিবিধি আর জাল বুননের রহস্য সম্পর্কে সঠিক অনুমান করে ফেললেন। তাঁরা ভস্মপ্রায় জালের অংশের নমুনা নিয়ে হুবুহু তেমনি এক জাল বুনে নিলেন, কেননা তাঁরা অনুমান করলেন এই জালটি বুনন শেষ হয়নি তাই এইরুপ জাল থেকে মুক্ত হবার কৌশল লোকি আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি। স্যামনের ধূর্ত দৃষ্টি সবই দেখছিল আর ধরা না দেবার ছক আঁকছিল। পাহাড়ি অঞ্চলের হ্রদ, হ্রদের প’রে ছোট বড় শিলাখণ্ড ছড়ানো ছিটানো; কোনোটি অস্থায়ী কোনোটি আবার জলের তলদেশ হতে বিস্তৃত। এমনই বৃহৎ দুটি শিলাখণ্ডের মধ্যবর্তী স্থানে লোকি লুকিয়ে রইল; জলের তলদেশাবধি গাঁথা শিলাখণ্ড জালে জড়িয়ে তুলে আনা কখনই সম্ভব নয়, আর পাথরের ঠিক পেছন দিকে থাকবার কারণে ধাবিত জাল পাথরের অগ্রভাগ ছুঁয়ে বারবারই লোকির অর্থাৎ স্যামনের মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে।
জাল বুনন শেষে দেবতারা জাল নিয়ে জলে নামলেন। বজ্রদেবতা মহাশক্তিশালী থর জালের একদিক ধরলেন আর বাকী সবাই মিলে ধরলেন অন্য প্রান্ত। লোকির ধারণাই সঠিক হল; দু’পাশে উঁচু পাথরের কারণে দেবতাদের জাল তার মাথার উপর দিয়ে ঠিকই চলে গেল। দেবতাদের দৃষ্টি ও অনুমানশক্তি দুইই প্রখর; তাঁদের মনে হল, কি যেন একটা জীবিত বস্তু জালকে ফাঁকি দিয়ে গেল। তাঁরা ফিরে এসে একই স্থানে আবারো জাল ফেললেন। এবার জালের সাথে একটি পাথর আটকে দিলেন যাতে তার ভারে জালটি কিছুটা নিম্নমুখী হয়ে এগুতে পারে; এতে ডুবে থাকা বা শিলাখণ্ডের আশ পাশে থাকা বস্তুগুলোকেও জালে আটকানো সম্ভব হবে। লোকি বুঝলো এবার আর রক্ষে নেই। এই জলাধারটি একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়, কিছুদূর পর সাগরের সঙ্গে এর একটি ক্ষীণ সংযোগ আছে। লোকি মনস্থির করে নিল, এ যাত্রা বাঁচতে হলে তাকে এই জলাধার ত্যাগ করে সাগরে পৌঁছুতেই হবে। সে জালের উপর দিয়ে বিশাল এক লাফ দিয়ে সাগরমুখী স্রোতে নিজের গা ভাসিয়ে দিল। বজ্রদেব থর স্যামনের সেই লম্ফঝম্ফ দেখে হাতুড়ি হাতে ধাবিত হলেন। এবার দেবতারা জাল পেতে লোকির পিছু নিলেন। লোকি প্রাণপণে লাফানো শুরু করলো; নিক্ষিপ্ত জালের উপর দিয়ে আবারো লাফ দিল। তার লাফানো অবস্থায় থর থাবা দিয়ে তাকে বারকয়েক ধরবার চেষ্টা করলেন, কিন্ত স্যামন মাছের অমন স্থূল দেহ থাবা দিয়ে ধরা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে স্যামনের দেহ স্থুল বটে, কিন্তু তার নিম্নাঙ্গের শেষ প্রান্ত অর্থাৎ লেজটি বড্ড পাতলা; আর থরের থাবায় আটকে গেল সেই লেজটি।
অবশেষে ব্যাপক পরিশ্রমের পর বহু ঘাম ঝড়িয়ে দেবতারা গ্রেফতার করলেন ধূর্ত লোকিকে। তাকে তাঁরা দিতে চান মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি; যাতে সে প্রতিপলে তার কৃতকর্মের ফল উপলব্ধি করতে পারে। দেবতারা তাকে নিয়ে গেলেন নির্দিষ্ট এক গুহায়। তিনটি বিশাল শিলাখণ্ড নিয়ে তার প্রত্যেকটিতে গর্ত করা হল। তাঁরা লোকির পরিবারকেও ধরে নিয়ে এলেন গুহায়। লোকির এক পুত্র ভালি (এই ভালি অডিন এর পুত্র নয়। একই নাম কয়েকজনের থাকতেই পারে।)-কে নেকড়ে তে রুপান্তরিত করা হল; আর এই নেকড়েই লোকির অন্য পুত্র নারি-কে কামড়ে টুকরো টুকরো করলো। নারির ছিন্নবিচ্ছিন্ন সেই দেহাবশেষ থেকে দেবতারা তুলে নিলেন অন্ত্রটুকু, অর্থাৎ পাকস্থলীর নিম্নভাগ থেকে পায়ুদ্বারাবধি প্রসারিত খাদ্যনালী। ছাড়িয়ে নিয়ে সেটিকে দড়ির মত বানিয়ে তা দিয়ে বাঁধা হল লোকিকে ঐ তিনটি প্রস্তরখণ্ডের সঙ্গে; আর বাঁধাবার পর সেই তন্ত্রীকে লৌহ বন্ধনীতে রুপান্তরিত করা হল। যাতে কেউ তা ছিঁড়তে না পারে। শিকারি দেবী স্কাদি তখন এক বিষধর সাপ ধরে এনে লোকির মাথার উপর ঝুলিয়ে দিলেন। এই সাপের মুখ হতে অবিরাম লালার মত বিষ ঝরে, আর সেই বিষ যেখানে পড়ে সেখানটা ছারখার করে দেয়। সাপটিকে দেবী স্কাদি এমন ভাবে ঝুলালেন যাতে করে ঐ বিষ সর্বদা লোকির মুখমণ্ডলে এসে পড়ে।
কিছুটা নাটকীয়তার খাতিরে লোকির স্ত্রী সিগুনা-কে পাত্র হাতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। স্বামীর মুখমণ্ডল বাঁচাতে সিগুনা পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকে আর সাপের বিষ এসে পড়ে সেই পাত্রে। কিন্তু জমতে জমতে বিষ যখন প্রায় উপচে পড়ে তখন তাকে তা ফেলে দিতে যেতে হয়। চটজলদিই সে ফিরে আসে খালি পাত্র হাতে; কিন্তু এই যাওয়া আর আসার মাঝে যে সময়টুকু সেটিই লোকির শাস্তি। এক এক ফোটা বিষ এসে তার কপালে কপোলে চোখে নাকে ওষ্ঠাধরে এসে পড়ে আর সেই বিষাক্ত যন্ত্রণা তার কাছে ততটাই যতটা ভুমির ক্ষেত্রে ভুমিকম্পের কালে। লোকির এই শাস্তি ধার্য করা হল র্যাগনারক অবধি; অর্থাৎ অন্তিম দিন অবধি, অর্থাৎ বালডার যতদিন মুক্তি না পাচ্ছে। যথার্থ শাস্তি বটে।
মন্তব্য
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
শাস্তি বটে।
নিষ্ঠুরতা দেখাতে ওমেগা ক্লাস নর্স দেবতারা কেউই কম জাননি।
সত্যি, নিষ্ঠুরও বটে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
অনুবাদ ঝরঝরে হয়েছে। কিন্তু বালডারের কী হল?
facebook
বালডার ফিরবে র্যাগনারকে। সেদিন দেব ও অসুরে তুমুল যুদ্ধ হবে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ইয়ে মানে শেষটা যেন কেমন, শেষ হইয়াও হইল না শেষ টাইপ। সাধারনত লোকি/অ্যারিস টাইপ দেবতারা কেমনে কেম্নে ছাড়া পেয়ে আবার কূটনামী শুরু করে। সে ব্যাপারে কিছু আছে নাকি পরবর্তীতে?
না, লোকি আর নিস্তার পাচ্ছে না এ যাত্রা। র্যাগনারক এলে পরে দেখা যাবে। লিখব কখনো তা নিয়ে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
লোকির সাথে তুলনা দেবার মত দেবতা খুব কম পুরাণে পাওয়া যায়। বেচারা ভাই, আপনি যদি গ্রীক দেবতা এরিস-এর কথা বলে থাকেন, তো একটা কথা বলি।
এরিস হচ্ছে মাথা মোটা এক যুদ্ধদেবতা। আর লোকি হচ্ছে অপকর্ম, কুকর্ম, দুষ্কর্ম, অনর্থ আর অনিষ্টের দেবতা।
অকাজ এরিস কিছু করেছে বটে, কিন্তু লোকির তুলনায় তা বড়ই শিশুতোষ। লোকি'র সাথে বরং মিশরিয় পুরাণের "সেট" এবং আব্রাহামিক পুরাণের "স্যাটান" -এর বেশ সাযুয্য পাওয়া যায়।
কি চিন্তা করতে গিয়ে যেন "সাযুয্য" শব্দটা লিখেছি। আসলে "চারিত্রিক মিল" হবে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
খাসা হচ্ছে। গল্প চলতে থাকুক।
- একলহমা
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
হুমম - ভালো লাগলো বালডার উপাখ্যান।
সুকুমার রায়ের লেখনীতে ছোটবেলায় পড়েছিলাম অহংকারী দেবতা থরকে দৈত্যদের শিক্ষা দেয়া। মজা পেয়েছিলাম আর বুঝেছিলাম অহংকারীকে কেউ পছন্দ করে না।
আর পড়েছিলাম হীমদলের কাহিনী। ওখানে লেখা ছিল দেবতা ও দানবদের যুদ্ধের সময়ে বাঁধন ছিঁড়ে লাফ দিয়ে উঠে আসে লোকী, পরে হিমদলের খড়গের আঘাতে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে কোন লেখা আসবে নাকি?
হুমম, হারকিউলিস, অরফিয়উস এদের কাহিনি'র উৎস ঐ লাল বইটাই
আসবে
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
আসবে
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
দারুন, খুবই ঝরঝরে লেখা, আরও কাহিনী চাই
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
নতুন মন্তব্য করুন