ভ্রান্তি সংক্রান্ত
আগেরগুলো পড়তে চান? এই নিন, উজার করিয়া দিলাম ১ ২ ৩ ৪
পর্ব ৫
সাল- ২০১৩
স্থান- নিউ ইয়র্ক
দেশ- আমেরিকা
ভ্রমনে বিভ্রাটের পঞ্চম পর্ব জমা রেখেছিলাম নিউ ইয়র্ক ঘুরে এসে তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে লিখবো বলে। ঐ দেশে বিভ্রাট কিংবা বিড়ম্বনা যে ঘটবেই তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। জেএফকে-তে নামতে না নামতেই বিশাল দেহী ইমিগ্রেশন অফিসার যাচ্ছেতাই জিজ্ঞাসাবাদ করবে, কাস্টমের পাকানো গোঁফের জাঁদরেল অফিসারটি ন্যাংটো ফ্যাংটো করে জায়গায় বেজায়গায় তল্লাশি চালাবে- এমন একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই নিউ ইয়র্ক রওনা হলাম। পাঠক ভাবতেই পারেন এমন সন্দেহ সত্ত্বেও এমন ঝুকি নেবার অর্থ কি? আছে, অর্থ বিলক্ষণ আছে। ঝুকি এবং আতঙ্ককে মোকাবিলা করার মাঝে যে উত্তেজনা ও আনন্দ, নিশ্চিন্ততার মাঝে তা কিন্তু মোটেও নেই। কালবোশেখীর ঝড়ে গাছতলায় পরে থাকা আম কুড়িয়ে খাওয়া অত্যন্ত আনন্দের, তবে পা পিছলে পড়ে হাত পা ভাঙ্গার সম্ভাবনা সত্ত্বেও এডাল ওডাল বেয়ে আম পেরে খাওয়ার মাঝে একটা আত্মতৃপ্তি আছে। উদাহরণ দেখে ভ্রু কপালে উঠলো? ভাবছেন কিয়ের মইধ্যে কি? সত্যি কথা আমারো তাই মনে হচ্ছে। থাক, যুতসই উদাহরণ না হলেও কাটাকুটি করছি না।
এইবার একটু সংক্ষেপেতে সারি। নিউ ইয়র্ক নেমে জেএফকে, জ্যাকসন হাইটস, ম্যানহাটন আরো দূরে নায়াগ্রা কোথাও কোনো বিড়ম্বনার শিকার হলাম না। আমার মেজাজতো প্রচণ্ড খারাপ; আরে বাবা, ফিরে গিয়ে লিখবো কি? ধুর। একটা কিছু হযবরল খুঁজতে চিরুনি অভিযান চালালাম। যা একটা পেলাম সেটাকে ঠিক বিভ্রাটের পর্যায়ে ফেলা যায় না। একটু ঝেড়ে কাশি। নিউ ইয়র্ক, নায়াগ্রা, আটলান্টিক সিটির কোনো হোটেলে কিংবা কারো বাড়ীর টয়লেটে কমোডের পাশে
হ্যান্ড শাওয়ার নেই। এটা একটা যাচ্ছেতাই অবস্থাই বটে। ব্যাটারা সব কাগজ দিয়েই কর্ম সারে। তাতে কি আর কর্ম সম্পাদিত হয়। বাঙ্গালীদের বাসায় বাসায় অবশ্য কমোডের পাশে প্লাস্টিকের বদনা কিংবা নিদেন পক্ষে একটা প্লাস্টিকের মগ শোভা পায়। অত সুন্দর গোছানো টয়লেটে বদনা বড্ড বেখাপ্পা হলেও উদ্দেশ্য সাধিত হয়। তাতেও ঠিক সুবিধে হয়ে উঠলো না। হাই কমোডে বসে বদনা ব্যাবহারের কৌশল আমার জানা নেই।
মূলত আট দিনের এনওয়াই সফরে পুরো সময়টাই প্রাণ ভরে আনন্দ করেছি। উঁচু উঁচু দালান, রঙ বেরঙের মানুষ, দেশ বিদেশের খাবার। সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকানদের ব্যাবহার। চেনা নেই জানা নেই রাস্তাঘাটে মানুষজন চোখে চোখ পড়লেই জিজ্ঞেস করেছে- হ্যালো, হাউ আর ইউ? তবে এত প্রাপ্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই যা নিয়ে দু ছত্র আলাদা করে লিখা যায়। আসবার আগেরদিন এক বাঙ্গালী যুবকের সঙ্গে দেখা। তাঁর কাছে একটা খবর পেলাম; আমার এই ভ্রমনে সেটাই হাইলাইটেড অংশ।
ছেলেটি ম্যানহাটনের মূলকেন্দ্রে কোনো এক ইলেকট্রিক ফার্মে কাজ করে। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী। মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করা তার অভ্যাস। বাসা জ্যামাইকার বাঙ্গালীপ্রধান অঞ্চলে, সেথায় মসজিদের অভাব নেই। কিন্তু কাজে থাকা অবস্থায় তার জামাতে নামাজ পড়া হয়ে উঠতো না। খোঁজ নিয়ে দেখলো আশেপাশে আরো অনেক কর্মস্থলে কর্মরত বিভিন্ন দেশীয় কিছু মুসলমানদেরও একই সমস্যা। এলাকাটি এতই বাণিজ্যিক এবং ব্যস্ত যে, কোনো ফ্ল্যাট ভাড়া করে মসজিদ বানানোও সম্ভব নয়। কোনো খালি জায়গা নেই। এ দপ্তর ও দপ্তর ঘুরে কোথাও কিছু সুরাহা হচ্ছিল না। অবশেষে ঐ এলাকার একটি গির্জার কর্তৃপক্ষ এসে তাদেরকে গির্জার একটি ঘর নামাজের জন্যে ব্যাবহারের আমন্ত্রন জানায়। গত কয়েক মাস ধরে তারা প্রায় ৬০/৭০ জন মুসলমান সেখানেই জামাতে নামাজ আদায় করছে। ঘরটি গির্জার মূল প্রার্থনাকেন্দ্র নয়। তবে দেয়ালে যীশুর ছোট্ট একটি ছবি আছে। নামাজের সময় সেটি সরিয়ে ফেলা হয়, নামাজ শেষে আবার যথাস্থানে সেটি লাগিয়ে দেয়া হয়।
কেউ বলে ইহুদি নাছারাদের কাজ, কেউ বলে রিপাবলিকানদের রাজনৈতিক চাল, কেউ বলে মুসলিম দেশগুলোতে আক্রমনের ইস্যু তৈরী করা; যে যেভাবেই ভাবুক না কেন, আমেরিকা এবং মূলত নিউ ইয়র্কের বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে এটাতো প্রমানিত যে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পিছনে আর সামনে কে বা কারা দায়ী। একবার ভাবুনতো, ঢাকা শহরের সেনাকল্যান কিংবা নগরভবন যদি অমলেশ বসু কিংবা প্রদীপ বড়ুয়া অথবা ভাস্কর গোমেজ নামে কেউ বোমা মেরে উড়িয়ে দিত, তবে তাদের জাতভাইদের একজনও আমাদের হাত থেকে রক্ষা পেত কিনা? আমেরিকায় মুসলমানরা যে নিগ্রহের শিকার হয়নি তা নয়, হয়েছে এবং হচ্ছেও। বেশভূষার কারণে অনেক শিক সম্প্রদায়ের লোকজনও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তার পরিমান নিতান্তই কম। এই দেশে আসবার আগে হয়রানি আর নিগ্রহের আশঙ্কা ছিল। আসবার পর দেখলাম উল্টো চিত্র। এই দেশে কোরআন পোড়ানোর জন্যে যেমন দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়, আবার গির্জার ঘরে মুসলমানদের নামাজের ব্যাবস্থাও করা হয়। বিচিত্র বহুরঙ্গা এক দেশ। কেউ কেউ ভাবতেই পারেন, আমেরিকার আমি কতটুকু জানি? যতটুকু জানি, যতটুকু দেখেছি তাইতো লিখবো। বাঙ্গালী ঐ ভাইয়ের কাছে জানলাম, নিউ ইয়র্কের অনেক হুজুর বলেছেন গির্জায় নামাজ কবুল হইত ন। ঐ হুজুরগুলোকে আমার বলতে ইচ্ছে করে, মধ্যাঙ্গুলি মলদ্বারে প্রবেশোত্তর চুপচাপ বসে থাকুন।
সবশেষে ফিরবার পথের ভ্রমনের সঞ্চয় হিসেবে ঐ গির্জা ও তার কর্তৃপক্ষের উদারতার কথাই ঘুরেফিরে বারবার মনে আসছিল। সম্প্রীতির এমন বিরল উদাহরণ আর কক্ষনো পাইনি। আমেরিকা সম্পর্কে হাজারো ভ্রান্ত ধারণা ছিল, ভেবে গিয়েছিলাম এক রকম আর ঘটলো অন্যরকম; এটাইতো এক চরম বিভ্রাট, তবে দারুণ প্রাপ্তি।
বি: দ্র: আগাম ভ্রান্তি উত্তম নয়; তবে ক্ষেত্রবিশেষে প্রাপ্তি যোগ হয়।
মন্তব্য
ভাল লাগল পড়ে।
র.নাহিয়েন
আামার এখানে একটা চমৎকার অনুষ্ঠানে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। অনুষ্ঠানটা ছিল একটা গির্জার ভেতরে। সেখানে একজন ইহুদি তার ধর্মের আচার পালন করে দেখালেন, একজন শিখ তার ধর্মের রীতি অনুযায়ী প্রার্থনা করেলন, মসজিদের ইমাম আজান দিলেন, চার্চের প্যাস্টর তার মত আচার দেখালেন। একজনের সাথে আরেকজনের মিশে থাকা নিয়ে তো ধর্ম বাঁধা দিচ্ছে না।
প্রার্থনার সময়টুকু বাদে সবাই তো একই রকম -সবাই মানুষ।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
গুরু সৈয়দ মুজতবা আলীর বইতে ছিল কোলোগনের গির্জাতে একবার ঈদের জামাত পালনের কথা, ঠাণ্ডার কারণে সেবার এমনটা হয়েছিল।
facebook
ক্যোলনে এখন মসজিদ বানানোর বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ নিরপেক্ষরা মিছিল করে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
চরম উদারতা ।
শাকিল অরিত
গির্জাটার অথবা প্রধান যাজকের কোন ছবি আমাদের জন্য দিতে পারতেন ।
? ছবির দুই ধরনের প্রয়োজন থাকতে পারে---১) যাচাই করার জন্যে? অতটা সন্দেহভাজন হই নি। ছেলেটার এই প্রসঙ্গে মিথ্যে বলবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এমন ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। উপমহাদেশের প্রথম মসজিদটিও একটি মন্দির ছিল এবং এক হিন্দু রাজা তা আরব দেশ থেকে আসা বনিকদের ধর্ম পালন উপলক্ষে প্রদান করেছিলেন।
২)গির্জা আর যাজকের ছবি যদি শ্রদ্ধা, সম্মান কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে দেখা আর দেয়াটা জরুরী হয়, তার কোনো প্রয়োজন নেই। ঘটনা সত্যি হয়ে থাকলে ঐ উদার ব্যাক্তি নিশ্চয়ই এতটা প্রচার পছন্দ নাও করতে পারে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
অবশ্যই ২...
" বিচিত্র বহুরঙ্গা এক দেশ। " - পুরোপুরি একমত। লেখা চমৎকার লাগল।
- একলহমা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বিভিন্ন রকমের মানুষ আছে বলেই পৃথিবী এত বৈচিত্রময়। তা না হলে জগৎটা সাদা-কালো হয়ে যেত, এত বর্ণিল থাকতো না। আর সব রঙের পাশাপাশি সহাবস্থানই তৈরী করে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে জমকালো ছবি - মানবজাতি। যখন আমরা এই সহজ সত্যটা ভুলে যাই, তখনই শুরু হয় বিভেদ আর মানবজাতির পশুতে অবনমন।
আমি বিশ্বাস করি এই উদারতাটাই মানুষের আসল রূপ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার এক পরিচয় - মানুষ এবং সবাই অন্তরের গভীরতম কোন্দরে এই মতটাকে ধারণ করে। তবে, কেউ সচেতনভাবে বুঝতে পারে, কেউ পারে না। যারা পারে না, তারা বড়ই দুর্ভাগা। আর যাঁরা পারেন, তাঁরা এই রকম মহান মানুষ।
আজকে যে কী হয়েছে, খালি টাইপো চোখে পড়ছে : গাছতলায় পরে থাকা - পড়ে থাকা। আম পেরে - পেড়ে।
ধন্যবাদ।
____________________________
আপনার এই সিরিজটা বেশ মজার। আপনার হ্যান্ড শাওয়ার এর কথা দেখে একটা জিনিস মনে পড়ে গেল, স্পেনে দেখলাম কোমডের পাশেই আর একটা একটা কমোড থাকে ঐ কর্ম করার জন্য, হুদাই জায়গার অপচয়, বাড়তি খরচ, একটা হ্যান্ড শাওয়ার দিয়ে দিলেই ল্যাটা চুকে যায়।
ওইটাকে কমোড নয়, bidet বলে বাছা।
চমৎকার, জয় হোক মানবতার
ইসরাত
ওমা, বিভ্রাট তো হলই না এবার, শিরোনাম মিলল কই!
আপনার লেখা পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো। কিন্তু অন্যদের কাছে যেরকম শুনেছিলাম, আপনার কাছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত জানলাম, ভালোই।
আপনার এই সিরিজটি ভালোই লাগে। চলুক ভাইয়া।
-নিয়াজ
আপনার লেখার হাত চমৎকার। ভবিষ্যতে আরো লিখবেন আশা করছি।
আপনার জন্য অনেক শুভ কামনা।
ভালো থাকবেন।
------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
আপনার ভ্রমণে বিভ্রাট এর আগের পর্বগুলো পড়ে আমি বেশ উপভোগ করেছি। কিন্তু এই পর্বে এসে হোচট খেতে হল। বিভ্রাট ব্যাপারটাই আমি দেখলাম না। বরং বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নয় বলে আমার মনে হয়, এমন বিষয়ের অবতারনা ঘটেছে।
নতুন মন্তব্য করুন