গোড়াতেই একটি সরল স্বীকারোক্তি অপরিহার্য; আমি খুব রাজনীতি বিমুখ মানুষ ছিলাম। বাংলাদেশের রাজনীতিকে নোংরা আবর্জনা সম জ্ঞান আমার মত অনেকেই করতো এবং এখনও করে থাকে। এই শ্রেণীর লোকেরা জীবনের সুখ সাচ্ছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে সর্বাগ্রে। সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ এদের কাছে নেহাতই গৌণ। যা কিছু মুখ্য তা হচ্ছে- আমার থালায় ফুলের মত ছড়িয়ে থাকুক ধোঁয়া ওঠা ভাত, মাছটা থাকুক, মাংসটা থাকুক, আমার বৌ এর অঙ্গে থাকুক ভাল শাড়ীটা, গলায় খুব না হলেও নিদেন পক্ষে দুই ভরির একটি সোনার চেন, দুহাতে রাঙ্গা হয়ে ফুঁটুক দুটি গোলাপ বালা, আমার ছেলেটা খেয়ে পড়ে বাঁচুক, একটা ভাল স্কুলে পড়ুক, আমার মেয়েটা হয়ে উঠুক বিবাহের হাঁটে সুযোগ্যা এক পাত্রী; দুই মহিলার চুল ছেঁড়াছেঁড়িতে দেশটা উচ্ছন্নে যাক, তাতে আমার কি? পুরোপুরি না হলেও আমিও আংশিক এই গোত্রেরই একজন ছিলাম। আমি ভোটার হলেও কখনও ভোট দিতে যাইনি, কখনও কোনো মিছিল সমাবেশ আমাকে আকৃষ্ট করেনি। তবে হ্যা, শৈশব থেকে একটি বিষয়ে আমার চেতনা ছিল একাগ্র আর সেটি হচ্ছে রাজাকারের প্রতি তীব্র ঘৃণা। মৃত্যুর আগে রাজাকারদের বিচার দেখে যাওয়া আমার একটি স্বপ্ন। তবে সে বিষয়ে আমার নিজস্ব কোনো উদ্যোগ ছিল না। আমার সপ্ন বাস্তবায়নের ভারও অন্যকেই বয়ে যেতে হবে যেন! জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালতের আন্দোলন আর রায় সবই ঘরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকায় পড়েছি, পুলকিত হয়েছি আর সন্ধ্যার আড্ডায় বোদ্ধার মত গলা ফাটিয়েছি। প্রবাসী হবার পর বড়জোর দু’একটা অনুষ্ঠানে রাজাকারদের গালি দিয়ে দু’একটা কবিতা আবৃত্তি করেছি কিংবা কখনও নাটকে অভিনয়ের ফাঁকে হেয় করেছি রাজাকার আর তার দোসরদের। আমার দৌড় ঐ অবধিই। দেশ নিয়ে সমাজ নিয়ে খুব যে উদাসীন, তা নয়। মঙ্গায় পীড়িত একটি পরিবারে বাবা যখন সন্তানদের পরপর তিনদিন খাদ্যের ব্যবস্থা করতে না পেরে উঠোনের আম গাছটিতে ফাঁসি নেয় আমি সে খবর পড়ে সারারাত কাঁদি। উল্লাপাড়ায় ২০০১ নির্বাচনোত্তর বিজয়ী জোট জামাত-বিএনপির ১১ জন হিংস্র পশু নৌকা মার্কায় ভোট দেবার অপরাধে যখন পূর্ণিমাদের বাড়িতে হানা দিল, যখন মা-বাবার শুধুমাত্র নৌকা মার্কায় ভোট দেবার অপরাধে অষ্টম শ্রেণীর পূর্ণিমাকে ১১ জন একত্রে ধর্ষণে উদ্যত হল তখন পূর্ণিমা রানী শিলের অসহায় মা সেই পশুদের ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করে অনুরোধ করলো- বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন কইরা আসো। ও ঈশ্বর, কি অসহায় সেই মা! এই খবর পত্রিকায় পড়ে আমার মস্তিস্কে রক্তে হৃদয়ে আন্দোলন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু কিছু করবার উদ্যোগটা কোথায়? মোদ্দা কথা আমাদের দেশে যা কিছু হয়, যা কিছু হচ্ছে কিংবা যা কিছু হবে তা আমরা অবলীলায় মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার এই কূপমণ্ডূকতায় সজোরে কুঠারাঘাত করলো ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ, একটি মাহেন্দ্রক্ষণ- ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩; জঙ্গম বাংলার গণসিন্ধু মন্থন করে জনতার সম্মিলিত কণ্ঠ ফুঁসে উঠেছিল সেদিন শাহবাগে। অন্যায়কে চরণে দলে এগিয়ে এসেছিল একঝাক তরুণ। ন্যায্য প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে স্বপ্ন ও সত্যের সুই সুতো দিয়ে তারা বুনতে শুরু করেছিল একটি চাদর, যার নাম চেতনা- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমার মত কূপমণ্ডূকদের তারা হেঁচকা টানে চার দেয়ালের গণ্ডির ভেতর থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। অন্ধকার একটি ঘরের অনেক দিনের বন্ধ জানালা টান মেরে খুলে দিয়েছে তারা আর সেই থেকে ঘর ভরে উঠেছে আলোয়, সুবাতাসে।
শাহবাগ আমাকে দেশ নিয়ে সঠিক ভাবনাটি ভাবতে শিখিয়েছে, গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা অধ্যয়ন করতে শিখিয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সশরীরে অবস্থান নিতে শিখিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে শিখিয়েছে। একটি অন্যায় রায়কে জনতার আকাঙ্ক্ষার আঘাতে পাল্টে দিয়ে একজন কুখ্যাত নরপিশাচকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে আমার ও আমাদের আজীবন লালিত সপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে এই শাহবাগ।
শাহবাগের বয়েস দশ মাস; এই পথচলায় কিছু ভুল, কিছু নিষ্প্রয়োজন পদক্ষেপ যে ছিল তা অনস্বীকার্য। তবে শাহবাগের ব্যপকতা তাতে বিন্দু মাত্র খাটো হয়নি। শাহবাগ আমাকে পরিনত করেছে রাজাকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক সৈনিকে, আমি আমার জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছি, লক্ষ্যকে নির্দিষ্ট করতে জেনেছি। তাই শাহবাগের কথা উঠলেই সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতায় নুজ্য হয়ে পড়ি।
আমার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের কসম, আমার পদ্মা মেঘনা যমুনার সমস্ত জলের কসম, আমার প্রতিটি চা বাগান, সবুজের ঢেউ, প্রতিটি পাহাড়ের কসম, আমার হাড়ভাঙ্গা প্রতিটি কৃষকের কসম, প্রতিটি বেদে মুচি কামারের কসম, আমার বাংলার প্রতিটি মসজিদ মন্দির প্যাগোডা গির্জার কসম, প্রতিটি শিক্ষক, প্রতিটি গণিকা, প্রতিটি পুরোহিত, প্রতিটি মৌলবী, প্রতিটি শ্রমিকের কসম, আমার ৩২ লক্ষ মা বাবা ভাই বোনের কসম- মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই চেতনাকে রাখবো সজীব, লক্ষ্যে থাকবো অবিচল, এই বাংলা রাজাকার মুক্ত হবেই। আমাদের শপথের প্রদীপ্ত সাক্ষরে নুতন অগ্নিশিখা জ্বলবেই।
মন্তব্য
শাহবাগের বয়েস দশ মাস; এই পথচলায় কিছু ভুল, কিছু নিষ্প্রয়োজন পদক্ষেপ যে ছিল তা অনস্বীকার্য। তবে শাহবাগের ব্যপকতা তাতে বিন্দু মাত্র খাটো হয়নি। শাহবাগ আমাকে পরিনত করেছে রাজাকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক সৈনিকে, ।।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
শাহবাগ , অনেক বছরের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে শিখিয়েছে।
মনে থাকবে ?
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
এইটা কে!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
। আমার অবস্থা ও ঠিক আপনার মতোই। আগে ফেসবুকে শুধু যাচ্ছি, খাচ্ছি, মন খারাপ এমন লুতুরপুতুর স্ট্যাটাস দিয়ে ভালোই লাইক আর কমেন্ট পেতাম, কিন্তু ৫ ই ফেব্রুয়ারির পর আমার সব কিছুই বদলে গেছে, আমার ভিতরের চেতনা বোধ সবি এখন আগের চেয়ে বেশি প্রখর হয়েছে। আমি জাহানারা ইমামের গন আদলত দেখিনি খুব ছোট ছিলাম বলে, কিন্তু গনজাগরন আমি দেখেছি, দিনের পর দিন সেখানে কাটিয়েছি। গনজাগরনের থাকতে পারা, নতুন করে বাঙালির মুক্তমনা মানুষগুলোর আবার একহতে দেখতে পারা আমার জীবনের সবচেয়ে সুখকর দৃশ্য আর অভিজ্ঞতা। এই অসামান্য ইতিহাসের অংশীদার হওয়া এই জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের একটি।
কি পেলাম শাহবাগে? আমার মতে শাহবাগের গনজাগরন মানুষ আর হায়নার মাঝে পার্থক্য চিনিয়ে দিয়েছে, বাঙালিত্বের মানুষের মুখোশ পড়ে অন্তরে পাপিস্থানকে লালন করে তাদের কে দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের খুব কাছের মানুষটিকে আমি-আপনি যেমন দেখে এসেছি কিংবা জেনে এসেছি তার চেয়ে পুরোটাই আলাদা সেটা আমরা আবিষ্কার করেছি ৫ই মে র পরে। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন ঘুমিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করেছে শাহবাগ সর্বস্তরে। আর মানুষকে ভীষনভাবে রাজনৈতিক সচেতন করেছে শাহবাগ। জয় বাংলা।
মাসুদ সজীব
@ মাসুদ সজীব। ভোর আসবেই।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
শাহবাগ হচ্ছে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা। আগুনে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হ্য়,ঝরে যায় ভেজালের অণু, তেমনি চেতনা থেকে ভেজালের অণু ঝরিয়ে এনেছি শাহবাগ থেকে। আমি একা নই, আমার মত আরো হাজারো জন। তাই শাহবাগ, শাহবাগই। আমি গর্ব ভরে বলি আমি একজন শাহবাগী।
____________________________
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
****************************************
ভয়ংকর! কী বিশাল ক্ষতি যে এরা করে চলেছে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমাদের চারপাশে এমন দেশ চিন্তকের সংখ্যাই বেশী।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
মুক্তিযুদ্ধের আলোয় উজ্জ্বল ২০১৩-র শাহবাগ আমাদের এক অসাধারণ প্রাপ্তি!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
-আনন্দময়ী মজুমদার
নতুন মন্তব্য করুন