আমি, আমরা তখন অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণীতে পড়ি; আমাদের বন্ধু শৈলীও তাই। শৈলী আমাদের কলোনীর মেয়ে। আমরা এক সঙ্গে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি। কলোনীর আরো অনেক মেয়েইতো ছিল; যাদের সাথে এক্কা-দোক্কা, বরফ-পানি আর দোকান-দোকান খেলা খেলতে খেলতে বড় হয়েছি আমি; তবু আজকের এই পড়ন্ত বেলায় স্মৃতির ক্যানভাসে শৈলীর মুখখানাই ভেসে উঠছে বারবার। শৈলী ছিল অনেকটা প্রচণ্ড কালবোশেখীর তাণ্ডবে টিকে থাকা একটি সপ্তপর্ণ বৃক্ষের মতন- অনন্যা, নিজেই নিজের উদাহরণ। কাঠফাটা দুপুরে হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামলে আমরা ফুটবল খেলতে নেমে পড়তাম, যতক্ষণ বৃষ্টি ততক্ষণ খেলা। কলোনীর পশ্চিম দিকের দেয়ালের কাছে একটি পানির পাম্প ছিল। তার উপর প্রকাণ্ড এক আমগাছ। খেলা শেষে আমরা কখনও রাজারবাগ পুলিশ ফারির ভেতরের পুকুরে গিয়ে স্নান করতাম, আর পুলিশের অপ্রয়োজনীয় দৌড়ানী খেলে আমাদের পানির পাম্পে এসে শরীরের কাদা দূর করতাম। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে সেখানে অনেক কাঁচা আম পড়ে থাকতো। উফ, সে কী স্বাদ! বিশ্বাস করুন পাঠক, এই প্রায় ত্রিশ বছর পরেও এখনও সেই স্বাদ ঠোটে লেগে আছে। আমরা ঢিল দিয়ে আরো কিছু আম পাড়তাম। তারপর কোঁচড় ভরে আম নিয়ে যখন ঘরে ফিরতাম, জানলায় বসে থাকা ঊর্মি কিংবা লুনা অথবা মুন্নি আমাদের কাছে আম চাইতো। ওদেরও হয়তো ইচ্ছে হতো ঝুম বৃষ্টিতে ছুটে বেড়াবার, ইচ্ছে হতো গাছতলায় সবুজ মুক্তো কুড়োবার; কিন্তু ওরা মেয়ে যে! পাঠক ভাবছেন, এই দৃশ্যে শৈলী কোথায়? শৈলী সেই বৃষ্টির শুরু থেকে কোঁচড় ভর্তি আম নিয়ে ঘরে ফেরা অবধি আমাদের সঙ্গেই। শৈলী ঝুম বৃষ্টি হলে জানলায় বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বেরুতে না পারবার জন্যে পরিতাপ করতো না, ছেলেদের কাছ থেকে আম চাইতো না। আমাদের ফুটবলের প্রতিটি লাথিতে, আম গাছের প্রতিটি ঢিলে, দেয়ালে পা ঝুলিয়ে আড্ডায়, আর প্রতিটি খিস্তি খেউরে শৈলীর সমান অংশগ্রহণ ছিল। শৈলী আমাদেরই একজন- মানে এই আমি, রুবেল, নোমান, শিহাব যেমন। আমরা এক সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে বল নিয়ে দৌড়িয়েছি, কাদায় পিছলে একজন আরেকজনের উপর পড়ে গিয়েছি। সেই বয়সে অবশ্যই শৈলীর শরীরেও পরিবর্তন এসেছিল, এসেছিল আমার এবং বাকী ছেলেদেরও; কিন্তু ওর সাবলীল চলন তা কখনই আমাদের ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দেয়নি। দেবে কেন? বন্ধু যে! আর হ্যা, শৈলী ছিল আমাদের কলোনীর অন্যতমা সুন্দরী। এসব নিয়ে ওকে কিংবা ওর অভিভাবককে মাঝে মাঝে কটু কথা শুনতে হয়েছে বৈকি। সেসব কানেই তোলেননি শৈলীর বাবা। ওর বাবা ছিল স্বনামধন্য এক সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুলের নামটি চেপে গেলাম, শৈলীও যে শৈলীর আসল নাম নয় সেটিও নিশ্চই পাঠক বুঝে নিয়েছেন। শিক্ষার সঙ্গে রুচির স্তরটাও অনেক উঁচু দরের ছিল ওর বাবার। মেয়ের প্রতি বিশ্বাস ছিল, মেয়েরও ছিল বাবার প্রতি আস্থা। সঠিক শিক্ষায় সন্তানদের বড় করেছেন তিনি। অযথা বাধ্যবাধকতার দেয়াল তুলে দেননি মেয়ের সামনে। এরপর বাবার সরকারী চাকরীর অবসরের কারণে শৈলীরা কলোনী ছেড়ে চলে যায়। তারপর আর কোনোদিন দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। তবু ওর প্রতি একটা গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ আছে আমার। শৈলী বলে কয়ে নয়, বরং ওর কার্যকরণের মাধ্যমে আমাকে, আমাদের শিখিয়ে গেছে একটা মেয়ে শুধু মা-বোন-কন্যা-জায়া কিংবা প্রেমিকা মাত্র নয়; বন্ধুও হতে পারে। আরো বড় করে যেটি শিখিয়ে দিয়ে গেছে সেটি হচ্ছে ওর মাঝে আর আমার মাঝে সামর্থ্যের পার্থক্য শূন্যের কোঠায়।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে কিছুদিন একটা কোচিং সেন্টারে পড়তাম। আমরা প্রায় পঁচিশ জনের একটি দল ছিলাম, তার মাঝে পনেরো জন মেয়ে। সবাই খুব ভাল বন্ধু ছিলাম। এদের মধ্যে একজন ছিল যার নাম ঢেউ। নামের মতই সে ছিল ব্যতিক্রম। ক্লাস শেষে ধুমধাম কলার ধরে টেনে বলতো- ‘চল কিমা পুরী খাবো’। আমরা জোনাকী হলের লাগোয়া গলিতে ‘রুটি হাউজ’ নামের যেমন তেমন একটা রেস্তোরায় বসে কিমা পুরী গিলতাম, সঙ্গে চেয়ে নেয়া একটু খানি গরুর মাংসের ঝোল আর কাঁচা পেয়াজ। চা খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। ঢেউকে বাড়ী পৌঁছে দিতাম। ওর মা আমাদের আবার চা বানিয়ে খাওয়াতো। ওর বাবা কোনো কোনো সন্ধায় হারমোনিয়াম বের করে আমাদের গান শোনাতেন। তাঁরা দুজনেই অত্যন্ত ভালবাসতেন ঢেউকে। মা কিংবা বাবা কেউই ওর সামনে অকারণে বারণের বেড়া তোলেননি। ঢেউ অসম্ভব রকমের আকর্ষণীয়া ছিল। অনেক দুপুর, অনেক বিকেল ঢেউয়ের ঘরে এক সঙ্গে পড়েছি, মুভি দেখেছি, সিগারেট ফুঁকেছি।। এমনও অনেক দুপুর গেছে যখন আমি আর ঢেউ পড়ার টেবিলে ক্যলকুলাস কষছি আর বাড়ীতে অন্য কেউ নেই। তবু ভিন্ন কোনো চিন্তা কোনো পক্ষেরই মাথায় আসেনি। আসবে কেন? বন্ধু যে!
এখন সরাসরি প্রসঙ্গে অবতরণ করি। নিজ পরিবারেরে বাইরে অন্য কোনো মেয়ে মানেই যে ভোগের বস্তু নয় সেই শিক্ষা গোড়াতেই পরিবার এবং সমাজ থেকে আসে। আর কিছুটা আসে বন্ধনহীন বন্ধুসুলভ মেলামেশায়। আবেষ্টনের বেড়ায় আবদ্ধ হলেই নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। শৈলী কিংবা ঢেউ যেভাবে ছেলেদের বন্ধু হতে পেরেছে, অন্য মেয়েরা ইচ্ছে থাকলেই তেমনটা হতে পারে না, পরিবার কিংবা সমাজ তা হতে দেয় না। আবার অনেক ছেলেরাও মেয়েদের সঙ্গে সুযোগ পেলেও সহজে মিশতে পারে না। এটি একটি সামাজিক দৈন্যতা। আমাদের সমাজ ছেলেতে-মেয়েতে আলাদা করে রাখে। ‘গার্লস’ আর ‘বয়েজ’ স্কুলের বিভেদকরণ এই দৈন্যতাকে গোড়াতেই অঙ্কুরিত করে। এখনও বিয়ে বাড়ী কিংবা নেমন্তন্নে গেলে পুরুষ আর নারীদের খাবারের টেবিল আলাদা স্থানে দেখা যায়। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মাঝে সাবলীল মেলামেশা নেই বলেই তাদের মাঝে এই পৌনঃপুনিক বৈসাদৃশ্য। মেয়ে দেখলেই তাই যৌনচাহিদাটাই সবার আগে ফণা তুলে ওঠে; প্রেম নেই, ভালবাসা নেই, শুধু নিরেট কামবাসনা। আর যৌনচাহিদা কেবল পুরুষের একক সম্পত্তিতো নয়, নারীরও এই আকাঙ্ক্ষা থাকে। যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো সম্পর্কেই পারস্পরিক সমঝোতায় একজন আরেকজনের কাছে নিজেকে বিছিয়ে দিক, উজাড় করে দিক; তাতে প্রেম থাকুক, ভালবাসা থাকুক, বিশ্বাস থাকুক।
তারপরও পুরুষে পুরুষেও বিভেদ আছে। আমাদের সমাজে বেশীর ভাগ পুরুষ হায়েনা হলেও, শুদ্ধ পুরুষ নেই তা নয়। এই সমাজের বেশীরভাগ পুরুষই শিশ্নোদরপরায়ণ- এ কথা ধ্রুব সত্য; তবু লিটন নন্দীরাও এই সমাজেরই পুরুষ। সিংহভাগ দুর্যোধনেরা দ্রৌপদীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, অন্যদিকে গুটিকয় লিটন নন্দী রুপী কৃষ্ণ ঠিকই বসন হাতে এগিয়ে আসে।
সবশেষে ‘নারী’ রুপী প্রতিমার প্রতি এই নৈবেদ্য- নারী আমার মা, যে আমাকে সকল ঝড় থেকে আগলে রাখে; যেমনটা চোখের সম্মুখ ভাগের পর্দা অনেক রোদে কিংবা ধুলোর ঝড়ে চোখের মণিকে আগলে রাখে। নারী আমার বোন, যার স্নেহ চৈত্রের দুপুরে শীতল পুকুরের মতন। নারী আমার প্রেয়সী, যার চোখের আকাশে আমার সর্বনাশের পাখিরা ডানা ঝাপটায়। নারী আমার জায়া, আমার নিত্যপথের নিত্যসাথী। নারী আমার কন্যা, আমার স্বপ্নরথের সারথী। নারী আমার বন্ধু, সংকোচ আর বন্ধনহীন সম্পর্কের বিমূর্ত প্রতীক। এমনকি নারী আমার গোপন পিয়া, সুক্তি যেমন বুকের ভেতর সকল দৃষ্টির অন্তরালে মুক্তোটিকে লুকিয়ে রেখে খুব গোপনে ভালবাসে, তেমনি কিছু। নারী আমার ভোগের বস্তু নয়; নারী আমার শ্রদ্ধার, আমার স্নেহের, আমার ভালবাসার বৈজয়ন্তী।
মন্তব্য
যেসিব নারীরা আপনাকে নারীর আসল রূপ চিনতে শিখিয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তারা নিজেদের চিনতে পেরেছে বলেই আশে পাশের পুরুষদের থেকেও সচেতনতা ও সম্মান আদায় করে নিতে পেরেছে। কিন্তু এই সমাজ মেয়েদেরকেও বারে বারে শিখায় মেয়ে তুমি পুরুষের ভোগ্যা হবার জন্য সাধনা কর। পেলব ত্বক বানাও, কটি করো ক্ষীণ, রাধতে শেখো যেন তোমার অন্নদাতা তোমাকে গুরুত্ব দেয় ইত্যাদি। মেয়েরা কখনো নিজেকে খুঁজে পাবার জানার সুযোগই পায় না, তার পুরুষের দাসী ছাঁচটাই কেবল জানতে পায় আর সেই ছাঁচের আদর্শে নিজেকে গড়তেই জীবন তামা তামা করে। নিজেদের সম্মান আদায়ের জায়গাটাই তারা জানতেই পারে না।
যেসব মেয়েগুলি জানালায় বসে বৃষ্টির জন্য আক্ষেপ করতো, বা আমের ভাগ চেয়ে আবদার করতো, সেইসব মেয়েদের আপনি কি ভাবে আপনার স্মৃতিতে ঠাঁই দিয়েছেন? তারা কি শৈলী বা ঢেউ এর মতন সম্মান পেয়েছে আপনার কাছে?
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
আমের ভাগ চাওয়া মেয়েগুলোও এখনও আমার বন্ধু হয়ে আছে। এখনও তাদের অনেকের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ আছে। তাদের সেদিনের সেই জানলায় বসে থাকা অপারগতা, যার জন্যে সমাজ দায়ী।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
শৈলীর বাবার ভেতর নিজের বাবকেই দেখলাম যেন!
কে বলে রে ছেলে আর মেয়ের মাঝে বন্ধুত্ব হয়না! পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা কিছু ব্যতিক্রমসহ এই প্রকারঃ
প্লেগ্রুপ - পঞ্চম শ্রেণীঃ সহশিক্ষা
ষষ্ঠ শ্রেণী - দ্বাদশ শ্রেণীঃ স্বতন্ত্র শিক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ঃ সহশিক্ষা
এই মাঝখানের সাত বছরের গ্যাপে একজনকে ছেলে আর একজনকে মেয়ে বানানো হয় (মানুষ বানানো হয় না)। এই সময়কালটাতে প্রচুর বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়। এবং তখনই বুঝিয়ে দেয়া হয় ছেলেরা আর মেয়েরা আলাদা জাত। এই দুই জাতে মিলে বিয়ে হয়, বন্ধুত্ব হয় না। এজন্য এরা টিনএজে উঠলে প্রেম করতে চায় (এবং করে) কিন্তু বন্ধুত্ব করতে চায় না। বড় হলে এরা প্রেম করে, বিয়ে করে কিন্তু একজন আরেকজনের বন্ধু হয় না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ঠিক তাই। আমরা সবাই সামাজিক ফিল্টারের শিকার।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
বন্ধু বন্ধুই। ছেলেবন্ধু-মেয়েবন্ধু আলাদা করে রাখলে সেটা কখনই প্রকৃত বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে না। এই উপলব্ধিটা আমার অনেক কাজে দিয়েছে। আমি যতদিন ভাবতাম আমি যে বন্ধুটির সাথে কথা বলছি সে একজন মেয়ে দেখা যেত আমার কথাগুলো যেন ফিল্টার হয়ে বের হচ্ছে। তাই আমি যেমন আমার বন্ধুটিকে প্রকৃতভাবে চিনতে পারতাম না সেও তেমনি পারত না। কিন্তু যখন তাকে মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করলাম মনে হল দুজনই দুজনের প্রকৃত রূপটা ধরতে পাচ্ছি!
রাসিক রেজা নাহিয়েন
পরিবার আর সমাজ মিলে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে এই দেয়াল তুলে মোটামুটি চিরস্থায়ী একটা ক্ষতি করে দেয়।
এই ব্যাপারটা আরো বেশি বিপজ্জনক হয় মাদ্রাসায় পড়া ছেলেদের জন্য। একেতো মেয়েদের সাথে মেশার কোন সুযোগ নেই তার ওপর পড়ে যাচ্ছে বেহেশতের সেই ৭০টা হুরের বর্ণনা। সেই হুরকে পেতে হলে কিছু সাধনার দরকার হয়, পৃথিবীর মেয়েকে জোর করতেতো কিছুরই দরকার নেই।
আপনার আম কুড়ানো আর জানালায় দাঁড়িয়ে আম কুড়ানো দেখা বন্ধুদের প্রতি শুভেচ্ছা থাকলো।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
নতুন মন্তব্য করুন