বছরখানেক আগে.........
মহসিনের বয়স চল্লিশের এদিক ওদিক; মোটামুটি গোছের একটা কাজ করে। বাড়ীতে বৌ আছে, নাম- মিলা। ওদের ঘর আলো করা পাঁচ বছর বয়সী ফুটফুটে একটি মেয়ে আছে, নাম- লাবনী। স্বচ্ছল না হলেও মোটামুটি সুখী পরিবার। মাসান্তের বেতনে সবকিছু ঠিকঠাক চলে যায়। তবে বাড়তি খরচের উপায় নেই। মহসিনের কর্মস্থল কলাবাগানে, বাড়ী আজিমপুরের নিউ পল্টনে; কবরস্থানের পশ্চিম ধারের দেয়াল ঘেঁষা গলিটাতে। পূবদিকের জানলা খুললেই কবরস্থান দেখা যায়। এই জানলাটি ওরা সবসময় বন্ধ রাখে। দোতলা ফ্ল্যাটের ঝুলন্ত এক চিলতে একটি বারান্দা; সেখানেও খুব প্রয়োজন না হলে যাওয়া হয় না। বারান্দার সামনেই একটু খোলা জায়গা, সেখানেও এলোমেলো ভাবে ভগ্নপ্রায় দু’দশটি প্রাচীন কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যদিও সেটি মূল আজিমপুর কবরস্থানের অংশ নয়; এটির নাম ‘ইরাকি গোরস্থান’। এই বাড়ীটিতে দম বন্ধ হয়ে আসে ওদের। তবে খুব সস্তা ভাড়ায় পাওয়া গেছে। মিলা প্রতিদিনই চাপ দিচ্ছে অন্য কোথাও বাড়ী খুঁজতে। মহসিন আশ্বস্ত করেছে তাকে।
বাড়ী ফিরতে প্রতিদিনই রাত হয় তার, ঘরে ফিরে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মেয়েটি বাবাকে দেখেই না বলতে গেলে। মহসিন যখন অফিসে যায় তখন সে ঘুমায়, আর যখন মহসিন ফেরে তখনও সে ঘুমিয়ে থাকে। একমাত্র শুক্রবারে বাবার মুখ দেখে সে। তবে আজ দুপুরের মুখেই বাড়ীর দিকে রওনা হয়েছে মহসিন। মিলা ফোন করে জানিয়েছে যে ফারুক দু’দিনের জন্যে ঢাকা আসছে একটি কাজে; ওদের বাড়ীতেই উঠবে। ফারুক মিলার ছোট ভাই, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে স্নাতকে পড়ে। ভর দুপুরে মহসিনকে ফিরতে দেখে মিলাতো অবাক। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো- ফারুক কোথায়? মিলার এবার আরো অবাক হবার পালা; বললো- বাব্বা, শালার জন্যে এতটা, শালী হলে না জানি কি করতে? চটজলদি ফারুক কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মহসিন। যে কাজে ফারুক ঢাকা এসেছিল সেই কাজ সেরে, নান্না মিয়ার মোরগ পোলাও খেয়ে, দুজনে নিউ মার্কেট গেল। মাসের মাঝমাঝি সময় এত বাজার কেউ করে না; বাজারের পরিমান দেখে মিলা প্রথমটা খেপলেও, মনে মনে বেশ খুশী হল। ঘরে ফেরা অবধি মহসিন মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে টিভি দেখছে। মেয়েও বাবার কোলে নেতিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, কতদিন এমনটা হয় না!। ও ঘরে ভাই-বোনে সুখ দুঃখের আলাপে ব্যস্ত। মহসিনও ঘুমিয়ে পড়েছে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে। এরই মাঝে মিলা এসে মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। মহসিন হঠাৎ ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো- লাবনী কৈ, লাবনী কৈ? ও ঘর থেকে মিলা আর ফারুক দৌড়ে এলো চিৎকার শুনে। মহসিনের এমন ব্যবহারে মিলা অত্যন্ত অবাক। মহসিন কোনোকালেই এতটা কেয়ারিং ছিল না। মিলা জিজ্ঞেস করলো- খারাপ কিছু স্বপ্ন দেখেছো? কোনো উত্তর না দিয়ে মহসিন বিছানায় ঘুমুতে চলে গেল।
ফারুক দু’দিন থাকলো। মহসিনের শরীরটা ভাল নেই। এই দু’দিন সে অফিসে যায় নি। সারাদিন ঘরেই কাটালো। যাবার আগে ফারুক মিলাকে বললো- আপা, তুমি একটা ডাহা মিথ্যুক। দুলাভাই কত কেয়ারিং! এই দু’দিন লাবনীর সব দেখভাল সেই করলো। সারাদিন মেয়েটাকে বুকে বুকে রাখলো। আমার সাথে কত কথা বললো! মিলার হিসেব মেলাতে খানিক কষ্ট হচ্ছে বটে। ফারুক চলে গেছে।
এর ২২ বছর আগে……
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, হাতে অফুরন্ত সময়। মফস্বলের ছেলে-মেয়েরা ভর্তি পরীক্ষার জন্যে ততটা প্রস্তুতি নেয় না। মহসিনের এক নতুন নেশা ধরেছে; প্রায় প্রতি সন্ধ্যেয় বাজারের এক ক্লাব ঘরে ভিসিআর দেখতে যায়। পাঁচ টাকা টিকিট; হিন্দি সিনেমাই বেশী দেখানো হয়। হঠাৎ করে একদিন সেখানে দশ টাকা টিকিটে অন্য কিছু দেখানো হল। দেখতে দেখতে কানের লতি গরম হয়ে আসছিল মহসিনের, তলপেটে শিরশির করছিল। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছিল না নিজেকে। বাড়ী পৌঁছে দরজা আটকে শুয়ে পড়লো। সে রাত এক অন্য অনুভুতির রাত; কেমন যেন নিষিদ্ধ এক শিহরণ! সারারাত এক বিন্দু ঘুম হয়নি। এরপর থেকে সে আর পাঁচ টাকার টিকিট কেটে সময় নষ্ট করেনি। প্রতিদিন দশ টাকা যোগাড় করা একটু সমস্যা হলেও, এক দুই দিনের বিরতিতে নিষিদ্ধের প্রতিই আকর্ষিত হল মহসিন। একদিন মুক্তাগাছা থেকে ওর ফুপাতো বোন বেড়াতে এলো সপরিবারে। মানে স্বামী সন্তান সহ। দিন কয়েক থাকবে ওদের বাড়ীতে। বোনের মেয়েটির বয়েস পাঁচ কি ছয় হবে। সে সময়টা মহসিনের হিতাহিতজ্ঞান একদম শূন্যেরঅনেক নীচে। একদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে বাড়ীতে সবাই ঘুমুচ্ছে; মহসিন সেই বাচ্চা মেয়েটির নিস্পাপ ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো। সে এক ভয়ানক অনুভূতি, এমনটা এর আগে হয়নি কখনও। মহসিন এর চেয়ে বেশী কিছু করেনি, তবে এই হাতেখড়ি তাকে নিয়ে গেল এক পৈশাচিক স্তরে। সে ঘন ঘন সেইসব আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে যেত, যেসব বাড়ীতে পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ে আছে। শুধুমাত্র একবার ঐ ছোট ছোট ঠোঁটগুলোর উপর নিজের পাশবিক কামনা চেপে ধরতে সে বিভিন্ন রকমের ঝুঁকি নিত। এর চেয়ে বেশী কিছু নয়। ওইটুকু বাচ্চারা হয়তো এটিকে আদরের অংশই মনে করতো। না এ ব্যাপারটি কখনও জানাজানি হয়নি; মহসিন অত্যন্ত দক্ষ ছিল তার সেই ঘৃণিত কর্মে। এভাবে কেটেছে দু’তিন মাস; প্রথম যেদিন বন্ধুদের সঙ্গে গাঙ্গিনার পাড়ের নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলো সে, তারপর থেকে বাচ্চা মেয়েদের নিস্পাপ ওষ্ঠাধর আর তাকে আকর্ষিত করেনি।
এর ২২ বছর পর........
ফারুকের ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে মহসিন শরীর খারাপের ছুতো দিয়ে ঘরে থেকে মেয়েকে পাহারা দিয়েছে। ফারুককে সে নিরাপদ মনে করেনি। ফারুকের এই ঘটনাটি একটি উদাহরন মাত্র। মহসিনের এই মানসিক সমস্যাটি ইদানীং প্রকটাকার ধারণ করেছে। ঘরে যে কোন পুরুষ মানুষ বেড়াতে এলেই সে অফিস কামাই দিয়ে সারাক্ষন ঘরে বসে থাকে মেয়েকে কোলে নিয়ে। অফিস থেকে বার কয়েক সতর্কবার্তাও শুনতে হয়েছে। এমনকি মহসিনের বাবা এসেছিল দু’দিনের জন্যে, তখনও মহসিন ঘরে বসে বসে অফিস কামাই করলো।
বর্তমান.........
মহসিনের চাকরীটি আর নেই। সে ২৪ ঘণ্টা ঘরে থাকে। শেষ কবে দু’চার ঘণ্টা একত্রে ঘুমিয়েছিল তা আর সে মনে করতে পারে না। মিলা একটি চাকরী নিয়েছে, নিতে বাধ্য হয়েছে। মহসিন কারো সঙ্গে কথা বলে না। পূব দিকের জানলাটি প্রায়ই খুলে রেখে অপলক চেয়ে থাকে সারি সারি কবরগুলোর দিকে। কবরের ভেতরকার লাশ গুলোকে মাঝে মাঝে সে স্পষ্ট দেখতে পায়। প্রতিটি লাশ তার দিকেই মুখ ফেরানো। মা কে কবর দেয়ার সময় সে দেখেছিল, লাশগুলোর মাথা থাকে উত্তরদিক বরাবর আর মুখটি পশ্চিম দিকে ফেরানো। লাশগুলো মহসিন কে দেখে হাসে, একসঙ্গে হাসে। সে কী শব্দ! প্রতিটি লাশই পাঁচ-ছয় বছর বয়সী কোনো মেয়ের। কোনোকোনো গভীর রাতে মহসিন বারান্দায় বসে সিগারেট ধরায়, গলির মুখের দুটি কুকুর করুণ স্বরে ডেকে ওঠে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় ইরাকি গোরস্থানের প্রতিটি কবরের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে পাঁচ কি ছয় বছর বয়েসী কোনো মেয়ে; রঙিন ফ্রক পড়া, ঠোঁটে তাদের গাঢ় লাল রঙের প্রলেপ, রক্তের প্রলেপ। তারা হাসে, একত্রে হেসে ওঠে; সে হাসিতে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সমস্ত শহর। মহসিন দুহাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে, হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। মিলা দৌড়ে আসে। মহসিন ক্ষেপে ওঠে- লাবনী ঘরে একা, তুমি এখানে কেন?
মন্তব্য
ঈয়াসীন,
আপনার লেখা "নারী সপ্তাহ" ট্যাগটি জুড়ে দেবেন। তাহলে নারী সপ্তাহের লেখাগুলোর সাথে এটাকে একত্রে পাওয়া যাবে: http://www.sachalayatan.com/taxonomy/term/19583
সবাই কী এভাবে শাস্তি পায়! গল্পটা ভালো লিখেছেন।
এইভাবে সবার শাস্তি হইলে ভালো হতো! তাতো আর হয়না! নিজের মেয়েকেও না ছেড়ে দেওয়া পাষণ্ড শেষ বয়সে এসে ধর্মকর্মের তুলোধুনা করে ভালোই থাকে!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
ধর্মকর্ম ধরার আগে ভাবেঃ পাইছি যখন তখন সাধ মিটায়া লই!
ধর্মকর্ম ধরার পরে ভাবেঃ ঐ সময় যা করার করছি, এখন তো আর করি না! আর আমি তো তওবা পইড়াই নিছি!
কোন পর্বেই এদের মধ্য অনুশোচনা থাকে না। এরা সব সময় ভালো থাকে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই গল্পের মহসিনের মতো কাউকে অনুশোচনায় পুড়ে উন্মাদ হতে দেখিনি বা শুনিনি। তবে এমন কয়েকটা উন্মাদ থাকলে মন্দ হতো না। বাকি ইতরগুলো কিছুটা হলেও ভয় পেতো।
গল্প ভালো লেগেছে। তবে আজ থেকে অনেক দিন পরে এই গল্পটা নিজেই আবার পড়বেন। তখন হয়তো কিছু সম্পাদনা করার কথা ভাববেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গল্পটা ভাল লাগল।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ভালো লাগলো গল্পটা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল ভাই।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
না, এমন কাউকে অনুশোচনা করতে কিংবা উন্মাদ হতে আমিও দেখিনি; পরিণতিটি কল্পনা প্রসূত। এদের প্রাপ্য শাস্তি কল্পনাতে নিশ্চিত করবার প্রয়াস।
ধন্যবাদ সবাইকে
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
গল্পের একটা স্তর ধরে যাবার বিষয় লক্ষ্য করলাম।
পর্ন দেখে আকৃষ্ট হওয়া>যৌনকামনা মেটানোর জন্য শিশুর প্রতি নির্যাতন>পূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতা হবার পর শিশুদের প্রতি অত্যাচার বন্ধ করে দেয়া।
যদিও আপনি একেই একমাত্র উদাহরণ বলেননি কিন্তু এরকমটা ঠিক নয়। শুধুমাত্র অবদমিত বাসনা মেটানোর জন্য সবাই এরকম করেনা, করে বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করার জন্য। পূর্ণ অভিজ্ঞতা হলেই এইসব বিকৃত জিনিস বন্ধ হয়ে যায়না।
যাই হোক। নারী সপ্তাহে লেখার জন্য ধন্যবাদ
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
সত্যিই এমনটি হলে খারাপ হতো না।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
গল্প বিন্যাস ভালো লেগেছে, ভালো লেগেছে গল্পের বিষয় গভীরতা।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
সত্যিই যদি এমন হতো!!!! ঘরে ঘরে মহসিনদেরকে দেখা যেতো।
দেবদ্যুতি
নতুন মন্তব্য করুন