ভ্রমনে বিভ্রাট ৬

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৭/২০১৫ - ৬:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চরমানাকাঙ্ক্ষিত

cric

প্রায় দুই দশক আগে কোনো এক পৌষ মাসে গাইবান্ধা যেতে হয়েছিল একটি বিশেষ কাজে। কি কাজে, তা নাই বা বললাম। তাহা মানুষেরও কানে, ঢালিতে যে লাগে প্রাণে; লুকানো থাক তা সখি হৃদয়ে আমার। গাইবান্ধায় আমার পূর্ব পরিচিত কেউ ছিল না। রওনা হবার আগেই খবর নিয়ে জানলাম সেখানে ‘আর রহমান’ নামের একটি থাকবার হোটেল আছে। যাবার ঠিক দু’দিন আগে কলোনীর আড্ডায় কথাটা পাড়তেই আমার এক বন্ধু, নাম কামু, জানালো- ‘রুশো ভাই’দের বাড়ী গাইবান্ধা শহরেই। রুশো ভাই আমার স্বল্প পরিচিত; একবার দু’বার ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে কথা হয়েছে। আমার চেয়ে বয়সে খানিক বড় আর আমাদেরই আরেক বন্ধু- সুমনের খালাতো কিংবা চাচাতো ভাই হয়তো। কামু, শিপন, সালাউদ্দিন, সুমন আমাদের কলোনীর সান্ধ্যকালীন আড্ডার প্রায় নিয়মিত সদস্য, যদিও তারা কেউই কলোনীর বাসিন্দা নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে থাকলেও সন্ধ্যের মুখে আড্ডার মোহে চলে আসতো আমাদের কলোনীতে। এদের সবার নাম কেন টানলাম, সে প্রসঙ্গ যথাসময়ে উন্মোচিত হবে। কামু আর সুমন আমাকে সঙ্গে করে সন্ধ্যের দিকে রুশো ভাইদের ক্লাবে (কোনো এক ক্রিকেট ক্লাব, নামটা মনে নেই) নিয়ে গেল। সবটা শুনে রুশো একটি চিঠি লিখে দিল আর জানালো- বিকেলের পর গাইবান্ধার পশ্চিম পাড়ায় মূল সড়কের ধারে রিকশা থেকে নামলেই চায়ের দোকানের পাশে একটি গাছের তলায় তিনজন সতেরো-আঠারো বছর বয়সী ছেলেকে দেখা যাবে এবং তাদের হাতে চিঠিটি পৌঁছুনোর পূর্বে চিঠিটি যেন আমি না পড়ে ফেলি সেই অনুরোধও করলো। মনে মনে হাসলাম, ভাবলাম গাছতলায় গেলেই তিনটি ছেলেকে পাওয়া যাবে, কেমন জানি একটা ফাঁকিবাজি আছে এর মধ্যে! এড়িয়ে যাবার মত কৌশল। এমনতর নির্দেশনা খানিকটা হাস্যকরই বটে; নির্ঘাত ছেলেগুলোকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবে কিংবা আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

খুব সকালে কমলাপুর থেকে রেলগাড়ি ধরলাম। গাড়ী জামালপুর পেরিয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে এসে থামলো। এখান থেকে ফেরীতে ব্রহ্মপুত্র পার হতে হয়। নদী পেরুলেই গাইবান্ধার বালাসীঘাট। সেখান থেকে আবার রেলে করে মূল ইষ্টিশনে যাওয়া যায়। তবে রুশো ভাইয়ের পরামর্শ মতে রিকশা নিয়েই চলে গেলাম, সেটিই নাকি শ্রেয়তর। তখন পৌষের আকাশে সূর্যে কমলা রঙ ধরেছে। মন কেমন করা একটা পড়ন্ত যৌবনা রোদ্দুর! আকাশের এমন রঙ দেখেই বুঝি জীবনানন্দ লিখেছিলেন- ‘অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল, অনেক কমলা রঙের রোদ’! রাস্তার দু’পাশে থেকে থেকে সরষের খেত। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে হয়, এমনটা ঢাকা শহরে হয় না। সোজা আর-রহমান হোটেলে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টে একটি রিকশা নিয়ে গন্তব্য অর্থাৎ পশ্চিমপাড়ার গাছতলায় গিয়ে হাজির হলাম। মূলত যে কাজে এসেছি তাতে স্থানীয় কেউ সাথে থাকলে সুবিধে হয়। পাঠক, কি কাজ, সেটি অনুমান যদি করে ফেলেন, তবে চেপে যান; হাজার হোক এখন ঘর সংসার করি। যাইহোক, আমাকে আবাক করে দিয়ে তিনটি ছেলে গাছতলাতেই গুলতানি মারছিল, খুঁজতে হল না। নাম জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম। খোলা খামের চিঠি, তবু রুশো ভাইয়ের অনুরোধ এবং নিম্নতম সভ্যতা আর পারিবারিক সুশিক্ষার্জনের খাতিরে চিঠিটি পড়া হয়নি। ছেলে তিনটি কিছু না বলেই আমাকে নিয়ে হোটেলে চলে এলো। ম্যানেজারকে কি সব বলে আমার ব্যাগ নিয়ে আমাকে ঠেলতে ঠেলতেই এনে তুললো তাদের একজনের বাড়ীতে। আর সে কী আপ্যায়ন! চেনা নেই, জানা নেই; এমনটা বাংলাদেশেই ঘটে! বুঝলাম কি লেখা ছিল চিঠিতে। তিনদিনের জন্যে গাইবান্ধায় আগমন; যে কাজে এসেছি, তা সুনিপুণ ভাবে পালন করতে যার পর নাই সাহায্য করলো ছেলেগুলো। ছোট শহরতো, সবাই সবাইকে চেনে; অনুসন্ধান সহজতর হয়।

এতো বেশ মজাই হল; বিভ্রাট কোথায়? অচেনা জায়গায় ঘরোয়া আতিথ্য, সার্বক্ষণিক সহযোগিতা, অনাকঙ্খিত সমস্যার শঙ্কা থেকে নির্ভাবনা; এযে মেঘের কথা না ভাবতেই আকাশ ভাঙ্গা জল! আছে, বিভ্রাটের পর্বটা ভয়ঙ্কর। একটু রয়েসয়েই বলি। মেইন ডিশের আগে হালকা স্টার্টার ভোজনের রুচি বাড়ায় বৈ কমায় না। রুশো ভাইদের একান্নবর্তী পরিবার। তার ছোট বোন এবং চাচাতো বোন দুজনে জাতীয় পর্যায়ে টেবিল টেনিসে গাইবান্ধাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং বরাবরই তারা তাদের জেলাকে গর্বিত করে। পরিবারের প্রায় সব তরুণ তরুণীই কোনো না কোনো খেলার সঙ্গে জড়িত। মফস্বল শহরে সূর্যাস্ত আইন বড্ড কড়াকড়ি, তাই যে কাজে এসেছি সে কাজ বিকেলেই শেষ হয়ে যায়। সন্ধ্যের পর থেকে অনেক রাত অবধি এই ক্রীড়াপ্রেমিক পরিবারটির সঙ্গে আড্ডা দিতে বেশ লাগছে। ক্রিকেট বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সর্বস্তরে; এটি আর শুধুমাত্র শহুরে খেলা বলে বিবেচিত হয় না। আমার বন্ধুমহলে আমিই একমাত্র কলঙ্ক, বাকীরা প্রায় সবাই ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত। রুশো ভাইয়ের ভাই বোনেরা আমার বন্ধুদের গল্প শুনতে চায়। পুরো পরিবারটিই বেশ আড্ডাপ্রিয় আর আড্ডার মূল বিষয়ই হচ্ছে ক্রীড়া। আর আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে এটা সেটা কত ধরণের খাদ্য! স্বভাবে আমি বেজায় পেটুক। ভালমন্দ খাইয়ে আমাকে ক্রীতদাসও বানানো সম্ভব। তাই বেশ সুসময় কাটছিল। যেদিন ঢাকায় ফিরবো বলে ভাবছি তার আগের সন্ধ্যেয় ছেলেগুলো অনুরোধ করলো আর একটা দিন বেশী থেকে যেতে। ফেলতে পারলাম না। এই অনুরোধ রক্ষার ফল যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা বিন্দুমাত্রও কল্পনা করতে পারিনি তখন।

মফস্বল শহরের পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ধরণের প্রতিযোগিতা লেগে থাকে। পরদিন অন্য এক পাড়ার সঙ্গে পশ্চিম পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচ। হাজার টাকার বাজি। মাইকিং না হলেও সারা বিকেল চায়ের দোকানে কিংবা রাস্তাঘাটে সবার মুখে এই খেলার আলোচনা শুনেছি। ছোট শহর, রমরমা অবস্থা। মফস্বল শহরগুলোতে মনোরঞ্জনের প্রতুলতা নেই। হ্যা, খেলা দেখার জন্যই একদিন বেশী থেকে যেতে বলেছে ছেলেগুলো। এদের মাঝে দু’জন রুশো ভাইয়ের পরিবারের আরেকজন ওদের বন্ধু; এরা তিনজনই খেলছে পরেরদিন। আর খেলা হবে পুরাদস্তুর ডিউস বলে। ভাবলাম মন্দ কি? খেলা দেখে না হয় একদিন পরেই ঢাকা ফিরলাম। আমার না ফেরাতে সামান্যতম ক্ষতি হবে না ঢাকা শহরের।

আসলেই এলাহি কাণ্ড। মাঠের চারদিকে অনেক দর্শক চাদর, গামছা, ছালা পেতে বসে আছে। পাশাপাশি দুটো প্যান্ডেলের নীচে দুই দলের বসার জায়গা। বাজির হাজার টাকার চাইতে ঢের বেশী খরচ হয়েছে এইসব আয়োজনে। বুঝলাম, বাজির টাকার চাইতে ‘ইজ্জত’-এর লড়াইটাই বড়। খেলা শুরু হতে কিছুটা সময় বাকী। সবাই কাপড় বদলে নিচ্ছে, সাদা পোশাক। বিভ্রাটের শুরু এখান থেকেই। ঐ তিন তরুণের একজন এক সেট কাপড় এনে বললো- নেন, তাড়াতাড়ি পইরা নেন। টসে জিতলে ব্যাটিং নিমু, আপনে ওপেনে যাইবেন। বিষয়টিকে ঠাট্টা হিসাবে নিব নাকি বিপদ হিসাবে তা নির্ণয়ের আগেই একজন এক জোড়া কেডস এনে জিজ্ঞেস করলো- দেখেন তো পায়ে লাগে কিনা? ভ্যাবাচেগা খেয়ে শুধু বলতে পারলাম- এসবের মানে কি? মানেটা একটু খোলাসা করি। এর আগে আমার যেসব বন্ধুদের নাম উল্লেখ করেছি; মানে যাদের মাধ্যমে রুশোর সঙ্গে পরিচয়; তাদের পরিচয়টা এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কামু ঐ সময়টায় ব্রাদার্সের উইকেট কিপার, শিপন মোহামেডানের ওপেনার এবং এরই মধ্যে জাতীয় দলের হয়ে শারজায় দুটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। সালাউদ্দিন তখন ব্রাদার্সের চৌকস অলরাউন্ডার, এক ওভারের ছয়টা বল ছয় ধরণের করতে পারতো, আড্ডায় বসেও আঙ্গুল নেড়েচেড়ে নতুন কোনো ডেলিভারির কথা ভাবতো। সারাক্ষন নতুন কিছু উদ্ভাবনের চিন্তা। সে কারণে ওকে আমরা আরকেমেডিস ডাকতাম। তখনও বুঝিনি একদিন ও জাতীয় দলের সহকারী কোচ হবে। সুমন দ্বিতীয় বিভাগে খেললেও ক্রিকেট জগতে তখন পরিচিত নাম; বিশিষ্ট খ্যাপের প্লেয়ার যাকে বলে। রুশো ভাই নিজেও দ্বিতীয় বিভাগের একটি দলের নিয়মিত খেলোয়াড় এবং বিকেএসপিতে সারোয়ার (প্রখ্যাত ক্রিকেট কোচ এবং বিকেএসপির ক্রিকেট শিক্ষক) স্যারের সহকারী হিসাবে কর্মরত। মোটের উপর বিকেএসপির প্রথম ব্যাচের বেশীর ভাগ ক্রিকেটারই আমার পরিচিত। কিন্তু এই সম্পর্ক গঠনে ক্রিকেটের কোনো হাত নেই। আমার ছোট বেলার বন্ধু, আমার পাশের বাসার শিহাব ঐ প্রথম ব্যাচেরই ক্রিকেটার। সে খেলতো আবাহনীতে। মাদ্রাজ-এ ডেনিশ লিলির কাছ থেকে কোর্স করা ‘ফাস্ট বোলার’ এই শিহাব। মাদ্রাজে থাকাকালীন ওর রুমমেট ছিল চামিন্দা ভাস। সমস্যা হল এই সবকিছুই এই ছেলে তিনটি জানে, গত ক’দিন এইসব গল্প করে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছি। আর সেই সুবাদে ওদেরও ধারণা হয়েছে আমি আর কিছু না হলেও অন্তত একজন ক্রিকেটার। তবে আমি ঘুনাক্ষরে কখনই বলিনি যে আমিও ক্রিকেট খেলি। কলোনীর মাঠে টেনিস কিংবা বড়জোর টেনিস বলে টেপ পেঁচিয়ে খেলেছি, তাই বলে ডিউস বল! এও হয়? আর আমার টেনিস ও টেপটেনিস কেরিয়ারে সর্বোচ্চ সংগ্রহ তখন অবধি ১৪; বুঝে লেও। ওদের ব্যাপারটা পরিষ্কার করলাম, কিন্তু সেটা তারা আমার বদান্যতা বলে ভেবে বসলো। হেসেই উড়িয়ে দিল। যতই বলি কাঠের (ডিউস, অনেকে আবার লেদার বলও বলে) বলে আমি জীবনেও খেলিনি, প্যাডস কিংবা গ্লভস পড়ে নড়াচড়া করার অভ্যেস আমার নেই; ততই তারা হাসে। কেউ আবার অভিমান করে বলে- ভাই এই পচা মাঠে খেলতে চায় না, স্টেডিয়ামে খেলে অভ্যাস তো! ও মা, সে কী কথা! স্টেডিয়ামের ঘাস একবারই মাড়িয়েছি স্কুলে পড়া অবস্থায়, বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ করতে গিয়ে। তা ছাড়া স্টেডিয়ামের সঙ্গে আমার সম্পর্ক লেখা আছে ২১ নম্বর গ্যালারীর (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে, খুব সম্ভব গ্যালারিটি এখন প্রেস বক্স) ইট সিমেন্টে, মাঠের ঘাসে নয়, মোটেও নয়। না, কিছুতেই তাদের বিশ্বাস করাতে পারলাম না। ততক্ষণে টস হয়ে গেছে। আগে ব্যাটিং, তার মানে ‘ওপেন’! আর কিছু না হলে শেষে দৌড়ে পালানোর পরিকল্পনাও করে ফেললাম। একসময় বেশ রাগত স্বরেই বললাম- আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমি গেলাম। একজন প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো- ভাই, আমরা গত তিন ম্যাচ ওদের সাথে হারছি; আপনেই ভরসা। খেলা আছিল আরো দুই দিন পর; আপনে আছেন বলে খেলা একটু আগিয়ে আনছি। সে কী কথা! সে সময়ে মোবাইল ফোনের চল ছিল না, নইলে সুমন কিংবা রুশোকে ফোন করে ওদের সঙ্গে কথা বলানো যেত; জল মিশ্রিত দুধের জল ও দুধ পৃথক হয়ে যেত। দুচোখে অন্ধকার দেখা শুরু হল, সেই সাথে তলপেটে চিনচিনে একটা ব্যাথা। এরই মধ্যে আম্পায়ার আর বিপক্ষ দলের ফিল্ডারস মাঠে নেমে গেছে। প্যান্ডেলের নীচে একদল ছেলে অসহায়ের মত চেয়ে আছে আমার দিকে। একজন বললো- আপনের ওপেনে ভরসা না থাকলে চাইরে (টু ডাউন) যান। তার প্রস্তাব অন্যান্যের মনে ধরলো। ভাবলাম কিছুটা সময় আরো পাওয়া গেল ওদেরকে বোঝানোর জন্য। না, সে আশাতেও গুড়ে বালি; ৩ ওভার না যেতেই স্কোর ১২ রানে দুই উইকেট। ক্যাপ্টেন জানালো- দল চাপে আছে, আপনের ভাল উইকেট এখন হারালে সমস্যা। আপনে আরেকটু পরে যান। আমার উইকেট তাও আবার ভাল! ধরণী ঝটিতি দিধা হও গো! আর এমন হতচ্ছাড়া দল সচরাচর দেখা যায় না; ৩২ রানে চারটি উইকেট পড়ে গেল; বুঝলাম যে কোনো মুহূর্তে ডাক আসবে। তলপেটে চিনচিন ব্যাথাটা ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে, হালকা কাঁপুনিও অনুভব করলাম; অতিরিক্ত টেনশনে এমনটা হয়। একবার ভাবলাম নামতেই যদি হয় তবে যেন কপালে মিরাকল কিছু ঘটে, যে রকমটা সিনেমাতে ঘটে থাকে; মানে নামলাম আর চার-ছক্কার ছড়াছড়ি, একাই জিতিয়ে দিলাম অসহায় একটি দলকে। কিন্তু হায় নিজেকে যে খুব ভাল করেই জানি, কোনো রকম মিরাকল আমার শূন্য করা ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না। হঠাৎ করে পেটে হাত দিয়ে গোংরানো শুরু করবো কিনা ভাবছি। যেমন অভিনয় কেউ কখনও করতে পারে নি তেমন অভিনয় করে বুঝিয়ে দিব এমন পেটের ব্যাথা কখনও কাউরো হয়নি। অভিনয়টা ধরা পড়ে গেলে আবার বড় লজ্জার ভিতরে পড়তে হবে। না, মাঠে বুঝি নামতেই হচ্ছে, আমি ধীরে ধীরে পোশাক পাল্টাচ্ছি, হঠাৎ বেদম কাঁপুনি শুরু হল। কাঁপতে কাঁপতে বুকের পাঁজরে তোলপাড় অবস্থা। এমন কাঁপুনির ঘটনা এর আগে দুবার মাত্র ঘটেছিল; একবার সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে বাৎসরিক পরীক্ষা চলাকালে বিজ্ঞান পরীক্ষা দেবার সময়, আরেকবার মেট্রিক পরীক্ষায় অংকের প্রশ্ন দেখে। সত্যিই, কাঁপুনি কোনোভাবেই থামছে না। বিপক্ষ দলের প্যান্ডেল পাশেই ছিল। লাল-নীল প্যান্ডেলের নীচে হাসির রোল উঠলো। সেখান থেকে কে যেন বললো- ভাইয়েক টয়লেটে লিয়ে যা। অনেকে হয়তো ভাবলো কাঁপুনিটা ছুতো; একজনতো বলেই বসলো- ভাই, আপনে মনে হয় মানইজ্জতের ভয়ে আছেন, এই গাইবান্ধার কোনো বোলারের বলে আউট হইলে বন্ধুরা আপনেরে চেতাইবো। কিন্তু একজন বলে উঠলো- ভাইয়ের বুঝি শীতে ধরছে। (গাইবান্ধায় পৌষে দারুণ শীত বটে, কিন্তু এ কাঁপুনি শীতের জন্যে নয় রে!) এই ছোকরাকে শুরু থেকেই একটু অন্য রকম লাগছিল, মনে হচ্ছিল আমার আগের কথাগুলোও সে বুঝতে পেরেছিল; বেশ বিচক্ষণ। তা না, পরে বুঝলাম ওকে বসিয়েই দলে আমাকে জায়গা দেয়া হয়েছে।

ঈশ্বর স্বয়ং এসে সেদিন আমাকে রক্ষা করলো শেষোবধি; মাঠে নামতে হল না। অনবরত কাঁপতে থাকা একজনকে মাঠে নামানোর ঝুঁকি কেই বা নেবে! হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, দল দেড়শ পেরুলো। দলের স্কোর ১৫৮, আমি খেললে তা হত ১৩৯। যে ছেলেটি আমার কাঁপুনি ঠেকাতে দলে জায়গা ফিরে পেয়েছিল, তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১৯। দল শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি আর তার দায়ভার আমার উপরই বর্তেছে সিংহভাগ। পরদিন বিকেলের রেলগাড়ি ধরবার কথা থাকলেও রাতের রেলেই ঢাকা রওনা হলাম। বড্ড লজ্জা লাগছিল যে! ঐ মুখ নিয়ে ঐ ক্রীড়াপ্রেমী পরিবারটির সঙ্গে আর সময় কাটানো যায়?

গাইবান্ধা ছেড়ে অনেকদূর চলে এসেছি। ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। দিনের কথা স্মরণ হতেই শিউরে উঠছে শরীর, ছি কী লজ্জা! খেলার ভয়ে কাঁপতাম না যদি টেনিস বলে খেলা হত। অমন একটা প্রচণ্ড গোলক ধেয়ে আসবে, সেটা থেকে কি করে রক্ষা পেতাম? আর কোনোমতে প্যাডস, গ্লভস, এটা ওটা গার্ডস দিয়ে শরীরটাকে রক্ষা করা গেলেও দলকেতো রক্ষা করা যেত না। অমন ধেয়ে আসা মারনাস্ত্র আমি কিছুতেই ঠেকাতে পারতাম না। নির্ঘাত শূন্য। অমন ব্যাটিং দেখে হাসির বন্যা বয়ে যেত গোটা গাইবান্ধায়। টেনিদার সহচর প্যালারামের ক্রিকেট অভিজ্ঞতা আরেকবার মঞ্চস্থ হত। বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছি। সম্মানের কিছুটা হানি হয়তো হয়েছে; বৃহত্তর হানি থেকে তো বাঁচা গেল।

ভ্রমনে বিভ্রাটের আগের পর্বগুলো- ভ্রমনে বিভ্রাট ১ | ভ্রমনে বিভ্রাট ২ | ভ্রমনে বিভ্রাট ৩ | ভ্রমনে বিভ্রাট ৪ | ভ্রমনে বিভ্রাট ৫

ছবি- ইন্টারনেট


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হা হা হা... পড়তে পড়তে ঠিক প্যালারামের কথাই মনে পড়ছিল, বাদ দেননি দেখছি। চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ঈয়াসীন এর ছবি

হে হে, প্যালারাম আমার প্রিয় চরিত্র

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

মন মাঝি এর ছবি

হা হা - বড় বাঁচা বাঁচছেন! দেঁতো হাসি

****************************************

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

মজা পেলাম। আগের বিভ্রাটগুলো পড়া হয়নি। এই পর্ব পিছনে তাকাবার আগ্রহ জারি করলো।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ভাই, এ যে রজ্জুকে সর্পভ্রম! পটলার গল্পের মত মনে হলো!

____________________________

ঈয়াসীন এর ছবি

পটলার গল্প পড়া নাই। পড়ে নিব কোনো এক সময়।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

শক্তিপদ রাজগুরুর লেখা। চরম একটা সিরিজ। একসময় ভাইয়াকে দিয়ে শারদীয়া শুকতারা কেনাতাম এর জন্য।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবই ভাল লাগলো। উত্তম জাঝা!

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

তারেক অণু এর ছবি

দেঁতো হাসি বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল বোঝাই যাচ্ছে-

ঈয়াসীন এর ছবি

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

Nuruzzaman Labu এর ছবি

মজা পাইলাম।

নুরুজ্জামান লাবু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।