গাঁয়ের নাম মহেরা। ছোট্ট গ্রাম; পূব প্রান্তে টুক্কুর গোলা, পশ্চিমে তালুকদার বাড়ীর পুকুর, উত্তরের শেষ বাড়ীটি নজুমিয়াদের। তালুকদারদের পর তারাই গাঁয়ের ধনী। দক্ষিনে অবারিত সবুজের সুখরঙা ঢেউ; সেই ঢেউ বইতে বইতে আছড়ে পড়েছে আকাশের তটে। এ বাড়ী ও বাড়ী মিলে গোটা ত্রিশেক পরিবারের বাস। গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে ডাক্তার বাড়ী। সৈয়ম ডাক্তার ইংরেজ সেনাবাহিনীতে ডাক্তারি করতেন, বয়সের ভার আর ডায়াবেটিসের বাড়াবাড়িতে পাঁচ বছর আগে গত হয়েছেন; তবে ডাক্তার বাড়ী এখনওযে তাঁর নামেই নামকরণের সার্থকতা বহন করে যাচ্ছে তা নয়। সৈয়ম ডাক্তারের বড় ছেলে সালাউদ্দিন ডাক্তারি পাশ করে ঢাকা মেডিকেলে সরকারী চাকরী করেন অনেকদিন যাবত। প্রতি সপ্তাহেই গাঁয়ে আসেন, বাড়ীতে আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক রোগী এসে ভিড় করে তখন। সালাউদ্দিন রোগী দেখেন, বিনা পয়সায় ঔষধ দেন, পূর্বে দেয়া নির্দেশানুযায়ী নিয়ম মত ঔষধ না খেলে কিংবা খাবার আর বিশ্রামে অনিয়ম করলে বেদম রাগারাগি করেন রোগীদের উপর। মারতেও উদ্ধত হন মাঝেমাঝে, তবে মারা হয়ে ওঠে না। গ্রামবাসীর প্রতি অগাধ মায়া তার। ত্রিশের মধ্যে প্রায় পঁচিশটি পরিবারই দরিদ্র। দরকার পড়লে নিজেই রোগীকে নিয়ে গিয়ে মির্জাপুর হাসপাতালে ভর্তি করান, সারারাত জেগে থাকেন রোগীর শিহরে। এই অভ্যেসটা তার পিতার রেখে যাওয়া সম্পদগুলো থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সালাউদ্দিন ডাক্তারকে গাঁয়ের মানুষ ভালবাসে, তবে যত না ভালবাসে তার চেয়ে ঢের বেশী ভয় করে। একটা দু’নলা বন্দুক আছে তার, সেটিও পিতার রেখে যাওয়া। এই গাঁয়ে আর কারো বন্দুক নেই। তাছাড়া খুব বদরাগী মানুষ তিনি।
পাশের গ্রামের নাম ছাওয়ালি, মস্ত বড় আর গোছানো গ্রাম। সেখানে সাপ্তাহিক হাঁট বসে। মহেরাতে কোনো বাজার নেই বিধায় মহেরার লোকজনকে সেখানে গিয়েই বিকিকিনি করতে হয়। ছাওয়ালিতে প্রকাণ্ড এক জমিদার বাড়ী আছে; সেখানকার জমিদারদের সঙ্গে পুরনো একটি শত্রুতা ছিল ডাক্তার বাড়ীর। সে অনেক আগের কথা। সৈয়ম ডাক্তার তখন বেঁচে ছিলেন। সালাউদ্দিনের বয়স তখন বাইশ তেইশ হবে হয়তো। তার ছোট বোন জাহানারা তখন সাত-আট বছরের ছোট্ট বালিকা। এগারো ভাইবোনের মধ্যে এই বোনটিকে বড্ড ভালবাসতেন সালাউদ্দিন। জাহানারা সফেদা ফল পছন্দ করতো খুব। ছাওয়ালির জমিদার বাড়ীর বাগানে সফেদা গাছ ছিল কয়েকটি। কী যে অসম্ভব মজা সে সফেদা! মিষ্টি আর বেলে বেলে, মুখে পুরলে মুখ রসে ভরে যায়। মায়ের চোখের আড়াল হলেই জাহানারা লুকিয়ে গিয়ে সেই গাছ থেকে কোচর ভর্তি করে সফেদা পেড়ে নিয়ে আসতো। পরের গাছের চুরি করা ফল খেতে দেখলেই মা মারতে আসতো আর তখুনি সালাউদ্দিন ঢালের মত সামনে এসে দাঁড়িয়ে রক্ষা করতো ছোট বোনটিকে। বোনকে বোঝাতো- আর পাড়িস না অন্যের গাছের সফেদা, আমি কিনা আইনা দিমুনি বাজার থিকা। উপদেশ গ্রহণ করবার মত মস্তিষ্ক তখনও গড়ে ওঠেনি জাহানারার। একবার নিস্তব্ধ এক দুপুরে মনের আনন্দে সফেদা পাড়ছিল জাহানারা। জমিদার বাড়ীর সকলে তখন ভাতঘুমে। মালিকেও দেখা যাচ্ছিল না আশপাশে। কিন্তু জমিদারের হতচ্ছাড়া ছেলেটা শব্দ পেয়ে দৌড়ে এলো। গাছটি অত বড় নয়। জাহানারা তখন মাঝামাঝি এক ডালে। জমিদারের ছেলে গাছের গোঁড়া ধরে ঝাঁকাতে থাকে। গাছ থেকে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায় জাহানারা। মালি এসে চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে কিছুক্ষণ পর, কিন্তু ছোট্ট জাহানারার ছোট্ট হাত দুটো ভেঙ্গে যায়। গগন মালি নিজেই কোলে করে ডাক্তার বাড়ী পৌঁছে দেয় তাকে। মেয়েটি তখন ভয়ঙ্কর ব্যাথায় হাউমাউ করে কাঁদছে। মালির কোল থেকে বড় ভাইয়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়েটি। সালাউদ্দিন ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু করে দিল বোনের ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে। বাবা চটজলদি চিকিৎসা শুরু করলেন। মালির কাছে বিস্তারিত জেনে নিল সালাউদ্দিন। জাহানারার কান্না কিছুটা থেমেছে, বারবার ভাইয়ের কোলে চড়তে চাচ্ছে। সালাউদ্দিন বললো- এহন তোরে কোলে নিমুনা বইন, আরেকটু কান; আমি কামডা সাইরা আহি, তারপর তোরে আর কোল থিকা নামামু না। জাহানারাকে হাসপাতালে নিতে হবে। ডাক্তার বাবাই সঙ্গে করে নিয়ে যাবে তাকে। কিন্তু ওর ইচ্ছে ভাইয়ের কোলে চড়ে হাসপাতালে যাবার। ভাই তখন ঘরে নেই, গ্রামে নেই। ভাই তখন ছাওয়ালি বাজারের মুখে ময়রার দোকানের সামনে জমিদারের ছেলেকে মাটিতে ফেলে চ্যালা কাঠ দিয়ে পেটাচ্ছে। তার সঙ্গে তার একান্ত বন্ধু এবং সকল দুঃসাহসী অভিজানের একান্ত সহযোগী ধলা ভাই। এই ধলা মিয়া সম্পর্কে তার চাচাতো ভাই হয়, বয়সে কিছুটা বড়। দুজনের গায়েই অসুরের মত শক্তি, দুজনেই লম্বায় ছ’ফুটের উপরে, দুজনেরই দড়ির মত পাকানো মেধবিহীন শরীর। জমিদারের চারজন লাঠিয়ালও পেরে উঠছে না তাদের দুজনের সঙ্গে। জমিদারপুত্র বেশ আহত হল, থানা-পুলিশ হল, মামলা হল, কয়েকদিন জেলও খাটতে হল সালাউদ্দিনকে আর জমিদার পুত্রকে কয়েদিন হাসপাতালে থাকতে হল। সেই থেকেই জমিদারদের সঙ্গে ডাক্তারবাড়ীর সম্পর্ক সাপে-নেউলে। এরপরই ডাক্তার দু’নলা বন্দুক কেনেন একটি।
গাঁয়ের অন্য দুই বনেদী পরিবার ডাক্তারদেরই নিকট আত্মীয়। তালুকদার বাড়ী সৈয়ম ডাক্তারের শ্বশুরবাড়ী আর উত্তরের বিল ঘেঁষা বাড়ীটিও ডাক্তারের চাচাতো ভাইয়ের। সেই চাচাতো ভাইও মারা গেছেন, সৈয়ম ডাক্তারও আর নেই। নজু মিয়া ডাক্তারের সেই চাচাতো ভাইয়ের বড় ছেলে; বয়সে সালাউদ্দিনেরই সমান।
বাবা মারা গেছেন পাঁচ বছর হয়, মা গাঁয়ের বাড়ীতেই থাকেন। দেশের অবস্থা উত্তাল। সালাউদ্দিন সে সময়টা ঢাকায় থাকে, তবে সপ্তাহে একবার ঠিকই গ্রামে যায় মাকে দেখতে আর রোগী দেখতে। ঢাকা মেডিকেলে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তার। ধানমণ্ডিতে তার বাসা। তার নিজের পরিবারও বড়; পাঁচ ছেলেমেয়ে। এক রাতে কিছু বুঝবার আগেই কেয়ামত শুরু হয়ে গেল ঢাকা শহরে। সে কী ভয়ঙ্কর শব্দ! সে রাতে পশুর সশস্ত্র আক্রমনে ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষ মরেছে অগনিত। সে রাতে ইপিআর, রাজারবাগ, পুরান ঢাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তের সাগর বয়ে গেছে, আর সেই রক্ত থেকে লাফিয়ে ওঠা আহত সিংহিনির মত উত্থিত হয়েছে পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গার অঙ্গীকার।
দু’দিন পর কারফিউ ভাঙ্গতেই সালাউদ্দিন পরিবারের সকলকে নিয়ে গ্রামে চলে এল। হায়েনার থাবা তখনও গ্রাম অবধি এসে পড়েনি। শহরের মত আতঙ্ক না থাকলেও গ্রামজুড়ে একটি থমথমে অবস্থা বিরাজমান। গাঁয়ের মানুষ সালাউদ্দিনের কাছে ঢাকার কথা শুনতে চায়, মুজিবের কথা শুনতে চায়। যুদ্ধ শুরু হবার দু’সপ্তার মাথায় সালাউদ্দিনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেই সঙ্গে দু’নলা বন্দুকটি এবং ধলা ভাইও গ্রাম থেকে উধাও। তারা দুজনেই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। মাস দুয়েকের মাথায় জানা গেল সালাউদ্দিন আর ধলামিয়া মিলে আশপাশের গ্রামের কিছু তরুণকে সংগঠিত করে তৈরি করেছে এক দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনীর দল। তারা রাতের অন্ধকারে পাক মিলিটারি ক্যাম্পে চোরাগোপ্তা হামলা চালায়, মিলিটারিদের ব্যবহৃত নৌকোগুলোর তলা আগে থাকতে ফুটো করে দেয়, ব্রীজের পিলারগুলোতে গোপনে বোমা বেঁধে আসে। তারা সংখ্যায় মাত্র ১৪ জন, কিন্তু শক্তিতে অসীম। এ শক্তি যে হৃদয় থেকে আসে, এ শক্তি আসে বিশুদ্ধ রক্ত থেকে, মুক্তির চিরন্তন কামনা থেকে। মহেরাতে তখনও পাকবাহিনী আক্রমন করেনি। নিকটবর্তী পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছাওয়ালির সেই জমিদার বাড়ী। সেই জমিদারেরা কয়েক বছর আগেই পাকাপোক্ত ভাবে দেশ ছেড়েছে। তাদের নায়েব এতদিন দেখাশুনা করতো প্রকাণ্ড প্রাসাদটি। পাকবাহিনী এসে সেখানেই ঘাটি গাড়ে। ‘সালাউদ্দিন’ আর ‘ধলা’ নাম দুটো তখন অত্র এলাকার পাকবাহিনীর চক্ষুশূল।
অনেকদিন মাকে দেখে না সালাউদ্দিন, দেখে না ছেলে মেয়েগুলোকে, বৌকে; তাদের কথা ভাবতেই চোখ জ্বালা করে ওঠে। ভাইবোনেরা সবাই বিয়েথা করে সংসারী। তারাও কি আসতে পেরেছে গ্রামে? এ সময় গ্রামে যাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়, পাশের গাঁয়েইতো শুয়োরদের আস্তানা। তাছাড়া সে জেনেছে তার চাচাতো ভাই নজুমিয়া রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। অগাস্টের মাঝামাঝি সময় এক রাতে সে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বৃষ্টি পড়ছিল ঝিরিঝিরি; পিচ্ছিল মেঠো পথ; সালাউদ্দিন আর তার পিছনে বাজারের থলে হাতে ধলা ভাই। থলেতে বাজার নেই, অন্য কিছু। ধলামিয়াকে বারণ করেছিল আসতে, কিন্তু ধলা মিয়া হ্যা না কোনো উত্তর দেয়নি, মাথা নিচু করে পিছু পিছু চলে এসেছে। ছায়াকে বারণ করলে ছায়া কি সঙ্গ ছাড়ে? দরজায় আস্তে টোকা দিয়ে সালাউদ্দিন বললো- মাগো, দরজা খুলো; আমি আইছি। মায়ের সে কী আনন্দ! প্রতীক্ষিত ঈদের চাঁদ কিংবা হঠাৎ পাওয়া গুপ্তধন, ধুর কোনো কিছুর সঙ্গেই কি সে আনন্দের তুলনা হয়? হয় না। সালাউদ্দিন মাকে বললো- মা, বেশিখন থাকুম না। আকাশ কালা থাকতে থাকতেই যামুগা। কয়ডা ভাত দাও। যা আছে তাই দাও বাসুনে। নতুন কইরা কিছু রান্দনের দরকার নাই। দেরী হইলে বিপদগো মা। আহা, মা কি আর শোনে সে কথা! সালাউদ্দিনের বৌ বাচ্চারা কেউ বাড়ীতে নেই। পাশের গাঁয়ে ক্যাম্প বসার সঙ্গে সঙ্গেই মা তাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। বুড়ি মা একাই বাড়ী আগলে রেখেছে।
মা জলদি করে একটু আতপ চালের ভাত চড়িয়ে দিলেন হাড়িতে। খোপ থেকে দুটো কবুতর বের করে খুব করে মশলা মেখে কষাতে লাগলেন। ছেলের বারন কানে তুললেন না। সালাউদ্দিনের প্রিয় খাবার কবুতরের ঝাল কষানো মাংস আর চালের রুটি। চালের গুড়া ঘরে ছিল না, তাই ভাত চাপানো হয়েছে উনুনে। রাত যত গভীর হয় পিশাচেরা ততই সক্রিয় হয়, সক্রিয় হয় ধূর্ত শিয়ালেরা, সক্রিয় হয় হায়েনারা। ছোট্ট গ্রাম, গভীর রাতের নিস্তব্ধতা; মশলার ঘ্রাণ, চুলোর ধোঁয়া, বুড়ি মায়ের থেকে থেকে কান্নার শব্দ- কিছুই চেপে রাখা গেল না। সালাউদ্দিন আর ধলা মিয়া মাত্র থালায় ভাত নিয়ে বসেছে। অত উঁচু করে ভাত নেয়া সচরাচর চোখে পড়ে না। বুড়ি মা কবুতরের মাংস তুলে দিচ্ছেন তাদের পাহাড়-উঁচু ভাতের চুড়ায়। হঠাৎ বাড়ীর চতুর্দিক ঘিরে ভারী বুটের শব্দ। হায়েনারা ঘিরে ফেলেছে বাড়ী। ধলা মিয়া বাজারের থলেতে হাত ঢুকানোর আগেই রাইফেলের বাটের আঘাতে তার কপাল থেকে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগলো। দুজনকেই বেঁধে ফেলা হয়েছে শক্ত দড়ি দিয়ে। মা শুধু বললো- বাজানেরা এহন ভাতে বইছে, ভাতটুক খায়া নুইক। সৈন্যদের পিছনে সালাউদ্দিনের চাচাতো ভাই নজুমিয়া। ক্যাম্পে দুই দিন দুই রাত বেয়নেট খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের পর বিলের ধারে নিয়ে গিয়ে হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের দুজনকে গুলি করে বিলের পানিতে ছুড়ে ফেলা হল।
যাদের সর্বাঙ্গ প্রাণশক্তিতে ভরা, যাদের দুচোখ ভরা স্বপ্ন, যাদের সংকল্পের জমিন জুড়ে মুক্তির বীজ বোনা, তারা কখনও কখনও তাদের নিয়তি নিজ হাতেই গড়ে নেয়, অদৃষ্টের ভার মেনে নেয় না। যতটুকু প্রাণ ছিল তাদের দেহে ততটুকু দিয়েই প্রাণপণে ভেসে থাকার চেষ্টা করলো তারা। ভাসমান অবস্থায় এক জেলে নৌকা তাদের উদ্ধার করলো। অলৌকিক নয়, লৌকিকতার বলেই দুজনেই প্রাণে বেঁচে গেল। মির্জাপুর হাসপাতালে গিয়ে ধলা মিয়ার পেটের চামড়ায় আটকে থাকা বুলেটটি সহজে বের করা গেলেও, সালাউদ্দিনের মেরুদণ্ডের হাড়ের পাশে আটকে থাকা বুলেটটি বের করা গেল না। সেটি বেশ ভিতরে ঢুকে গেছে। ভয়ঙ্কর ব্যাথা। অপারেশন করে বের করতে হলে দু’তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হবে, কিন্তু তা মোটেও নিরাপদ নয়। মিলিটারিরা নিয়মিত টহল দেয় প্রতিটি ওয়ার্ডে। ডাক্তারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং তুলো-ব্যান্ডেজ নিয়ে চলে গেল সালাউদ্দিন। চলে গেল আবার যুদ্ধের ময়দানে। বুলেটের অস্তিত্ব প্রতিটি ক্ষণেই জানান দিতে থাকে তীব্র ব্যাথা, কিন্তু সেসব তখন বড্ড তুচ্ছ।
যুদ্ধ শেষ হল, বিজয় এলো। কী অসম্ভব সুন্দর সে বিজয়! সোনালী সূর্যের মত সুন্দর। ধলামিয়া বললো- আগে হাসপাতালে যাই, চল। তোমার গুলিডা বাইর কইরা আনি, পিঠে তোমার ঘাউ ধরছে, অনেক ব্যাথা সইয্য করছো ভাই। সালাউদ্দিন একটু মুচকি হাসলো, বললো- ব্যাথাডা থাইক আর দুইডা দিন। নও যাই, কামডা সাইরা আহি। তারা যখন গ্রামে পৌঁছুল, তখন দুপুরের গায়ে ঝিমুনি রঙ ধরেছে, একটি গাভী চোখ বুজে ঝিমোচ্ছে নজুমিয়ার গোয়ালঘরে, বাছুরটি অবাকচোখে চেয়ে আছে বেড়ার দিকে। শূন্য উঠোনে কি যেন খুটে খুটে খাবার চেষ্টা করছে তিনটি চড়াই। বাড়ীতে নজুমিয়া একা। মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর অবস্থা বেগতিক দেখে বাড়ীর অন্য সবাইকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। দুটি পাকানো দড়ির মত শরীর সম্মুখে দেখে নজুমিয়া ভুতদেখা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইল; বললো- তোমরা বাইচা আছো? ধলামিয়া বললো- রাখে আল্লাহ মারে কে, তা তোমারে কিন্তু আইজ আর আল্লাহ রাখবো না। মোট তিনটি গুলি খরচ করলো সালাউদ্দিন; একটি পেটে, একটি বুকে আর মৃত্যু নিশ্চিত করবার জন্য একটি মাথায়। গুলি করবার আগে সালাউদ্দিন বললো- আমারে ধরাইছ, মাইর খাওয়াইছ, তার নিগা তোমারে মাফ করতে পারতাম। কিন্তু আমার মায়ের গতরে হাত দিছ, তোমার ছাড়ান নাই।
গুলির শব্দে চড়ুইগুলো উড়ে গেল বিলের দিকে; শূন্য উঠোন। তারা যখন গ্রাম ছেড়ে অনেকদূর চলে এসেছে তখন ধলামিয়া প্রশ্ন করলো- ভাই, চাচীর গতরেতো নজু হাত দেয় নাই; তাইলে যে কইলা তোমার মা’রে নজু মারছে! সালাউদ্দিন অনেক দূরে তাকিয়ে রইল, যতদূর অবধি তাকানো যায় তার থেকেও দূরে। দুচোখ ভরে দেখতে থাকলো সবুজের ছড়াছড়ি, সর্ষের ক্ষেতে নববধুর হলদে শাড়ির আঁচল, একঝাক নাম নাজানা পাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশে, কোন এক গেঁয়ো বাউল একতারা হাতে কি যেন গাইছে, উদোম গায়ে তিনটে অল্প বয়েসী ছেলে আলপথ ধরে দৌড়ুচ্ছে, তাদের একজনের হাতে ছেড়া কাগজের লালসবুজের পতাকা, তারা দৌড়ুচ্ছে, তারা বলছে- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। সালাউদ্দিনের চোখ ভরা থই থই জল, বললো- ধলা ভাই তোমার জাননের কাম নাই এইডা কোন মা। তুমি খালি সারাডা জীবন আমার বুগলে বুগলে থাইকোগো ভাই। নও যাই, এইবার হাসপাতালে যাই।
মন্তব্য
আরও যত্ন নিয়ে লিখা উচিত ছিলো। খসড়ার মতো লাগছে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কোনো নির্দিষ্ট অংশ নাকি পুরোটাই খসড়া মনে হচ্ছে? একটু খুলে বলেন ভাই। একটু বিস্তারিত। যেকোনো সমালোচনা সাদরে গৃহীত হবে। । পরবর্তীতে লেখার সময় তাহলে বিষয়টি মাথায় থাকবে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
গল্প লেখার পর সেটা খসড়া হয়, তারপর একটু আধটু পড়ে, কিছু শব্দ, লাইন বদলে দিয়ে সেটাকে পাঠকের পাতে দেয়া হয়। এটাই সাধারণ নিয়ম। আপনার গল্পটা পড়ে মনে হলো, সম্ভবত লেখার পর আর পড়া হয়নি। যদি হতো, তাহলে সালাহউদ্দিন ডাক্তার ‘তার’ থাকতেন না, ‘তিনি’ হয়ে যেতেন। গল্পের আবহ সেটাই দাবী করে।
দ্বিতীয় পাঠের পর ‘মহেরাতে কোনো বাজার নেই বিধায় মহেরার লোকজনকে সেখানে গিয়েই বিকিকিনি করতে হয়’এই লাইনটাতে ‘বিধায়’ এর মতো শব্দ আপনি অবশ্যই রাখতেন না বলে মনে হয়েছে, কিংবা বাক্যের শুরুতে ‘মাহেরাতে’ বলে আবার চার শব্দ পরে ‘মাহেরার’ লোকজন নাও বলতে পারতেন।
ঢাকায় পাকিস্তানীদের আক্রমণের রাতটার বর্ণনায় পাকিস্তান শব্দটা আসা প্রয়োজন ছিলো। সেখানে শুধু পশু বলা হয়েছে। আপনার সাথেতো এটা যায় না।
আপনি একটা গল্প বল্লেন। সেটা পড়ার সময় যখন বাক্য নিয়ে খচখচানি তৈরি হয় পাঠকের, তখন সেটারে খসড়ার মতো লাগে। মনে হয় আরেকটু বিন্যস্থ হলে ভালো হতো। এখানে গল্পের খামতি নেই, বলার কিছুটা সমস্যা হয়তো আছে। তবে সেটা লেখক নিজেই বের করতে পারলে চমৎকার হয়। একেবারে মিহি সমস্যা।
আপনি মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর ‘ক্যাম্প’ পড়েছেন? ফজলকে ঠিক এমন একটা অবস্থা থেকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিলো মতি রাজাকার। ফজলকে মেরে ফেলে। এখানে দুজনই বেঁচে গেলেন। একটু সিনেম্যাটিক হলেও ভালো লেগেছে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ধন্যবাদ। আসলেই তাড়াহুড়া হয়ে গেছে। সময় নিয়ে পরে ঠিক করবো, আর ঠিক করার সময় পয়েন্টগুলো অবশ্যই মাথায় রাখবো। 'ক্যাম্প' পড়া হয়নি। এমন ঘটনা অনেক। তবে গুলি খেয়ে বেঁচে যাওয়া যথেষ্ট সিনেম্যাটিক হলেও এই ঘটনা নির্জলা সত্য। সালাউদ্দিন আমার আপন বড় মামা আর তার সেই ছোট্ট বোনটি আমার মা। মামা, মা সবাই মারা গেছেন, ধলা মিয়া এখনও বেঁচে আছেন। এইসব কথা আমি মায়ের কাছ থেকে, ধলামিয়ার কাছ থেকে শৈশবে শুনেছি। বড় মামা আমাদের পরিবারের গর্ব। ১৯৮৫ তে তিনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ঢাকায় মারা যান। তখন আমি খুব ছোট, ক্লাস ফাইভে পড়ি। তবে মামা একবার আমাদের বাসায় আসবার পর তাঁর বুকে পিঠে অনেক ক্ষত চিহ্ন দেখেছিলাম।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
এভাবে গুলি খেয়ে সাতরে বা পানিতে ভেসে বেঁচে যাবার ঘটনা অনেক আছে আমাদের ভাটি অঞ্চলে। সম্ভবত পানির এলাকার মানুষ বলে পানিতে এরা অনেক স্বতস্ফুর্ত, তাই বেঁচে যেতে পেরেছেন। আমি নিজে এমন কয়েকজনকে দেখেছি। হাসান মোরশেদ দাশ পার্টি নিয়ে যে পুস্তক লিখেছেন, তাতেও একজনের কথা পাবেন (সম্ভবত)
আপনার মামা! তাহলেতো আপনার খবরাছে। এতো কাছের একজনকে নিয়ে এমন ছন্নছাড়া গল্প তৈরি করাটা ভারি অন্যায়। আপনার উচিত হবে ধলা মিয়ার কাছ থেকে যতটা পারা যায় তথ্য নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পুস্তক তৈরি করা। সেটা হোক ১৬ পাতার, তবুও।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
পুরাই সহমত।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সাবলীল ভঙ্গী, মুহূর্তেই গল্পের ভেতর টেনে নেয়। বোঝাই যায় ঈয়াসীন ভাইয়ের কলমে যাদু আছে। কিন্তু গল্পটা যেন আরো পরিসর দাবী করে। প্রায় অনুচ্ছেদেই মনে হচ্ছে আরো একটু বিস্তৃতি থাকলে ভালো হতো।
সোহেল ইমাম
ধন্যবাদ। হ্যা, আরেকটু বিস্তৃত হওয়া উচিৎ ছিল।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
এমন গল্প গুলিতে প্রায়ই একটা অংশ থাকে, যেখানে মা আকুলতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, মাঝ রাত্তিরে রান্না বসান ছেলে্কে একটু ভাল কিছু খাওয়াতে, আর তাতেই সময় আর সুযোগ মিলে যায় রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলতে। আমার মনে হয় ঐ মায়ের মনের অবস্থা। সে কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারে, আবেগের আতিশয্যে সন্তানকে বিপদে ফেলার জন্য?
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
নজুভাইয়ের সাথে আপনার কথোপকথনে নজর রাখছিলাম। এই বীরদের নিয়ে আরও গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সচলে নজুভাই একজনই। সে নজরুল ইসলাম তাই
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন