আমার বন্ধু হাসান

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৮/০৪/২০১৬ - ১০:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(কিছু চরিত্র কাল্পনিক, কিছু বাস্তব। কারো সঙ্গে মিলে গেলে লেখককে দোষারোপ করবার পূর্বে নিজেকে শুধরে নিয়েন।)

তখন আমরা থাকতাম পুরান ঢাকায়। গায়ের সাথে গা লাগানো বাড়িঘর, ইট পাথর আর সুরকির দারুণ সখ্যতা! এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে অনায়াসে লাফিয়ে লাফিয়ে পাড়ার এমাথা-ওমাথা ঘুরে বেড়ানো যেত। পাড়ার মানুষগুলোর মধ্যেও ছিল গায়ের সাথে গা লাগানো সম্পর্ক। সবাই সবার হাড়ির খবর জানতো। আমরা যে বাড়িটিতে থাকতাম তাতে মোট সাত ঘর পরিবার ছিল। আমাদের ঠিক সামনে দুটি বাড়ি- যার একটি এক ধনী ব্যবসায়ীর তিনতলা দালান আর অন্যটি গাছগাছালিতে ঘেরা টিনের চালা ওয়ালা ছিমছাম মস্ত একটি ঘর; টিনের চালের উপরে গোটা বাড়ি ছায়া দিয়ে আগলে রাখা একটি প্রকাণ্ডাকার জামরুল গাছ। তাতে বিশাল বিশাল জামরুল ধরতো, আমাদের ছোট হাতের মুঠোয় ঢেকে রাখা মুশকিল একেকটি জামরুল। ভরা বর্ষায় সাদা রঙ ভেদ করে সবুজ পাতা দেখা যেত না গাছটির। বাজারের জামরুলগুলো সাদার মাঝে হালকা সবুজাভ, কিন্তু ও বাড়ির জামরুলগুলো ছিল একদম সাদা; আর সে কী স্বাদ! না এখনও মুখে লেগে আছে তা নয়, তবে আমাদের মস্তিস্কের কোনো এক বিশিষ্ট স্মৃতি-কোষে সেই জামরুল ঠিকই স্থান করে নিয়েছে। বাড়ির পিছনেই দেয়ালের ঐপারে আমাদের স্কুল। দেয়াল টপকেই স্কুলে চলে যেতাম। আমাদের সকাল বেলার এলার্ম ঘড়ি ছিল কলতলার ঝগড়া। ভোর হলেই বাড়ি বাড়ি থেকে গৃহপরিচারিকারা কলসি নিয়ে জড় হত কলতলায়। কে কার আগে কলসি ভরবে তা নিয়ে প্রতি সকালে ঘটে যেত নিয়মিত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ। যদিও খুব কম সময়ই সে যুদ্ধ হাতাহাতি কিংবা চুলোচুলির পর্যায়ে যেত, কিন্তু যেসব ‘গালি’ শুনে শুনে আমাদের ঘুম ভাঙ্গতো সেসব ভয়ানক; সেসবও স্থায়ী আসন করে নিয়েছে আমাদের স্মৃতি-কোষে, আর সেই কোষগুলো খুবই সমৃদ্ধ। আমাদের পাড়ার গঠন ছিল সরল; লম্বা একটা গলি যার দুধারে জড়াজড়ি করে থাকা আমাদের বসতি। গলির একধার একটি মসজিদ থেকে শুরু হয়ে অন্যধারে গিয়ে হরিদা’র ডালপুরির দোকানে গিয়ে শেষ হয়েছে। হরিদা’র ডালপুরির কথা আলাদা করে না বললেই নয়। ডালপুরিকে হরিদা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন; তা খেতে কেমন তা কি করে বুঝাই? ব্যাপারটা অনেকটা এমন- ধরু, বাই এনি চান্স, থার্ড আম্পায়ারের অনেক রিভিউয়ের পর বেনেফিট অফ ডাউটে বেহেস্তে যাওয়ার কোনোরকম সৌভাগ্য আমার ঘটতো আর সেখানে যখন অন্যান্য যত্নাত্তি আর সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে আমার নিজস্ব খাবারের তালিকার উইশ লিস্ট জানানোর অপশন থাকতো তবে বিলক্ষণ বেহেস্তে বসে প্রতি বিকালে হরিদা’র হাতে ভাজা ডালপুরি খেতাম! না, এমন প্রত্যাশায়ও গুড়েবালি, কেননা হরিদা’র স্বর্গ আমার বেহেস্তের চেয়ে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে; হরিদা’রা মালু, হরিদা’রা ছিলেন আমাদের শৈশবে শেখা ‘লাল পিপড়া’।

আমাদের ভাড়াবাড়িটি ছিল দোতলা। প্রতি তলায় তিনটি করে ফ্ল্যাট। এক তলার একটি ফ্ল্যাটে একঘর সাবলেট ভাড়াটিয়াও ছিল। সাত ঘর পরিবারের বলতে গেলে সবাই ছিলাম নিম্নতম মধ্যবিত্ত ঘরানার। অভাব আমাদের সকাল বিকাল কেলিয়ে কেলিয়ে দাঁত দেখাতো। তবে আমাদের মাঝে হৃদ্যতার অভাব ছিল না বিন্দুমাত্র। সব ফ্ল্যাটেই আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। কত দিন পাশের বাসার বন্ধুর সাথে খেলতে খেলতে দুপুর হয়ে এলে ওদের বাসাতেই স্নানাহার সেরেছি। আমার পাশের বাসার বন্ধুটির নাম হাসান। আমরা সমবয়সী ছিলাম। হাসান ছিল দুরন্ত এক কিশোর। সরু সরু কার্নিশগুলোতে ওর মত দ্রুত আর কেউ দৌড়ুতে পারতো না। খুব সহজেই গাছ বেয়ে পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করে আনতে পারতো সে। হাসান আমার শৈশবে দেখা টারজানের বালক সংস্করণ। বন্ধু হলেও আমি তাকে সমীহ করতাম তার বীরত্বগাথার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে হাসান ছিল আমার শিক্ষক; তবে সেসব বাঁদরামি শিক্ষা পরবর্তী জীবনে খুব একটা কাজে লাগেনি। আমরা সবাই সব বাড়ির আদর পেতাম, তবে কবির ভাই আদর পেতেন সব চেয়ে বেশি। কবির ভাই কখনও কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি, কখনও কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলেননি। অমন ভদ্র আর শিক্ষিত একটি ছেলে গোটা পাড়ায় খুঁজে পাওয়া যেত না। আমরা ছোটরা বড়রা মিলে বিকেল বেলায় যখন ফুটবল খেলতাম, অষ্টম শ্রেণীতে পড়া কবির ভাই তখন নবম শ্রেণীর অংকের বই নিয়ে কঠিন কঠিন অংক ঝালাই করতেন। ভর দুপুরে আমরা যখন কাঠফাটা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে ঘুড়ি উড়াতাম কিংবা সিঁড়িঘরে কাচের গুড়ো, আঠা আর রঙ মেখে নাটাইয়ের সুতোয় মাঞ্জা দিতাম, তখন কবির ভাই ইয়া মোটা শরৎ রচনাবলী পড়তে পড়তে মস্তিস্ককে খানিক বিশ্রাম দিতেন অংক কষা থেকে। সাতটি পরিবারের প্রতিটি ছেলেকেই মা বাবারা কবির ভাইকে আদর্শ হিসেবে গ্রহন করতে বলতেন। আমরা, মানে আমি আর আমার শিক্ষকতুল্য বন্ধু হাসান ভুলেও ও রাস্তায় হাঁটতাম না। পড়ার বই, গল্পের বই তখন আমাদের টানতো না একটুও। ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সবুজ ফড়িঙের সঙ্গে ছিল আমাদের ভীষণ বন্ধুত্ব, আমাদের এইম ইন লাইফ ছিল কার্নিশ বেয়ে পাশের বাড়ির গাছ থেকে সবচেয়ে বড় জামরুলটি পেড়ে আনা কিংবা জয়া’দের বারান্দা থেকে সবচেয়ে বড় আর সুন্দর গোলাপটি চুরি করে নিয়ে আসা। আশপাশের সবগুলো সুতো কেটে দিয়ে একটি চক্ষুদার ঘুড়ি আকাশ দাপিয়ে বেড়াবে একা এক শাহেনশার মত, অন্যসব ছাদের ছেলেরা বোকার মত সেদিকে তাকিয়ে থেকে হিংসায় জ্বলবে- তাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। তবে হ্যা, কবির ভাইকে আমরা সবাই কিছুটা হিংসা করতাম, এ কথা সত্য। তিনি সবার বাড়তি আদর পেতেন যে! আবার অবাকও হতাম, ভাবতাম এ কেমন ছেলে গো- খেলতে পছন্দ করে না! না, কবির ভাই খেলাধুলো যে করতেন না তা নয়; দাবা খেলতেন তো! কবির ভাইয়ের মেট্রিকের ফল যেদিন বেরুলো, সে এক এলাহি কাণ্ড! আমাদের যে শাখা গলিটি পাড়ার মূল গলি ছুঁয়েছে সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। এই প্রথম এই গলিতে সাংবাদিক এসেছে, তাও একজন নয়, বেশ কয়েকজন; তাদের সাথে কবির ভাইয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং মহল্লার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। কবির ভাই ঢাকা বোর্ডে প্রথম হয়েছে। এর গুরুত্ব কি, তা তখন অতটা বুঝতাম না। ভিড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখে এলাম, খাটের উপর মধ্যখানে কবির ভাই বসা, দুপাশে তার মা আর বাবা। সাংবাদিকেরা ছবি তুলছে পটাস পটাস। আমরা বিচ্ছুর দল বুঝে না বুঝে শ্লোগান জুড়ে দিলাম- কবির ভাই, কবির ভাই, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ; বলা বাহুল্য সেই শ্লোগান মুখর মিছিলের অগ্রভাগে ছিল বিচ্ছুবর হাসান। বাসায় ফিরে ভাত খাওয়ার পর মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো- আহারে আমার বাসায় যদি এমন সাংবাদিকেরা আসতো! চেষ্টা করিস বাপ, কবিরের মতন হইতে। না, ঐসব বৃথা চেষ্টা আমি কখনও করিনি। বয়স যত বেড়েছে, পড়ালেখার সঙ্গে দূরত্ব ততই গভীরতর হয়েছে পৌনঃপুনিক হারে। শুধু পড়ালেখা কেন, জীবনে কোনো ক্ষেত্রেই এমন কিছু করিনি যা নিয়ে আমার মা গর্ব করতে পারে। বাসায় ফিরে ভাত খাবার পর হাসানের মাও নাকি হাসানের মাথায় হাত বুলিয়ে ঐ একই আবদার রেখেছিলেন। হাসানও ঐ দুর্গম দুস্তর পথ মাড়াবার ঝুঁকি নেয়নি, সেই দুরূহ পথ এড়িয়ে আমারই পথের সাথী হয়েছিল সে।

আমরা দু’বন্ধু কেউই আমাদের মা’দের সুখী করতে পারিনি। তবে আমার ব্যাপারটি খানিক ভিন্ন, আমি কিংবা মা কেউই ঐসব সিরিয়াসলি নেইনি। আমার মা বলতেন- ‘পড়ালেখা করস আর নাই করস, বড় হইয়া মানুষ হইস’। মা আমাকে কখনও খুব ভাল কোনো ছাত্র হবার জন্য তাগাদা দেয়নি। হাজার হোক ছেলের সামর্থ্য মায়ের চাইতে ভাল আর কেই বা বোঝে! ওদিকে হাসানের মায়ের সবসময় একটি আক্ষেপ ছিল হাসানকে নিয়ে। ছেলেকে তিনি কবির ভাইয়ের মত করে বড় করতে চেয়েছিলেন, পারেননি।
এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। হাসান আর আমি এখনও আগের মতই বন্ধু। হাসানের মা মারা গেছেন, আমার মা-ও বেঁচে নেই। আমার জীবন নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ কিংবা অনুশোচনা নেই; কিন্তু হাসান মাতৃবিয়োগের পর থেকেই বড্ড অনুশোচনায় ভোগে। ওর মায়ের স্বপ্ন ছিল হাসান পড়ালেখা করে বড় হয়ে মস্ত বড় কিছু একটা হবে; ডাক্তার, ইঞ্জিনয়ার নতুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার মত হাসানও সেসব হতে পারেনি, ওসব হবার কথা আমাদের ছিল না। কবির ভাইকে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। কতদিন দেখা হয়নি! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার দেখা মিলল আবার। দেখা পেয়ে ভাল লাগলো খুব। তিনি এখন কেতাদুরস্ত মস্ত বড় এক ব্যক্তিত্ব। তার প্রতিপত্তি আকাশ ছোঁয়া। পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি, তার প্রোফাইলে চোখ পড়লে চোখ কপালে ওঠে। বহু বড় বড় কোম্পানির লোকজন কোমর বেঁধে তাকে নিজেদের দলে ভিড়াতে চাইছে। শুনেছি বিদেশ গিয়ে এক ঘণ্টার একটি মিটিঙে বসে কিছু পরামর্শ দিলেই কয়েক লাখ টাকা চলে আসে তার ব্যাংক একাউণ্টে। বিশ্বের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই বক্তৃতা দিয়ে আসেন তিনি। বছর খানেক ধরে তিনি আমার আর হাসানের অনলাইন বন্ধু। তার বিচক্ষণতা আর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তার প্রতিটি লিখিত স্ট্যাটাসে। আমরা নিয়মিত তার অনলাইন স্ট্যাটাস অনুসরণ করি আর তার জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হই। এমন সুপ্রজ্ঞ কবির ভাইকে আমরা যতই দেখি ততই গর্বিত হই। আজ এত বছর পর সত্যিই খানিকটা অনুশোচনা হয়, কেন যে ফড়িং জামরুল আর চক্ষুদার ঘুড়ির পিছনে দৌড়ে দৌড়ে এই এককালীন জীবনটাকে পার করে দিলাম! হাসানকে ইদানীং বিষণ্ণতায় ভর করেছে। কবির ভাইয়ের আজকের এই সফলতা হাসানের অনুশোচনার মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে অনেক। শুরুতে কিছুটা আক্ষেপ হয়েছিল আমার নিজের মাঝেও, কিন্তু তা ঝেড়ে ফেলতে সময় লাগেনি। আইনস্টাইনের মত আমারও দুটি হাত, দুটি পা, একটি মাথা থাকলেই আমি আইনস্টাইন হতে পারবো এর কোনো মানে নেই। আবার আইনস্টাইনও কখনই পারবে না ‘এই আমি’ কিংবা ‘হাসান’ হতে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে পাঁচিল টপকে পাশের বাড়ির বাড়িওয়ালার রক্তচক্ষুর আড়ালে পিচ্ছল ডাল বেয়ে জামরুল পেড়ে আনা অত সহজ কথা নয়। এসব বলে সান্ত্বনা দিয়েছি হাসানকে, কাজ হয়নি, ও শুধু বলে- ‘কেন যে ছোটবেলা থিকা কবির ভাইরে পদে পদে ফলো করিনাই! কবির ভাই যেই স্কুলে পড়ছে আমরাওতো সেই স্কুলেই পড়ছি, একই বিল্ডিঙে থাকছি, আইজকা দেখ তুই-আমি কই আর কবির ভাই কই! জীবনে মনেহয় খালি ভুলই কইরা গেলাম দোস্ত’! হাসানকে আমার ইদানীং চিনতে কষ্ট হয়। সেই আমার চিরচেনা পোংটা বন্ধুটিকে আর খুঁজে পাচ্ছি না। জানি, জামরুল পাড়ার চেয়ে বিদ্যার্জনের গুরুত্ব অনেক; কিন্তু সবাইকে দিয়ে সব কিছুতো হয় না।
কখনও কখনও এমনতো হয়- এক ঝটকায় কোনো কোনো বাস্তবতা এসে অনুশোচনার অন্ধকার গভীর কুয়ো থেকে আমাদের আলোয় তুলে আনে। অর্থাৎ যে ভুলটাকে ভুল ভেবে অনুশোচনায় মূঢ় হয়ে আছি, হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকের মত একটি সত্য এসে জানালো- না, সেতো ভুল নয়। কুয়াশা কেটে গেলে, মায়ার ভ্রম কেটে গেলে রুঢ় সত্যটা বেরিয়ে আসলে পরে মনজুড়ে দারুণ এক পরিতৃপ্তি আসে।

এবারের বর্ষবরণ দিবসটি অনুষ্ঠিত হবার আগে ব্যপক সারা ফেলেছে বিভিন্ন ধাঁচের ফতোয়া। রাষ্ট্রীয় ধর্ম রক্ষায় এইসব অনুষ্ঠান যে সার্বিকভাবে পরিত্যাজ্য সেটিই ছিল সেইসব ফতোয়ার সারাংশ। হেফাজত, জামাত, ওলামালীগ সহ ধর্মীয় সংগঠনগুলো এইসব অপপ্রচার প্রায়ই চালিয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে; তবে এবছর সাধারণ মানুষদেরও তাতে অংশগ্রহণ বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ধর্ম যেন যায় যায় অবস্থা, আর তা রক্ষা করবার প্রধান উপায় হচ্ছে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার মত বিধর্মী বেলেল্লাপনা বন্ধ করা! অমন যে অমন কবির ভাই, তিনিও তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তার অভিব্যক্তি। কবির ভাই মহাজ্ঞানী এবং মহাশিক্ষিত, তিনি যখন কিছু বলেন বা লিখেন তাতে যথেষ্ট জ্ঞানগর্ভ প্রজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। পহেলা বৈশাখের ঠিক আগের সন্ধ্যায় ভুমিকম্পের পরপরই তিনি লিখেছেন তার বিচক্ষণ চিন্তাধারা। মঙ্গল শোভাযাত্রা আর কিছু পুতুল যে কখনই আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না আর এইসব অনাচার ও শিরক ঠেকাতেই যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের সতর্ক করার উদ্দেশ্যে ভূমিটাকে হাল্কা কাঁপিয়ে দিয়েছেন- এটি অন্যান্য কয়েক লক্ষ মহাজ্ঞানীর মতন কবির ভাইও জানেন এবং অবলীলায় তা প্রকাশ করেছেন। কবির ভাই বিজ্ঞানের ছাত্র, এ বিষয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এই যে আমি কিংবা হাসান সল্পশিক্ষিত দুটি বন্ধু ভুমিকম্পের যেসব কারণ এতদিন জেনে এসছি; অর্থাৎ ভুঅভ্যন্তরে অবস্থিত প্লেট, ফল্ট এবং অন্যান্য যা কিছু আজগুবি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, তার সবই তুরি মেরে উড়িয়ে দিলেন কবির ভাই। শুধু কি তাই! এইযে অধুনা একের পর এক মুক্তচিন্তক মানুষগুলোকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারা হচ্ছে, সে বিষয়েও সুপ্রজ্ঞ কবির ভাই তার সুচারু যুক্তির ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন; তিনি দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে উপর দিকে থুথু মারলে নিজের মুখে থুথু পড়বেই কিংবা ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হবেই। তিনি এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা ঠিকই করেছেন আর সেইসাথে লেখককে কলমের ঔদ্ধত্যে লাগাম ধরতে বলেছেন, নইলে এমন হত্যাকাণ্ড তো হবেই, তার জন্যতো লেখাই দায়ী। কবির ভাইয়ের এমন পর্যবেক্ষণে মন কিছুটা আহত হলেও এটিকে এমন কোনো ঘটনা বলে মনে হয়নি আমার, বহু শিক্ষিত মানুষেরই ভুমিকম্প এবং মুক্তচিন্তক হত্যা সম্পর্কে এমন ধারনা রয়েছে; তবে এই ঘটনাটিই আমার চিরচেনা হাসানকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিল। কবির ভাইয়ের স্ট্যাটাসগুলো পড়েই হাসান ফোন করলো আমাকে- ‘দেখছস, ছাগলে লেখছে কি? পড়ালেখা করলেই ছাগল মানুষ হয় না। ল্যাঞ্জা ঢাকনের ক্ষমতা কোনো ছাগলেরই নাইরে দোস্ত। খুন করে একজন, দুইজন; কিন্তু খুনের দায় এই কবির ভাইয়ের মতন ছাগলের উপরও বর্তায়। আর ভূমিকম্পের রিজন কি কইছে দেখছস? আল্লাহর রহমত যে কবির ভাইয়ের মতন ছাগল হই নাই। দোস্ত জীবনে কোনো ক্লাসেই আমার আর তোর রোলনম্বর ৪০ এর এইদিকে আসে নাই, কিন্তু মনে হইতাছে আমি কবির ভাইয়ের চাইতে বহুত বেটার ছাত্র; তুইও। আমরা অল্প শিখছি, কিন্তু যা শিখছি তা জামরুলের মতন সাদা’। এরপর আরেকটি গালি দিয়েছিল হাসান, সেটি আর লিখতে পারলাম না। সেই যে বলেছিলাম- জামরুলের শুভ্রতা আর কলতলার গালাগাল আমাদের স্মৃতি-কোষে সুরক্ষিত হয়ে আছে! যাইহোক, আমি আমার বন্ধুকে ফিরে পেলাম, আমার শিক্ষকতুল্য বন্ধু হাসানকে আবার ফিরে পেলাম।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

চমৎকার লেখা। চলুক
শেষটা আরেকটু বড় করতে পারতেন। তনু হত্যা, প্রশ্ন ফাঁস-- এগুলো নিয়েও কবির ভাইয়ের লেজের নড়নচড়ন আসতে পারতো।

পাঁচ তারা।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ঈয়াসীন এর ছবি

ধন্যবাদ।
আসলে 'কবির ভাই' চরিত্রটি কাল্পনিক নয়। নামটি শুধু পাল্টানো হয়েছে। সে যে ব্যাপারে লিখেছে সেগুলিই শুধু উল্লেখ করেছি। আর হাসান নামে কস্মিনকালেও আমার কোনো বন্ধু ছিল না। হাসান চরিত্রটি একেবারেই বানানো।
পাঁচ পাঁচটি তারার জন্য আপনাকে আরো পাঁচ পাঁচবার ধন্যবাদ।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

ফুল্গার্ল এর ছবি

চমৎকার!

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হুমম... সকল লছাগুর মাইদ্যে গছাগু থাকে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ঈয়াসীন এর ছবি

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

অতিথি লেখক এর ছবি

কবির ভাইয়ের মতো ছাগু আইজকাইল অহরহই দেখতাছি।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলেই যে সত্যিকার জ্ঞানী হওয়া যায় না,বাস্তবজগতের জ্ঞানটাও লাগে,কবির ভাই এর আদর্শ উদাহরন।

ঈয়াসীন এর ছবি

ঠিক তাই।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

'কবির ভাই'য়ে ভরা এই সময়ে 'হাসানে'র মত বন্ধু ফিরে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।

ঈয়াসীন এর ছবি

ডাইনে বায়ে উপরে নীচে- দশদিক জুড়ে শুধু ছাগু আর ছাগু।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সোহেল ইমাম এর ছবি

আমরা অল্প শিখছি, কিন্তু যা শিখছি তা জামরুলের মতন সাদা’

অসাধারন লাগলো কথাটা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আরে, হাচল হয়ে গেলেন নাকি? অভিনন্দন! হাততালি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- এবং হাচল হবার জন্য অভিনন্দন। আমি আপনার লেখা নিয়মিত পড়ি, ভাল লাগে।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সোহেল ইমাম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ঈয়াসীন ভাই হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সোহেল ইমাম এর ছবি

হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মাসুদ সজীব এর ছবি

ভীষন ভাবে ছুঁয়ে যাওয়া একটি লেখা চলুক

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

ইয়ামেন এর ছবি

একেবারেই জীবন থেকে নেয়া। আমরা সবাই আমাদের জীবনে এমন এক বা একাধিক কবির ভাইকে দেখেছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখার জন্য চলুক ইয়াসীন ভাই।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

গগন শিরীষ এর ছবি

ভাল লেগেছে লেখা!

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চলুক
আমার মনে হয় সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ে ভুমিকম্প কেন হয়, টেকটনিক প্লেট এসবের উপর কিছু কথা থাকা দরকার (আছে নাকি এখন?)

আর, টিভিতে বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু অনুষ্ঠান করা দরকার। আমরা ছোটবেলায় একটা দেখতাম অণু-পরমাণু, মনে আছে ডেভিড সুব্রত দাসের ইলেক্ট্রনিক্স এর আঁকিঝুঁকি। এখন অবশ্য ইন্টারনেট আছে প্রায় সবার; অবশ্য সবাই কি জ্ঞানে আলোকিত হতে পারল? বরং, ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো কুশিক্ষা আর অমুক নিউজ২৪ এর চটকদার খবরেই মজে গিয়েছে অনেক। একারণে এখনও দু'একজন সুনিতা উইলিয়ামসের খরব ফেসবুকে শেয়ার করে। কেন যেন, ভালো আর সঠিক তথ্যের চাইতে ভুল আর প্রোপাগান্ডা বেশি দ্রুত ছড়ায় মন খারাপ মানুষ সেনসেশনাল বা চাঞ্চল্যকর খবরই বেশি পছন্দ করে।

শুভেচ্ছা হাসি

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

চিতাম্বর এর ছবি

বহুদিন পর সচলায়তনে মন্তব্য করলাম। লেখা ভাল হয়েছে। আরও আসুক এরকম। ধন্যবাদ।

ঈয়াসীন এর ছবি

ধন্যবাদ

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।