একটি যাত্রা শুরু হয়েছে, বড় দেরী হয়ে গেলেও যাত্রাটি শুরু হয়েছে। সেই চলমান যাত্রায় কোনো এক অংশে নিজেও যাত্রী হলাম। মেঠো পথ ধরে হাঁটছি আমরা তিনজন। ঢালু সেই পথ নেমে গেছে সুরমা নদীর এক খেয়াঘাটে। এইসব পরিবেশ অনেকদিনের অচেনা। হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত সুন্দর কিছু ফুল দেখে এক জায়গায় থামতে হল। রাস্তা থেকে নেমে ক্ষেতে গিয়ে বসলাম। ছুঁয়ে দেখছি ফুলগুলো। নাম জানি না। সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলে যদি লজ্জা পেতে হয়! যদি ভাবে এইটাও চিনি না! একটু কাছে গিয়ে বুক ভরে সেই ফুলের গন্ধ নিলাম, এই গন্ধ ধনে পাতার। সত্যি বলছি, ধনে পাতা খেয়েছি অনেক কিন্তু ধনে পাতার ক্ষেত এর আগে দেখিনি কখনও। এর যে ফুল হয় আর সেই ফুলগুলো যে দেখতে এত মায়াবী তা জানতাম না। এতে গর্বের কিছু নেই, এটি আমার ব্যর্থতাই। খুব ছোট ছোট বলে প্রথমটায় পাতাগুলোও চিনতে পারিনি। বিজ্ঞের মত ‘ধনে ফুল ভারী সুন্দর’ বলতে বলতে উঠে এলাম রাস্তায়; ভাবখানা এমন যে আগেই জানতাম এটি ধনে ক্ষেত। ছোট্ট দুটি নাম না জানা পাখি উড়ে গেল ক্ষেতের উপর দিয়ে। শুধু ধনে ফুল আর পাখি দুটিই নয়, এই গোটা এলাকা সম্পর্কেই আমি অজ্ঞাত।
সাঁতার জানিনা। কাঁধের ব্যাগে বৌ একটি লাইফ জ্যাকেট দিয়ে পইপই করে বলে দিয়েছিল যখনই যেখানে জল পার হতে হয় আমি যেন লজ্জাশরমের তোয়াক্কা না করে জ্যাকেটটি ব্যবহার করি। না, পারলাম না। নৌকায় এতোগুলো মানুষের চোখের উপর সে সাহস পেলাম না। সবাই যদি হাসে! নৌকায় হরেক রঙা মানুষ; গায়ের রঙের কথা বলছি না। বলছি উদ্দেশ্যের বিভিন্নতার কথা। কারো হাতে দুটো নধর মুরগি, কারো ঝুরিতে শীতের সবজি, দুটো ছেলের গায়ে স্কুলের পোশাক, আলাপচারিতায় বোঝা গেল একজন ইউনিয়ন অফিসে যাচ্ছেন কোনো এক কাজে আর আমরা যাচ্ছি একেবারে ভিন্ন এক উদ্দেশ্যে। দৈনন্দিন কর্মতালিকার একেবারে বাইরে অথচ ভীষণ জরুরী এক কাজে। সেই কাকভোরে সিলেট শহর থেকে রওনা হয়েছি। পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। আমার যে দুজন সঙ্গী তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অনলাইনে। ঢাকা থেকে আসবার সময় নজরুল এর সঙ্গে প্রথম দেখা আর সিলেটে এসে দেখা পেলাম মোরশেদের। সকালে গাড়িতে উঠে তিনজনেই আবিস্কার করলাম যে আমরা তিনজনেই ভয়াবহ পর্যায়ের চা খোর। অত ভোরে পথে চায়ের দোকান চোখে পড়েনি। নদী পার হওয়ার সময় নজরুল বললেন- ঐ পারে নাইমাই কিন্তু আগে এক বালতি চা খামু। ঘাটে নেমেই সবার আগে চায়ের দোকানে ঢুকলাম আমরা।
আমরা যে ঘাটে এসে নামলাম তার নাম দোয়ারা বাজার, সুনামগঞ্জের একটি উপজেলা। আমাদের যেতে হবে আরো ভিতরের কিছু গ্রামে। আমরা কিছু মানুষকে খুঁজছি, যে মানুষদের কেউ খোঁজে না। আমরা কিছু ঘটনাকে খুঁজছি, যে ঘটনাগুলো এখন আর কাউকে ছুঁয়ে যায় না। প্রথমেই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এর সঙ্গে দেখা করে কিছু প্রাথমিক তথ্য জেনে নিলাম। তিনি আমাদের থাকবার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের ডাকবাংলোর একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা যার পর নাই কৃতার্থ হলাম। কিন্তু সমস্যা প্রকট হল যখন আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছুলাম। বাংলোর চারটি ঘরের একটিই খালি আছে। সেই ঘরের ভিতরেই খাটের পাশে একটি পানির পাম্প। তাতে আর সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল এই পাম্পটি চালু দেয়ার একমাত্র সময় নাকি রাত দুটোয়। কেয়ারটেকার হাতে কলমে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে পাম্প চালু করতে হবে। দুই ঘণ্টা সেটি চালু রাখতে হবে। একবার ভাবুন, রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠে পাম্প চালু করে রাত চারটা পর্যন্ত সেই বিকট শব্দের মধ্যে খাটে বসে থাকতে হবে! আমাদের অন্য উপায় ছিল না। ব্যাগ ট্যাগ রেখে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এই প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মধ্যে নজরুলের কাঁধে প্রায় বিশ কেজির একটি ব্যাগ। এই প্রয়োজনীয় জগদ্দল পাথরটি তিনি হাসিমুখে বয়ে বেড়ান প্রতিটি ফিল্ড ট্রিপে, মাইলের পর মাইল হাঁটেন; বিরক্তি নেই, ক্লান্তি নেই। নজরুল আর মোরশেদ- তাঁরা এই যাত্রা শুরু করেছেন আরো তিনমাস পূর্বে।
প্রথম গন্তব্য টেংরাটিলা। সেখানে যার সঙ্গে দেখা করবার কথা তিনি আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। তার কাছ থেকে খবর পেলাম আমরা যাঁদের খুঁজছি সেরকম সাতজন মানুষ এখনও জীবিত আছেন কাছেই আরেকটি গ্রামে। তিনি নিজেই যোগাযোগ করে তাঁদের সাতজনকে একত্রে কোথাও অপেক্ষা করতে বললেন। এইসব বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য মোরশেদ আগেই নিয়ে রাখেন, তবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ স্থানীয় কারো সাহায্য নিতেই হয়। গ্রামটির নাম- মহব্বতপুর। ‘আসফ আলীর চায়ের দোকান’ নামে একটি দোকানে তাঁদের অপেক্ষা করবার কথা। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা যখন সেখানে পৌঁছুলাম, দেহাতি সেই চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলো সাতটি ভাঙাচোরা মুখ। গাল বসে গেছে, তেলের অভাবে রুক্ষ চুল, খসখসে হাতের চামড়া, চোখগুলো একেবারে কোটরে ঢুকে গেছে। তাঁরা জানতে চাইলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি, জানালাম। এরপর বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন এত দূর দূর থেকে এই অজপাড়াগাঁয়ে আমরা কেন এসেছি। বললাম- আপনাদের কথা শুনতে। এমন অবাক তাঁরা গত ৪৫ বছরে কখনো হননি। তাঁদের কোটরে ঢোকা তেরোটি চোখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে কী তৃপ্তি সেই চোখে, সে কী দীপ্তি সেই চোখে! তাঁদের মাঝে একজনের একটি চোখ নেই, ৪৫ বছর আগে সেই চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। পাঠক, এই সাতজন দেহাতি বৃদ্ধ একাত্তরের সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা এক মহাকালের সাক্ষী, তাঁরা এক মহাকাব্যের কোনো এক খণ্ডের রচয়িতা; সেই মহাকাব্যের পঙক্তিমালা শুনবো বলেই আমরা এতদূর এসেছি। এই রচয়িতারা আর বেশিদিন বাঁচবেন না। সত্যি বড় দেরী হয়ে গেছে। আর কয়েক বছর পর জীবিত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো।
গ্রামের এক ধারে স্থানীয় সাবসেক্টর কমান্ডার জনাব হেলালের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়েছে, সেই সৌধের উদ্দেশ্যে আমরা দশজন হাঁটা ধরলাম। আমাদের সেই মিছিলে অংশ নিল আরো কিছু উৎসাহী গ্রামবাসী। হাঁটতে হাঁটতে ৪৫ বছর ধরে বলতে না পারা স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে সাতজন বৃদ্ধ ক্ষণে ক্ষণে যেন ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন সেই একাত্তরে। পাকিস্তানী আর্মি গ্রামে হানা দিলে তাঁরা জঙ্গলে কোন বড় গাছটির পিছনে লুকাতেন তা দেখালেন। সে জঙ্গলে নাকি মশা আর বানরের উপদ্রব ছিল ভীষণ। বানর ঘাড়ের উপর বসে খামছে ধরলেও তারা শব্দ করতে পারতেন না। এইযে রাস্তার পাশে একটি ছোট্ট ডোবা; তাতে নাকি গোটা একটি রাত ডুবে থাকতে হয়েছিল তাঁদের। কচুরিপানার আড়ালে কোনোমতে মুখটিকে পানির উপরে ভাসিয়ে রেখে সারারাত লুকিয়ে ছিলেন তারা। ডোবায় জোক ছিল অনেক। তাঁদের চোখে একটি স্বপ্ন ছিল; সেই স্বপ্ন তাঁদের জাগতিক সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখতো। বানর হয়তো খামছে ঘাড়ের চামড়া ছিঁড়ে নিয়েছে, জোক আর মশা শুষে নিয়েছে রক্ত, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিলনা মোটেও; অন্য সব যন্ত্রণা ভুলে তাঁরা শুধু সেই স্বপ্নটিকে জিইয়ে রেখেছিলেন। সেই স্বপ্নই একদিন বিজয়ের সোনালী সূর্য হয়ে উদিত হয়েছিল পুবের আকাশে।
এবার আরেকটি ব্যর্থতার কথা বলি। দেশ ছেড়ে আসবার পর গত ১৬ বছরে যতবার দেশে গিয়েছি ততবারই পেটের গণ্ডগোলে ভুগেছি। আগে ফকিরাপুল বাজারের নর্দমার পাশে ইটালি রেস্তোরায় পরটা আর ভুনা ডাল খেতাম; চটপটি, সস্তা হালিম কোনোকিছুতেই কোনো সমস্যা হত না। লোহার মত শক্ত পেট ছিল বৈকি। এখন দেশে গেলেই সেই পেট তরল হয়ে উঠে। দেশে গিয়ে প্রতিবারই তিনচারদিন বিছানায় কাটাতে হয়। এবার তাই খুব সাবধানে ছিলাম। দেশে যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই নিয়মিত একটি ওষুধ খাচ্ছিলাম। সেটি আসলে একটি ব্যাকটেরিয়া, যা পাকস্থলীর জন্য সামান্য মাত্রায় ক্ষতিকর। উদ্দেশ্যটা হল অধিক মাত্রায় দূষিত আর ভেজাল খাদ্যে হঠাৎ কোনো বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পাকস্থলীকে অল্প অল্প করে ভেজালে অভ্যস্ত করা। পেটের এই বিষয়টিতে ভয়ানক লজ্জার ভিতরে থাকি, কিন্তু বাস্তবকে এড়াই কি করে?
আমরা মহব্বতপুর স্মৃতিসৌধের মাঠে কয়েক ঘণ্টা ৭১ এর মহাকাব্যের আবৃত্তি শুনলাম। তাঁরা বলতে পারার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের একজন, যিনি ছিলেন তাঁদের প্লাটুন কম্যান্ডার, আমাদেরকে উঠে আসবার সময় আক্ষেপ করে বললেন- আহারে, আপনেরা কতদূর থিকা আসছেন, আপনাগো কোনো আপ্যায়ন করতে পারলাম না, কিছু দিতে পারলাম না। আজ এই বৃদ্ধ বয়স আর দারিদ্রের ভারে ন্যুজ, কিন্তু চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দুর্ধর্ষ এক সেনাপতিকে; স্টেনগান হাতে তিনি ছুটে যাচ্ছেন টেংরাটিলা পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পের দিকে, ছোট্ট দলটিকে নিয়ে পজিশন নিচ্ছেন কোনো এক ঝোপের আড়ালে, হুঙ্কার দিচ্ছেন ‘ফায়ার’ আর তখনি টেংরাটিলার শুয়োয়ের খামার ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে কিছু পবিত্র বুলেট। এমন একজন যখন কাতর হয়ে বলেন- আপনাদের তো কিছু দিতে পারলাম না, তখন তুচ্ছ আমার মুখে কীইবা শব্দ আসে! কাঁপাঠোঁটে শুধু বলতে পারলাম- আপনারা আমাদের যা দিছেন, তা কেউ দিতে পারেনা; আপনারা এই দেশটা আমাদের দিছেন।
মাঠের সাথেই লাগোয়া বাড়িটি একাত্তরে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানীরা। সে বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে বাজারের দিকে ফিরছিলাম। অতি দরিদ্র পরিবারটি। আমাদের দেখে হয়তোবা গৃহিণী কিছু একটা হাড়িতে চড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে আতিথেয়তার এই সংস্কৃতি এখনও আছে এবং থাকবে। আমাদেরকে নেমন্তন্য দিতে উঠান পেরিয়ে এগিয়ে এলেন স্বামীস্ত্রী দুজনেই। আমার পেট নিয়ে দুশ্চিন্তাটি চিলিক দিয়ে উঠলো। কিছু ভাববার আগেই রাস্তার পাশেই ছোট্ট অলিন্দে আমাদের খাবার চলে এলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে আগের রাতের বাসি ভাতগুলো কিছু ছোলা সমেত ভেজে আনা হয়েছে। বুঝলাম এই খাদ্য পেটে গেলে ওষুধের কার্যকারিতা উপেক্ষা করে সর্বনাশা এক তরল প্রবাহ বয়ে যাবে। তবু আমার চোখে তখন একটি স্বপ্ন, যে স্বপ্ন সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে একত্রে বসে ভোজনের সৌভাগ্য অর্জন করা। মুহূর্তে জাগতিক দুশ্চিন্তা কোথায় উড়ে গেল! এমন মধ্যাহ্ন ভোজন ক'জনের ভাগ্যে জোটে! এমন আন্তরিক এক গৃহিণীর নেমন্তন্ন ফিরিয়ে দেয়ার শক্তিই বা আছে কজনার!
রাতে ঘুমানোর একটি ব্যবস্থা হল। ব্যবস্থাটি এরকম- দোয়ারাবাজারের যে ভাতের হোটেল অর্থাৎ রেস্তোরায় খাওয়া-দাওয়া করছিলাম সেটির দোতলায় কয়েকটি ঘরে সেই রেস্তোরার পাচক এবং অন্যান্য কর্মচারীরা রাতে থাকেন; তার দুটি ঘর খালি ছিল। ভয়ানক নোংরা সেই ঘরে শরীরের তলায় ছারপোকা আর উপরে মশার কামড় সহ্য করে রাত কাটিয়ে দিলাম। একটাই স্বস্তি- রাত জেগে ডাকবাংলোর পানির পাম্পের শব্দ শুনতে হল না।
এরপর তিনদিনে দোয়ারবাজার আর ছাতকের নৈনগাঁও, পাণ্ডারগাঁও, পাণ্ডব, বাঁশতলা সহ আরো কয়েকটি গ্রামে গেলাম। সেইসব গ্রামে পাকিস্তানের অত্যাচারের ঘা এখনও শুকোয়নি, শুকোবেনা কোনোদিন। খুঁজতে খুঁজতে একটি অবহেলিত গণকবরের সন্ধানও পেলাম। ভুক্তভোগীরা এখনও নিরবে চোখের জল ফেলে সেইসব গ্রামে। যে সাত বছরের ছেলেটির চোখের সামনে তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল, আজো ৫২তে আসা সেই মানুষটি বাবার স্মৃতি মনে পড়লেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। যে স্ত্রী তার স্বামীর রক্ত বয়ে যেতে দেখেছিল সারা উঠানে, সেই বৃদ্ধা আজও সেই উঠানে অন্যদের চোখের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসে আদরের হাত বুলাতে থাকেন শুকনো মাটির উপরে। কতটা অসভ্য হলে পরে পাকিস্তানী হওয়া যায়, তা নিজ চোখে দেখছিলাম। থেকে থেকে নিজেকে সংবরণ করা দুরূহ হয়ে উঠছিল। অনেক আগে করা একটি প্রতিজ্ঞা-বাক্য মনে মনে আবার আওড়াতে লাগলাম- "আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই, স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবোই"।
৭১-এ এই লোকটির বয়স ছিল সাত। পাকিস্তানী আর্মি বাড়িতে ঢুকবার পর মায়ের সাথে ঝোপের পিছনে লুকিয়ে ছিল। তার বাবা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে মই বেয়ে ঘরের চালে উঠে পড়ে; তবে হায়েনার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। গুলি লাগবার পর বাবার রক্তাক্ত লাশটি চাল থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। ঐটুকু বয়সের স্মৃতির আগে পরের অনেক কিছুই মনে নেই আর, শুধু বাবার লাশটি গড়িয়ে পড়ার সেই দৃশ্যটি গেঁথে আছে মনের খুব ভিতরে। এতবছর পরও সেই কথা বলতে বলতে চোখ সিক্ত হয়ে উঠছে তার। কী দমবন্ধ করা এক কষ্ট!
শুনে আসা সেইসব মহাকাব্যের স্তোত্রগুলো বুকের মধ্যে ঝড় তুলছে এখনও। মানুষের জন্মে মানুষের হাত থাকে না। থাকলে আমার জন্মের আরো অন্তত কুড়ি বছর আগে জন্ম নিতাম। তাহলে একাত্তরে আমি থাকতাম এক টগবগে তরুণ। রাইফেল হাতে যুদ্ধ করতাম। আর কিছু না পারলে অন্তত জামার বোতাম খুলে বুকটা ঝাঁজরা না হয়ে যাওয়া অবধি পাকিস্তানী হায়েনার পালের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতাম- আমার মাটির একটি কণাও ছাড়বো না। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার মতন গৌরবের আর কিছু আছে কি?
হ্যা, যে যাত্রার কথা দিয়ে এই ভ্রমণ-স্মৃতিকথা শুরু করেছিলাম- যাত্রাটি শুরু হয়েছে; মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ১১টি সেক্টরের প্রতিটি সাব সেক্টর একদিন এই যাত্রার অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই শেষটা দেখে যেতে পারবো কিনা জানিনা। তবে যেকোনো ব্যাপক কর্মের শুরুটা খুব কাছ থেকে দেখার মাঝে একটি বাড়াবাড়ি মাত্রার তৃপ্তি আছে।
এই লেখায় মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে শুনে আসা সেইসব অমৃতবচন উল্লেখ করবার একটি দায় আছে, নইলে এতে অপূর্ণতা থাকে। তবু দায় এড়িয়ে লেখা শেষ করছি। উদ্দেশ্যটাই তাই- কোনো ভাবাবেগ নয়, ফিকশন নয়, লেখকের বাড়তি আবেগের প্রলেপ নয়, কেবল নিরেট নির্জলা সত্য গাঁথা থাকবে এক
অমৃতভাণ্ডারে।
মন্তব্য
পড়তে পড়তে চোখ ভিজে উঠলো। অনেক অনেক শুভকামনা এই মহান উদ্যোগের জন্য।
ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
জরুরী কাজ। সফল হোন, এই শুভেচ্ছা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
- চোখ ভিজিয়ে দিল এই একটা লাইন।
শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
এই মানুষগুলোর সাথে কথোপকথনের সময় অনবরত ভিজে যাচ্ছিল আমাদের চোখ।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
খুব জরুরি এই কাজটা আপনারা করে যাচ্ছেন দেখে ভালো লাগলো। আমাদের সবারই উচিত আমাদের আশেপাশের সেই সময়ের মানুষদের কাছ থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত যথাসম্ভব তথ্য সংগ্রহ করে ফেলা। সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে, এই মানুষ গুলো বেশিদিন আমাদের আশেপাশে থাকবেননা। এই কাজটা একজন দুজনের নয়, দায়িত্বটা আমাদের সবার।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ঠিক তাই, অনেকের এগিয়ে আসার মাধ্যমেই এই কাজটি ডানা মেলবে। সময় সত্যিই ফুরিয়ে যাচ্ছে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
দেরীতে হলেও যে এই জরুরী উদ্যোগটি বিভিন্ন জায়গা থেকে নেয়া হচ্ছে এটাই আশার ব্যাপার। এত বড় একটি জিনিস কে আমরা কি হেলাফেলাই না করে গেলাম পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে!
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
এমন কত বীর ছড়িয়ে আছেন কিংবা মিশে গেছেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে। আপনাদের এই উদ্যোগের কারণে ৭১'এর এসব অবহেলিত বীরেরা তো অন্তত এইটুকু স্বস্তি বুকে নিয়ে পৃথিবী ছাড়বেন তাঁদের কেউ তো মনে রেখেছে! আন্তরিক সাধুবাদ জানাচ্ছি এমন মহৎ উদ্যোগের জন্য।
ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
চলে গেছেন অনেকেই। যারা আছেন তাঁদের জীবদ্দশায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে হাত দেবার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ থাকবে জাতি। এই দেশের অনেক কিছু ঘাটতি আছে, অনেক অক্ষমতা আছে, কিন্তু ইতিহাসকে অক্ষয় রাখার চেষ্টাটা আগামী প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে বাঁচিয়ে রাখবে।
আমি খুব আশাবাদী। এই উদ্যোগের কোন একটা অংশে আমিও আপনাদের সঙ্গী হবো, হয়তো।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
নতুন মন্তব্য করুন