ক
ছাত্রজীবনে দীর্ঘসময় আজিমপুর কলোনীর ষোল নম্বর মাঠে ক্রিকেট খেলে কাটিয়েছি। বন্ধুত্ব কিংবা পরিচয় সূত্রে আমার মত অনেকেই কলোনীর বাইরে থেকে খেলায় যোগ দিতে আসত। লালবাগ, শেখ সাহেব বাজার, নবাবগঞ্জ, চৌধুরীবাজার কিংবা রহমতগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার অনেকের সাথে পরিচয় গড়ে উঠেছিলো সেসময়। এমনই একজন হচ্ছে সাইদ। লালবাগে থাকতো, বেজায় শুকনো ছিলো আমরা ডাকতাম হেলথ মিনিস্টার। ঢাকাইয়া অ্যাকসেন্টে কথা বলত, কথা বলার সময় একটু একটু দুলত, মজার চরিত্র, স্বভাবে হাসিখুশি।
মাঠের চারদিকে চারটা এক্সিট, খেলা শেষে যে যার মত বের হয়ে যেতাম নিজের গন্তব্যের দিকে। একদিন একটু বেশি সন্ধ্যা হয়ে গেছিল গল্পে গল্পে। সাইদ আর আদনান বের হলো আজিমপুর ম্যাটারনিটির গেট দিয়ে। জায়গাটা এমনিতে বেশ অন্ধকার থাকে সবসময়, আমরা কখনো কখনো টং দোকানে চা কিংবা চিতই পিঠা খেতে বসতাম দল বেঁধে। তো সেই দুইজন বেরিয়েই পড়ল তিনজন টহল পুলিশের হাতে। তারা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় থাকো তোমরা?” সাইদের নাকি তাড়া ছিলো, সে বিরক্ত স্বরে বলল, “ক্যা, লালবাগ!” ঠাস করে একটা চড় এসে পড়ল তার গালে। পুলিশ ধমকে উঠল, “ওই, গাড়িতে ওঠ দুইজনে। আইজ মজা দেখাইতাছি।” আদনান নাকি মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছিলো তার অপরাধ কি, ধমকে থেমে গেল।
পুলিশের গাড়ি তাদের নিয়ে ঘুরল রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। তারপর যেখানে ধরেছিলো সেখানে নামিয়ে দিয়ে বলল, “ছোটভাই কিছু মনে কইরো না, স্যারের হুকুম ছিলো সন্ধ্যাবেলা দুইটা পোলারে আটক দেখাইতে হবে। ডিউটির জন্য তোমাদের ধইরা রাখছিলাম”। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। হতভম্ব সাইদ আর আদনান বাড়ির পথ ধরল, অল্পে ছাড়া পেয়ে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছে।
খ
২০০৬ সালের কথা। বন্ধুদের একটা গ্রুপের সাথে কোলকাতা বেড়াতে যাবার কথা। কিন্তু আমার পাসপোর্ট নেই। হাতে সময় আছে দশ দিন। নানান জন নানান কথা বলে। কারো ধারণা, দালাল ধরলে এক দিনে পাসপোর্ট পাওয়া যায়। কেউ বলে, তিনদিনের কমে পৃথিবীর কেউ পাসপোর্ট করায় দিতে পারবে না। কেউ বলল, দালালের যুগ শেষ, এখন আর দালালদের পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতে দেয় না। আমি পুরাই কনফিউজড। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট বলছে, অতি জরুরী পাসপোর্ট তিন দিনে ইস্যু করা হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশন পরে করা হবে। আমি অত জরুরী ক্যাটাগরিতে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিলাম দালাল ধরা ছাড়াই। পাসপোর্ট আর আসে না। বন্ধুরা যথাসময়ে তাদের প্রোগ্রামে চলে গেল। আমি আমার সবুজ বইয়ের পথ চেয়ে থাকি। দুই সপ্তাহ যাবার পর বাধ্য হয়ে পাসপোর্ট অফিসে ফোন করলাম। তারা জানাল, আপনার পুলিশ ভেরিফিকেশন আটকে আছে। মালিবাগ ডিবি অফিসে অমুকের সাথে যোগাযোগ করেন।
পুলিশের সাথে কোন খারাপ অভিজ্ঞতা তখন পর্যন্ত নেই। তারপরও এই প্রজাতিকে বাঘের চেয়ে বেশি ভয় করি। ডিবি হচ্ছে সেই বাঘের ওপরে টাগ। গলা শুকিয়ে গেল সামনের মোলাকাতের কথা ভেবে। দুই তিন দিন ইতস্তত: ঘুরে কাটিয়ে মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা করলাম বিভিন্নভাবে। তারপর সেই ইতস্তত: ভাব নিয়েই চলে গেলাম ডিবি অফিসে। আমার কন্ট্যাক্টকে খুঁজে বের করলাম। ভদ্রলোকের বক্তব্য, আপনার স্থায়ী ঠিকানা ভুল। আশুলিয়া নামে কোন থানা নাই (বিকেএসপির পাশে একটা গ্রামে আমাদের একটা জমি আর একটা টিনের একচালা আছে, সেটাকেই স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়েছি)। তাকে যতই বলি সাভার থানা ভেঙে নতুন থানা করা হয়েছে, তিনি ততই মাথা নাড়েন। একবার হুমকি দিলেন ভেরিফিকেশন রিপোর্ট নেগেটিভ পাঠিয়ে দেবেন। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ তার রুমে বসে থাকলাম। লোকের আসা যাওয়া কমলে দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে কি করতে হবে?”। আমার অজ্ঞতায় ডিবি সাহেব যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। এইখানে মনে হয় শুধু বুদ্ধিমানরাই আসে, ইশারাতেই সব বুঝে যায়। তিনি বললেন, “স্যারকে দিয়ে সাইন করাইতে হবে আপনার কাগজপত্র। তিন হাত ঘুরে যাবে। কিছু টাকা দেন, দেখি কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা”।
অভিজ্ঞ কিছু বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, পুলিশ ভেরিফিকেশনে সবসময় টাকা দিতে হয়। আমি প্রস্তুত হয়ে এসেছি। পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করলাম। মুঠো পাকিয়ে তাকে সেটা দিতেই রীতিমত ধমকে উঠলেন ডিবি সাহেব। “আপনার কি মাথা খারাপ নাকি? বললাম না তিনজন অফিসারের সাইন লাগে। এক এক জনের জন্য মিনিমাম এক হাজার টাকা করে না দিলে তারা সাইন করবে?” আমি থতমত খেয়ে বললাম, “আমার কাছে তো এত টাকা নাই”।
“তাইলে চলে যান, আরও টাকা নিয়া তারপর আসেন”
আমি বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম ইতিমধ্যেই। টাকা আসলেই নাই। পাসপোর্টের জন্য কারও কাছে ধার করতেও ইচ্ছা করছে না। চুপচাপ মিনিট খানেক বসে রইলাম আরও। দেখে মনে হয় দয়া হলো ভদ্রলোকের। জিজ্ঞেস করলেন, “কত টাকা নিয়া আসছিলেন?”
আমি বললাম, “সব তো ভাংতি টাকা, গুনে দেখি নাই”।
“গুনেন”
নিতান্ত অনিচ্ছায় পকেটের টাকাগুলো বের করলাম। বাবার কাছ থেকে একটা দশ টাকা আর একটা দুই টাকার নতুন বান্ডিল নিয়েছিলাম দুই দিন আগে। কিছু খরচ করেছি। বাকিগুলো সাথেই ছিলো। চকচকে টাকাগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিছু ময়লা টাকাও ছিলো। সব মিলিয়ে সতেরশো টাকার মত হলো। ডিবি সাহেব দয়া করে সবই নিয়ে গেলেন। উপদেশ দিলেন একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যেতে, বাসায় গিয়ে যাতে রিকশা ভাড়া দিতে পারি।
গ
কয়েক দিন আগের কথা। আমার খুবই ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু স্পাউস ভিসা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। তার একটা কাগজ লাগবে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র আর আইন মন্ত্রণালয়ের সইওয়ালা। কথা হচ্ছিলো কত টাকা লাগলো সেই বিষয়ে (টাকা লাগবেই, এটা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে)। সে কিছুতেই অঙ্কটা বলতে রাজি হলো না। আমি অনেক পীড়াপীড়ি করলাম, তবুও না। শুধু বলল, কখনো যদি অনেক টাকা হয় তখন এই দুঃসময়ের গল্প তারিয়ে তারিয়ে বলবে বিভিন্ন পার্টিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কত লাগলো, বিশ হাজার? তিরিশ? পঞ্চাশ?
একটু তিক্ত হেসে ও বলল, ধরে নে ওইরকমই। যদিও স্পষ্ট হলো না, তবু একটা ধারণা পেলাম। আমরা কি কোন সভ্য সমাজে বাস করি?
দুর্নীতি আমাদের প্রশাসনের হৃদপিণ্ড হয়ে গেছে কবে যেন। এটা ছাড়া মনে হয় কারোই চলে না।
আমার কাছে কোন রেফারেন্স নেই, কাজেই নিচের কথাগুলোকে একান্তই ব্যক্তিগত ধারণা বলে গণ্য করতে হবে। কয়েকজন বন্ধু, বড়ভাই, পরিচিত লোকের কাছে শুনেছি, পুলিশ বিভাগ তাদের দায়িত্ব পালন করুক বা না করুক, তাদেরকে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা সংগ্রহ করে ওপরওয়ালাদের কাছে জমা দিতে হয়। টাকা আসে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি, ফুটপাথের হকার, এলাকার ব্যবসায়ী, মামলাবাজি, সাধারণ মানুষকে হয়রানি সূত্রে চাঁদাবাজি ইত্যাদি থেকে। একদম নিম্নপর্যায় থেকে সংগৃহীত টাকা চলে যায় ধাপে ধাপে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত। তারপর কোথায় যায় জানা নেই। পূর্ববর্তী সব সরকারের আমলেই এটা ছিলো একটা অবশ্যপালনীয় প্রথা। ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকার এই ব্যাধিতে আক্রান্ত কিনা, এই বিষয়ে আমার কোন আলোচনা হয় নি কারও সাথে। কারও কিছু জানা থাকলে যোগ করতে পারেন।
দুই দিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই খবরটা পড়লাম।
দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন প্রধানমন্ত্রীর বেতন কত? একই প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একজন কর্মকর্তার সম্মানী দিনে এক লাখ তেরো হাজার টাকা কিভাবে হয়? কার ক্ষমতায় এত বড় চুরি করেও পার পেয়ে যায় লোকে?
এক এগারোর সরকারের সময় বন বিভাগের জনৈক কর্মকর্তার তোষক থেকে গাদা গাদা টাকা বের হবার খবর এসেছিলো। ইদানীং আর খবর আসে না। তার মানে কি দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেছে?
বড় বড় দুর্নীতির খবরগুলো চিপাচুপা দিয়ে বের হয়ে যায় মাঝেমধ্যেই। সবাই সবসময় সবকিছু সামলে রাখতে পারে না। সারা বছর মেতে থাকার মত যথেষ্ট খবর তৈরী করেন আমাদের মন্ত্রী, নেতা, আমলাগণ। পাবলিক আর তাই ছোটখাটো দুর্নীতির খবর নিয়ে উৎসাহ পায় না। এগুলো মনে হয় আমাদের ভাবান্তরও ঘটায় না আজকাল। কিন্তু ছোট ছোট এসব ডালপালা নিয়েই বেড়ে উঠেছে দুর্নীতির মহীরুহ পাপবৃক্ষ।
আমরা হয়তো পুরো গাছটাকে একবারে কেটে ফেলতে পারব না, কিন্তু আমার মনে হয় ডালপালা ছেঁটে ফেলার কাজে ব্যক্তিপর্যায়ে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারি। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তি সবাই দেখেছেন। এই শক্তিটাকে কি কোনভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যায়?
আইডিয়া আসুক, আলোচনা চলুক। আমি একেবারে সাধারণ কিছু কথাবার্তা দিয়ে শুরু করছি, অভিজ্ঞরা এই আলোচনাকে সমৃদ্ধ করবেন আশা রাখি
ক
কোথাও কোন দুর্নীতির শিকার হলে, নিজের কাজ হওয়া পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করুন। তারপর ব্যক্তির নাম, পদবী, প্রতিষ্ঠানের নাম, ঘটনার বর্ণনা ফেসবুকে তুলে দিন। বন্ধু বান্ধবকে শেয়ার দিতে বলুন
খ
শোনা কথা নিয়ে পোস্ট দেবেন না। যার ঘটনা, তাকে লিখতে উৎসাহ দিন
গ
কারও ঘটনা অথেন্টিক মনে হলে, সমর্থন জানান, শেয়ার দিন
ঘ
দুর্নীতিকারীর ফেসবুক আইডি সংগ্রহ করার চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে তার তালিকায় থাকা ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবের ওয়ালে তার কুকীর্তি পোস্ট করার ব্যবস্থা করুন। ছোটখাটো থেকে শুরু করে অনেক বড়সড় দুর্নীতিবাজ তার সামাজিক মর্যাদাকে ভয় পায়। তার পরিচিত মহলে তার মুখোশ খুলে দিলে নিন্দার ঝড়েই অনেক কুবুদ্ধি উড়ে যাবে
ঙ
জেলিফিশ সিন্ড্রোম থেকে বের হয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে। মনে রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন দুর্নীতিবাজদের নাম। একাধিক ব্যক্তি একই কর্মকর্তার নামে অভিযোগ করলে সেটা কোথাও টুকে রাখার ব্যবস্থা করুন, যাতে মনে থাকে বা প্রয়োজনে রেফারেন্স দিতে পারেন। অনেক অভিযোগের নাকি সাক্ষীই পাওয়া যায় না।
চ
সম্ভব হলে দুদকে লিখিত অভিযোগ করুন
ছ
পরিচিত চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের সামাজিক ভাবে বয়কট করুন। তাদেরকে নিমন্ত্রণ করবেন বা তাদের নিমন্ত্রণে যাবেন না
(সব সাজেশন পর্যায়ক্রমে পোস্টে আপডেট করে দেয়া হবে। গুরুত্বের বিবেচনায় ক্রম পরিবর্তন করা হতে পারে)
মন্তব্য
লেখক এর সাথে আমি এক মত । যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিয়ে আসেন সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। এক এক করে আমাদের এই দেশকে গড়ে তুলি।
নতুন মন্তব্য করুন