জুতোটা খুব পছন্দ হয়ে গেছে। দাম চাচ্ছে তেত্রিশশো টাকা, এক দর। আমার বাজেট তিন। মিনিমিন করে বললাম, ভাই আঠাশশো রাখেন। দোকানী একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। উঁচুগলায় বলল, ‘ভাই এক দর লেখাটা দেখেন নাই? পুষাইলে নেন, না পুষাইলে আরেকখানে যান, আমার অন্য কাষ্টমার বইসা আছে’।
কথা সত্যি। দোকানে লোক দিয়ে ভর্তি। এই লোক দাম কমাবে না। কি আর করা! পকেট হাতড়ে আস্ত খুচরো মিলিয়ে তেত্রিশশো টাকা বের করে দিলাম।
বাসা কাছেই। তবু হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। একটা খালি রিকশা পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, হাত নেড়ে থামালাম, ‘এই খালি, ভূতের গলি যাবে?’
যামু। বিশ ট্যাকা।
কি বলো? পনেরো টাকা ভাড়া। কাছেই তো।
অন্য রিকশা লন গা, বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো রিকশাওয়ালা।
রাগে মুখ তেতো হয়ে গেলো।
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ছোটলোকের বাচ্চা।।
মিরাজ আমাদের বাসার ‘কাজের ছেলে’। আমার দাদাবাড়ির কাছেই ওদের বাড়ি ছিলো। গেলো বর্ষায় পদ্মা নদীর পেটে গেছে। মিরাজের বাবা আমার দাদাকে ধরে ওকে ঢাকায় পাঠিয়েছে আমাদের বাসায়, এখানে থেকে টুকটাক বাসার কাজ করবে আর সম্ভব হলে স্কুলে যাবে।
‘ঢাকার স্কুল সম্বন্ধে ধারণা থাকলে এইরকম আশা কেউ করবে না। গ্রামের মানুষের যে কবে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে’ বলছিলেন মুরুব্বীরা।
আমি জানতে পেরেছি, মিরাজ আমাদেরটা খায়, পরে। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয় নি। বাইরের লোকে আমাদেরটা খাবে কেন?
মিরাজ কাজেকর্মে অবশ্য বেশ উৎসাহী। কিছু করতে বললে ছুটোছুটি লাগিয়ে দেয়। যার কাজ সে করবে, খুব ভালো কথা। কিন্তু আমাকে নিয়ে যখন টানাটানি পড়ে গেলো, বিরক্ত হলাম ভীষণ।
সকালে মা বলল, লন্ড্রি থেকে কাপড় নিয়ে আয় তো মিরাজ। সে মহাখুশি। কিন্তু একটু পরেই বলল, লনডিরি তো চিনি না খালাম্মা। মা বলল, রাজিব কে সাথে নিয়ে যা, ও চেনে। মিরাজ দাঁত বের করে এসে আমাকে বলল, ভাইয়া, চলেন।
কি যন্ত্রণা, শান্তিতে একটু গল্পের বইও পড়তে পারব না? তিন গোয়েন্দার বইটা এনেছি পাশের বাসা থেকে, আজ বিকেলে দিয়ে দেয়ার কথা।
মিরাজকে বললাম, তুই একা যা। মিরাজ আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়। বড়দেরকে আপনি করে বলতে হয়, ছোটবেলা থেকে বাসায় শিখিয়েছে। বাসার সবার দেখাদেখি ওকে আমি তুই করে বলি, কেউ কখনো সেটা নিয়ে আমাকে বকে নি। বাসার বাইরের লোকদের বেলায় সম্ভবতঃ এই নিয়ম খাটে না। মিরাজও কখনো এটা নিয়ে আপত্তি করে নি।
মিরাজ গেলো না। ঘ্যানঘ্যান করতে থাকল, ভাইয়া চলেন, ভাইয়া চলেন। আমি এলহা চিনুম না তো।
মহা বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নামলাম। স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলিয়ে বের হলাম মিরাজের সাথে। বাসার বাইরে বেরিয়েই ঝেড়ে লাথি দিলাম ওর কোমর বরাবর। রাগ কমাতে হলে যার ওপর রাগ হয়েছে তাকে মার দিতে হয়, এটা আমি জানি।
শালা, লন্ড্রি চিনিস না কেনো?
শালা কথাটার মানে কি, কে জানে? বিকেলে মাঠে খেলতে গেলে মাজেদ ভাইদেরকে এটা বলতে শুনেছি। কেউ যখন কাউকে ঝাড়ি দেয়, তখন শালা বলে ডাকতে হয়। থ্রীতে পড়লে কি হবে, এমন অনেক জিনিস জানি আমি।
মিরাজ কাতর গলায় বলল, ক্যামনে চিনুম। আমি তো আগে কখনো যাই নাই।
এটা কোন অজুহাত হলো? আগে কেন যায়নি? গত পরশুই তো লন্ড্রিতে কাপড় দেয়া হলো, তখন কারো সাথে গিয়ে চিনে আসলেই পারত। আবার কোমর বরাবর লাথি লাগালাম।
মিরাজ কিছু বলল না। তবে দাঁত বের করাটা বন্ধ হয়েছে আপাততঃ। গুড। একটা জিনিস শিখলাম।
তিন দিন পরে আবার যন্ত্রণা। সিরাজ মিয়ার দোকান থেকে বাকি আনতে হবে। মিরাজকে সে চেনে না, তাই বাকী দেবে না। আবার আমাকে সাথে যেতে হবে।
বাসা থেকে বেরিয়েই মিরাজকে একটা ঘুষি দিলাম। মা খেলা ফেলে দোকানে যেতে বলায় যতখানি রাগ হয়েছিলো, তা একটু কমে আসল। পুরোপুরি কমত, কিন্তু মিরাজ জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া, আমারে মারলেন ক্যা?’ শুনে আবার আমার রাগ চড়ে গেলো। শালা, বুঝিস না কেন মারছি? আবার একটা ঘুষি লাগালাম। মিরাজ এবার আর কিছু বলল না, বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।
বাসায় একটা নতুন জিনিস এসেছে। টেপ রেকর্ডার আর মাইক্রোফোন। দুটো জোড়া লাগিয়ে রেকর্ড বাটন চাপলে কথা রেকর্ড করা যায়। দারুন!
আমি আর আমার ছোট ভাই সদ্য শেখা ডন টু ছবির বাংলা গানগুলি রেকর্ড করছি। কোথা থেকে মিরাজ এসে হাজির। সেও একটা গান রেকর্ড করতে চায়। কি আপদ! ‘তোর কাজকর্ম নেই?’ জিজ্ঞেস করলাম। মিরাজ মাথা নাড়ল।
মিরাজের মন ভালো থাকলে সে গ্রামে শেখা একটা গান গায়, ‘ বাড়ির পাশে ব্যাতের আড়া......’। এই গানের মানে কি, একমাত্র সেই বলতে পারবে। তবে বাসার সবাই একসাথে হলে এটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করে। কেউ বেড়াতে এলে মিরাজের ডাক পড়ে গান শোনানোর জন্য। সবাই হেসে কুটিকুটি হয়।
মিরাজের ঘ্যানঘ্যানানির সাথে আমি পরিচিত। মাইক্রোফোন না দিলে ভাইয়া ভাইয়া করে পাগল করে ছাড়বে। দিলাম।
সে সুযোগ পেয়ে শুরু করল, ‘ বাড়ির পাশে ব্যাতের আড়া......’
মিরাজ বসে ছিলো। আমি দাঁড়ানো। ‘এটা একটা গান হইলো?’ বলে মিরাজের পিঠে একটা লাথি দিলাম। একটু জোরে লেগেছে মনে হয়, কারন মিরাজ বাঁকা হয়ে পড়ে গেছে। চোখ দিয়ে পানিও বের হয়েছে কিছুটা।
আমি পাত্তা দিলাম না। আমাদেরটা খায়, পরে, একটু মার আমি দিতেই পারি। শোধবোধ।
মেশিন চলছে। চলবে আরও অনেক দিন। ঘরে, হয়তো বা বাইরেও।
গাছের পাতায় পাতায় ফিসফিসানী, রাজপথে মৃদুমন্দ হাওয়া। অহো!
এপক্ষের আক্ষেপ, শান্তির সুবাতাসে লোকজন আপত্তি করে কেন? সমস্যা কি?
বিপক্ষের বিলাপ, টাকার খনিটা বুঝি হাতিয়েই নিলো হতভাগারা।
‘নিরপেক্ষ’পক্ষের আষ্ফালন , আমরা স্বাধীন। বাজে বকে অবমাননা করবেন না।
আমি নির্বাক। ব্যাথায় পশ্চাদ্দেশ হাতাই কেবল।
কান পাতলে দূরাগত খ্যাক খ্যাক অট্টহাসি শুনি। জংলী হায়েনার নাকি গৃহপালিত কুকুরের ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারি না। তবে প্রতিদিন আওয়াজ আগের চেয়ে জোড়ালো হয়। আমার গায়ে কাঁটা দেয়!
যে আমার নাম জনতা রেখেছিলো গালাগালি করে তার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করি। হতাশ লাগে প্রায়ই। আমাকে কেউ পোঁছে না কেন? মেরা নম্বর কব আয়েগা?
আশায় বুক বাঁধি আবার। স্বপ্ন হারালে চলবে না।
বিক্রি হতে পারার মত একটা অবস্থানে আমাকে পোঁছাতেই হবে একদিন।
মন্তব্য
দারুণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অনুপ্রেরণা পাইলাম
মনে হইলো একটা লাথি খেলাম।
চমৎকার গল্প।
অনেক ধন্যবাদ আইলসা।
আপনার একটা কল্পকাহিনীর প্রথম পর্ব পড়েছিলাম। আপনি পরের পর্বগুলো দিয়েছিলেন কিনা, জানি না। যদি দিয়ে থাকেন, কষ্ট করে লিঙ্ক দিয়ে দিয়েন, আগাম ধন্যবাদ
২ য় টা খুব টাচি।
সুলতানা সাদিয়া
আমারও তাই ধারণা। পড়বার জন্য ধন্যবাদ সাদিয়া।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মাথায় কিছু আসলে নামিয়ে ফেলব
চমৎকার! ৫ তারা মারতে বাধ্য হলাম।
শুভেচ্ছা
বিশেষ ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ
ভাল লাগলো, নিত্যগল্প।
আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা, প্রৌঢ় ভাবনা
১ - ঠিকঠাক অণুগল্প
২ - এটাকে বাড়িয়ে ছোটগল্প করা যেতো
৩ - এক্সপেরিমেন্টটা নিয়ে আরো কাজ করা দরকার ছিল, যাতে ঠিকঠাক একটা গল্প হয়ে ওঠে
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তিন নম্বরটা আসলে নাখাস্তা কিছু একটা হয়েছে, ঠিক ঐ রায়টার মতন। রাগের মাথায় আসলে কিছু লিখতে হয় না, একটা শিক্ষা হয়ে থাকলো পাণ্ডবদা।
দুই নম্বরটা অণুগল্প হিসেবে বড় হয়ে যাচ্ছিলো, তাই কেটেছেঁটে দিয়েছিলাম।
তিনটা গল্পের মূল থীম একই। প্রতিদিন নিজেদের নানা আচরণের মধ্যেই আমরা জাতিগত ভণ্ডামী আর দূর্বল ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে থাকি। নিজেরা ঠিক না হলে একটা 'দেশ' আশা করি কিভাবে?
একটা প্রশ্ন, ঠিক আপনাকে নয়, অনেকটা স্বগত। তবে আপনি হয়তো উত্তর জানবেন। আমাদের সমাজে অসৎ আর ভণ্ড লোক এতো বেশী কেন?
এইরকম নিত্যগল্প নিত্য নিত্য আসুক।
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
অসংখ্য ধন্যবাদ
খুবই ভালো লাগলো। তৃতীয়টা বেশ অন্যরকমের লাগলো। চালিয়ে যান।
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
বিশেষ ধন্যবাদ জানবেন এইচডিআর গুরু
পুরো কম্পোজিশানই দারুণ লেগেছে।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
অনেকগুলো বিশেষ ধন্যবাদ জানবেন।
প্রশংসায় আপনি কার্পণ্য করেন, এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না
গল্পগুলো তিনদিন আগে পড়লেও আজ খেয়াল হলো ভালো লাগার আবেশে ভেসে গিয়ে মন্তব্য করা হয়নি। অনুগল্প আমার বিশেষ প্রিয়। অন্যদের লিখতে দেখলে নিজেরও দুয়েকটা লিখতে ইচ্ছে করে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
'ভালো লাগার আবেশে' খাইছে। এতো বিশাল প্রশংসা
আমার ধন্যবাদ জমা রাখার জন্য আপনার তো গুদামঘর লাগবে
১) - সার্থক অণুগল্প।
২) - পর্যবেক্ষণ যথার্থ। গল্প - অণু নয়।
৩) - ব্লগরব্লগর, গল্প নয় ঠিক,
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
৩ এর ব্যাপারে একমত
১ চমৎকার, ২ দারুণ।
৫ তারা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
নতুন মন্তব্য করুন