মাতৃপুরাণ

??? এর ছবি
লিখেছেন ??? (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৭/২০০৭ - ১১:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

আদিপর্ব

পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা শৈবালেরও থাকে পাহাড়কে গিলে খাবার বাসনা। তাদেরই কোনো একজনের শৈশবের জুতোজোড়া থেকে আমার জন্ম। উল্লসিত ঊষাকাল থেকে প্রজ্ঞাশায়িত প্রদোষ পর্যন্ত আমার আয়ুষ্কাল। এর মধ্যেই সকল রহস্য আমি জেনেছি, সেই বৃষ্টি ব্যতীত, যা আমার পায়ের পাতায় জমে বাতাসের প্ররোচনায় উপত্যকায় ফুল ফোটায়।

কেবল স্বপ্নের সাথেই আমি বিবাহিত, পূর্বপার্শ্বের "যন্ত্রণা" নামক হ্রদটির কন্যা সে। ওর প্রেম ছিল সূর্যাস্তে, আমাকে সে বলেছিল মাইলের পর মাইল ধুলিপথের শেষে অপেক্ষা করা শান্তশিষ্ট একটি সন্ধ্যাবেলার গল্প। আমাদের প্রথম সন্তান: মৃত্যু।

মৃত্যুর সঙ্গী ছিল না। তাকে জুটিয়ে দেয়া হল "ঈর্ষা" নাম্নী পাহাড়ি ছাগলের সাথে। দুজনে তারা আমাদের সঙ্গমদৃশ্য লুকিয়ে দেখত। কিন্তু ঈর্ষা ছিল নিজেরই ছায়ার বাগদত্তা, আর সবুজ অঙ্গুরীখানি সে রেখেছিল পিতাপুত্র থেকে সমান দূরত্বে। হায় প্রদোষ, আমি সবই জানতাম!

যে পাহাড়চূড়ায় আমাকে প্রোথিত করা হল, তারই কোনো খাঁজে স্বপ্ন আমার মাতৃদেবীকে প্রসব করেছিল।

সমতলপর্ব

মাতৃদেবীর সাথে মৃত্যুর সখ্যতা দীর্ঘ দীর্ঘ সময়ের। তাদের প্রথম সন্তান "প্রযুক্তি" -- বিকলাঙ্গ এই শিশুটিকে তারা নিক্ষেপ করে "অদৃষ্ট" নামক অন্ধগহ্বরে। ফেরার পথে তাড়া করে অপরাধবোধের বাদামি এক ষাঁড়। ফলে পাহাড় থেকে পালিয়ে সমতলে। প্রথম কুটির রচনা। পুনর্জন্ম হয় আমার। নাম রাখা হয় "অনিদ্রা"।

সুতরাং জন্ম থেকেই আমি হাসপাতালের মত নীরব এবং দর্শনার্থীর মত উদ্বিগ্ন একটি দ্বৈততা। বেড়ে উঠেছি পরিত্যক্ত রেলস্টেশনে, তালি বাজিয়েছি প্রেক্ষাগৃহের দৈনিক উল্লাসে, শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী। আমি কি জানতাম প্রতিটি রোমাঞ্চযাত্রার লেজ ধরে এক অবধারিত অশ্রুধারায় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে আমার ফেলে-আসা পথরেখা!

তবুও ভাল লাগত, শ্লথগতির ট্রেন যখন স্লিপারগুলোর ঘুম ভাঙাতে ভাঙাতে যেত। আমার পাটখড়ির গাণ্ডীব ছিল দুপুরের মৌন ঘুড়িগুলো থেকেও ধ্যানী। এভাবেই সকাল থেকে সন্ধ্যা -- মৌমাছির মত ব্যস্ত, জিরাফের থেকেও নীরব। পথে বেরুত নিদ্রামাসি, আমাকে খুঁজে না-পেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত গোটা মধ্যাহ্নটিকেই।

ধাঁধা এবং প্রবাদ: যুদ্ধপর্ব

ধাঁধা ওর কুমারী মায়ের গর্ভপাতের ফলে নষ্ট হয়ে যাওয়া সন্তান। আর প্রবাদের সাথেও বন্ধুত্ব হয় নি, না-হওয়াটাই ছিল প্রথা। সেই আমার প্রথম শরসন্ধান, অশ্বমেধের শুরু। তারপর যুদ্ধ, রক্তক্ষয়ী কত যুদ্ধ শেষ হল। যুদ্ধবন্দী হয়ে এল কল্পনা -- ঘুমন্ত স্তনস্পর্শের শিহরণ থেকে ওর জন্ম। আমার ক্রোধের ওপর পোশাক খুলে রাখল সে, আমার দিগ্বিজয়ের বাসনার ওপর মেলে ধরল নগ্ন পা। আমারো গাণ্ডীব নমিত হয়ে এল, পৃথিবীর মহান আর পৌরাণিক সব সেনাপতিদের মত।

তারো আগে পার্বণের যুগ -- কৃষিসভ্যতার শিরার ভিতর দিয়ে বিন্দু বিন্দু স্যালাইনের প্রবাহের মত ধীরগতি। কথা বলতে শিখল মেঘনা, আর তাতে আরো অপ্রতিভ হয়ে গেল ব্রহ্মপুত্র। উত্তর থেকে এল যে ধানবোঝাই নৌকা, ফেরার পথে ইক্ষুগুড়ের গন্ধে টলছিল সে। তবুও বাণিজ্য হয় নি প্রবাদের সঙ্গে। না হওয়াটাই ছিল প্রথা।

প্রথার ঘোড়াটি ছিল কৃষ্ণবর্ণের, চাবুকটিতে ছিল মৃত দাড়াশের হামবড়া ভাব। পূর্বপুরুষদের দর্পিত পোর্ট্রেটগুলোর মধ্যে বসে আলবোলা টানত সে। শেষবার ওকে যারা খোলা হাওয়ায় চাবুক হাঁকাতে দেখেছে, আমার পিতা সেই অবশিষ্ট লাঠিয়ালদের একজন। আজ যখন ওর দরজায় নিজের মাথা রক্তাক্ত করছি -- মর্মর উঠল বাঁশবনে।

নির্বাসনপর্ব

মাতৃহাসিটি আজো কাঠের পুরনো দোতলা বাড়ির মত। তার ঔজ্জ্বল্যের ছায়া ম্লান হয়ে পড়েছে আমার মুখমণ্ডলে। মৃত্যু উদ্ভিদ হয়ে জন্মেছে ওর নিজেরই উঠানে, শুধু বিচিত্র ফলের সম্ভারে সে আমার মাতৃমুখটিকে বন্দী করে রেখেছে। আমার পা জড়িয়ে আছে ওর শেকড়ে, সেই আর্তি আমি ছড়িয়ে দিতে চাইছি ওরই ডালপালায়। ধাঁধা-বিজিত প্রবাদে-বন্দী জীবন, একবার মাত্র জীর্ণ কোনো কবরের ওপর দিয়ে খুব নিচু হয়ে উড়ে যেতে পেরেছিলাম। সেই প্রশান্তিটুকুই ফুটে আছে নিঃশব্দে, প্রতিটি বৃন্তচ্যুতির সম্ভাবনার নিচে, ঘনঘাস হয়ে।

* রচনাটি বিগত দশকের প্রথমভাগে রচিত ও প্রকাশিত। লাগোয়া ছবিখানা (Mystery and melancholy of a street) বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জর্জিও ডি চিরিকো কর্তৃক আরো পঞ্চাশধিক বছর পূর্বে অংকিত


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

টেস্ট

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হায় অর্জুন, ওটা মাছের চোখ নয়-আসলে ছিল বন্ধুর হৃদয়
কেনো মনে পড়লো? চোখ টিপি
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

??? এর ছবি

হায় হায়.... আপনের কবিতা নাকি? নকল কৈরা ফালাইলাম!চোখ টিপি

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ঠিক বুঝতে পারলাম বইলা মনে হইল না! চিন্তিত
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

??? এর ছবি

ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা
সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে
কবিতা বোঝে না মন খারাপ

??? এর ছবি

এমন সুন্দর সুন্দর সব পরিকল্পনা দিয়েই তো আমাদের জীবন আমরা সাজিয়েছিলাম!

তারেক এর ছবি

ভয়ংকর ভাল লাগছে। কেন? সেইটা জানি না। খালি ভাল্লাগছে হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

??? এর ছবি

ভাল লাগার আসলে কোনো ব্যাখ্যা হয় না। কবিতার ক্ষেত্রে। সেইরকম কবিতার চর্চা শুরু হোক সচলায়তনে।

...................

শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।