মান্দাই ক্রিমাটরিয়ামে পৌঁছলাম সাড়ে চারটায়, ঝা ঝা দুপুরশেষের রোদের মধ্যে। বুকিত্তিমা রিজার্ভ ফরেস্টের বেশ খানিকটা ভিতরে সুনসান ছায়াঘেরা বিশাল একটা ইনস্টিটিউশন। গাড়ি ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা মড়ার গাড়ি যাওয়ার জন্য, অন্যটি ভিজিটরদের জন্য। আমাদের গাড়ি ভিজিটরদের রাস্তা ধরে আরো একটু ভিতরে ঢুকল। তারপর আমরা নেমে গেলাম। সামনে একটা মাঝারি সাইজের ডিসপ্লে বোর্ড। সেখানে দেখলাম সাথিয়ার অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময় দেয়া আছে, পাঁচটা পয়তাল্লিশ। শবযাত্রার গাড়ি তখনো এসে পৌঁছায় নি। সাতটায় আরেকটা দাহ, কোনো এক চীনা মানুষের নাম ডিসপ্লেতে। একই আগুনে! মড়ার আবার জাত কি রে?
আমাদের বন্ধু সাথিয়া মারা গেছে গতকাল রাতে। আরো দুইদিন আগেই আমরা জেনেছিলাম সাথিয়া মারা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা জানতাম না যে, সাথিয়া ওর মৃত্যুর আগাম সংবাদ জানত আরো একবছর আগেই। এই অবধারিত মৃত্যুকে বুকে চেপে পিএইডি থিসিস লিখত সে তামিল সিনেমার ওপর, দুর্দান্ত নাচত ভরতনাট্যম, আমার সাথে মিলে বাসন্তী টিভিতে বাচ্চাদের জন্য একটা পাপেট শো করার প্ল্যান করত দিনের পর দিন।
সোয়া পাঁচটার দিকে শবযাত্রার গাড়ি এল সাথিয়ার। সাথে রেকর্ডেড স্তোত্রপাঠের গুরুগম্ভীর ধ্বনি। দেখলাম কী ভয়ানক সুন্দরভাবে সাজানো একটা কাসকেট। মড়ার গাড়ি। শোক উথলানোর আগেই চোখ জুড়িয়ে গেল যে!
গত চারমাস একদম লাপাত্তা ছিল সাথিয়া। আমরা ভাবতাম টিপিক্যাল সিঙ্গাপুরিয়ান, নিশ্চয়ই দরজায় খিল দিয়ে থিসিস শেষ করছে! এটা ওর ক্যানডিডেচারের শেষ সেমিস্টার ছিল। তার ওপর স্কলারশিপও ফুরিয়ে গেছিল ওর। সেমিস্টারের শুরুতে টিএশিপের জন্য স্কুলে একবার নাকি এসেছিল। কিন্তু মেলে নি সেটা।
জানানো হল, সাথিয়ার অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রাথমিক কৃত্যাদি ঘটবে অডিটরিয়াম-২এ। গেলাম সেদিকে। গিয়ে দেখি চমৎকার একটা থিয়েটার। সামনে বেদিমঞ্চে সাথিয়াকে শোয়ানো হয়েছে ফুলে ফুলে। ওর খাটিয়ার সামনে সমাবর্তনের পোশাক-পরা সাথিয়ার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা সামনে। স্পিকারে মন্ত্রধ্বনি বাজছে। মাইকে একজন তামিল ভাষায় কিছু বললেন, তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন আরেকজন। গ্লোবাল সিটি বলে কথা, সবখানেই বাই-লিঙ্গুয়াল ব্যবস্থা।
স্তোত্রপাঠ শেষে আমরা সাথিয়াকে শেষ দেখা দেখলাম সারি বেঁধে। তারপর ছুটলাম ই-৭ ভিউয়িং হলের দিকে। চিকন একটা একসেলারেটর কোনাকুনি উঠে গেছে ওপর দিকে। সেখান দিয়ে উঠে হাতের ডানে সারি সারি ভিউয়িং হলের দরজা। ই-৭এ ঢুকলাম। কাচঘেরা মাঝারি সাইজের ঘর। সেখান থেকে কাচের ওপাশে বিশাল একটা দক্ষযজ্ঞ দেখার ব্যবস্থা। একটু পর দেখলাম কাচের ওপাশে ট্রামলাইন ধরে সাথিয়ার শবগাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে, বার্ন চেম্বারের দিকে। কোথাও কেউ নেই। পুরোটাই রিমোট কন্ট্রোলে। এই একটা জায়গায় মিনিট কয়েকের জন্য মাতম হল, কাঁদল সাথিয়ার বোনেরা। মাত্র কয়েক মিনিট। শবের গাড়ি ঢুকে গেছে লালাভ বার্ন চেম্বারে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দরজা। শোকের দরজাও যেন সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেল।
বার্ন চেম্বারের দরজা বন্ধ হতেই সবাই বেরিয়ে এল ভিউয়িং হল থেকে। আমার অবাক লাগল কিছুটা। একাই পুড়বে সাথিয়া? প্রযুক্তি কি এই দৃশ্যটি দেখার ব্যবস্থা কেড়ে নিল শেষমেষ? ফেরার পথে ডিসপ্লেতে দেখি সাথিয়ার নামের শেষে "একোমপ্লিশড" লেখা। হঠাৎ বিষাদ এল কোত্থেকে যেন। যেন দূর থেকে গায়ে লাগছে বহুদূরের তিতাসপারের শ্মশানঘাটের হাওয়া।
ভস্ম ছড়িয়ে দাও তোমার, প্রিয় সাথিয়াবতী। তোমার অপার মমতার কথা জগত মনে রাখুক। এই অটোমেটেড দাহ ব্যবস্থার বাইরে বুকিত্তিমা রিজার্ভ ফরেস্টের গাছপালা শোকে আরেকটু স্তব্ধ থাকুক না হয়। ধুলা হয়ে ছড়িয়ে যাও, এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীর আনাচে কানাচে। তাহলে বিদায়, বন্ধু!
মৃত্যু, নিঃসঙ্গ ভেড়ার চেহারা
হয়ত বা কিছুই না, শিশুর জন্মের পর
ওর জন্য রেখে যাওয়া একমুষ্টি ধুলা....*
*কফিল আহমেদ-এর কবিতা
মন্তব্য
ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে না, মডুরামের শরণ চাইছি।
...............................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
ছবি ঠিক করতে গিয়ে দেখি ওখানে কোন ডকুমেন্ট নেই বলছে!!!!!
http://www.esnips.com/doc/73671811-81a8-46fc-807b-fdae424fc1a4/Photo-0206
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সুমনীয় লেখা।
পাঠককে নিয়ে যায় বিষয়ের ভিতরে।
পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থান কাল ভুলে, একেবারে বুঁদ হয়ে থাকতে হয়।
-------------------------------------------------
'অত্তাহি অত্তনো নাথো, কোহিনাথো পরোসিয়া'
নিজেই নিজের প্রভু, অন্য কোন প্রভুর প্রয়োজন নাই।
ছবি ঠিক করে দিলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এই একই বিষয়ের উপর আপনার আগের লেখাটা - যেটা হারিয়ে গেছে বলে জানিয়েছিলেন; সেটা পাবেন বাম মেন্যুর "অ্যাকাউন্ট" > "আমার কীর্তিকলাপ" থেকে। আগেরটা মনে হয় আরেকটু বেশী লিখেছিলেন। সেখান থেকে কয়েক প্যারা এখানে জুড়ে দিতে পারেন। সমস্যা হলে জানাবেন।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এই বিষয়গুলো পড়ে চুপ কের থাকতে হয়। বলার কিছু থাকে না ।
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
এত চমৎকার লেখা পড়বার আনন্দ আপনার বন্ধু হারানোর দুঃখকে ছাপিয়ে উঠতে চাইছে, তবু সমব্যাথী।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
ধন্যবাদ মা.মু। শুকরিয়া যারা পড়লেন। আসলে আমার আগ্রহ ছিল একটা মেট্টোপলিসে শেষকৃত্য জিনিসটা কেমন হয় দেখার। এখানে লেখাটা অনেক সংক্ষিপ্ত আকারে এসেছে, আর অনেক জায়গায় ছবিও তুলতে পারি নি। তবে পুরা বিষয়টা অনেক চিন্তার খোরাক দেয়। মৃত্যুশোকেরও বাইরে কোনো একটা জায়গায় নিয়ে যায়।
................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
আর কী বলি?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন