বয়স আমার বাড়ে না

??? এর ছবি
লিখেছেন ??? (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/১০/২০০৭ - ১০:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

বয়স আমার বাড়ে না। তাই চান্দু ড্রাইভারের ছাপড়াঘর পার হৈয়া একফালি চিপামতন যে জায়গাটা আছে, ঐখানে দিনভর হল্লামাস্তি করি। আমি, ইয়ামিন আর কানাফজল। ফাইজুল আর ভ্যাদারশিদও আছিল, কিছুদিন হৈল গাবতলীতে গিয়া মলমপার্টিতে নাম লেখাইছে। এখন তাগো পোজপাজই অন্যরকম, হাতে মোবাইল, ফুরুত্ ফারুত্ এখানে ওখানে গিয়া খাড়ায়া থাকে, আমাগো সাথে মিশেটিশে না। মোবাইল ফোনের লোভে ইয়ামিনও তাগো লগে লটকাইতে চাইছিল, কিন্তু মলমের ওস্তাদে নাকি ওরে ফিরায়া দিছে। ইয়ামিনের সামনেই ফাইজুলরে গালি দিছে “দুধের বাচ্চা” নিয়া আসছে বৈলা। আরো বলছে, বলদের কাম কি আর ছাগল দিয়া হয়? সেই দুঃখে এখন ইয়ামিন সারাদিন খালি গাঞ্জা খায় আর নানানজনের মা-বইন লৈয়া খিস্তি করে। একটু পরপর খালি কয়, না-খায়া না-খায়া হাতপায়ের গিট্টুগুলা জ্যাম হৈয়া আছে, গিঁটে-গিঁটে বয়স আটকায়া গেছে। দেখতে নাকি তাই পোলাপাইন লাগে। বড়লোকের পোলাগো মত ফলফুরুট খাইলে কবেই লম্বাচওড়া হৈয়া যাইত সে!

আমাগো বস্তির নাম কালাপানি। ভদ্রলোকেরা কয়, বেগুনটিলা। সরকারের খাতায়ও এই নাম। আমাগো সমিতিঘরের সাইনবোর্ডেও লেখা, বেগুনটিলা ভূমিহীন সমবায় সমিতি। কিন্তু আমরা ডাকি কালাপানি। বেগুনটিলা নাম শুনলে হাসি লাগে। কিসের বেগুন, আর কিসের টিলা? শেলটেক কম্পানি গাজীপুর থিকা ট্রাক ট্রাক লালমাটি আইন্যা সব টিলাটক্কর সমান কৈরা ফেলাইছে কবে! এইখানে এপার্টমেন্ট হবে, হাসপাতাল হবে, খেলার মাঠ হবে, ব্যাকাত্যাড়া একখান লেকও নাকি হবে। জায়গায় জায়গায় এই সাইনবোর্ড ওই সাইনবোর্ড, এইখান দিয়া হাঁটবেন না, এইখানে খাড়ায়া পেশাব করবেন না, এই জায়গার মালিক অমুক ব্যাংকের কাছ থিকা ট্যাকা নিছে, কত আগড়ম বাগড়ম! আর এইসব বড়লোকী হুমকিধামকির মাঝখানে হাবাহাবলার মত আমাগো একখান কালাপানি বস্তি! কুদ্দুছ চাচায় কয়, দুনিয়ার লীলা বোঝা কঠিন। গেরাম থিকা ঢাকায় আসছিলাম রেলগাড়ি দিয়া, অথচ ঢাকা থিকা ঢাকার মধ্যেই কালাপানি বস্তিতে আসতে হৈল নৌকায় কৈরা! তখন কালাপানি বলতে নাকি আছিল জলে-ভাসা একটা টিলা। সেই টিলার মধ্যে, ছপছপ পানির উপরে আমাগো ভোদাই বাপচাচারা বিছাইছিল সংসারের চৌকি। সেই চৌকি থিকা ঘুমের মধ্যে এপাশ ওপাশ করতে গিয়া ময়লা কালাপানির মধ্যে টপাশ টপাশ পটল তুলছে কত্ত পোলাপাইন, সাপেখোপে কাটছে আরো কত্তগুলারে! শুকনা মাটি যেটুক আছিল, কবর দিতে দিতেই শেষ! তখন এইখানে না-ছিল গভমেন্ট, না-আছিল শেলটেক কম্পানি। এখন তো যেদিকে চোখ যায় সবই শেলটেক কম্পানির মাটি। সেই চাপাতিও নাই, শামসুও নাই। কালাপানি নামটাই খালি আছে।

এত যে উলট পালট, জলে-ভাসা কালাপানি সেই কবে ভদ্রলোকের বেগুনটিলা হৈয়া গেল, তবু বয়স আমার বাড়ে না। চাক্কা জ্যাম। আমারো, ইয়ামিনেরও। তিনকুলে ওর কেউ নাই, আর আমার তো বাপ থাইক্যাও নাই। ল্যাংড়া ফরুরে খামোখাই বাপ ডাকছি আমি। ব্যাবাক পিটাইত হালায় আমারে, সকালবিকাল পিটাইত আর বলত, কোকিলের বাচ্চা দুধকলা দিয়া পালতেছি, তুই আমার পয়দা না! শেষে একদিন আমিও হালারে পিটায়া তবে ঘর ছাড়ছি। এরপর থিকা আর বাপের মুখ দেখি না, ইয়ামিন আর কানাফজলের সাথে সমিতিঘরে ঘুমাই। কানাফজল কিন্তু কানা না, মানে সে চোখে ঠিকই দেখে, তবে একটু ট্যাগড়া বৈলা আদর কৈরা আমরা ওরে “কানা” ডাকি। যাউক, আমরা তিনজন সমিতিঘরের মাটিতে মাদুরের ওপরে ঘুমাই। যেদিন আমার ঘুম আসে না, অনেক রাইতে ঠকাঠক শব্দ আইসা জানলার কাছে থামে। আমার ল্যাংড়া বাপের গলায় আস্তে আস্তে ডাক শুনি, ভুট্টো, অ ভুট্টো, ঘুমাইছস? জবাব না-দিয়া মটকা মাইরা থাকি। কে জানে, বাপও হৈতে পারে, জ্বিনভুতও হৈতে পারে। একটু পর ঠকাঠক শব্দ আবার দূরে মিলায়া যায়। তবে এইটা কি স্বপ্ন, না বাস্তব ঠাহর পাই না। রাইতে খুব বাস্তব লাগলেও সকালে উইঠা মনে হয় স্বপ্নই দেখছিলাম। বাপের ঘরে আর ফেরত যাই না। সমিতিঘরে ঘুমাইবার ব্যবস্থা অনেক ভালো, কারেন্টের ভোল্টেজ কম থাকলেও একটু-একটু কৈরা ফ্যান তো ঘোরে। আর বাপের হোটেল ছাড়াও আরো কত কত খাইবার ব্যবস্থা আছে খোদার দুনিয়ায়! বাপের হোটেল যেদিন থিকা বন্ধ হৈয়া গেল, সেইদিন থিকা খোদার হোটেলগুলাতে ঘুইরা ঘুইরা খাই। লিস্টি দেই খাড়ান:

শনিবার ......................গুরুদুয়ারা শিখমন্দির
রবিবার .......................রামকৃষ্ণ মিশন
সোমবার ......................শাহআলীর মাজার
মঙ্গলবার ......................হোসেন আলী পীরের দরগা
বুধবার ........................বেনারস পল্লীর কারিতাস অফিস
বিষ্যুদবার......................শাহআলীর মাজার
শুক্রবার ........................পল্লবী জামে মসজিদ এতিমখানা

তো, এইভাবে খোদার খাসি হৈয়া কতদিন! কাঁহাতক ভাল্লাগে? আমার অবশ্য ইয়ামিনের মত মলম পার্টির ধান্দা নাই। আরো বড় ধান্দা আমার। উছিলা পাইলেই যাই আমাগো ওয়ার্ড কমিশনারের অফিসে। সেইখানে কত রঙবেরঙের বড়ভাইরা! রড শাহীন, কুত্তা শিরু, চাপাতি হীরা, বিচি বাছির। কাউরে কিছু কই না, খালি ঘরের কোনায় খাড়ায়া থাকি। কমিশনার আমারে চিনে। সেইবার যখন পল্লবী সুপার মার্কেটের জোবেদ আলীর জুয়েলারি দোকান চুরি হৈল, পুলিশ আইসা খামোখাই আমাগো তিনজনারে লক-আপে নিয়া গেল, তখন কমিশনার নিজে থানায় গিয়া আমাগো ছাড়ায়া আনছিল। সেই থিকা মনে-মনে তার সাকরেদ হৈয়া গেছি। আমারে ইশারায় সামনে আসতে কয় সে একদিন।

: জোবেদ আলীর সোনার দোকান ভাঙছিল কেডা রে?
: জানি না ভাইজান। আমরা তো ভাঙি নাই।
: লকআপে গেছিলি ক্যান তাইলে?

আমি কথা কই না। খাড়ায়া থাকি।

: আরে খানকির পোলা, চুরি করলি না, কিন্তু লকআপে তোগোরে ঢুকাইছিল ক্যান?
: না-কৈরাই ভুলটা হৈছে। করলে আর লকআপে যাওয়া লাগত না।

কী মনে হৈল, আমি ধুস কৈরা বৈলা ফেললাম। জবাব শুইন্যা কমিশনার থ।

: তোর মাথায় তো অনেক বুদ্ধি! ঐ শুনছস তোরা?

শুনছে সবাই। গালে ঠোনা খাইলাম বেশ কয়েকটা। পিঠে চাপড়ও পড়ল মনে হৈল।

: ভাইজান, একটা কাম দেন না আমারে!

তোতলাইতে তোতলাইতে কৈয়া ফেললাম। এইবার দাপায়া হাসে কমিশনার।

: কাম দিমু তোরে? আচ্ছা দিমুনে। তোগোরেই তো দিমু, তোরাই তো আমাগো ভবিষ্যত। সময় হোক, দিমু। এখন গিয়া খেলাধুলা কর যা। তোর তো এখন হৈ হল্লা করনের দিন।

হৈ হল্লা করনের দিন? কয় কি উস্তাদে? সেই দিন আর নাই গো নাতি, খাবলা খাবলা ছাতু খাতি! কেমনে বোঝাই?

কয়দিন পর আবার কমিশনারের সাথে দেখা। খুব ক্ষেইপ্যা আছিল সে।

: ঐ পিচ্চি... কী যেন নাম তোর?

পিচ্চি? এইবার বুকটা সত্যি সত্যি ফাইট্টা যায় আমার!

: ভুট্টো।
: শোন্ .... ঐ সদরুদ্দিন খানকির পোলা সমিতি অফিসে যদি ঢোকে, ওর হোগার মধ্যে দুইটা ক্ষুরপোচ লাগাইতে পারবি?

উত্তেজনায় কাঁপাকাঁপি দশা আমার। সদরুদ্দিন আমাগো সমিতির সভাপতি আছিল। শেলটেক কম্পানির বিরূদ্ধে অনেক আন্দোলন করছে। সবাই কয়, ওর হল্লাচিল্লার কারণেই নাকি এই বস্তি এখনও কেউ গিলতে পারে নাই। ইলেকশনের সময় অন্য দল করছিল, তাই ইলেকশনের পর কমিশনার আইসা ওরে খেদায়া দিছে। এখন বাইরে কৈ জানি থাকে। তবে মাঝে মাঝে চামেচিকনে সমিতিঘরে আসে। সদরুদ্দিন মানুষটা অন্যরকম। গাবতলী টার্মিনালে ভ্যান চালায়, আবার ওর নিজের ভ্যানের ওপর খাড়ায়া গরম গরম বক্তৃতা দেয়। আইনকানুন খুব বোঝে, কলিজাও বড়। একবার রাজউকের বুলডোজারের সামনে শুইয়া পড়ছিল বস্তি বাঁচাইবার জন্য।

: খুব পারুম।

আমি কমিশনারের কথার জবাবে বলি। কারে কী করন লাগব সেইটা পরে। আগে কাম পাওয়া দিয়া কথা। কী যেন ভাবে কমিশনার।

: ঠিকাছে, তোর কিছু করা লাগবে না। তুই খালি খবরটা দিবি, ওরে দেখলে।

আমার ভিতরটা হায় হোসেন হায় হোসেন কৈরা ওঠে।

: আমি পোচাইতে পারুম তো ভাইজান। আপনে দিয়া দ্যাহেন। এমুন পোচ পোচামু খানকির পোলা জিন্দেগিতে আর চেয়ারের মধ্যে পুটকি লাগাইতে পারব না।

কমিশনার আবার হাসে।

: এখন না। এখন শুধু খেয়াল রাখিস। বয়স হোক আগে, সবই হবে।

মরণের আগে আমাগো বয়স কি কোনোদিন একবার হবে? ছাপড়াঘরের চিপায় বৈসা আমি আর ইয়ামিন এইসমস্ত আলাপসালাপ করি। এইখানে দিন পার করনের দুইটা সুবিধা। এক, সমিতিঘরের দরজাটা এইখান থিকা স্পষ্ট দেখা যায়। ফলে, আমাগো চোখ ফাঁকি দিয়া সদরুদ্দিনের আব্বারও সমিতিঘরে ঢুকবার ক্ষমতা নাই। দুই, কালাপানি থিকা দূরের দেশবাংলা গার্মেন্টস বরাবর একসারা লম্বা যে রাস্তাটা গেছে, এই চিপা থিকা পুরাটা রাস্তাটাই দেখা যায়। খুব সক্কালবেলা, আমরা যখন সমিতিঘরের ভিতর ঘুমায়া থাকি, তখন এই রাস্তা ধৈরা হানুফা গার্মেন্টসে যায়। যখন দুপুরে খাইতে আসে, বা সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফেরত আসে, তখন ওরে দেখতে পাই কোনো কোনোদিন। মনে পড়ে, এই হানুফার সাথে আমি ছোট্টবেলায় কত জামাইবৌ খেলছি, একসাথে সিনেমা দেখছি! গার্মেন্টসে ভর্তি হৈয়া সে তড়বড়ায়া বড় হৈয়া গেল। ছয়মাস আগে ধারকর্জ কৈরা ওরে আবার সিনেমা দেখাইতে চাইলাম। কী কমু দুঃখের কথা, শালী এখন তাকায়া থাকে আমার মাথা থিকা কম কৈরা আধাহাত উপরে! আমার কথা শুইন্যা কী সাংঘাতিক মিষ্টি কৈরা হাইসা উল্টা-হাঁটা দিল, অথচ পরের মাসেই টেম্পু ড্রাইভার শাহালমের সাথে পর্বত সিনেমা হলের সামনে ওরে দাঁড়ায়া থাকতে দেখলাম। আমারে দেইখ্যা একটু ভড়কাইল অবশ্য। শাহালমের কানে কানে কী যেন কৈল, শাহালম এদিকে তাকায়া ইশারা দিয়া আমারে ডাকল। ওই বেটার আদুইর‌্যা হাসি দেইখ্যা পিত্তি জ্বইল্যা যায়! গেলাম না, ইজ্জত বিলায়া দেওনের জায়গা আরো আছে দুনিয়ায়। এইবার শাহালম নিজেই আগায়া আসল।

: কিরে ভুট্টো, ছবি দেখবি নাকি ভাই?
: না।
আমি ঘাড় গোঁজ কৈরা থাকি।
: তাইলে এইখানে কী করস?
: কী করুম? খাড়ায়া আছি।

সবচে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল তারপরে। শাহালম পকেট থিকা দুইটা টাকা বাইর কৈরা আমারে দিল।

: নে। লজেন্স খাইস।

মাথার ওপরে যেন ঠাডা পড়ল হঠাৎ! যেন মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্করের মাঝখানে পরনের লুঙ্গি খুইল্যা তলা উদাম হৈয়া গেছে আমার! কী করুম বুঝতে পারি না। সিনেমার পোস্টারের দিকে তাকায়া থাকি। ডিপজলের বগলের চিপায় মান্নার মাথা।

: আমি লজেন্স খাই না।

কোনোরকমে কৈতে পারলাম। তাও হানুফার দিকে তাকায়া।

: তাইলে ঝালমুড়ি খাইও। নেও না! এখন খাইতে ইচ্ছা না-করলে পরে খাইও!

এইবার হানুফা, গলায় মিনতি! এই প্রথম কেউ আমারে মিনতি করল। এই প্রথম আমার বয়সের জ্যাম চাক্কাও একটু নৈড়াচৈড়া উঠল যেন। লজেন্স থিকা ঝালমুড়ি! নিলাম টাকাটা। নিয়া পিছন ফিরা হাঁটা দিলাম। মোড় ঘুরবার পর কি যেন হৈল আমার, দৌড় দিলাম একটা। দৌড়াইতে দৌড়াইতেই মনে হৈল, আহা, সিনেমার নায়কদের মত দৌড়াইতে দৌড়াইতেই যদি বড় হৈয়া যাইতে পারতাম! গার্মেন্টসের সেলাইয়ের পয়সায় তো মা-ভাইবইনের সংসার চলবার কথা না। চোদ্দ-পনের বছরের হানুফার লাগব চল্লিশ বছর বয়সের একখান বেটামানুষ, বাপ কি ভাতার সেইটা পরের প্রশ্ন। আমার মত লাফাঙ্গার সাথে সিনেমা দেইখ্যা কী করবে সে? আমি কি টেম্পু চালাই? আমি কি গার্মেন্টস কম্পানির সুপারভাইজার? আমার কি ছাদে মাল আছে?

না। আমার ছাদে মাল নাই। আবার শালার বয়সের চাক্কাও আটকায়া গেছে। রাতে ওয়াসার চোরাই পানির কলের সিরিয়ালে গিয়া খাড়াই সবার আগে। একটাই পানির লাইন সারা কালাপানি বস্তিতে, কিন্তু সেইটাতে পানি আসে চব্বিশ ঘণ্টায় একবার: রাত বারটা থিকা ভোর চারটার মধ্যে কোন একটা সময়ে। সাড়ে এগারটা থিকা পানির সিরিয়ালে খাড়ায়া-খাড়ায়া গুলতানি আর মশা মারা শুরু হয় মানুষের। পাতলা একখান ঝোপ, কিন্তু ঝোপের মধ্যে বেদম মশা! হানুফার কামে যাওন লাগে আটটায়, তবু পানির সিরিয়ালে ওরই খাড়ান লাগে। ওর মা শোয়া থিকা উঠতেই পারে না, আর ভাইবোন দুইটা ঘুমায়া পড়ে উজান রাতেই। পাইপে পানি আসবার আগে-আগে যখন শোঁ শোঁ ছ্যাত্ ছ্যাত্ শব্দ করতে থাকে, তখন হানুফা আইসা খাড়ায় সবার পিছে। কিন্তু ওর সিরিয়াল আসতে আসতে প্রায়-দিনই পানি ফুরায়া যায়। আমার তখন জামাইবৌ খেলার টাইম:

: হানুফা, নেও এই পানিটা ঢাইল্যা লৈয়া যাও।
: তুমি কি করবা? তোমার পানি কৈ?
: ইয়ামিন আর কানা পানি নিয়া গেছে। আমার পানি লাগে না, নিয়া যাও।
: লাগে না তো পানি নিতে খাড়াইছিলা ক্যান?
: তুমি দেরি কৈরা আসো যে, তাই আগে-আগে খাড়াইছি তোমার পানির লাইগ্যা।

আমার এক কান্ধের ফেরেশতা আরেক কান্ধের ফেরেশতার সাথে এই খেলা খেলে। বাস্তবের হানুফার সাথে আমার কোনো কথাই হয় না। পানি নিতে খাড়ায়াই বেড়ার মধ্যে ঠেস দিয়া ঘুমায়া পড়ে সে। কখনো বৈসা বৈসাও ঘুমায়। বারো ঘণ্টার চাকরি চালায়া যাইবার জন্য চার ঘণ্টার ঘুম তো লাগে, নাকি? ডায়ালগ-ছাড়া বোবাসিনেমার মত আস্তে কৈরা আমার পানিটুকু ঢাইল্যা দেই ওর বালতির মধ্যে। হানুফা কিছুই টের পায় না, ঘুম ভাঙলে দেখে বালতির মধ্যে পানি। অবাক হয় না সে, পানি তো বালতির মধ্যেই থাকবে, নাকি? ঘুমে-হাঁটা মানুষের মত ভরা-বালতি নিয়া ঘরের দিকে হাঁটা দেয়। অন্যদিকে তাকায়া তাকায়া এই জিনিস ঘটতে দেখি, আর ভাবি কে বেশি ভোদাই? আমি? না ওমর সানি? কোনটা বেশি ভাল? খালি বালতি? না ভরা বালতি?

একদিন চুইংগাম চিবাইতে চিবাইতে র‌্যাবের লোক আইসা হাজির। ওরা প্রজেক্টের ভিতর খুব ঘেরাও টেরাও দিয়া একটা ক্রসফায়ার করল, তারপর লাশটার ফটো তুলল, ভিডিও করল। তাদের ফোন পাইয়া সাংবাদিকরা আসল, পিছন পিছন আমরাও গিয়া দেখি, খোদার দুনিয়ায় এত লোক থাকতে লাশটা টেম্পু ড্রাইভার শাহালমের! অথচ টেলিভিশনের খবরে কৈল এইটা নাকি কালা জাহাঙ্গীরের লাশ, সে নাকি বিরাট সন্ত্রাসী! সবাই কৈতেছিল শাহালম নাকি একটা পিঁপড়াও মারে নাই জীবনে, ফুলের টোকাও দেয় নাই কারো গায়ে। এরপর রাতের পর রাত বস্তিতে রেইড দিতে থাকল র‌্যাবের লোকেরা, কালা জাহাঙ্গীরের নেটওয়ার্ক বাইর করার লাইগ্যা। ভয়ে সব বোবা হৈয়া গেল। বিলাপ গিলতে গিলতে হানুফা খালি হিক্কা তুলতে লাগল। হিক্কা তুলতে তুলতে ফর্সা চামড়া লাল হৈয়া যায় হানুফার, কী যে সুন্দর লাগে, মনে হয় একটা হিক্কার জন্য সাতবার মরণ হৈলেও ভাল। র‌্যাবের লোকের আশপাশ দিয়া ঘুরাঘুরি করি, কেউ জিগায়াও দেখে না কিছু। বয়স আমার বাড়ে না, ক্রসফায়ারের মরণ আমার কপালে নাই।

সমিতিঘরে বুক ফুলায়া আসা-যাওয়া করা শুরু করে সদরুদ্দিন। সবাইর ঘরে-ঘরে গিয়া শোনায়, শেলটেক কম্পানি নাকি রাজউকের সাথে ভাইল কৈরা ফেলাইছে। দিনকয়েকের মধ্যেই বুলডোজার নামায়া দিবে কালাপানিতে। সবাইরে একজোট থাকা লাগবে, এইবার ঠেকাইবার কেউ নাই। দিন বদলায়া গেছে, গুলশান-বনানীর দালানকোঠা ফালায়া বড় বড় মুরুব্বিরা এখন চোদ্দশিকের ভিতর বৈসা হাওয়া খায় এখন! দিনকয়েক ধৈরা অচেনা মানুষ দেখি কালাপানিতে। ঘুরাঘুরি করে, নানান মাপজোখ করে। পুলিশ না সিআইডি না ক্যাডার কেউ জানে না, কেউ কিছু জিগায়ও না। একের পর এক আগুন লাগতেছে কড়াইল, ভাষানটেক, খিলক্ষেত, বেড়িবাঁধ বস্তিতে। পালা কৈরা রাত জাগে সবাই, বস্তি পাহারা দেয়।

আমাগো কমিশনার আর নড়েচড়ে না। সদরুদ্দিনরে ক্ষুর দিয়া পোচায়া দিমু নাকি, জিগাই তারে গিয়া। হা হা কৈরা ওঠে সে, বলে, চুপ কৈরা থাক শুওরের বাচ্চা, দেখস না দেশে আর্মি নামছে র‌্যাব নামছে? সাঙ্গপাঙ্গহীন অবস্থায় তারে কেমন পঙ্গু পঙ্গু লাগে। সে ফিসফিস কৈরা কয়, সদরুদ্দিন ভালা কাম করতেছে। করুক। ওর লগে আমার হিসাব পরে চুকামু। আমার খানকির পোলা ক্যাডাররা তো সব ভাগুর্তা হৈয়া গেছে। যাক, আর কোনোদিন জায়গা দিমু না অগোরে, খোদার কসম। দিন আসুক, তোগো দিয়া একটা পিচ্চি বাহিনী বানামু। তোরাই তো ভবিষ্যত।

কমিশনারের ভয়ে-শাদা মুখের দিকে তাকায়া-তাকায়া আমি আমার ভুত-ভবিষ্যত দেখি। নানান হিসাব নিকাশ করি। র‌্যাব-আর্মি ডরায়া আমার কি ফায়দা? ক্রসফায়ারের মরণ তো আমার কপালে নাই। যে হানুফার চোখ আগে আমার মাথার আধাহাতের মধ্যে আছিল, শাহালম মরার পর সেইটা কোনাকুনি সাত আসমান বরাবর উইঠা গেছে। এখন কারো দিকেই সে আর চাইয়া দেখে না, পানিও নিতে আর আসে না। ওর ছোট ভাইটা মাঝে মাঝে আইসা সিরিয়ালে কলসিটা রাইখ্যা যায়, সেই কলসি সকাল পর্যন্ত সেইখানেই পৈড়া থাকে। সমিতিঘরও আজকাল সাংঘাতিক গরম, টিভিতে খবর শুরু হৈলে লোক উপচায়া ওঠে। খোদার লীলা বোঝা কঠিন, কুদ্দুছ চাচায় যেমন কয়। সদরুদ্দিন আইসা আবার কালাপানি চাঙা কৈরা দিল, আর আমাগো কমিশনার কেমন বাসি মুড়ির মত পোতায়া গেল! ভাবতেছি, এই কমিশনার হালারেই একদিন যত্ন কৈরা পোচায়া দিমু। অচল নোটের মত দশা, সকালবিকাল আল্লাবিল্লা করে, আর কয়দিন পরপর হাসপাতালে এডমিশন লৈয়া ঘুমাইতে যায়। দেখলেই হাসি লাগে। দিই একদিন পোচায়া, কী কন?

আগস্ট ২০০৭


মন্তব্য

আরশাদ রহমান এর ছবি

পড়লাম।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

চমৎকার!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুজন চৌধুরী এর ছবি

বেশ মজা পাইলাম।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

??? এর ছবি

আরশাদ রহমান, প্রীত হলাম।
জুবায়ের ভাই এবং সুজন চৌধুরী, খুশি হলাম।
অলৌকিক হাসান, "আমি সেইদিন হব শান্ত"!

..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

শ্যাজা এর ছবি

চমৎকার...

অফ টপিক- এই লেখার নামটা দেখে ইস্তক তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলম বায়োস্কোপ গানটা বেজে চলেছে ভিতরে ভিতরে হাসি


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

??? এর ছবি

একেবারেই অন টপিক শ্যাজা, নামটা ঐ গানটার দুলুনি থেকেই নেয়া। যদিও ব্যবহারের কারণে অর্থ অনেক বদলে গেছে হয়ত।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

কনফুসিয়াস এর ছবি

গুরুদুয়ারায় শনিবারেও খাওয়ায় নাকি?
শুক্রুবারেই শুধু খাওয়ায় জানতাম।

-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

??? এর ছবি

একদিন খাওয়ায় আর কি, দিনক্ষণগুলো এখানে এগজাক্টলি আছে এমন হয়ত না। আপনার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাস আমাকে মোহিত করল। হাসি
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

কিছুদিন কবিতার দিন গেলো।
এখন সচলে মনে হয় গল্পের কাল যাচ্ছে।
এতো কাজ হাতে। এতো সব গল্প কবে পড়বো?
প্রথম প্যারাটুকু পড়েই বুঝলাম অনেক সময় দাবী করে গল্পটা। কাজ শেষ করে এসে পড়তে হবে।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

??? এর ছবি

কাজ শেষ করে, হাতে সময় থাকলে, এবং পড়তে ভাল লাগলে, পড়বেন। হাসি
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

যাক, সুমন রহমানের প্রায় নতুন একটা গল্প পড়ার সুযোগ হলো ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আপনার সেই অসমাপ্ত সমালোচনাটা আবার লিখতে ইচ্ছা করতেছে। মিরপুরে কালাপানির কাছেই আমাদের বাড়ি। ঘটনাগুলো পড়ার সময় জায়গাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। গল্পের আগে আপনি যে প্রচুর রিসার্চ করেন সেটা টের পাওয়া যায়।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

??? এর ছবি

হাসান মোরশেদ, প্রায়-নতুন কেন? এটা তো রীতিমত নতুন গল্প। আগস্ট মাসে লেখা।

মাহবুব মুর্শেদ, আপনার বাড়ি কালাপানির কাছে? ওয়াও.... তাইলে তো আপনের বাড়ির কাছে কত গেছি! হয়ত আপনেরে দেখছিও, হাফপ্যান্ট পইরা খেলাধুলা করতেছেন বাড়ির আঙিনায়...হাসি
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

প্রায় নতুন এ অর্থে যে, মাসখানেক গত হয়েছে হাসি
জানতে কৌতুহল হচ্ছে এই সময়ের মাঝে কি নতুন কোনো লেখা সৃষ্টি হয়েছে? গল্প,কবিতা,সমালোচনা?
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

??? এর ছবি

সমালোচনা লিখতে হয়েছে একটা, পিটার ম্যানুয়েলের "ক্যাসেট কালচার"এর। একাডেমিক প্রয়োজনে অনেকটা। ঐ সব কাজকর্মই চলছে। এর বাইরে একটা গল্পের হালকা খসড়া করতে পেরেছিলাম। তাও মনে মনে।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

সমসাময়িক বিষয় এবং চরিত্রগুলোর প্রাণবন্ত চিত্রায়ন,
এক কথায় অসাধারণ!

চমৎকার-
এই বিষয়ে অমত কার?

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

ধ্রুবক এর ছবি

ভালো লাগলো ভীষন। একটানে পড়লাম।

হাসিব এর ছবি

আরেকবার পড়লাম ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।