ওমর শেহাব ভাইয়ের কল্যাণে বাংলাদেশের কিছু খবরের কাগজগুলোর আর্কাইভ আমার হাতে আসে কয়েক মাস আগে। ব্যস্ততার মধ্যে সেগুলো ভালো করে ঘেটে দেখা হয়নি অনেকদিন ধরে। শেষমেশ সময় পেলাম কিছুদিন আগে আর্কাইভ নিয়ে একটু সময় নিয়ে বসার। ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা তৎকালীন মিডিয়াতে কিভাবে রিপোর্ট করা হয়েছিল তা জানবার কৌতূহল ছিল অনেক বছর ধরে। কোন খবরের কাগজেই যে ঘটনার আসল নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয়নি, এবং খবর/সম্পাদকীয়গুলোর মধ্যে রকমফের ছিল না বললেই চলে তা আগে শুনেছিলাম, কিন্তু নিজের চোখে দেখার সুযোগ এই প্রথম। তাই প্রথমে ১৬ই আগস্ট ১৯৭৫ এর আর্কাইভটাই খুললাম। নীচে সেই সময়ের শীর্ষস্থানীয় চারটি খবরের কাগজ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্যা বাংলাদেশ টাইমস (The Bangladesh Times) আর দ্যা বাংলাদেশ অবজার্ভার (The Bangladesh Observer) এর প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা তুলে ধরলাম।
দৈনিক ইত্তেফাকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিরোনাম ছিল 'খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহন'। এই খবরের প্রথম দুই লাইন দ্রষ্টব্যঃ
'রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যূষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহন করিয়াছেন।
শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।'
উল্লেখযোগ্য যে ইত্তেফাকের মত প্রভাবশালী খবরের কাগজে একটা অবৈধ ক্ষমতা দখলকে রীতিমত ডালভাত হিসেবে পরিবেশন করা হয়েছে। অনেকটা আফটার থটের মত বলা হয়েছে 'শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হইয়াছেন', কিভাবে 'নিহত হইয়াছেন' তা কোথাও লেখা হয়নি। জাতির জনক যে সপরিবারে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, নিহতদের মধ্যে তার আট বছর বয়সী শিশুপুত্র শেখ রাসেল ছিল, গর্ভবতী পুত্রবধূ ছিল, এসব কথা সুন্দরভাবে চেপে যাওয়া হয়েছে। ইত্তেফাকের এজেন্ডা আরও পরিস্কার হয় 'ঐতিহাসিক নবযাত্রা' শিরোনামে সম্পাদকীয়, এবং 'নয়া সরকারের জন্য মোনাজাত', 'জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস', 'বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন' শিরোনামে খবরগুলো দেখলে। এর সাথে 'নয়া সরকারের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি' এবং 'যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাবে' খবর দুটোও চোখে পড়ার মত।
বাংলাদেশ টাইমস এর খবরগুলো ইত্তেফাক থেকে খুব বেশী আলাদা ছিল না। 'Martial Law proclaimed in the country: Mujib killed - Mushtaque Assumes Presidency' শিরোনামের খবর থেকেঃ
'The Armed Forces of Bangladesh took over power in the 'greater national interest' under President Khondkar Mushtaque Ahmed, topping the former President Sheikh Mujibur Rahman early on Friday morning, reports BSS.
The former President Sheikh Mujibur Rahman was killed at his residence during the takeover, it was announced.'
বাংলাদেশ টাইমস অন্তত বঙ্গবন্ধু যে ক্ষমতা দখলের সময় খুন হয়েছেন তা শিরোনামে স্পষ্ট করে লিখেছে। তবে আবারও দেখা যাচ্ছে যে সপরিবারে হত্ত্যার বিষয়টা ইত্তেফাকের মতই চেপে যাওয়া হয়েছে। এবং পুরো জিনিসটাকে হালকা করে দেখানোর যে প্রবনতা ইত্তেফাকে ছিল, সেটার প্রতিফলন এখানেও পাওয়া যায় 'On the threshold of a new era' নামক সম্পাদকীয়তে। সেখান থেকে নিম্নোক্ত লাইন দ্রষ্টব্যঃ
'The valiant armed forces of the country under the leadership of President Khondkar Mushtaque Ahmed have taken over the reins of the Government in a smooth and orderly way at a time when a change had become absolutely necessary; but the situation was such that no change could be effected in a constitutional manner.'
যেই সামরিকভাবে ক্ষমতা দখল বিনা রক্তপাতে ছিল না, সেই ক্ষমতা দখল ঠিক কিভাবে 'smooth and orderly' হয় সেটা বোঝানোর চেষ্টা আর বাংলাদেশ টাইমস এর সম্পাদকরা করেননি। এ ছাড়া বাকি উল্লেখযোগ্য খবরগুলো ছিল খন্দকার মোশতাকের জাতির উদ্দেশ্যে বিবৃতি নিয়ে ('Values have to be rehabilitated'), জনগনের 'স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি' নিয়ে ('People thank Armed Forces', 'Special Prayers', 'Mujib's picture removed' এবং আমেরিকা/পাকিস্তানের স্বীকৃতি দান নিয়ে ('US ready for normal ties', 'Pakistan decides to recognise'।
দৈনিক বাংলা খবরের কাগজের শিরোনাম ছিল 'শেখ মুজিব নিহতঃ সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারিঃ সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ'। খবরের সারমর্ম ইত্তেফাক এবং টাইমস থেকে খুব একটা পৃথক ছিল না। সম্পাদকীয়র শিরোনামও একই রকম ('ঐতিহাসিক পদযাত্রা'), এ ছাড়া বাকি খবরগুলোও মোটামুটি একই।
শেষ যেই খবরের কাগজটিতে চোখ বোলালাম তা হলো বাংলাদেশ অবজার্ভার। বাকি তিন কাগজে লক্ষ্য করা ধারা এখানেও আবহমান। প্রথম শিরোনাম 'Armed Forces take over: Martial Law proclaimed: Curfew imposed - Mushtaque becomes President - Mujib killed: Situation remains calm' এবং আবার সেই একই রকম সম্পাদকীয় ('Historical Necessity') চোখে পড়ার মত।
চারটি তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় খবরের কাগজ। দুটো বাংলা, দুটো ইংরেজি। একটিরও প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং সামরিক ক্ষমতা দখলের আসল কাহিনী পরিস্কার করে তুলে ধরে হয়নি। চারটিরই প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয়র লেখার ঢঙে অদ্ভুত মিলে খুঁজে পাওয়া যায়। অন্তত শিরোনামে কি কি শব্দ ব্যবহার করতে হবে '(ঐতিহাসিক/Historic)' এবং সারমর্ম (বঙ্গবন্ধুর পরিবারকেও হত্যা করার বিষয় বেমালুম চেপে যাওয়া, জনগণ এই ক্ষমতা দখলে খুশি এমন একটা আভাস দেয়া) বলতে গেলে চার খবরের কাগজেই এক। এ থেকে বোঝা যায় যে এই খবরের কাগজগুলোর একটিও ক্ষমতা দখলকারী শক্তির প্রভাবমুক্ত ছিল না, তাদের লাইনে চলে আসতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এক দিনও লাগে নাই। সাধারনত কোন সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল হলে খবরের কাগজগুলো দুই একদিন বন্ধ থাকে, যাতে দখলকারী দল তাদের ন্যারেটিভ জনগনের সামনে পেশ করার জন্য কিছু সময় পায়। এখানে তেমন কোন সময়ের দরকারই পড়েনি, যেটা আসলেই ইন্টারেস্টিং।
এ থেকে আবারও পরিস্কার যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা কোন 'কতিপয় সামরিক অফিসারের বঙ্গবন্ধুর স্বৈরাচারে অতিষ্ঠ হয়ে করা বিপ্লব' ছিল না। দেশ এবং বিদেশের প্রভাবশালী চক্রের আশীর্বাদ এবং মদদে অনেকদিনের সাবধানে করা পরিকল্পনা ছাড়া এতটা কোঅর্ডিনেটেডভাবে কার্যসিদ্ধি করা, মিডিয়াকে এতো তাড়াতাড়ি নিজেদের সুরে কথা বলতে বাধ্য করা, এ সব স্রেফ কিছু জুনিওর অফিসারের পক্ষে সফলভাবে সম্পন্ন করা বলতে গেলে অসম্ভব।
আরেকটা কথা। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মহসিন আলী দেশের মিডিয়াকে 'খবিশ' ডেকে গতবছর আলোচিত হয়েছিলেন। ১৬ই আগস্ট ১৯৭৫ এর খবরের কাগজগুলো ঘেঁটে উপলব্ধি হলো যে আমাদের দেশের মিডিয়ার খবিশগিরি আজ থেকে নয়, যুগ যুগ ধরে। যেই মিডিয়া একদিন জাতির জনকের সপরিবারে হত্যার বিষয়ে সত্য ঘটনা জনগনের সম্মুখে তুলে না ধরে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছিল, খুনি চক্রের প্রভাবে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞকে 'ঐতিহাসিক' আখ্যা দিয়ে খুনিদের হিরোর সার্টিফিকেট দিতে কার্পণ্য করেনি, সেই মিডিয়ার বেশীরভাগ তো ঐতিহ্যবাহীভাবেই খবিশ!
কৃতজ্ঞতায়ঃ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (ICSF), সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চ (CBGR), ওমর শেহাব।
১৬ই আগস্টে লেখা খবরের কাগজের সম্পাদকীয়সমূহ নিয়ে শেহাব ভাই এর একটা চমৎকার লেখা সচলায়তনেই আছে, এটা পাবেন এখানে।
মন্তব্য
মিডিয়া মোগল-পাঠান যারা আছেন, উনারা যে দাবি করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে চূড়ান্ত বাকস্বাধীনতা জারী ছিল। আপনারা এভাবে দুষ্কৃতিকারীদের মতন বিভ্রান্তি ছড়ান কেন, শুনি?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ইয়ে না মানে, উনাদের চোখে বাকস্বাধীনতা বলতে কি বুঝায় আমি তো তাই দেখতে আর্কাইভটা নিয়ে বসেছিলুম সত্যানন্দ-দা।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
বলতে গেলে চার খবরের কাগজেই এক। এ থেকে বোঝা যায় যে এই খবরের কাগজগুলো বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ একমত ছিল! বাকস্বাধীনতা প্রমানেও চারজন স্বাক্ষী লাগে। হল তো, এবার চোখটা পকেটে পুড়ুন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
ইত্তেফাকের ভূমিকা এরকমই তো হওয়ার কথা ছিল। তখন হিরু মিয়া (ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন) ইত্তেফাকের সম্পাদক(মালিক তো বটেই)। তো এই হিরু মিয়ার ল্যাঞ্জা বহু আগেই দৃশ্যমান ছিল, কিন্তু কেউ সেটা আগে চিনতে পারে নাই। অনেকেই তাকে সিআইএ'র এজেন্ট বলে মনে করত, তার নানা কান্ড এবং ইত্তেফাকের ভূমিকা দেখে পরবর্তীতে বোধ হয় সে বিষয়ে কারো আর সন্দেহ ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রের বিচার হয় নি। ষড়যন্ত্র সে ভাবে উদ্ঘাটিতও হয় নি, হলে হিরু মিয়াও জালে ধরা পড়তো বলেই মনে হয়। মোশতাক পরে ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিল, হিরু মিয়া সে দলে যোগ দিয়ে একজন নেতা হয়ে বসেছিল। সুতরাং বোঝাই যায়, মোশতাক এবং ফারুক-রশিদের ঘৃণ্য তৎপরতার সাথে হিরু তথা ইত্তেফাও জড়িত ছিল ওতপ্রোতভাবে।
ওমর শেহাবের পোস্টে করা ষষ্ঠ পান্ডবের কমেন্টটা এক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী। আসলে ওইসময় পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সকলের মনস্তত্ব আসলে ঠিক কি ছিল তা কি পরবর্তীতে জানার চেষ্টা করা হয়েছিল (অন্যরা জানতে চেয়েছিল কি?)। মানে তাঁরা কখনো বই বা অন্যকোনভাবে ১৫/১৬ অগাস্টে ঠিক কি হয়েছিল মানে তাঁদেরকে কি করতে বলা হয়েছিল, কতটুকু চাপ দেয়া হয়েছিল নাকি পুরোটাই নিজেদের কাজ ছিল তা কি জানিয়েছেন?
এই কলামটা সম্ভবত ইত্তেফাকেরই। এটা কত তারিখ প্রকাশিত হয়েছিল তা কেউ জানেন? আমি নিজে কোথা থেকে পেয়েছি তা আর এখন বলতে পারছিনা।
শেহাব ভাইয়ের পোস্টটা লিঙ্ক করার জন্য ধন্যবাদ, উনি যে এই বিষয়ে ইতিমধ্যে একটা লেখা দিয়েছেন সেটা জানি কিভাবে আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। আমি তার পোস্টের লিঙ্কটা লেখার সংযোজন করে দিচ্ছি।
আনোয়ার হোসেনের এই উপ-সম্পাদকীয়টা ১৬ বা ১৭ তারিখে ছাপা হয়নি, তা বলতে পারি এখনই কারন আমার গুগল ড্রাইভে এই দুই দিনের ইত্তেফাকের স্ক্রিনশট সংরক্ষিত আছে। বাকি দিনগুলো চেক করতে বাসায় গিয়ে খুঁজে দেখতে হবে হার্ড ড্রাইভে। খুঁজে পেলে আমি আপনাকে জানাবো। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
নতুন মন্তব্য করুন