নাসিরনগরের কথা মনে আছে? গত বছরের ৩০শে অক্টোবর রসরাজ দাস নামক এক দরিদ্র হিন্দু জেলের ফেসবুক আইডি থেকে 'ইসলামকে অবমাননা' করে পোস্ট ছাড়া হয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দুপল্লীতে আক্রমন করে আপামর 'ধর্মভীরু' জনসাধারন। ধর্মকে রক্ষা করার নামে স্থানীয় হিন্দুদের বাড়িঘর, পনেরোটি মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়, লুটপাট করা হয় দোকান, এর পরের দিনগুলোতে সেই হিন্দুপল্লীতে তিনদফা আগুন দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের দলীয় কোন্দলও রয়েছে এই হামলার নেপথ্যে, এমনও উঠে এসেছে কিছু প্রতিবেদনে। এখন পর্যন্ত শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে যুবদল নেতা, থেকে শুরু করে 'মূল হোতা' হিসেবে চিহ্নিত আওয়ামী লীগ নেতা, দলমত নির্বিশেষে সবাই আছেন। যাই হোক আমার এই লেখার আলোচ্য বিষয় নাসিরনগরের হামলা নিয়ে কোন বিশ্লেষণ নয়, এই লেখা হামলার সাথে যারা সম্পৃক্ত, তাদের নিয়েও নয়।
এই লেখাটা রসরাজকে নিয়ে। নাসিরনগরে হামলার সময় থেকেই রসরাজ 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার' অভিযোগে জেলে ছিলেন। যদিও কেবল ক্লাস ফাইভ পাশ করা অর্ধশিক্ষিত রসরাজের পক্ষে যে এমন ছবি ফটোশপ করে পোস্ট করা প্রায় অসম্ভব, সেটা হামলার পরের দিনগুলোতেই তদন্তে উঠে এসেছিল। যেই সময় রসরাজের আইডি থেকে সেই ছবি পোস্ট করা হয়, তখন তিনি বিলে মাছ ধরছিলেন, তার ফোন ছিল বাড়িতে। শুধু তাই নয়, নভেম্বরের ১৯ তারিখেই পুলিশ নাসিরনগরের জাহাঙ্গীর আলম নামক এক যুবককে গ্রেফতার করেঃ
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, “জাহাঙ্গীর আলম হরিণবেড় বাজারের আল আমিন সাইবার ক্যাফের স্বত্বাধিকারী। পুলিশের ধারণা, জাহাঙ্গীরই রসরাজের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ ছবিটি পোস্ট করেন।”
অর্থাৎ ধর্মীয় অবমাননার 'অপরাধে' যে রসরাজ নির্দোষ, তাকে ফাঁসানো হয়েছিল, সেটা তো পুলিশ বেশ আগেই নিশ্চিত করেছে। তারপরেও কেন তাকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত জেলে থাকতে হলো? সে বিষয়ে আবার রসরাজের জামিন শুনানির আগের দিন পুলিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সে নির্দোষ হলেও 'অসতর্কতার' জন্য দায় তাকেই নিতে হবেঃ
ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় উসকানি ছড়ানোর অভিযোগে রসরাজের বিরুদ্ধে করা মামলাটির অগ্রগতি বিষয়ে গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মফিজউদ্দিন ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার যে কোনও ডিভাইসের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব আমার নিজের। সেটি কে কিভাবে ব্যবহার করলো তা দেখার বিষয় না। আমরা এই লাইনেই এগোচ্ছি। আশা করি, ইতিবাচক ফল পাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুরু থেকে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন সে নিরপরাধ। কিন্তু কে কোথা থেকে পোস্ট করেছে এবং কখন ডিলিট করে দিয়েছে সবই বেরিয়ে এসেছে। একটি পোস্টই শুধু না, পরেও একটি পোস্ট দেওয়া হয়। এখানে রসরাজের নিজের সতর্ক হওয়ার বিষয় ছিলো। যদি ধরেও নিই সে সতর্ক হতে পারেনি, তবু সেটার একটা শাস্তি আছে। আমরা দেড় মাস ধরে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। শিগগিরি আমরা তদন্ত শেষ করতে পারব বলে ধারণা করছি।’
সৌভাগ্যক্রমে, আদালত পুলিশ কর্তৃপক্ষের এমন 'চমৎকার যুক্তিকে' দুই পয়সার দাম না দিয়ে রসরাজের জামিন মঞ্জুর করে, এবং ১৭ই জানুয়ারি তিনি আড়াই মাস বিনা অপরাধে জেল খাটার পর মুক্তি পান। এখানে একটা সুন্দর সমাপ্তি ঘটতে পারতো। তবে বাস্তব জীবনের সাথে সিনেমার রূপালী পর্দায় দেখা 'হ্যাপি এন্ডিং' এর বিস্তর ফারাক।
জেল থেকে বেরিয়েই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রসরাজঃ
মুক্তি পাওয়ার পর নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে রসরাজ বলেন, ‘অপরাধ করিনি। এলাকায় যাব। কপালে যা হবার হবে।’
জেল গেইটে রসরাজের মামা ইন্দ্রজিত দাস জানান, ‘ভাগ্নেকে নিয়ে তার গ্রামে যাবো। এলাকার মুরব্বিদের কাছে তাকে তুলে দেবো। এর বেশি কিবা (কিইবা) করার আছে।’
এরপরের সর্বশেষ পাওয়া খবর মতে, রসরাজ তার বোনের বাড়িতে আছে। তার এবং তার পরিবারের নিরাপত্তাহীনতাবোধ কাটছে না, যদিও স্থানীয় পুলিশ সবপ্রকার সহযোগিতার এবং নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেঃ
রসরাজের কাছে মোবাইল ফোন না থাকায় তার সঙ্গে সারাদিন যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে রসরাজের বোন-জামাই নেপাল দাসের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাই, শইলটা (শরীর) ভালা (ভালো) না। খুব দুর্বল লাগতাছে। খাওন-দাওনও করতে পারতাছি না। সারা শইলে বেদনা করতাছে। জেলখানায় ঠিকভাবে খেতে পারিনি। ডাক্তার বলছে, বেশি কইরা ডিম-দুধ খাইতাম। কুসতা (কিছু) ভালা লাগে না। তাই ঘুমাইয়া পড়ছি।’ আধাভাঙা কণ্ঠে রসরাজ জানান, বৃহস্পতিবারই বাড়িতে ফিরবেন তিনি।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পরও রসরাজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না তার পরিবারের সদস্যদের। রসরাজের বড় ভাই দয়াময় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানুষের মন বলে কথা। কার ভেতরে কী আছে তা তো আর বলা যায় না।’ একই ধরনের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন রসরাজের মামা ইন্দ্রজিত ও বোন-জামাই নেপাল দাস। তবে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা তাদের অভয় দিয়েছেন জানিয়ে নেপাল দাস বলেন, ‘তারা (পুলিশ কর্মকর্তারা) বলেছেন, কোনও সমস্যা নেই। তারা বলেছেন, রসরাজ নিজের বাড়িতে আগের মতোই থাকবে।’
এ বিষয়ে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু জাফর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রসরাজ এলাকায় ফিরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তার নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশ তৎপর আছে। তার বাড়ির সামনে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। এছাড়া, সে জামিন পাওয়ার পর এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।’
রসরাজের ভবিষ্যতে শেষ পর্যন্ত কি আছে জানি না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এটাই, যেই এলাকার মানুষেরা একদিন তাকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতে গিয়েছিল, যারা তার পল্লীতে, তার মন্দিরে ভাংচুর করেছিল, বারবার তিনবার আগুন দিয়েছিল, সেই এলাকার 'মুরব্বিদের' কাছেই তাকে ধর্না দিতে হবে সপরিবারে হেফাজতের জন্য। যেই পুলিশ কর্তৃপক্ষ তার উপরেই দায় চাপাতে বদ্ধপরিকর ছিল জামিন পাবার আগ পর্যন্ত, 'তার অসতর্কতাই সব ঝামেলার কারন' (যুক্তিটা একেবারে 'মেয়েটার কাপড়চোপড় ঠিক ছিল না' মার্কা শুনাচ্ছে না?) বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছিল, তাদের আশ্বাসের উপরেই ভরসা রাখতে হচ্ছে তাকে। হয়তো আমার আশংকা অমূলক, হয়তো রসরাজের এলাকাবাসীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাকে বুকে টেনে নেবে, তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইবে, এবং তার এবং তার পরিবারের সুরক্ষার দায়িত্বটা তারাই নিবে। তবে আবহমান বাংলায় সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষরা কতটুকু নিরাপদ থাকেন সেটা আমরা সবাই জানি। হয়তো কিছুদিন পরে শুনবো হুমকির মুখে রসরাজ সপরিবারে ইন্ডিয়া পাড়ি দিয়েছেন। তখন আমরা কিছুদিন তাকে গালি দিবো, বলবো 'শালার নিমকহারাম মালাউন, যাবিই তো। আসলে এটাই তো চাইছিলি, সুযোগ পেলেই তোদের বাপের দেশে ভাগার।' অবশ্য আমাদের দেশটা আজকাল স্বল্পমেয়াদী ইস্যুভিত্তিক কিনা, প্রতিদিন নতুন কোন 'ইস্যু' এসে হাজির হয়, তখন রসরাজকে ভুলে সেই নতুন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। ব্যাপার না।
প্রয়াত কবি শামসুর রহমানের 'সুধাংশু যাবে না'র শেষ লাইনগুলো আজকাল ক্রমশ প্রহসনের মত শুনায়ঃ
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।
কবির সেই সুধাংশুর কি হয়েছিল তা আমরা জানি না। তবে আমি নিত্যনৈমিত্তিকভাবে দেখছি বাস্তবের রসরাজরা হারিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবের রসরাজরা হারিয়ে যায়।
মন্তব্য
ডকুমেন্টেশনের জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ শেহাব ভাই।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
আজকাল এসব শুনে খারাপ ও লাগে না| কি ই বা আমরা করতে পারি| মনে হয় যেসব বিস্বাস নিয়ে সারাজীবন বেচে আছি সব মিথ্যে | সবকিছু নষ্টের অধিকারে চলে গেছে |
না চলে গেলেও চলে যাওয়ার পথে অনেকদুর হাটা দিয়েছে এটা অস্বীকার করা অসম্ভব।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
হুম ! লিখাটা ভালো লাগলো । হান্টার হান্টার
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
আহারে নিজের দেশে একটা পরিবার কেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে!
ব্যাপারটা ভাবলে অপরাধী মনে হয় কেমন।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
রসরাজতো বটেই, তার সাথে আমরা অনেকেই কিন্তু চোরাগোপ্তা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতেই পড়ে আছি। ধিক্কার জানাবার গলার জোর টুকুও নেই, ভয় হয় চিৎকার করে নিজেকে জানান দিয়ে যদি বিপদে পড়ি। কিন্তু কখনও কখনও চিৎকারটা বুকচিরে সমস্ত সাবধানতা চিরে ঠিকই বেরিয়ে আসে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আপনার সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত সোহেল ইমাম ভাই।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন