স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ ছিল ১৯৭২ সালের ঈদুল আজহা। তারিখটা ছিল ২৭শে জানুয়ারি। দেশ দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছে তার মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগে। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে এক যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের হাল ধরেছে মোটে দু সপ্তাহ হলো। এর মাঝে দেশে ঈদ উদযাপনটা কি রকম ছিল, তা জানার একটা কৌতূহল ছিল। ভাবলাম বিস্তারিত না জানতে পারলেও আর্কাইভ ঘেঁটে ঈদের আগের দিন (২৬শে জানুয়ারি) এবং ঈদের ছুটির পরের প্রথম কর্মদিবসের (২৯শে জানুয়ারি) খবরের কাগজগুলো দেখলে হয়তো কিছু আঁচ পাওয়া যাবে। সেই দুইদিনের দৈনিক বাংলা থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন, খবর এবং বিজ্ঞাপন তুলে ধরলাম।
ঈদের আগের দিন ছুটির নোটিশ জাড়ি, ঈদ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ বাণী, ঈদ উদযাপনের প্রতিবেদনগুলো প্রথমে দিলাম। একটা জিনিস পরিস্কার যে ঈদ একটি উৎসবের দিন হলেও স্বাধীন বাংলার মাটিতে এই প্রথম ঈদের সাথে যে গভীর শোকও মিশেছিল তা স্বাভাবিকভাবেই ফুটে উঠেছে রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর বাণী এবং প্রতিবেদনে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাণীতে উল্লেখ করেছেন 'ঈদুল আজহা আমাদের আত্মত্যাগের আদর্শই শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশের সাহসী মানুষ দেশকে স্বাধীন করার জন্য সম্পদ ও রক্ত দিয়ে চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন।' বিচারপতি আবু সাঈদ এর সাথে যোগ করেছেন 'সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক পরিবারই প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় শোকাভিভুত। ঈদের দিন সেই ব্যথা আরও গভীরভাবে পরিব্যপ্ত। তাই এবারকার ঈদ অত্যন্ত শান্ত এবং ভাবগম্ভীর পরিবেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানরূপে পালন করা উচিত।' শোকার্ত পরিবেশের প্রতিফলন 'আনন্দের পাশাপাশি মূর্ত হয়েছিল শোক আর বেদনার প্রতিচ্ছবি' শিরোনামের প্রতিবেদনেও প্রতিফলিত হয়েছে, যেমনটি হয়েছে আবদুল আওয়ালের 'কোরবানিঃ আজকের দিনের তাৎপর্য' কলামে।
তারপরেও, ঈদ বলে কথা। তাই স্বাভাবিকভাবে ঈদ উদযাপনের প্রচেষ্টার কিছু নিদর্শনও দেখা যায়। যেমন নীচের রেস কোর্স ময়দানে বিশাল গরুছাগলের হাটের ছবিটি দেখলে এ যে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র কিছুদিন পরের কথা বুঝা যায় নাঃ
এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে প্রেক্ষাগৃহে নতুন বাংলা চলচ্চিত্রের আবির্ভাবও থেমে থাকেনি। এখানে উল্লেখযোগ্য হলো সদ্য প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাক এবং কিংবদন্তীর নায়িকা কবরি অভিনিত বিখ্যাত ছবি 'ময়নামতি' যে এই ঈদেই মুক্তি পেয়েছিল সেটা এই লেখার জন্য আর্কাইভ ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করার আগে জানা ছিল নাঃ
ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তৎকালীন কিছু শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনঃ
এ ছাড়া সেই ঈদের সমসাময়িক কিছু আগ্রহোদ্দীপক খবর চোখে পড়েছে, যা তুলে ধরছি। যেমন, বাংলাদেশের পতাকার চূড়ান্ত মাপ নকশা এবং রং অনুমোদিত হয়েছিলে ঈদের আগের দিনঃ
মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক বই ইতিমধ্যে লেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল, এবং সেসব বাজারে আসার বিজ্ঞাপনও দেখতে পাই আমরাঃ
ঈদের দুইদিন আগে এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি সেখানে বলেন, 'দেশে এখন সামরিক আইন নেই। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ শাসন করছেন। তাই সশস্ত্র বাহিনী জনগণের সার্বভৌমত্ব ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছেন। প্রশাসন কাজ পরিচালনায় তাদের কিছু করার নেই।' কর্নেল ওসমানীর কথাগুলো ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর পর খোন্দকার মোশতাকের সরকারে তাঁর সক্রিয় ভূমিকার কথা স্মরণ করলে একেবারেই ফাঁপা শুনায় বৈকি!
তবে ঈদের আগের দিন, এবং ঈদের পরের দিন, বারেবার আমরা যেই খবরগুলোকে কাগজের পাতায় উঠে আসতে দেখি, তা হলো মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের কাহিনী, পাকিস্তানী মিলিটারি এবং তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণী, তাদের অত্যাচারের ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য। দেখুন শুধু এই দুইদিনেই এমন কতগুলো প্রতিবেদন এসেছিলঃ
প্রতিটি প্রতিবেদন, প্রতিটি বিবরণী মর্মস্পর্শী, পড়লে শিউরে উঠতে হয় পাকিস্তানী মিলিটারি এবং তাদের দালালদের হিংস্রতার কথা কল্পনা করে। কত আত্মত্যাগের বিনিময় অর্জিত আমাদের লাল-সবুজের পতাকা, সেটা সহজেই অনুমেয় হওয়া উচিৎ এসব পড়লে। আর এমন সব প্রতিবেদন কিন্তু সেসময়ের খবরের কাগজগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই আসতো। ভাবতে অবাক লাগে, এর পরেও ১৯৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর ষড়যন্ত্রকারীরা কতটা সফলভাবে সক্ষম হয়েছিল সুসম্বদ্ধভাবে সিংহভাগ বাঙালীদের সবকিছু ভুলিয়ে স্রেফ 'হানাদার বাহিনীর' গল্প শুনিয়ে আচ্ছন্ন রাখতে, 'বহুদলীয় গণতন্ত্রের' লেবাসে জামায়াতে ইসলামকে আবার দেশের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় ফিরিয়ে আনতে, সেই সাথে স্বাধীনতাবিরোধী এবং গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত দালালদের ক্ষমতার শিখরে নিয়ে যেতে। যেখানে একসময় দিনের পর দিন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ এতবার করে খবরের কাগজে আসতো, ঈদের সময়েও সেসব ছাপাতে ভুলতো না কাগজের সম্পাদকরা, সেখানে মাত্র সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন আসলেই চোখে পড়ার মত।
যাই হোক, স্বাধীন বাংলায় প্রথম ঈদ কেমন ছিল, তার কিছুটা ধারনা হয়তো পাওয়া গেছে এই ফিরে দেখায়। আর দুই দিন পরে দেশসহ বিশ্বব্যাপী আরেকবার ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ঈদ সবার জন্য আনন্দময়ভাবেই কাটবে বলে আশা করি, ১৯৭২ সালের ২৭শে জানুয়ারির মত ভাবগাম্ভীর্য এবং মিশ্র অনুভূতি নিয়ে উদযাপন করা হবে না। তবে শত আনন্দের মাঝে একবার হলেও যেন তিরিশ লক্ষ শহীদ, চার লক্ষ বীরাঙ্গনাদের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধায় মাথা নত করি। কারন তাঁদের ত্যাগের বিনিময়েই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ঈদ উদযাপন করতে পারছি।
সবাইকে ঈদের অগ্রীম শুভেচ্ছা। জয় বাংলা।
খবরের কাগজের আর্কাইভের জন্য কৃতজ্ঞতায়ঃ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (ICSF), সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চ (CBGR), ওমর শেহাব।
মন্তব্য
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
হ্যাঁ, সেই ঈদ ছিল আনন্দ বেদনার এক অপূর্ব মিশেল। তবে দুঃখের বিষয়, বেদনার সত্যিকারের প্রতিফলন আমাদের সমাজে দেখা যায় নি।
আর সেই ঈদে নতুন ছবি মুক্তি পেয়েছিল একটিই, সেটা "মানুষের মন"। ময়নামতি সহ অন্যগুলি স্বাধীনতার আগের ছবি, স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে মুক্তি পেয়েছিল।
Thanks for that information, about the timeline of the movie releases. This was not clear from the newspapers.
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সেই সময়-
বেশ ভালো লেগেছে।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।
নতুন মন্তব্য করুন