আজ বাংলা ট্রিবিউনের সাইটে গিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো খবরটাঃ জামায়াত নিয়ে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকের ওপর চটে গেলেন ড. কামাল। খবরের সারমর্ম যা বুঝলাম, বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গেলে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। এক পর্যায় জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে তার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডঃ কামাল রেগে যানঃ
"এরপর সাংবাদিকরা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গে ড. কামালকে তার অবস্থানের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। এতে চটে যান তিনি। তখন তিনি সাংবাদিকদের উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘কত পয়সা পেয়েছো এসব প্রশ্ন করতে? চিনে রাখবো। কত পয়সা দিয়েছে? শহীদ মিনারের এসে শহীদদের অশ্রদ্ধা করো। শহীদদের কথা চিন্তা করো। চুপ করো, খামোশ।’"
সাম্প্রতিক ঘটনাস্রোতে ডঃ কামালকে জামায়াতে ইসলামী নিয়ে জিজ্ঞেস করাটা অবশ্যই যৌক্তিক। ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক হলো বিএনপি, যাদের জামায়াত-সখ্যতা পাঠকদের অজানা কিছু নয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন, তাই দলটা সরাসরি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। কিন্তু তাদের ২২ জন নেতাকে বিএনপি নিজেদের ধানের শীষ প্রতিকের অধীনে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়েছে। ডঃ কামালকে কিছু মহলে এই দেশের 'সেক্যুলার আইকন' মানা হয়। উচ্চশিক্ষিত ব্যারিস্টার মানুষ, ভদ্রলোক বলে খ্যাতি আছে বেশ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর, তাঁর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাধীন বাংলার প্রথম সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা। এমন মানুষের কাছে একটা ব্যাতিক্রমী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম পাওয়া যাবে সেই বিষয়ে দেশের সুশীল সমাজের অনেকেই, এমনকি অনেক প্রো-৭১ মানুষও আশাবাদী ছিলেন/আছেন।
সমস্যাটা এসে দাঁড়ায় যখন বিএনপির এই ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে তারপর বিএনপি খোলাখুলিভাবেই জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর বৈধতা দিয়ে দেয়, এবং সে বিষয়ে যতবার প্রশ্ন করা হয় ডঃ কামাল সরাসরি কোন উত্তর দিতে অস্বীকার করেন, যার সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদহারন ছিল আজকে সাংবাদিকদের সাথে চটে যাওয়া। অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী একাত্তরের চেতনাধারী একজন মানুষ কোন যুক্তিতে জামায়াতে ইসলামীর মত স্বাধীনতাবিরোধী এক সন্ত্রাসী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিএনপির ভূমিকা মেনে নিবেন? আর সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বারেবার এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন, এক প্রকার সাংবাদিকদের এহেন প্রশ্ন করার জন্য হুমকি দিয়ে হলেও? এমন মানুষ কোন মুখে আবার বাক এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন?
'ভদ্রলোক' কামাল হোসেনের জন্য চটে গিয়ে কিঞ্চিত অভদ্র আচরণ করা কিন্তু এই প্রথম নয়। এর আগে গত বছর সুপ্রীম কোর্টে এক মামলার শুনানির সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে ইংরেজি ভাষায় 'জারজ' বলেও গালি মেরেছিলেন তিনিঃ
"কামাল হোসেন তখন বলেন, “সিন্ডিকেটে এক সময় (বিএনপি-জামায়াত জোটের সময়) ডাক্তারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এখন ওনারা সেই সিন্ডিকেটের বিপক্ষে স্ট্যান্ড নিচ্ছে। এগুলো হলো ইন্টেলেকচুয়াল প্রস্টিটিউশন।”
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে এ ধরনের শব্দ চয়নে আপত্তি জানান। তখন তাকে উদ্দেশ্য করে কামাল হোসেন বলেন, “শাট আপ, বাস্টার্ড। ইউ টেক ইউর সিট।”"
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা যে রাখতে পারে না, নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে এভাবে আরেকজন সতীর্থকে গাল দেয়, এই মানুষের জন্য দেশের সুশীল সমাজ ব্যাকুল (অবশ্য বাংলায় 'জারজ' না বলে ইংরেজীতে 'বাস্টার্ড' বলেছে, এই আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য হয়তো অনেক সুশীলদের তাঁকে ভালো লাগতেও পারে, কে জানে)।
সেটাও অবশ্য সমস্যা না। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে মানুষ যে কাউকেই পছন্দ অপছন্দ করার অধিকার রাখে। তবে কিনা, দ্বিচারীতা প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যখন এই সুশীল সমাজের ধ্বজাধারীদেরই দেখি আওয়ামী লীগ প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঠিক একই কারনগুলোর জন্যই দোষারোপ করে, কঠোর সমালোচনা করে। শেখ হাসিনা হেফাজতের মত ধর্মীয় গোঁড়া সংগঠনের সাথে সখ্যতা গড়ছেন। শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের অধিকার হরণ করার জন্য ৫৭ ধারার মত কালো আইন প্রয়োগ করছেন, এবং আগত ডিজিটাল সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করছেন। শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে আবু রেজা নিজামুদ্দীন নদভীর মত জামাত-বান্ধবকে লীগের সাংসদ হবার সুযোগ করে দিয়েছেন, এইবার বিকল্পধারার মেজর আব্দুল মান্নানের মত পাকিস্তানের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্রভাবে অংশ নেয়া রাজাকারকে জোটের শরিক হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বেজ্জায় ঠোঁটকাঁটা একজন মানুষ, মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন না, এমনভাবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আক্রমণ করেন, ছিঃ ছিঃ!
আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করার যৌক্তিক কারন এর মধ্যে অনেকগুলোই আছে। কিন্তু একই রকম সমালোচনা করার ক্ষেত্রগুলো ডঃ কামাল হোসেনের মত 'ভদ্রলোকের' মধ্যেও থাকে? ডঃ কামাল হোসেন সুপ্রীম কোর্টে গালি মারতে পারেন, তার নেতৃত্বে গড়া রাজনৈতিক জোটে এক মৌলবাদী সন্ত্রাসী দলের এক গুচ্ছ নেতাকে হালাল করে নির্বাচন করতে দেয়া হয়, ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী তফসিলে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা থাকলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি কোন স্থান পায় না, সেসব বিষয়ে সাংবাদিকরা যৌক্তিক প্রশ্ন তুললে হয় তিনি 'আমি ঘুমে থাকি হিসেব থাকে না' মার্কা উত্তর দেন নাহলে সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে হুমকি দেন, তারা টাকা খেয়ে এসব প্রশ্ন করছে বলে হাস্যকর অভিযোগ করেন। ডঃ কামালের জামাতা ডেভিড বার্গম্যানের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রাইব্যুনালের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়া, মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করে আন্তর্জাতিক মহলে অপপ্রচার চালানো, সেসবের কখনও তিনি প্রতিবাদ করেছেন বলে পড়িনি। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় ডঃ কামালের কোথায় ছিলেন, এবং কি ভূমিকা পালন করছিলেন, তা যে আজো অজানা এবং সে বিষয়ে যে যথেষ্ট ধোঁয়াশা আছে, তা নিয়ে নাহয় কথা নাই বাড়ালাম।
তারপরেও সুশীল সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ ডঃ কামাল হোসেন বন্দনায় মত্ত। একই রকম অভিযোগ এনে শেখ হাসিনার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার চলে প্রতিনিয়ত, কিন্তু ডঃ কামাল থেকে যান বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আশার স্থল। কেন এই দ্বিচারীতা? আমার ব্যক্তিগত মত হলো, এখানেই আমাদের দেশের সুশীল সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বিদ্যমান। শেখ হাসিনা যা করেন, যা বলেন, তার অনেক কিছুই সমালোচনার যোগ্য। কিন্তু এসব জিনিসগুলো একজন নারী করছে দেখে এত মানুষের কিছুটা বেশীই গাত্রদাহ হয়। কারন কাজগুলো ঠিক তাদের সংজ্ঞাতে 'নারীসুলভ' নয়। একই বা কাছাকাছি রকমের কাজগুলো কোন পুরুষ মানুষ করলে তখন সেটা অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য মনে হয়। ইংরেজীতে গালাগাল করেছে? আরে উচ্চশিক্ষিত মানুষ, ইংরেজীতে একটু গালি না মারলে কি হয়? জামায়াতের জোটে পরোক্ষভাবে যোগদান? আরে, রাজনীতির মারপ্যাঁচে কতরকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টা তফসিলে এড়িয়ে যাওয়া? দেখো ভাই, বেশীরভাগ শীর্ষস্থানীয় রাজাকারদের তো ঝুলিয়েই দিয়েছে, এ নিয়ে কচলাকচলি করার আর কি দরকার। ডেভিড বার্গম্যানের বেলায় ডঃ কামাল স্পিক্টিনট? আরে বাবা, জামাতার কাজকর্মের দায় শ্বশুর নিবে কেন? সাংবাদিকদের দেখে নেয়ার হুমকি দেয়া? এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাশভারী পুরুষ নেতাই তো চাই, বেয়াদব সাংবাদিকগুলোকে এভাবেই তাদের অবস্থান মনে করিয়ে দিতে হয়।
একটা সময় অবশ্য এই সুশীল সমাজের অনেকেই কুখ্যাত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীকেও ভালো পেতো। একাত্তরের এই নরপিশাচ বিএনপি নেতার মুখ ছিল অসম্ভব খারাপ, একেবারে কোন রকম লাগাম ছাড়া। হেন কোন বিষয় নাই যা নিয়ে সে নোংরা বচনে লিপ্ত হতো না, তা সংসদে হোক, বা টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে বা কোন ভাষণের মঞ্চে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক উচ্চশিক্ষিত সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষকেও সাকা চৌধুরীর এমন কথনকে বাহবা দিতে দেখেছি, বলতে শুনেছি 'লোকটা শয়তান হতে পারে, কিন্তু মানতেই হবে একেবারে উচিৎ কথা বলে। এমন লোকের আসলে আমাদের দেশের রাজনীতিতে দরকার আছে।' বলাই বাহুল্য এসব মানুষের প্রায় সবাইকেই আমি শেখ হাসিনার নিন্দা করতে শুনেছি 'প্রধানমন্ত্রীর পদের সাথে যায় না এমন অসুলভ আচরণের' জন্য।
যেই সুশীল সমাজ সাকা চৌধুরীর নোংরামিকে প্রশ্রয় দিতে পারে, সেই নোংরামির মধ্যে ইতিবাচক কিছু খুঁজে পেতে পারে, তারা যে এখন ডঃ কামাল হোসেনকে প্রশ্রয় দিবে, তাঁর লাগাতার অসাদাচরণ উপেক্ষা করে যাবে, এতে হয়তো অবাক হবার কিছু নাই। মিয়া মিয়া ঠিকই থাকে, শুধু সোনাটা লাল হয়ে যায় কিনা!
মন্তব্য
ড: কামাল হোসেনকে বহুকাল পর সেদিন দেখলাম খামোশ সংবাদ ক্লিপটাতে। লোকটার জন্য করুণাই হলো। বেচারা শারিরীক মানসিক দুইভাবেই ভারসাম্যহীন মনে হলো। এই লোকের উপর ভর দিয়ে বিএনপি দলটা নিজেও ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে নির্বাচনের পর।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন