ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে তৈরি মসজিদটিকে মুঘল আমলের তৈরি বলে মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি নির্মিত হয় আরও অনেক পরে। মসজিদের গায়ে খোদাই করা তারিখ অনুসারে মসজিদটি নির্মিত হয় বঙ্গাব্দ ১৩১৭ সালে। স্বভাবতই প্রথমে আমরা মনে করেছিলাম, মসজিদটি হয়তো ১০০ বছরেরও কম সময় আগে নির্মিত। কিন্তু নির্মাণকারী মেহের বক্শ সরকার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এবং মসজিদটির দেয়ালের কিছু অংশ খোলার পর বেরিয়ে আসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। প্রথমত, মসজিদের নির্মাতা মেহের বক্শ সরকারের কবরেও তার মৃত্যুর তারিখ খোদাই করা আছে ১৩১৭ সাল। মেহের বক্শের মৃত্যুর সময়েই যদি মসজিদটির বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে (যেমনটি স্থানীয় মানুষেরা আমাদের বলেন), তবে তা কোনোভাবেই ১৩১৭-এ নির্মিত হতে পারে না। মেহের বক্শ এর পরিজনরা আমাদের জানান, মেহের বক্শ মসজিদটি নির্মাণ করার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি নিয়ে আসেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সমাপ্তির আগেই স্থপতি মারা গেলে মসজিদের কাজ থেমে যায়। বেশ কয়েক বছর স্থগিত থাকার পর, মেহের বক্শ স্থানীয় নির্মাতাদের নিয়ে নিজেই মসজিদের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু শেষ করার আগেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। এ পর্যায়ে আরো কয়েক বছর মসজিদের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকে। মেহের বক্শের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারো উদ্যোগ নেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, নির্মাণকাজ সমাপ্ত না করেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় মানুষ এবং মেহের বক্শ-এর পরিবারের কাছে এভাবে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে যায় যে, এই মসজিদটি সম্পন্ন হবার নয়, কেননা এটিতে অশুভ ছায়া রয়েছে। কাজেই শতাধিক বছর ধরে পরিত্যক্ত হয়ে জনমানসের আড়ালে বৃক্ষ ও শ্বাপদের আশ্রয়ে পরিণত হয়। এই তথ্য থেকে মনে হয়, মেহের বক্শ-এর মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগেই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। অপর দিকে, সংরক্ষণ কাজের অংশ হিসেবে ফাটল ধরেছে এবং আলগা হয়ে পড়েছে এমন একটি অংশকে আমাদের খুলে ফেলতে হয়েছে। দেয়ালের যে অংশটি খোলা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান মসজিদের ১১ ইঞ্চি গভীরে অলঙ্করণবিহীন হুবুহু একই নকশার একটি স্থাপনা। পুরো মসজিদেই এই ১১ ইঞ্চি দেয়ালের ভেতরের স্থাপনাটি আছে, যা পূর্ববর্তীকালের নির্মিত। শুধু তাই নয়, এই ভেতরের স্থাপনাটির ইটের আকৃতি, গঠন এবং মর্টারের সাথে পরবর্তীতে নির্মিত ইটের আকৃতি, গঠন ও মর্টারের পার্থক্য রয়েছে। স্পষ্টই এই দুয়ের নির্মাণকালের পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে। তবে তা কতো আগের তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এই তথ্যসমূহ মিলিয়ে আমরা মসজিদটির প্রাক্কলিত বয়স নির্ধারণ করেছি, ১২০ বছর। তবে (ব্যয়বহুল বলে) বয়স নির্ধারণে কার্বন-১৪ বা থার্মালুমেনিসেন্স এই ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়নি।
মেহের বক্শ-এর মৃত্যুর পর যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং প্রচলিত মিথ ও ভীতির কারণে মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি অথবা এটিকে কোনো রকম যত্ন-আত্তিও করা হয়নি। অযত্ন-অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে মসজিদের বিভিন্ন অংশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমগ্র দেয়াল জুড়ে পাকুড় ও অন্যান্য জাতের গাছপালা, মস, শৈবাল, ছত্রাক রয়েছে, নোনা ধরেছে এবং ফাটল রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মসজিদ উপকরণের অপব্যবহার এবং খোঁচাখুঁচি ও ঝাঁকানোর কারণেও মসজিদটি তিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় ইট ক্ষয়ে গেছে, আলগা হয়ে গেছে, কোণা ভেঙ্গে গেছে অথবা ফেটে গেছে। ছাদের লেবেলে কয়েকস্তর ইট খুলে পড়ে গেছে। মর্টারের ক্ষেত্রেও একই বিষয় লক্ষনীয়। অনেক জায়গায় মর্টার ক্ষয় হয়ে ইট খুলে পড়েছে। গাছের শিকড়ের কারণে প্রায় সব অলঙ্করণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং যেগুলো টিকে আছে তা-ও দেয়াল থেকে আলগা হয়ে আছে। অলঙ্কৃত স্তম্ভগুলোতেও ফাটল ধরেছে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্তম্ভসহ দেয়ালের ওপর থেকে নিচ বরাবর লম্বালম্বি ভাবে ফেটে গেছে।
ইট ও মর্টারের ফাঁকে এবং দেয়ালের ফাটলে বসতি স্থাপন করেছে সাপ, বিছা, চিকা, শেয়াল, খাটাস, মাকড়সা, টিকটিকি, পিঁপড়া ও নানা ধরনের পোকামাকড়; আর স্কুইঞ্চগুলোতে কয়েকটি মৌচাক।
এই রকম একটি অবস্থাতেই আমাদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে পুনঃনির্মিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি। বাংলাদেশে বিজ্ঞানসম্মত প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণের প্রাথমিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে এটি একটি। বলা বাহুল্য অপর উদ্যোগগুলোও আমাদেরই। (চলবে)
মন্তব্য
অসাধারণ ছবি এবং আপনাদের কাজ।
শ্রদ্ধা।
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফ্লিকার | ইমেইল
দারুণ হচ্ছে। ছবিগুলো একটু ভেতরের দিকে পেস্ট করলে প্রথম পাতায় তিনটা ছবি যাবেনা, দেখতেও ভাল্লাগবে।
প্রশ্নঃ আপনি কি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের পক্ষে কাজ করছেন?
যায়গাটার প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষনের পাশাপাশি এটাকে বেড়ানর একটা স্পট হিসাবে (পর্যটনে অর্থে) গড়ে তোলার সম্ভাবনা যাচাই করা যায় কি? যেসব অবসারভেশনের কথা বললেন সেগুলোর সহজ তাত্ত্বিক বিশ্লেষন, কারিগরি এবং নির্মান ইতিহাস, সময়কালের নির্মানশৈলি এবং সামাজিক সংস্কৃতির আলোকে ব্যখ্যা, পারিবারিক গল্প যেটা উপরে বলেছেন এসবের আলোকে ছোট ছোট গল্পের (ছবি এবং চিত্রকর্মসহ) মাধ্যমে পর্যটকেরা হয়ত ইতিহাস-সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে একটা ভ্রমন সেরে নিতে পারেন। দৃষ্টিনন্দন লেন্ডস্কেপিং-এর পাশাপাশি এই তথ্য উপস্থাপনার সুযোগ কাজে লাগালে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে ভ্রমন অর্থনীতির পাশাপাশি এলাকার সাধারনের মধ্যে কৌতুহল আর গর্বের সঞ্চালন করতে পারে।
চমৎকার কিছু ধারনার সংমিশ্রন ঘটান যেতে পারে এখানে। যেমন যেই মডেলটির কথা বললেন সেটার একটা ছোট প্রতিকৃতি থাকতে পারে একটা জাদুঘরের মুখে। স্থাপত্যশৈলির ব্যখ্যাসহ। দেশের অন্যান্য স্থানের স্থাপত্যবিচারে উল্লেখযোগ্য স্থানের সাথে একটা তুলনামূলক আলোচনা থাকতে পারে। কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনার কথা বললাম। আশা করি অবাস্তব কিছু বলছিনা।
পোস্ট ভাল লাগল।
না, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হয়ে কাজ করছি না আমরা, সেখানে আমাদের কাজের সুযোগ নেই, এই বিষয়ে আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ আর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচ্চগলনশীল নাসিকা
প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ ছাড়া জায়গাটাকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই, আমরা আসলে প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ কাজটাই জানি, পর্যটনের কাজ তেমন একটা জানি না। তবে কেউ যদি প্রত্নস্থান সংশ্লিষ্ট পর্যটন নিয়ে কাজ করতে চান তাহলে, আমরা তাকে পুরো সহযোগিতা করবো, এই বিষয়ে আমাদের কিছু গবেষণাও করা আছে, কয়েকটি প্রস্তাব-ও আছে। দরকার হলো, হেরিটেজ টুরিজম বিষয়ে আগ্রহ এবং কিছু টাকা (প্রায় ৪-৫ লাখ) বিনিয়োগের সামর্থ্য।
বাকি যে প্রস্তাবগুলো করেছেন, সবগুলোই খুবই ভাল। সত্যি কথা বলতে কি, একটা মডেল তৈরি করা হয়েছে। আর তুলনামূলক বিশ্লেষণ ছাড়া তো কাজ করাই সম্ভব না।
ধন্যবাদ, অসাধারণ সুন্দর মন্তব্য করার জন্য।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
যখন ঢাকায় আসবেন একবার চায়ের আমন্ত্রণ রইলো। হেরিটেজ টুরিজম না হোক অন্ততঃ প্রাথমিক কাজ গুলো যেমন জিও ট্যাগিং এর জন্য অবস্থান, বিশেষত্ব এসব নিয়ে একটা ইবুক চাইলেই করে ফেলা যায়।
...........................
Every Picture Tells a Story
ভাস্কর মাহবুব ভাইও বলছিলেন, এর কথা। সত্যি কথা বলতে কি, কয়েক বছর আগে আমরা প্রাক-জরিপের জন্য বাংলাদেশের প্রায় সব জেলার প্রত্নস্থানগুলোতেই গিয়েছিলাম। লাখ লাখ ছবি তোলা হয়েছে এবং আমাদের সাথে জিপিএস ছিল বলে ভালো মতোই পজিশনিং করতে পেরেছিলাম। এই কাজটা আমরা বিক্রি করতে চাই। বিশেষ করে আমাদের আলোকচিত্রী বারীণ ঘোষ-কে কিছু টাকা দেয়াটা অত্যন্ত জরুরী। কাজ করতে গিয়ে বারীণ একবার তার ক্যামেরা ও এক্সেসরিস হারিয়েছে, যার দাম প্রায় এক লাখ টাকা। এশিয়াটিক সোসাইটি কালচারাল সার্ভে এবং বাংলাপিডিয়ার জন্য ছবিগুলো কিনবে বলেছিল। ওই বইগুলোতে তারা ৫ শতাধিক ছবি ব্যবহার-ও করেছে, নিয়মানুয়ায়ী ছবিপ্রতি ৮০০ টাকা হিসেবে ৪ লাখ টাকার বেশি বারীণের প্রাপ্য। কিন্তু তারা কৃতজ্ঞতা স্বীকারে নাম সংযোজন ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। ব্যাপারটা বর্তমানে আইনী প্রক্রিয়াধীন আছে। এই ফটো ও তথ্য যদি কেউ কিনতে চান আওয়াজ দিয়েন।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
এই বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ কি লিখতে পারেন?
আরেকটা আইডিয়া এসেছিলো মাথায়। আপনারা একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে পারেন নিজেদের কাজ নিয়ে।
হ্যা লিখবো, এই লেখাটার পরবর্তী কিস্তিগুলোতেই বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলো আসবে।
প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। আমাদের পক্ষে সম্ভব-ও না, তবে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু ফুটেজ নেয়া হচ্ছে, কেউ যদি ভিডিওগ্রাফির কাজ করতে চান, দেয়া যাবে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
তারমানে কি মেহের বকশ্ এর ছোটভাই কেবল আগের অবয়বকে জ্যাকেট পড়িয়েছে?
আপনাদের কাজের ধারা খুবই রোমাঞ্চকর বলে মনে হচ্ছে! কার্বন আইসোটোপ কতো দামী বা থার্মা-লুমিনেস্যান্স জিনিসটাই বা কতো দামী।
... ... আমি দিতে চাইছি না, শুধু ধারণা নিতে জানতে চাইলাম।
মেহের বক্শ-এর ভাই কোনো জ্যাকেট পড়াননি মন হয়, সম্ভবত মেহের বক্শ-ই জ্যাকেট পড়িয়েছিলেন, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। ডেটিং করা গেলে নিশ্চিতভাবে বলা যেত। কার্বন-১৪ ডেটিং-এর খরচ প্রতি স্যাম্পল লাখ টাকার ওপরে, কমপক্ষে তিনটি স্যাম্পল ডেটিং করানো উচিত। থার্মালুমিনিসেন্স-এর খরচ কম, স্যাম্পল প্রতি ৫০-৬০ হাজার টাকা লাগে।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
ছবি ভালো লাগল, কিন্তু আরো বিশদ লিখলে ভালো লাগত।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
দুর্দান্ত কাজ হচ্ছে!
আপনাদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা
---------------------
আমার ফ্লিকার
পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। রেগুলার লেখার মতো সময় পাই না, আর একটা বড় সমস্যা, সাধারণত ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
ভালো লাগলো আপনাদের এই উদ্যোগ। সাধু...
এভাবে যদি দেশের প্রত্নসম্পদগুলো সংরক্ষণ করা যেতো। তাহলে খুব ভালো হতো।
এবার কিছু প্রশ্ন করি-
(প্রথমেই মূর্খের মতো একটা প্রশ্ন করি) মর্টার বলতে আমরা খালি যুদ্ধে ব্যবহৃত হাতিয়ারের নাম শুনছি। এখানে মর্টার বলতে কী আসলে?
২. এই যে আপনারা কাজটা করছেন, এটাও তো সম্ভবত কম ব্যয়বহুল না। সেই টাকাটা কোথা থেকে আসছে?
৩. এটা আপনারা ঠিকঠাক করে দিয়ে চলে এলেন, বা পরবর্তী প্রকল্পে হাত দিলেন। তারপর এটার ভবিষ্যত্ কী? বলছেন পর্যটনের কোনো উদ্যোগ নাই। হয়তো এটা মসজিদও হবে না (অনুমান)। তাহলে এটার কী হবে? এটা যে কিছু কুতসিত লোক দখল করে আবাসন প্রকল্প বানাবে না তার নিশ্চয়তা কী? জমির পরিমান তো কম না দেখা যাচ্ছে?
৪.
অপর উদ্যোগগুলো কোথায় কোথায়? সেগুলো নিয়েও বিস্তারিত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করছি। (জানি ব্যস্ততায় আছেন, তবু অনুরোধটুকু জানিয়ে রাখলাম, আস্তে ধীরে জানাতে থাকেন, আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি)
৬. পুরনো ঢাকা নিয়ে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
একটা প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব ।
মর্টার = মশলা । দুই ইটের মাঝখানে চুন সুরকি ইত্যাদির মিশ্রন বা "মশলা" দিয়ে দেয়াল গাঁথা হত আগেকার দিনে । আধুনিক কালে সিমেন্ট বালির মিশ্রনকে ব্যবহার করা হয় ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
১। মর্টার হলো মিশ্রণ। নির্মাণকাজে মর্টার হলো- সিমেন্টিং এজেন্ট (সাধারণত সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়) এবং ফিলার (সাধারণত বালি ব্যবহৃত হয়) এর মিশ্রণ। সাবেকী আমলের যুদ্ধে বারুদ ও অন্যান্য বিস্ফোরকের মিশ্রণ মর্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বালিয়া মসজিদে মর্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে চুন-সুরকি। তবে স্থানভেদে চুন-সুরকির অনুপাতে পার্থক্য আছে। হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সাথে মর্টার মেশালে মর্টারের বস্তুগুলো আলাদা হয়ে যায়, অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই রঙ দেখে বস্তুগুলোকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
২। জনগণের টাকা। আগের একটা লেখাতে বলেছিলাম, মসজিদের কাজ বাংলাদেশে আটকে থাকে না। এখানেও নেই। ঝামেলা যেটা হচ্ছে, সেটা হলো মন্দিরের কাজটা। বার বার বলেছি, আবারো বলছি, আমাদের মন্দিরের কাজটাতে কিভাবে টাকাপয়সা পেতে পারি, আপনারা একটু তথ্য দিয়ে সাহায্য করুন।
৩। এটা ব্যবহার করার জন্য (অর্থাৎ নামাজ পড়ার জন্য) তৈরি হচ্ছে। সমস্যা হবে না। ভয় পাবেন না, দখলের সম্ভাবনা নেই। এই ব্যাপারগুলো আমরা খুঁটিয়ে দেখেছি।
৪। অপর উদ্যোগগুলো হলো- নাটোর, নোয়াখালী এবং রাণীশঙ্কৈল (ঠাকুরগাঁও)। তবে সব জায়গায় পুরো দমে কাজ হচ্ছে না।
৫ অথবা ৬। পুরনো ঢাকা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নাই। ঢাকার মানুষদের বোঝাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি। ঢাকায় কাজের জন্য আরবান প্লানার্স অবশ্য প্রয়োজন। কাজেই আমরা এবং আরবান প্লানার্সদের একটা সংগঠন যৌথভাবে চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয়নি। কারণটা তো সংবাদপত্রেই দেখেছেন, নিমতলী দেউরি সংরক্ষণের জন্য যে টিম করা হয়েছে, সেই টিম সারা বিশ্বে কিভাবে ভবন সংরক্ষণ করা হয়, তা দেখার জন্য বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়েছেন। অথচ দেশেই বিদেশী ডিগ্রি নেয়া সংরক্ষণ স্থপতি, প্রকৌশলী এবং প্রত্নতাত্ত্বিক রয়েছেন, তারা বিদেশে সংরক্ষণের কাজ-ও করেছেন। আমাদের টিমেই তিনজন আছেন যারা ইউরোপ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তবু নিমতলীর সংরক্ষণ টিম করা হলো, সংরক্ষকদের বাদ দিয়ে দলীয় পরিচয়ে এবং বিদেশ ভ্রমণের জন্যই। সুতরাং এই অবস্থায় ঢাকায় কাজ করা আমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
আমি একটা জিনিস বুঝি না, বিদেশ যাওয়ার জন্য এগুলা এতো লালায়িত কেন? বিদেশে কোন মধুটা খাইতে যায়। মিডিয়াতেও দেখি, একটা ক্যামেরা কিনতে হইবো... বিটিভি আর তথ্য অধিদপ্তর থেকে গোটা দশজন বিদেশ যায়। ক্যামেরার দামের চেয়ে ২০ গুন বেশি তাদের পিছনে ব্যায় হয়।
এগুলার সবটিরে স্থায়ীভাবে বিদেশ পাঠায়ে দিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু কাজের লোক বসানো জরুরী।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অসামান্য কাজ করছেন আপনারা। আপনার লেখাগুলো পড়ছি। অনেক কিছু জানতে পারছি আপনার লেখা থেকে।
ধন্যবাদ।
উপরের আলোচনা শুনে মনে হচ্ছে মসজিদটিকে নামাজ পড়ার যায়গা হিসাবে পূননির্মান করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে
১) বাকি কাজটুকু করার ক্ষেত্রে (অর্থাৎ যে কাজটা আপনারা করবেন) স্থাপত্য এবং নির্মানশৈলিতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হচ্ছে কিভাবে?
২) যেহেতু এই সাইটটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চিহ্নিত নয় সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায় যে আপনাদের কাজের ক্ষত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে কি করে?
এক্ষেত্রে আপনাদের ক্লায়েন্টের ভাবনা তো প্রত্নতাত্মিক ঐতিহ্যের চেয়ে বরং মসজিদ নির্মান অথবা পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার দিকে বেশি থাকবে। (অবশ্য আপনাদের ক্লায়েন্ট কে বা কারা সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি আমি) সেক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক হিসাবে আপনাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনত কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
যেহেতু 'প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষন', 'জনগনের টাকা', এবং 'মসজিদ নির্মান' -এর পাশিপাশি এটাকে কিছুটা ব্যক্তি উদ্যোগের মত মনে হচ্ছে তাই প্রশ্নগুলো মনে আসল। এখানে আমি ডেভিলস এডভোকেট (বাংলা কি?) হবার চেষ্টা করছি আরকি।
উপরে আলোচিত চ্যালেঞ্জগুলো কি করে সামাল দিচ্ছেন? আপনার পেশাগত দায়িত্ববোধের সাথে কোন রকম সংঘর্ষ/বৈপরিত্য কখনও অনুভব করেছেন কি?
আপনাদের কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে এবং সত্যিকারের একটা কার্যকর রূপ দিতে হলে এসব প্রশ্নের উত্তর বিশদাকারে দিতে হবে। আমার মতে এইসব কাজে ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগ থাকা দরকার তবে নিচের দু'টি মাত্রা তাতে যোগ হওয়া জরুরীঃ
টপিকটা খুব ভাল লাগছে।
বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের উপর কোন মেটেরিয়াল (ওভারভিউ ধরনের) কি অনলাইনে পাওয়া সম্ভব? অথবা আপনার সংগ্রহে যদি সফট কপি থাকে যদি ইমেইল করতেন? আপনার লেখাটা দেখে এই বিষয়ে কেমন জানি আগ্রহ অনুভব করছি।
অনেক ধন্যবাদ।
আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো আপনি হয়তো বাকি কিস্তিগুলো পড়লে পেয়ে যেতেন (সত্যি কথা বলতে কি, পুরো লেখাটাই রেডি, অনেক বড়ো বলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দিচ্ছি), তবু এখানেই আপনার প্রশ্নগুলোর জবাবে কিছুটা বলে রাখি।
১। সংরক্ষণ বলতে সাধারণত বোঝানো হয় যে অংশটুকু বর্তমানে টিকে আছে, সেই অংশটিকে টিকিয়ে রাখা। আর যাতে নষ্ট না হয়, তার ব্যবস্থা করা। সংরক্ষকের কাজ এখানেই শেষ। আগে যেমনভাবে বস্তুটি ছিল, সেই অবস্থার কাছাকাছি একটা রূপে নিয়ে যাওয়াটা রেস্টোরেশনের (পুনরানয়ন) পর্যায়ে পড়ে। এবং এই পর্যায়ে কিছু সংযোজনেরও সুযোগ থাকে। যেমন ভবনের ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক বাতি, এসি ইত্যাদি। সারা বিশ্বেই সংরক্ষিত প্রত্নবস্তু ব্যবহার করা হয়। কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধিন সম্পত্তি ব্যতীত বেশিরভাগ ঐতিহ্যবাহী বস্তুই তো আসলে ব্যক্তিমালিকানাধিন। পিতামহের ব্যবহৃত ছড়ি থেকে শুরু করে জমিদারবাড়ি সবই তো আসলে ব্যক্তিমালিকানাধিন, রাষ্ট্র কিছু কিছু সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে অথবা কেউ কেউ দান (ওয়াকফ) করে যায়। এই বাস্তবতায় সারা বিশ্বেই ব্যবহৃত হবে এমন প্রত্নবস্তুর সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সংরক্ষণ স্কুলগুলোর তাত্ত্বিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ বলেন, ব্যবহার করলেও যেখানে আগে মোমবাতি ব্যবহৃত হতো, সংরক্ষণ করার পরেও সেখানে মোমবাতি ব্যবহার করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, ব্যবহারোপযোগিতায় যেটা সুবিধা সেটা করতে হবে। অন্যদিকে সংরক্ষণের উত্তর-প্রক্রিয়াবাদী ঘরানার তাত্ত্বিকরা বলেন, সংযোজিত অংশগুলো অবশ্যই সমকালীন হতে হবে, যেটুকু নতুন লাগানো (মানে ভেঙ্গে/হারিয়ে গিয়েছে) হবে, সেগুলো অবশ্যই আলাদা হবে। মানে নতুন যে লাগানো হয়েছে, কালের যে পার্থক্য আছে সেটা যেন বোঝা যায়। আমরা সংরক্ষণের এই স্কুলটাকে মানি। আর তাই নতুন সংযোজিত অংশগুলো আধুনিক হবে। ভবনের যে অংশ ফাটল ধরেছে বা সংরক্ষণের প্রয়োজনে যে অংশটুকু আমরা খুলছি, সেটা পুরনো রীতিতে আগে যে উপাদান ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল, ওই উপাদান ব্যবহার করেই লাগানো হবে। তবে হ্যা, দৃঢ়তার জন্য আমরা জিন্ক ফ্লুরোসিলিকেট যুক্ত করছি (এ বিষয়ে ২য় কিস্তিতে বিস্তারিত লিখবো)। আর যে অংশটি বর্তমানে নেই, যেমন এই মসজিদের গম্বুজ, সেই অংশটি পুরোই আধুনিক হবে।
আর আপনার প্রশ্নের মূল অংশ কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আমাদের টিম স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের দলে প্রত্নতাত্ত্বিক, সংরক্ষক, স্থপতি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আছেন, আমরা এইসব ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, আশা করছি, তা খুব একটা ভুল হবে না। আর ভুল হলেও খুব বেশি ক্ষতি নেই, "সংরক্ষণ নৈতিকতা" বলে একটা ব্যাপার আছে, সেটা মেনে চললে, ভুল হলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না।
২। কোনো জবাবদিহিতা নাই। আসলেই নাই। আমরা কাজের ক্ষেত্রে একটা মূল্যায়ন করাই, সেটা আসলে যথেষ্ট না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নাই, সুতরাং তাদের আমরা কেয়ার করি না।
৩। আমাদের ক্লায়েন্ট আসলে স্থানীয় জনগণ। তারাই টাকা দিচ্ছেন, তারাই এখানে নামাজ পড়বেন। মসজিদ কমিটি বলে একটা কমিটি বিষয়টি দেখছেন।
"প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের চেয়ে বরং মসজিদ নির্মাণ অথবা পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার" বিষয়টি এক নম্বরেই বলেছি- এটাকে মসজিদ হিসেবেই ব্যবহার করা হবে, সারা দুনিয়াতেই ভবনগুলো ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর একটা দেখভাল করার জন্য সংরক্ষকদের সাথে একটা নিয়মিত যোগাযোগ রাখা দরকার। এখানে আমরা সেই যোগাযোগটা রাখতে পারবো আশা করি। তবে সব ক্ষেত্রে বিষয়গুলো তেমন সহজ না-ও হতে পারে। সংরক্ষণ অথবা প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য বিষয়ে কোনো নীতিমালা থাকলে ভাল হতো। বর্তমানে যে আইনটি আছে, তা একটা জঘন্য আইন। আগে এই বিষয়ে লিখেছি।
বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য বিষয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বক ঐতিহ্য নামে একটা বই আছে, এটা তুলনামূলকভাবে ভাল। এর একটা সফট ভার্সন সিডি/ডিভিডি আকারে পাওয়া যায়, ৫০-৬০ টাকা দাম।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
ধন্যবাদ বিস্তারিত উত্তরের জন্য। পরের কিস্তিগুলো পড়ে হয়ত আরো প্রশ্ন রাখব। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকাশনাটি যোগারের চেষ্টা করব।
নতুন মন্তব্য করুন