বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণের কিছু ছবি আমার ফেসবুকের এই অ্যালবামে এবং আমাদের একটি ওয়েবসাইটের অ্যালবামে দেয়া আছে, কেউ আগ্রহী হলে দেখতে পারেন।
বালিয়া মসজিদের সবচেয়ে কাছের বাড়িটি নবীরুলের। সুতরাং মসজিদটির ইতিবৃত্ত নবীরুলের কাছে কিছু জানা যাবে ভেবে আমরা তার কাছেই প্রথমে জিজ্ঞেস করি। নবীরুল দ্বিধাহীন চিত্তে জানায় সে নিজের কানে স্পষ্টভাবে শুনেছে, এই মসজিদটির ভেতরে পরীদের আনাগোনার শব্দ, তাদের নূপুরের নিক্কণ তার কানে এখনও পরিষ্কার বাজে। নবীরুলের পরী-কাহিনী মসজিদটি সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প হলেও, সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গল্প হলো- রাতারাতি মসজিদটির গজিয়ে ওঠার কাহিনী। একরাতের মধ্যেই নাকি মসজিদটি তৈরি করা হয়, অতিরিক্ত অলঙ্করণ ও পুরু দেয়াল তৈরি করতে করতে ভোর হয়ে যাওয়ায় মসজিদটি শেষ করা যায়নি আর, গম্বুজ তিনটি তৈরি না করেই চলে যায় জীনপরীরা। অন্যদিকে ইছহাক চৌধুরী আমাদের শোনালেন বাঘ ও খরগোশের গল্প। এই মসজিদে নাকি একই সাথে বাঘ ও খরগোশ থাকতো। গাছপালার জঙ্গলটিতে একটি ছোট্ট গহ্বর করে একটি গুহা সৃষ্টি করেছিল সেই বাঘ। সেখানে সে বাচ্চাসহ থাকতো। নিজ চোখে মসজিদ সংলগ্ন পুকুরঘাটে বাঘের পানি খাওয়া এবং পানি খাওয়া শেষে গুহামুখ দিয়ে মসজিদগুহায় প্রবেশ করতে দেখেছেন ইছহাক।
এমন অনেক গল্প আপনি পাবেন ঠাকুরগাঁও জেলাসদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী বালিয়া গ্রামের এই মসজিদটি সম্পর্কে। অনেকে অনেক ভাবে আপনাকে গল্পগুলো বলবে। নানা মত, নানা ভাষ্য শুনবেন আপনি। তবে সবারই একটাই প্রশ্ন, এই প্রত্যন্ত পাড়াগায়ে কে বা কারা অথবা কেন এই নয়নাভিরাম স্থাপত্য নির্মাণ করেছিল। এমনকি স্থানীয় এলজিইডি-র ইঞ্জিনিয়ার লিটন পর্যন্ত বললেন, আমি তো এই এলাকায় আট বছর ধরে আছি, এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করি, কোনো দিন তো এই মসজিদটি চোখে পড়েনি, এই মসজিদটি কি রাতারাতি তৈরি হলো?
না, নয়নাভিরাম মসজিদটি রাতারাতি তৈরি হয়নি। যদি স্থানীয় শাসককেই স্থাপনার নির্মাতা বলা হয়, সেক্ষেত্রে ‘মহারাজাধিরাজ’ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অন্তর্গত শালবাড়ি পরগণার জমিদার বিবি গুলমতি চৌধুরানী এই মসজিদের নির্মাতা। পরম্পরায় প্রকাশ, গুলমতি চৌধুরানীর পতি মেহের বক্শ-এর দাদা পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয়ের পর নিপীড়নমূলক অবস্থায় আত্মরক্ষার্থে পাটনা থেকে জলপাইগুড়ি চলে আসেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে তার পুত্র এবং মেহের বক্শ-এর বাবা রাজ-এ-মোহাম্মদ ঠাকুরগাঁও মহকুমার বালিয়ায় এসে ব্যবসা বাণিজ্য করে সমৃদ্ধি অর্জন করেন। স্থানীয় জমিদারের সাথে সুসম্পর্কের প্রেক্ষিতে তার ছেলে মেহের বক্শ-এর সাথে তৎকালীন জমিদারকন্যার পরিণয় সর্ম্পক স্থাপিত হয়। যদিও জমিদারী বিবি গুলমতি চৌধুরানীর নামেই ছিল, কিন্তু কার্যত শাসন করতেন মেহের বক্শ। ফলত মসজিদটি তিনিই নির্মাণ করেছিলেন বলে পরম্পরায় প্রকাশ।
তিন-গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হলেও মসজিদের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও অলঙ্করণে মুঘল রীতির স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। ভারবহনকারী বীম বা পিলার বিহীন ভবনটিতে ৪২ ইঞ্চি প্রশস্থ দেয়াল তৈরি করে ভার বণ্টন করা হয়েছে। সেই সাথে প্লাটফর্ম থেকে মাটির নীচ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দেয়াল তুলে এর দৃঢ়তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ওপরের দেয়ালের প্রস্থ যদিও ৪২ ইঞ্চি, কিন্তু বর্তমান ভূমি লেবেলের (ইজিএল) ওপরে প্লাটফর্ম লেবেল পর্যন্ত দেয়ালের প্রস্থ ৭৪ ইঞ্চি, ভিত্তিতে তা আরও বেশি।
পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তনের আয়তাকার মসজিদ কমপ্লেক্সটিকে ‘সিড়িসহ প্রবেশপথ’, ‘খোলাচত্বর’ এবং ‘মূলভবন বা নামাজঘর’ এই তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়। ৯ফুট বাই ২১ ফুট আয়তনের দুই গম্বুজবিশিষ্ট প্রবেশপথটি আলাদা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপত্য । মূলভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্থ। প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূলভবন একই প্লাটফর্মের ওপর অবস্থিত। বর্তমান ভূমি লেবেল (ইজিএল) থেকে স্থানভেদে সাড়ে ৩ ফুট থেকে সাড়ে ৪ ফুট গভীর ভিত্তির ওপর ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের ওপর মসজিদটি স্থাপিত। প্লাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত। ইটের আকৃতি বর্তমান কালের ইটের মতো হলেও ইটগুলো আদর্শমানের, সঠিকভাবে পোড়ানো এবং কঠিনত্ব গুণ সম্পন্ন। এর রং লাল এবং সুন্দর সুপরিস্ফুট কাদামাটির কণা দিয়ে তৈরি। ইটে কোনো অলঙ্করণ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ইট কেটে তৈরি করা নকশা স্থাপন করা হয়েছে। অলঙ্করণে ইট কেটে কলস, ঘণ্টা, ডিশ, বাটি, আমলকি, পদ্ম ইত্যাদি আকৃতি দেয়া হয়েছে। যদিও পুরো মসজিদেই কমবেশি অলঙ্করণ রয়েছে, তবে প্রধান প্রবেশপথ, পূর্বদিকের দেয়াল এবং মিহরাবে বেশি নকশা স্থাপন করা হয়েছে। দেয়ালের কোথাও আস্তরণ করা হয়নি। দরজা-জানালা কাঠামো নির্মিত হলেও দরজা-জানালা নির্মিত হয়নি। প্রবেশ পথ ও মূল প্রবেশদ্বারের খিলানে এবং মূল ভবনের ভেতরের ভারবহনকারী খিলানে লোহার আংটাসহ রিং দেখা যায়। সম্ভবত বাতি ঝোলানোর জন্য এই আংটাগুলো স্থাপন করা হয়েছিল।
(চলছে)
মন্তব্য
মসজিদ তৈরীর ঘটনাটা বেশ লাগল।
এক রাতে মসজিদ তৈরির গল্প মোটামুটি বেশ প্রচলিত। অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ সম্পর্কেই এরকম গল্প প্রচলিত। ধর্মীয় স্থাপনারে ঐশ্বরিক লেবাস দিতে এসবের পয়দা।
সিরিজ চলুক... মন্দিয়া পড়তেছি... ভালো লাগতেছে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বালিয়া'র আরেক নাম কি বালিয়া ডাঙ্গি?
---------------------------------------------------
আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কাব্য নিয়ে ঘুরি।
আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কব্য নিয়ে ঘুরি।
না। বালিয়াডাঙ্গি পাশের উপজেলার নাম। এটা সদর উপজেলাতেই কিন্তু প্রান্তিক, প্রায় পঞ্চগড়ের কাছাকাছি।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চলুক এই জার্নাল।
...............................
নিসর্গ
নতুন মন্তব্য করুন