বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা গেছে, নিজেও আক্রান্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তা সত্ত্বেও আমাদের সংরক্ষণ কাজে সবচেয়ে আগ্রহী মানুষটি ফারিয়া। প্রতিদিন এসে কাজের খোঁজখবর নিচ্ছে, আমাদের দলের কে কেমন আছে, অভিভাবকসুলভভাবে দেখভাল করছে। ওর ভাই-বোন (যাদের সাথে থাকে) আমাদেরকে চাচা-মামা ডাকলেও ফারিয়া এসব সাধারণ (কমন) সম্পর্কে আগ্রহী নয়। প্রত্যেকের সাথে তার ওয়ান-টু-ওয়ান সম্পর্ক, প্রত্যেককে কাস্টমাইজড নাম দিয়েছে সে। সাধারণত নামের আদ্যক্ষরটিকেই নাম হিসেবে তার পছন্দ, নিজের নাম বলে ‘ফা'। সুতরাং আমাদের দলের অধিকাংশ সদস্যই তার কাছে শা, আ, স ইত্যাদি। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ডাক নাম যে চুন্নু, ফারিয়া-র ‘চু' অনুসন্ধান ব্যতীত এটা আমি জানতেই পারতাম না। তবে একই অক্ষর একাধিক হয়ে গেলে অথবা কোনো বিশেষ কারণ থাকলে অন্য কোনো শব্দ বা অক্ষর বেছে নেয় সে। যেমন মামুন-কে ‘বন্ধু’ নামে কাস্টমাইজ করেছে, কেননা ‘মা’ অক্ষরটি অন্য কারো জন্য বরাদ্দ করতে সে আগ্রহী না। আমি যদিও এই দলের সবচেয়ে মুরব্বী সদস্য না, তবে দলনেতা হওয়ার কারণে প্রায়ই মুরব্বী গোছের লোকদের সাথে আমার আনাগোনা থাকায় আমাকেও আদ্যাক্ষর দিয়ে বিভূষিত করা যাবে কিনা, এ বিষয়টি ফারিয়া এখনো নিশ্চিত নয়। তাই ‘এই, ওই, এই যে’ ইত্যাদি ভূষণ নিয়েই আপাতত থাকতে হচ্ছে। আমাদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে তার সুস্পষ্ট বিধিমালা আছে, তা হলো- ফারিয়া থাকা অবস্থায় সিগারেট খাওয়া যাবে না, খেতে হলে দূরে গিয়ে খেতে হবে এবং ফারিয়াকে দেখা মাত্র সিগারেট ফেলে দিতে হবে- এর কোনো ব্যতিক্রম হলে ও আমাদের কাছে আসবে না। আর ওর সঙ্গ পছন্দ করে না, এমন সদস্য আমাদের দলে নেই। আমাদের দলের সদস্যদের তোলা ফারিয়ার ছবির কয়েকটি আমার ফেসবুকের এই অ্যালবামে আছে। (শুধু ফারিয়া-কে নিয়ে পরে একটা আলাদা পোস্ট দিবো, আশা করছি)।
১.
আজ সকালে যখন সাইটে গেলাম, দূর থেকে দেখলাম একটা মিছিল। কাছে গেলে বুঝলাম- একদল স্কুলের বাচ্চা এসেছে আমাদের কাজ দেখতে। প্রতিদিনই শত শত শিশু এখানে আমাদের কাজ দেখতে আসে। আশেপাশের এবং দূরের স্কুল, কিন্ডারগার্টেন এবং মাদ্রাসা থেকে শিশুরা দলবেঁধে কিংবা একা একা আসে। বড়োদের থেকেও ওদের উৎসাহ অনেক বেশি। এবং বড়োদের অনেকের মধ্যে যে অতিলৌকিক সংস্কারগুলো আছে, শিশুদের মধ্যে সেটা নেই। এতো বছরের পুরনো একটি ভবন, যা তৈরি করেছে জ্বীন-পরীরা, সেটা কি মানুষের পক্ষে পুনর্নিমার্ণ করা সম্ভব? এই প্রশ্নের জবাবে বড়োরা অনেক সময় দ্বিধান্বিত হলেও শিশুরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে- এর সংস্কার ও সংরক্ষণ হবেই।
২.
ফারিয়া কখনো এই লেখা পড়ার মতো বড়ো হবে কিনা, জানিনা। কিন্তু ফারিয়া এবং/অথবা অন্য সব শিশুরা একদিন বড়ো হবে। ওরা জানবে, এই দেশ সেই দেশ যে দেশে অর্থব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুদ্রা চালু হয়েছে পৃথিবীর সব দেশের আগে। (৬ষ্ঠ খৃস্টপূর্ব শতাব্দীতে উয়ারীতে প্রবর্তিত ইউনিফর্মড মুদ্রাব্যবস্থার আগে বিশ্বের কোথাও মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না)।
পৃথিবীর দেশগুলো যখন বিদ্যালয় কি এই বিষয়টিই জানতো না, তখন আমাদের উপমহাদেশেই প্রথম তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয় (তক্ষশিলা)। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খৃস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে আমাদের দেশে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয় (মহাস্থানগড়, হরিশচন্দ্র নির্মিত বিদ্যায়তন, সোমপুর বিহার, কুমিল্লার বিহারসমূহ ইত্যাদি), ইউরোপ যখন বিশ্ববিদ্যালয় কি, তা-ই জানতো না।
বর্তমান ডিজিটাল বিশ্ব যে দশমিক পদ্ধতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই দশমিক পদ্ধতি ও শূন্য এই বাংলাতেই আবিষ্কৃত হয়।
আমাদের দেশ এতোই অতিথিপরায়ণ ও সমৃদ্ধ যে এই দেশ অনুপ্রবেশকারী যোদ্ধা এই দেশেই জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন কি নিজের ছেলের সাথে যুদ্ধ করে এই দেশকে স্বাধীন রাখার চেষ্টা করেছে।
যে আলেকজান্ডারের ভয়ে সারা বিশ্ব কাপঁতো থর থর করে করে, সেই আলেকজান্ডার বাঙালি বীরের (নন্দ) বীরত্বগাঁথা শুনে অস্ত্র সংবরণ করেছিলেন।
এমনি আরো শত শত গল্প এইসব শিশুরা জানবে। শুধু জানা নয়, এইসব ঋদ্ধ অতীত আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেছি এটাও ওরা দেখবে।
৩.
এই যে নগর-সংসার ছেড়ে এই প্রত্যন্ত প্রান্তরে পড়ে আছি, তার প্রধান কারণ- ফারিয়া এবং/অথবা অন্য সব শিশুরা যখন বড়ো হবে, ততদিনে আমরা এই দেশের আরো অনেক স্থাপনা এবং অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষণ করতে পারবো। ওরা বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরবগাঁথা গর্ব করে বলবে এবং সেই সাথে এই গৌরবান্বিত অতীত থেকে অভিজ্ঞতা ও উৎসাহ নিয়ে আরো গর্ব করার মতো ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের যতো প্রয়াস, সব ওদের জন্যই।
মন্তব্য
খুব ভালো হয় যদি শিশুদের সংরক্ষণ কাজের পাশাপাশি কিছু সময় গল্পের ছলে ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্বের আকর্ষণীয় কিছু গল্প শোনাতে পারেন।
বড় কিছু ট্রান্সপারেন্সি কি তৈরি করা সম্ভব? সাদা ক্যানভাসের ওপর ফেলে বাচ্চাদের নানা জিনিস দেখানো সম্ভব তাহলে, বিশেষ করে রঙিন কার্টুন।
আর একটা ব্যাপার, আপনার আগের পোস্টে সাপের কথা বলেছিলেন, কাজেই বাচ্চাদের একটু সাবধানে দেখে রাখবেন। তারা অত্যুৎসাহী হয়ে কোনো বিপদে পড়লে আপনারা ধোলাই খাবেন।
ফারিয়ার জন্যে শুভেচ্ছা রইলো।
পরামর্শের জন্য খুবই ধন্যবাদ, একটা ক্যানভাস করবো করবো ভাবছিলাম, এখন তৈরি করা শুরু করা হয়েছে...
শেষের ব্যাপারটাতে একটু বলি, অন্য শিশুদেরকে আমরা দেখে রাখি, আর ফারিয়ার ক্ষেত্রে ও-ই আমাদেরকে দেখে রাখে। বিশেষ করে যখন আমরা এসিড নাড়াচাড়া করি, ওকে একটু ডেকে বুঝিয়ে বলে দিলেই হয়, সে নিজ উদ্যোগেই পাহাড়া দেয় কেউ যেন ওই দিকে না যায়।
ধন্যবাদ আবারো।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
লেখাটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া। শুধু ফারিয়ার উপরে আরেকটি পূর্ণাঙ্গ পোস্টের আপেক্ষায় রইলাম।
শুভেচ্ছা রইলো।
- নিয়াজ
ফারিয়ার জন্য ভালোবাসা।
আপনাদের কাজ এগিয়ে চলুক। ইতিহাস বেঁচে থাকুক আগামীর জন্য।
ফারিয়ার জন্যে শুভেচ্ছা।
_____________________________________________
কার জন্য লিখো তুমি জলবিবরণ : আমার পাতার নৌকা ঝড়জলে ভাসে...
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
মনটা কেমন করে উঠলো এই লাইনটা পড়ে।
আচ্ছা, আপনারা কী কাজ করছেন এর বিস্তারিত কোথায় জানতে পারি, আপনি কী সচলে এর আগে বিস্তারিত লিখে কোন পোস্ট দিয়েছিলেন?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
হ্যা, সচলেই পাবেন। এই লেখাটার ডানদিকেই দেখুন বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণ বলে কয়েকটা পোস্টের লিংক আছে।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
ফারিয়ার জন্য ভালোবাসা রইল...
কাজ এগিয়ে যাক...
--------------------------------------------------
একটি বাদরে, কি যে আদরে, খাচ্ছিল দোলা, ডাল ধরে ধরে!!!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
নিয়াজ, পথ হারানো মেয়ে, বালক, দুষ্ট বালিকা সহ সবাইকে ধন্যবাদ।
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
ফারিয়ার জন্য শুভকামনা রইলো।
আপনাদের কাছ থেকে এই শিশুরা যা শিখবে, তা তাদের আর্কিওলোজি আর ইতিহাস অনুসন্ধানে আগ্রহী করবে নিশ্চিত। এর মাঝেই হয়তো আমরা আরো কিছু যূথচারীকে পেয়ে যাবো ভবিষ্যতে।
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
ফারিয়ার জন্যে আদর....*তিথীডোর
নতুন মন্তব্য করুন