গণচাঁদার মাধ্যমে বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণ কাজে সাফল্যের পর (অন্য স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি) এবারে আমরা হাতে নিয়েছি জনজাদুঘর স্থাপনের একটি কাজ। জনজাদুঘর প্রত্যয়টি (পিপলস মিউজিয়াম বা কম্যুনিটি মিউজিয়াম) গত এক-দেড় দশক ধরেই জাদুঘরবিদ্যায় জনপ্রিয় একটি ধারণা হয়ে উঠছে। মানুষের (জনগণ) যা কিছু আছে সেগুলোকে মানুষ যেভাবে “উপস্থাপিত” দেখতে চায়, সেভাবে হাজির করাটাই এই ধরনের জাদুঘরের মূল লক্ষ্য। প্যালেস্টাইনের এই জনজাদুঘরটি একটু দেখুন, এই ধরনের জাদুঘর সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পেতে পারেন।
প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘর
প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘর ১
প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘর ২
দাতাসংস্থাগুলোর টাকায় বাংলাদেশে এনজিও-দের করা জনজাদুঘর বা গণজাদুঘর নামে বেশ কিছু জাদুঘর আছে। এমন কয়েকটি জাদুঘরের খোঁজ পেয়ে আমি সেগুলো দেখতে গিয়েছিলাম, প্রথম প্রথম যে অভিজ্ঞতাটি হতো তা হলো- জাদুঘর জিনিসটা যে উন্মুক্ত একটা ব্যাপার এই ধারণাও প্রতিষ্ঠাতাদের ছিল না। প্রায়শই আমাকে শুনতে হতো- এখন জাদুঘর খোলা যাবে না, অফিস থেকে অর্ডার দিলেই কেবল খোলা হবে। কবে সাধারণত খোলা হয় জাদুঘর? যখন বিদেশ থেকে কেউ আসেন।
এরপর থেকে যে এনজিও-র জাদুঘর দেখতে যাই, তাদের একজন কর্তাকে সাথে নিয়ে যাই। সে অভিজ্ঞতাও হতাশাব্যঞ্জক। প্রথমত, সংগৃহীত/উপস্থাপিত নিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ (কমন) হলো- ধান ও ধানচাষ সংশ্লিষ্ট কিছু জিনিসপত্র। এরপর থাকে যেগুলো তা হলো, কিছু গেরস্থালী জিনিস যা বিলুপ্তির পথে, শিলপাটা, ঢেঁকি, কাসার বাসনকোসন ইত্যাদি টাইপের জিনিসগুলো। তারপর এনজিও-টির কিছু প্রকাশনা- পোস্টার, লিফলেট, বইপত্র ইত্যাদি। আর কিছু যে থাকে না, তা না (দুএকটা ব্যতিক্রমী জাদুঘর আমাকে অবাক করে দিয়ে অফিস খোলা দিনগুলোতে খোলাই ছিল)। তবে মোটের ওপর এই ধরনেরই।
জনজাদুঘর করার জন্য জনগণের যে অংশগ্রহণ প্রয়োজন সেটি ওই জাদুঘরগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রে একেবারেই ছিল না। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো- জনজাদুঘর মানেই যে একটা উৎসব উৎসব ভাব, একটা প্রাণে প্রাণ মেলানোর ব্যাপার থাকে এইসব জাদুঘরে সেটি পুরোপুরি অনুপস্থিত।
একটি জনজাদুঘরের পরিকল্পনা আমরা করছিলাম গত ৪/৫ বছর ধরেই। সত্যিই আমরা জানি না, যেমন একটি জাদুঘরের স্বপ্ন আমরা দেখছি, তেমনটি করতে পারবো কিনা; তবে আমাদের দলের ছেলেমেয়েদের স্পৃহা অসীম। এই স্পৃহাই আমাদের নিরন্তর প্রেরণা জোগাচ্ছে একটি প্রাণবন্ত জাদুঘর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে। খুঁটিনাটি পরিকল্পনা সব সেরে ফেলেছি, এমন নয়। তবে তো আর কোনো কথাই থাকতো না। ধান, পাট থাকবে আমাদের জাদুঘরে- হয়তো; তবে প্রাণের ঐকতানটাকেই আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি।
এই জাদুঘরটি আমরা জনসচেতনতার জন্য করতে চাই না; বিশ্বশান্তি- নিদেনপক্ষে ওই এলাকাটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও না; দেখো আমাদের কী সম্পদ আছে, এই অহমিকা তৈরির জন্যেও না। আমরা এটি করতে চাই, মানুষের শক্তি ও দুর্বলতা, মানুষের অর্জন ও অপরাধ*, পরিবেশ ও ইতিহাসের সাথে মানুষের অভিযোজনশীলতা, মানুষের প্রকাশের আনন্দ ও অপ্রকাশের বেদনা- মোট কথা মানুষের অনুভূতিকেই অনুভব করার একটা জায়গা তৈরি করতে চাই। প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘরটিতে এক বৃদ্ধ নারী তার উদ্বাস্তু জীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন অন্যদেরকে। প্যালেস্টাইনের মানুষের কাছে উদ্বাস্তু জীবনের গল্প? মা-র কাছে মামাবাড়ির গল্পের মতোই ব্যাপার! তবু কিশোরকিশোরীরা তো বটেই, ওই উদ্বাস্তু নারীর অনেক সহযাত্রীও বার বার তার গল্প শুনে আপ্লুত হয়েছেন, আয়নাতে যেন নিজেকেই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে “মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো” প্রকল্পটি তাই এতো জনপ্রিয় হয়েছিল)
জাদুঘরের কাজ আসলে খুব কঠিন। বিশেষ করে টাকাপয়সার কথা ভেবে ব্যাপারটা আমাদের কাছে এক সময় খুব অসম্ভব বলেই মনে হয়েছিলো। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার আমাদেরকে বার বার আমাদের স্বপ্নের কাছে ফিরিয়ে আনে। টিমমেটদের স্পৃহা-টা তো আছেই, বাইরের কিছু প্রভাব-ও আছে। শিল্পকলা একডেমীর কনজারভেশন ল্যাবরেটরিতে যখন কাজ করতাম, অফিস সহকারী মীজান ভাই করতেন আমাদের দশগুণ কাজ। অফিসে বসে ফাইলপত্র নাড়াচাড়া করলেই তার চলতো, কিন্তু কিছু লোক আছেন যারা আরেকটু বেশি কিছু করেন, তিনি তেমন-ই একজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও, অনেক কাজেই তিনি এখনও আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল। জনজাদুঘরের জন্য নগর থেকে কিছুটা দূরে কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো এমন একটা জায়গা খুঁজছিলাম আমরা। মীজানুর রহমান আমাদের সেই সমাধান দিয়েছেন, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় পূর্ণিমাগাতীতে পাঁকা রাস্তার ধারে তার ৮ শতাংশ জমি এই জাদুঘরের জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার ভাই আমাদের জানিয়েছেন, আমরা যদি সত্যিই জাদুঘরের কাজ শুরু করি, তাহলে তিনি তার অংশের ৮ শতাংশ জমিও দান করবেন।
মীজান ভাইয়ের জমি আর আমাদের স্বেচ্ছাশ্রমের** সঙ্গে এবার আপনার একটু সাহায্য চাই; এখনও জাদুঘরের নামে কোনো একাউন্ট আমরা খুলিনি, সুতরাং টাকাপয়সা চাচ্ছি না (ভবিষ্যতে লাগলে জানাবো); যা চাচ্ছি তা হলো পরামর্শ। সচলের অনেকেই আছেন যারা দেশবিদেশের অনেক জাদুঘরেই গেছেন এবং/অথবা জানাশোনা/পড়াশোনাও অনেকের অনেক ভালো। সুতরাং আপনার মতামত খুবই কার্যকরী হতে পারে এই জনজাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে।
আর একটা অনুরোধ-ও এর পাশাপাশি করি। তা হলো- আপনাদের কারো কাছে যদি “পুরনো দিনের আবর্জনা” ধরনের জিনিস কিছু থাকে, বাপদাদার আমলের লোটাবদনা, ঘড়ি-ছড়ি, পুরনো বইপত্র, যা-ই হোক, যা ভাগাড়ে ফেলে রেখেছেন, ঝেটিয়ে বিদেয় করতে চান তাড়াতাড়ি, আমাদের খবর দিন। আমরা আপনার কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করবো।
*বিকল্প একটা ভালো শব্দ দিয়েন তো, বদলে দিবো।
** ভাল কথা, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে দেশের কাজ কিছু হচ্ছে, তবে আমাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজের মন্দা যাচ্ছে। বিশেষ করে স্বেচ্ছাশ্রমে মনোযোগ বেশি দিয়ে সঞ্চয় “বাড়ন্ত”। আমাদের প্রোফাইল ভালো, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে দূতাবাস, গ্যালারী ও বঙ্গদেশীয় “অভিজাত”দের ব্যক্তিগত সংগ্রহের অনেক জিনিসের সংরক্ষণ কাজ-ই করেছি আমরা। চিত্রকলা, পুরনো দলিল-দস্তাবেজ, ভাস্কর্য, পোড়ামাটি বা ইটের ফলক, মাটির জিনিসপত্র, পুঁতি, মুদ্রা (কয়েন), অলঙ্কার, স্থাপত্য ইত্যাদি যা-ই হোক না কেন, সংরক্ষণের প্রয়োজনে আমাদের খবর দিন। সচলদের নিজের সংগ্রহের/মালিকানার জিনিস হলে বিনা পয়সাতেই কাজ করে দিবো, “অভিজাত”দের হলে আমাদের বাণিজ্যিক হার প্রযোজ্য হবে।
মন্তব্য
আপনার পোস্ট পড়ে যা বুঝলাম, যাদুঘরটি হবে জনপদের যাদুঘর।
যাদুঘরের স্থানটুকুকে কালানুক্রমে সাজানো যায়। অভ্যাগতরা যাদুঘরে প্রবেশ করবেন ঐ জনপদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে, কয়েক মিটার পার হবার পর তারা কয়েক দশক পেরিয়ে ইতিহাসের আরেকটি অংশে পা রাখবেন। জনপদের কীর্তিমান মানুষদের কথা সেখানে বলা থাকতে পারে, প্রয়োজনে তাঁদের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে আঁকা ছবি বা ভাস্কর্য সেখানে স্থান পেতে পারে। জিগজ্যাগ নকশায় ছোটো জায়গার মধ্যেই অন্ত্রের মতো করে সাজানো যেতে পারে এই ব্যবস্থাটি। স্থানীয় সংস্কার (সু বা কু বলছি না) নিয়েও আলোকপাত করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় যে পরামর্শটি দেবো, সেটি শুনে কোনো কটুকথা মুখে এলে অনুগ্রহ করে গিলে ফেলবেন। যাদুঘরের ছাদে একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থা রাখবেন। উল্লাপাড়ায় আমি এককালে বিস্তর যাতায়াত করেছি, কোনো খাবারের দোকান নেই আশেপাশে (কমসেকম হাটিকুমরুল পর্যন্ত ফিরতে হবে খেতে চাইলে)। দূর থেকে অভ্যাগতরা গেলে পেটে কিল মেরে বসে থাকতে হতে পারে। রেস্তোরাঁর সার্ভিস ভালো হলে লংড্রাইভে লোকজন এসে বেরিয়ে যাবে। জনযাদুঘরের পয়সা গৌরীসেন না যোগালে যাদুঘরের পাশাপাশি স্বাদুঘর হলে একটা পূর্ণ আকর্ষণ বোধ করবে মানুষ। ঘুরলাম, দেখলাম, খাইলাম, চইলা আসলাম টাইপ একটা ট্রিপ ভালোবাসে বেশির ভাগ লোকে।
সহমত।
আপনার দেখি ভালই খাই খাই অভ্যাস হইসে
@ হিমু> ধন্যবাদ পরামর্শের জন্য। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, এটা জনপদের জাদুঘর হবে না। জনজাদুঘরের একটা বেসিক ব্যাপার হলো- এটাতে জনপ্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়। আমাদের দেশের মানুষ উৎসুক এবং তারা আশেপাশে এমনকি বিদেশ-ও জানতে চায় খুব। প্রত্যেক বাড়িতেই প্রবাসী থাকায় কিছুটা ধারণাও আছে তাদের। কাজে নামলে ব্যাপারগুলো ঠিকমতো বোঝা যাবে, তবে আমার ধারণা, কেবল নিজের ঘর না পরের ঘরের দিকেও তাকাতে চায় এইদেশের মানুষ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ইতিহাসের ক্রমপঞ্জিকার বিরোধী। আপনি নিশ্চয়ই একমত হবেন, ইতিহাসপঞ্জিকার মূলসুর হলো- "অমুক সনে অমুক রাজার সঙ্গে তমুক রাজার এক যুদ্ধ হলো" ইত্যাদি। জনগণের একটা নিজস্ব ইতিহাসবোধ আছে, সেখানে মোটের ওপর একটা ধারাবাহিকতা আছে, তবে তা মুখ্যত ঘটনাকেন্দ্রিক। পৃথিবীর অন্য যেখানেই জনজাদুঘর হয়েছে সেখানে এই ইভেন্টগুলোই মানুষ বেশি করে দেখতে চেয়েছে; দেখি আমাদের এখানে কি হয়। কালানুক্রমের এই ব্যাপারটিতে কিছুটা আলোচনার অবকাশ ছাড়া আপনার অন্য পরামর্শগুলো খুবই ভাল।
রেস্তোরার আইডিয়াটাও খুব ভালো, মোহাম্মদ মজহারুল হক ফরহাদ-এর প্রবর্তনা টাইপের দেশীয় খাবারের একটা রেস্তোরার আয়োজন করবো নাকি?
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
অসলোতে দেখেছিলাম ওদের folklore museum.
http://www.norskfolkemuseum.no/en/target-groups/About-the-Museum/
এরকম কিছুর কথা বলছেন?
মিজানুর রহমানকে সালাম জানাইলাম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন