সম্প্রতি আমি একটা চাকরিতে যোগ দিয়েছি। প্রত্নতত্ত্ব করে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ায় আবারো একটি চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হলাম। যোগ দেয়ার হিসেবে এটি আমার ১৮ নম্বর চাকরি, আর প্রাপ্তির দিক থেকে ৬৪-তম। বাংলাদেশের বেকারত্বের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও এতো এতো চাকরি কিভাবে পেলাম অথবা বার বার চাকরি কেন বদলাই আজকের পোস্টের বিষয় সেটা না। আজকের বিষয়- গল্প তৈরির গল্প।
এবার আমি যে প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছি, তাদের মূল কাজ মানুষকে অনুপ্রাণিত করা। স্বেচ্ছাব্রতী এই সংগঠনটি সারা দেশে মানুষকে স্বেচ্ছাকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। এই উদ্বুদ্ধকরণের কাজ ও সেই সম্পর্কিত কিছু প্রশাসনিক কাজ নিয়েই আমাদের অফিস। নতুন বলে, এখনো আমি আসলে শ্রোতাদের দলে। নিত্য নতুন গল্প শুনি। তেমনি একটি গল্প শোনালেন আমাদের এক সহকর্মী বকা (আদ্যক্ষর)। অফিসে বেশি বেশি বকবক করবেন, তার পিতামাতা যেন তা আকীকা দেয়ার সময়েই তা টের পেয়েছিলেন!
সে যাই হোক, তিনি আজ দুপুরে খাওয়ার সময় বললেন- "আর বলবেন না, একবার উদ্বুদ্ধকরণের জন্য গেছি নেত্রকোণা। সেখানে এক স্কুল টিচার এসেছেন উদ্বুদ্ধ হতে। ভদ্রলোকের তিন ছেলে, কোনো মেয়ে নেই। কিন্তু একটি মেয়ের খুব আকাঙ্খা ছিল তার। ভদ্রলোক রোজ স্বপ্ন দেখতেন যে, তার একটি মেয়ে আছে। স্বপ্নে স্বপ্নে মেয়েটি দিনে দিনে বড়ো হয়ে শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে চাকরিবাকরিও শুরু করেছে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো মেয়ে নেই। উদ্বুদ্ধুকরণ অনুষ্ঠানে আমার কথাবার্তা শুনে তিনি বললেন, যে মেয়েটিকে আমি স্বপ্ন দেখি সে হুবুহু তোমার মতো। তারপর তিনি আমাকে মেয়ের মতো স্নেহ ও যত্ন করলেন। বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। পরেও অনেক যোগাযোগ করতেন। তার স্ত্রীও আমাকে মেয়ে বলে ডাকতেন, ছেলেতিনটি দিদি দিদি বলতো ইত্যাদি। এই পর্যায়ে দুমুর্খের মতো আমরা জিজ্ঞেস করলাম, উনার নাম কি? বকা জবাব দিলেন- মনোরঞ্জনদা'!
আসল ঘটনা এটাও না। আমি এক সময় একটি মোবাইলফোন কোম্পানীতে চাকরি করতাম। আমি যে বিভাগে কাজ করতাম সেটি হলো- রিটেনশন এন্ড উইনব্যাক। সেসব গ্রাহক একসময় প্রচুর বিল দিতেন, কিন্তু পরে আমাদের ফোন ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে আনাই আমাদের কাজ ছিল।
কোম্পানীতে প্রথমদিকে বছরে ২ বার, পরে বছরে ১ বার আমাদেরকে মানোনন্নয়ন পরীক্ষায় বসতে হতো। একটা ভাইবা হতো, সেখানে আমাদের মান যাচাই করা হতো, তারপর একটা প্রমোশন। আমরা যারা অ-বাণিজ্যিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এই বহুজাতিক কর্পোরেশনে কাজ করতাম, আমরা এই মানোন্নয়ন পরীক্ষাপাসের একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলাম। এই পদ্ধতির প্রথম ধাপটি হলো- ইংরেজি এড়ানো। যেহেতু এটি একটি বিদেশিপ্রধান কোম্পানী, সুতরাং ভাইবাগুলো ইংরেজিতে হতো। আমরা একটি বাক্যের ট্রান্সলেশন মুখস্থ করতাম- "আমি আসলে ইংরেজি জানি, কিন্তু আমাদের আলাপের যথাযথ বিশ্লেষণ ও হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বাংলায় আলাপ করাটাকে আমি সুবিধাজনক মনে করি, আমরা কি পরবর্তী আলাপগুলো বাংলায় চালাতে পারি?" ভাইবার শুরুতেই আমরা গণহারে এই বাক্যটি বলতাম। নানাভাবে, নানা ভঙ্গিতে।
তারপর শুরু হতো বাংলায়- গরুকে নদীতে নামানো। যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেই আমরা ইনিয়ে বিনিয়ে একটা গল্প বলতাম। সেটি রসিয়ে রসিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বলতাম, যাতে ভাইবার নির্ধারিত সময় পার করে দেয়া সম্ভব হয়। আর গল্পটা আমরা আলাপ করে আগেই ঠিক করে রাখতাম। কে কোন্ গল্প বলবে, তা-ও ঠিক করা হতো। আমাদের আতিক ভাইয়ের ভাগ্যে একবার এমন একটি গল্প পড়েছিল।
সেটি হলো- "আমি একবার আমাদের এক পুরনো গ্রাহকের বাড়ি গেলাম, সেটি ছিল নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। উনার বাড়ি থেকে একসাথে ৪৬ টি পোস্টপেইড সিম একসাথে সারেন্ডার করা হয়, প্রত্যেকটি সিম প্রতিমাসে ২৫০০ টাকার ওপরে বিল দিতো। কোনো কোনোটি ৫-১০ হাজার টাকাও বিল দিতো। উনি ছিলেন, একজন গুড়া মরিচ ব্যবসায়ী। মরিচ ভাঙ্গিয়ে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করেন। ওই অঞ্চলে তার মরিচ খুব বিখ্যাত। আমি উনার বাড়ি যাওয়ার পর, উনি আমাকে বললেন- 'উনার মেয়ে একবার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়, মেয়েটি তার ফোন থেকে ফোন করে খোঁজ দিচ্ছিলো, কিন্তু কোনোভাবেই তাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। আমি তখন আপনাদের ফোনের অফিসে গিয়ে অনেক অনুরোধ করি, আমার মেয়েটা কোথায় আছে, তা খুঁজে দেয়ার জন্য, কিন্তু উনারা আমার কথা রাখেন নাই। তাই আমি রাগ করে আমার কোম্পানীর পুরা ৪৬ টি সিম একসাথে সারেন্ডার করি।' ভদ্রলোক আরো বললেন, উনি আমাদের কোম্পানীর ওপর খুবই ক্ষিপ্ত, এমনকি উনি আমাকে হুমকি দিলেন- 'আপনাকে যদি এখন আটকে রাখি, তবে আপনার কোম্পানীর কি সাধ্য আছে আপনাকে এখান থেকে উদ্ধার করে?' তারপর আমি নানাভাবে ভদ্রলোককে আগডুম বাগডুম বোঝাই, স্যার আমরা আসলে একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান- বাজার থেকে কেউ ছুরি কিনে যদি কাউকে খুন করে, তবে কি ছুরির কোম্পানীটির কিছু করার থাকে অথবা মানুষ কি ছুরির কোম্পানীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়, নাকি যে খুন করেছে তার বিরুদ্ধে মামলা করে, পুলিশ ব্যবস্থা নেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন উনি আমার কথা অনুধাবন করে তার ৪৬টি সিম-ই রিকানেক্ট করেন। আপনার হয়তো মনে আছে, একবার একসাথে বিপুল পরিমাণ রিকানেকশনের ঘটনায় খুশি হয়ে ডিএমডি একটা অভিনন্দন মেইল দিয়েছিলেন। তাই না?"
পুরো ঘটনাটাই সাজানো। ৪৬ টি সিম, মরিচের ব্যবসা, মেয়ে নিখোঁজ হওয়া কোনোটিই কস্মিনকালে ঘটেছিলো বলে আমাদের জানা নেই। সাথে ডিএমডি-র দোহাই দেওয়ার কারণে তা আরো ভারি হলো। এইচআরের লোকজনের আর খেয়ে কাজ নেই, কবে ডিএমডি কাকে কোন্ মেইল করেছিলো, এইসব মুখস্থ করে বসে থাকবে!
আসল কথা এটাও না। আসল কথা, এভাবেই গল্প তৈরি হয়। কর্পোরেশনে হয়, এনজিও-তেও হয়। খোদাই মালুম, আমাদেরকে নিয়েও কতো যে গল্প নামে-বেনামে প্রচলিত আছে!
মন্তব্য
আমার তো ধারণা ছিল পৃথিবীতে ভাইভা পরীক্ষায় আমিই সেরা
এখন তো দেখি আমার থেকে সরেস সেরা আছে আরো অনেক
০২
আমার একটা সাধারণ টেকনিক আছে বোর্ডের লোকজনকে আউলাঝাউলা করে মূল বিষয় থেকে সরিয়ে আমার জানা বিষয়ে নিয়ে যাবার
ইন্টারে বায়োলজির ভাইবায় আমি উত্তর এবং আলোচনা করেছি বাংলাদেশের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষামন্ত্রীর দক্ষতা নিয়ে (জমিরউদ্দিন সরকার ছিলেন বোধহয় তখন শিক্ষামন্ত্রী)
পানি ক্যাম্নে চ্যাপ্টা খেয়ে বরফ হয় এই আলোচনা করেছি ফিজিক্সএর ভাইভায়
আর ক্যামেস্ট্রির ভাইভা ছিল বাংলা কবিতার ছন্দ বিষয়ক...
প্রথম মাস্টার্স ফিলোসফিতে আমার ভাইভার বিষয় ছিল- আমি কেন নোটবই না পড়ে টেক্সট বুক পড়ি
আর দ্বিতীয় মাস্টার্স ফিল্মের থিওরি- টেকনিক্যাল সবগুলো ভাইভার বিষয়ই ছিল বাংলা সিনোমর এক্সট্রাদের দুরবস্থা নিয়ে...
আর এযাবতকালে আমি যত চাকরি পেয়েছি সব ভাইভার উপর। এবং কোনো চাকরিতেই চাকরি শুরু করার আগে সেই চাকরির কাজের বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিল না
কিন্তু প্রতিটাতেই বকবক করেছি ঘন্টার পর ঘন্টা
দারুণ লাগলো। আপনার দিনলিপি নিশ্চয়ই পড়তে ভালো লাগবে। বিদ্যুৎ সমস্যার উন্নতি হলে আপনার লেখা আরো নিয়মিত পাবো আশা রাখি।
@ লীলেন: আপনার মৌখিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা নিয়ে দিন না একটা লেখা। মনে হচ্ছে আপনার জীবনমুখী গল্পের মতো এগুলোও বেশ জম্বে।
---মহাস্থবির---
জব্বর লেগেছে।
--
শুধু এক ভাইবাতেই প্রমোশান? সারাবছর তাহলে বস এরা করে কি?
আমি আজীবন বেকার, তাই চাকরীর ইন্টারভিউ নাই আমার কপালে। তবে কলেজ পাস দেওনের সময়কার গপ কই।
এইচএসসির ভূগোল পরীক্ষায় ভাইবা ছিলো, বিভাগীয় প্রধান ইয়া মোটা এক ভদ্রমহিলা আমারে দেখেই ভুরু কুচকায়া জিগাইলেন তুমি কি এই কলেজে পড়? আমি কইলাম হ। [তখন আমার পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো লম্বা লম্বা চুল ছিলো]
কয় তোমারে তো জীবনেও দেখি নাই...
আমি কইলাম ক্লাস করা হয় নাই তেমন।
তাইলে কী করো? মাস্তানী করো? রাজনীতি?
না
তাইলে?
পত্রিকায় লিখি
কোন পত্রিকায়?
ইত্তেফাকে [তখন প্রথম আলোটালোর জন্ম হয় নাই, ইত্তেফাক দেশের এক নম্বর পত্রিকা]
কী লিখো?
আমার একটা সিরিজের নাম কইলাম, যেটা প্রতি সপ্তাহে ছাপা হইতো।
সেই শুনে ভদ্রমহিলা পুরা কাইত। কারন সেটা নাকি তিনি রেগুলার পড়েন। আর পায় কে? এই পিচ্চি বয়সে আমি কীভাবে এতো এতো...
ভূগোলের ভ'ও জিগায় নাই আমারে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হে হে হে, মজা লাগছে।
আসলে ঘটনা এটাও না। হে হে হে আসলে এভাবেই শুরু হয়। কে জানে কোথাও হয়ত আমাকে নিয়েও কেউ হে হে হে করছে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
মনটা খ্রাপমতো হয়ে গেলো - আপনাদের কতোজনের কত্ত মজার অভিজ্ঞতা! আমার সেইসব কিস্যুই নাই
- আপনার গল্প পড়ে তো এখন নিজের মাথা চুলকাচ্ছি। আল্লায়ই জানে কতো চায়ের কাপে যে হাহাহিহির ঝড় তুলে যাচ্ছি নিজের অজান্তেই!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
মজা পেলাম
--------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
বায়োলজি পরীক্ষার (এসেসসি টেস্ট) ভাইবায় আমারে স্যার দেইখ্যাই মুক্কালা কইর্যা ফালাইলো।... এরপরের আলোচনা নিম্ন্রুপঃ
- পড়াশোনা কর ?? দেক্লেই বুঝা যায় করো না।
- না স্যার, করি না।
-নামায কালাম পড় ?? দেক্লেই বুঝা যায় পড় না।
-না স্যার, পড়ি না।
- ... আচ্ছা, বলতো, "রোড" ছবির নায়ক কে ?? [আমি জানতাম না ঐ নামে তখন একটা হিট হিন্দি মুভি চলতেসে।]
- উম্মম, হাজী শরীয়তউল্লাহ ??
স্যার হতভম্ব, উনি আমার দিকে বেকুবের মত চেয়ে আছেন, আমিও তার দিকে বেকুবের মত চেয়ে আছি।...
_________________________________________
সেরিওজা
নতুন মন্তব্য করুন