খুট করে কোথায় যেন একটা শব্দ হোল। যদিও খুবই মৃদু শব্দ, তবুও তাতেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেল।
ধীরে ধীরে খুবই সন্তর্পনে চোখ খুললেন তিনি। ঘরে জিরো পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। তাতে সবকিছুকে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। প্রাথমিক উপলব্ধির রেশটা কাটার পর তিনি অবাক হলেন একটু। সাধারণতঃ তাঁর ঘুম বেশ গভীর, এমনকি এই বয়সেও তিনি একঘুমে রাত কাবার করে দেন। বাথরূমে যেতে না হলে রাতের বেলা তাঁর ঘুম ভাঙেনা সচরারচর। তার উপর ঘুম ভাঙানোর কারণটি তেমন জোরালো কোন শব্দ ছিলনা। এখন তার রীতিমত সন্দেহ হচ্ছে যে আদৌ কোন শব্দ হয়েছিল কিনা।
বিছানার অন্য পাশে সুলতানা নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। তার গভীর নিঃশ্বাস পড়ছে একতালে। একটু খেয়াল করে তিনি বুঝতে পারলেন যে সুলতানার আসলে হাল্কা নাক ডাকছে। ব্যপারটাতে তিনি বেশ মজা পেলেন। এতদিন পর আজকে তিনি প্রথম টের পেলেন যে ঘুমালে সুলতানারও নাক ডাকে। অথচ চিরকালই সুলতানা তার নাক ডাকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঠাট্টা করেছে।
বিয়ের মাস তিনেক পর একবার শ্বশুরবাড়ীতে পারিবারিক আড্ডাতে সুলতানা হঠাত্ বলেছিল," জানিস, তোদের দুলাভাইয়ের নাক ডাকার শব্দ এত প্রচন্ড যে সেই শব্দে তার নিজেরই ঘুম ভেঙ্গে যায়।"
সবার সে কি হাসি সেই কথা শুনে। সুলতানার ছোট বোন মিতুল হাসতে হাসতে বলেছিল, "দুলাভাই, আপনার নাক ডাকার আওয়াজটা পেটেন্ট করে রাখেন। আমরা এই ভয়ানক নাক ডাকাটা রেকর্ড করে একটা ক্যাসেট বার করবো। দেখবেন হুহু করে বিক্রি হবে এই ক্যাসেট।"
সুলতানার ছোটভাই বাবু জিজ্ঞেস করেছিল,"এই ক্যাসেট কে কিনবে মেজ আপা? কুকুরের ডাকের ক্যাসেট হলে না হয় বুঝতাম যে চোর তাড়ানোর জন্যে লোকেরা এটা রাতের বেলায় চালিয়ে ঘুমাবে। নাক ডাকার শব্দে তো চোরেরা আরো উত্সাহের সাথে জানালার গ্রীল কাটবে।"
মিতুল বলেছিল, "আরে ছাগল, এই ক্যাসেটতো চোর তাড়ানোর জন্যে না। এই ক্যাসেট লোকে কিনবে অন্যকে ভয় দেখানোর জন্য। ক্যাসেটের কভারে একটা ভয়াল দর্শন লোকের চেহারা থাকবে। বড় বড় লাল চোখ, টুথব্র্রাশের মতো মোটা কালো ভুরু, থ্যাবড়া নাক দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। তার উপর বিশাল হরফে লেখা থাকবে নাম। নাসিকা-নির্যাতন। শব্দ দ্বারা ভয় দেখানোর অব্যর্থ পদ্ধতি। বিফলে মুল্য ফেরত।"
"কিন্তু এই জিনিস কিনবে কে?"
"কেন, সবাই কিনবে। দজ্জাল বৌদের স্বামীরা কিনবে, অত্যাচারী স্বামীদের স্ত্রীরা কিনবে, দুষ্টু বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা কিনবে, কঠোর বাবা-মাদের বাচ্চারা কিনবে। কথা না শুনলেই ক্যাসেট চালানোর ভয় দেখানো হবে। ঈদে শাড়ী-গয়না দেবেনা? ক্যাসেট চালাবো। সন্ধ্যে বেলা পড়তে বসবেনা? ক্যাসেট চালাবো। রোজ রোজ বাপের বাড়ী যাবে? ক্যাসেট চালাবো। দুলাভাইয়ের অসাধারণ নাক ডাকার ভয়ে পূরো দেশ তঠস্থ থাকবে। ব্যাপারটা একবার ভাল করে সবাই ভেবে দেখো। মনে করো, একটা বড় মিছিল আসছে। তাদের বাঁধা দেওয়ার জন্য সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। সাধারণতঃ এই সময়ে পুলিশ কি করে? প্রথমে ঘোষনা দেয় থামার জন্য, তাতে কাজ না হলে কাঁদানে গ্যাস, তাতে না থামলে লাঠি চার্জ এবং সবশেষে গুলী। কত লোকের প্রাণ যায়, কত লোক আহত হয়, কত জিনিষের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এইবার ভেবে দেখো যদি পুলিশের হাতে এই ক্যাসেটটা থাকে, তাহলে কত সহজে সব কিছুর সমাধান হবে। পুলিশ শুধু একবার মাইক বাজিয়ে ঘোষনা দেবে, ভাইসব আপনারা আর এগোবেন না। যদি এই সতর্কবানীর পরেও আপনারা না থামেন, তাহলে আমরা নাসিকা-নির্যাতনের ক্যাসেট বাজাতে বাধ্য হবো। দেখা যাবে মুহুর্তের মধ্যে ময়দান ফাঁকা হয়ে যাবে। কোন গুলী খরচা নেই, কোন কাঁদানে গ্যাস মারতে হবে না। কমপ্লিট নন-ভায়োলেন্ট উপায়ে এবং বিনা ঝামেলায় সমস্যার সমাধান। নাসিকা নির্যাতনের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। ইউরোপ আমেরিকা থেকে অর্ডার আসবে। উই উইল বী রিচ, ফিলদি রিচ।"
বাবু বরাবরই সরল সোজা প্রকৃতির ছেলে। সে এতক্ষন চোখ বড়বড় করে শুনছিল মিতুলের কথা।
"তুই ঠিক বলছিসতো মেজ আপা? জাস্ট দুলাভাইয়ের নাক ডাকার শব্দ বেচে আমরা বড়লোক হয়ে যাব?"
"অফকোর্স। ক্যাসেটটা একবার বাজারে ছাড়তে পারলেই আর দেখতে হবেনা। দেখবি লোকে বাড়ির সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেনার জন্যে। এই দেশের আইনকানুনও দেখবি বদলে যাবে। যেমন ধর, এখন চুরি করলে শাস্তি হয় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড, তখন শাস্তি হিসেবে চোরবাবাজিকে একনাগাড়ে পাঁচদিন নাসিকা-নির্যাতনের টেপটা শোনানো হবে। এই শাস্তির পর সে আর জীবনে কোনদিন চুরির নাম করবে না। এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের জেলখানাগুলো দেখতে দেখতে ফাঁকা হয়ে যাবে। তাতে সরকারের কত পয়সা বেঁচে যাবে। সেই টাকা দিয়ে গরীব-দুঃখীর কত উপকার করা যাবে। নাহ- যতই ভাবছি ততই দেখি দুলাভাইয়ের নাসিকাগর্জনের নতুন নতুন উপকারিতা বেরুচ্ছে। এক নাক ডাকার আওয়াজেই পয়সা উপার্জন এবং বিশ্বশান্তি অর্জন দুইই হয়ে যাবে। শেষমেশ নোবেল প্রাইজও জুটে যেতে পারে। দুলাভাই- শুভকাজে বিলম্বের কোন প্রয়জোন নেই। আজ রাতেই আপনার বিখ্যাত নাসিকা ধ্বনিকে টেপ করা হবে। আপনি ভালভাবে পেট পুরে খেয়ে, নাকে বিশুদ্ধ সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাতে যাবেন। নাক ডাকা শুরু হলেই আমরা আমাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে যাবো। বাবু, তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে বেশ ভাল দেখে একটা ক্যাসেট কিনে নিয়ে আয়। আমি পাশের বাসার মিলি ভাবীদের টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে আসছি। এখন দুলাভাই আপনি বলুন, আপনার পার্সেন্টেজ কত হবে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে টোয়েন্টি-ফাইভ পার্সেন্টের বেশী দেবনা, পরে আবার চিন্তা করে দেখলাম যে আপনার ফর্টি পার্সেন্ট পাওয়া উচিত্, আফটার অল আপনিই তো নাসিকা-নির্যাতনের মূল স্টার। বাদবাকীটা আমরা ভাইবোনে ভাগাভাগী করে নেব। আপা কিন্তু আমাদের ভাগে নেই, কেননা সে এখন আপনার ইস্ত্রী। তাকে যা দেবার আপনি দেবেন। কি, এতে আপনি রাজী? রাজী থাকলে তিনবার বলুন কবুল, কবুল কবুল।"
তিনি এতক্ষন কোন কথা বলেননি। সাধারণতঃ তিনি স্বল্পভাষী, আর নতুন শ্বশুরবাড়ীতে তো বেশী কথা বলার প্রশ্নই আসেনা। তিনি চুপ করে শুনছিলেন মিতুলের কথাগুলো। যদিও বাইরে প্রকাশ করেননি, কিন্তু মিতুলের দীর্ঘ পরিকল্পনার প্ল্যান শুনে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এত তাড়াতাড়ি যে কেউ এত সুন্দর এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে কথা বলতে পারে, তা তিনি আগে কোনদিন দেখেননি।
সুলতানা একটু বিব্রত হয়েছিলেন মিতুলের বাড়াবাড়ি দেখে, নাকডাকার কথাটা তোলা বোধহয় ঠিক হয়নি। বিয়ের অল্পদিন পরেই তিনি স্বামীর গাম্ভীর্যকে টের পেয়েছিলেন। সুলতানা বুঝেছিলেন যে মানুষটি আর দশজনের মতো নয় যারা শ্যালক-শ্যালিকাদের সাথে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা হাসি-ঠাট্টা করতে পারে। মিতুল সব সময়ই বেশী কথা বলে, তবে আজকে বোধহয় একটু সীমা অতিক্রম করা হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষের দুর্বলদিক নিয়ে বেশী হাসিঠাট্টা করতে নেই।
তিনি তাই মৃদু ধমক দিলেন মিতুলকে, " তুই চুপ করতো। তোর লঘুগুরু জ্ঞানটা সবসময়ই কম, আর মাত্রা ছাড়িয়ে হাসিঠাট্টা করা ঠিক না। যা তোরা এখন শুতে যা, রাত অনেক হয়েছে।"
মিতুল মুখ নামিয়ে বলেছিল, "সরি দুলাভাই। আমি এমনই একটু মজা করছিলাম, বাট আই পসিব্লি গট ক্যারিড আ্যওয়ে।"
ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগ মুহুর্তে পেছন ফিরে তাকিয়েছিল মিতুল।
"এটা কিন্তু আপনাকে স্বীকার করতেই হবে দুলাভাই যে আই ওআজ গুড। আপা বাগড়া না দিলে আপনাকে মোটামুটি রাজী প্রায় করিয়ে এনেছিলাম। চল বাবু, আমরা যাই।"
বাবু গোটা ব্যাপারটা ঠিক ধরে উঠতে পারেনি। "ক্যাসেট কেনার কি হবে মেজ আপা?"
"পরে হবে।" বাবুর হাত টেনে চলে গিয়েছিল মিতুল।
সুলতানা মুখ কাঁচূমাচূ করে স্বামীকে বলেছিলেন,"তুমি মিতুলের কথায় কিছু মনে কোরনা। ও একটু পাগল প্রকৃতির,কথা বলা একবার শুরু করলে আর থামতে পারেনা। তোমাকে নিয়ে কি সব একগাদা হাবিজাবি কথা বলে গেল।"
তিনি কোন কথা বলেননি, শুধু অল্প হেসেছিলেন। সুলতানা তাতে নিরুত্সাহ হননি।
"না না তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছোনা। ওকে তুমি চেননা। ও আমার মায়ের পেটের বোন, ওর প্রতি হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি। লঘুগুরু জ্ঞান নেই, যাকে যা ইচ্ছা তাই বলে ফেলে। আব্বার আশকারা পেয়ে ও একদম মাথায় উঠেছে। তুমি ওকে একদম পাত্তা দিওনা। বরঞ্চ একদিন একলা ডেকে আচ্ছা করে বকে দিও। মুখে যাই বলুকনা কেন, ও কিন্তু তোমাকে আসলে খুবই ভয় পায়।"
"তুমি তিলকে তাল করছো সুলতানা। মিতুল শুধু মজা করার জন্য কথাগুলো বলেছে। আমি আসলে বেশ ইম্প্রেসড হয়েছি তার বুদ্ধি দেখে। তার কল্পনাশক্তি খুব ভাল, তার উচিত্ গল্প লেখা । আমি তাকে বলবো সে যেন তার এই ক্ষমতাটির নিয়মিত চর্চা করে। তোমাদেরও উচিত্ তাকে এই ব্যাপারে উত্সাহ দেয়া।"
সুলতানা একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীর এই মন্তব্যে। তিনি এই ব্যপারে আর কথা বাড়াননি। পরদিন দুপুরবেলা মিতুল এসেছিল তার ঘরে।
"দুলাভাই, মাপ চাইতে এলাম।"
বিছানায় আধশোয়া হয়ে তিনি একটা ল' জার্নাল পড়ছিলেন। ফিরে গিয়ে কয়েকটা মামলার শুনানী আছে। মিতুলকে দেখে তিনি উঠে বসলেন।
"এসো মিতুল।"
"আপা বললো আপনার কাছে মাপ চাইতে। কাল রাতে আমি বোধহয় একটু বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।"
"তোমার আপা আমার মানসম্মান নিয়ে খুব চিন্তান্বিত, তাই এই কথা বলেছে। তোমার কাল রাতের পারফরমেনস খুবই চমত্কার ছিল। আমি নিজেই ভয় পাচ্ছিলাম যে তোমার আপা আবার শাড়ী-গয়নার দাবীতে আমার নাকডাকার ক্যাসেট দিয়ে আমাকেই শেষে ভয় না দেখায়। মাপ চাওয়ার মত কোন অপরাধই তুমি করোনি।"
"তার মানে আপনি রাগ করেননি।"
"না, রাগ করিনি।"
"তাহলে একটা প্রশ্ন করি দুলাভাই?"
"করো।"
"আপনি সবসময় এত গম্ভীর হয়ে থাকেন কেন? আপনাকে অনেক বয়সী লাগে দেখতে।"
"আমার চেহারাটাইই অমনি।"
"মোটেওনা। আপনি সবসময় হাসি হাসি মুখ করে থাকবেন, দেখবেন কত ভাল লাগবে দেখতে।"
"বেশী হাসলে সমস্যা আছে মিতুল। শেষে কোর্টে গিয়ে আসামীকে জেরা করতে গিয়ে হয়ত হেসে ফেলব। মুখ রাগী রাগী না করলে আসামীরা ভয় পাবেনা।"
"সে আপনি কোর্টের রাগী রাগী চেহারা কোর্টেই রেখে আসবেন। আমাদের সামনে হাসি হাসি মুখ করে থাকবেন। আপনাকে সবাই ভয় পায় দুলাভাই। এমনকি আব্বা আম্মাও।"
"সেকি, কেন?"
"আয়নায় নিজের ভুরু কুঁচকানো চেহারা দেখে আপনি নিজেও ভয় পাবেন। বিশ্বাস না হলে এক্ষুনি বাথরূমে গিয়ে দেখে আসুন।"
"আইনের নথিপত্র পড়তে পড়তে আমার ভুরুজোড়া পার্মানেন্টলি কুঁচকে গেছে মিতুল। ও আর এ জীবনে সোজা হবেনা। অনেকটা দেশী কুকুরের লেজের মত।"
মিতুল হেসে ফেলেছিল সে কথা শুনে। "আপনি শুধু অকাজের কথা বলেন দুলাভাই।"
সুলতানা বিকেলের চা নাস্তা হাতে ঘরে ঢুকেছিলেন।
"এই- তোকে যে কথা বলতে বলেছিলাম, বলেছিস?"
"কোন কথা?"
"আমার সাথে ন্যাকামী করোনা মিতু। তোকে মাপ চাইতে বলেছিলাম, মাপ চেয়েছিস?"
তিনি সুলতানার কথায় ঈষত্ বিরক্ত হয়েছিলেন সেদিন। আস্তে আস্তে বলেছিলেন, "ছোট্ট একটা ব্যাপার নিয়ে এত কচলানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা।"
যদিও তার কণ্ঠস্বরে মেঘগর্জনের মত কোন গাম্ভীর্য ছিলনা, তবুও মুহুর্তের মধ্যে ঘরের পুরো আবহাওয়াটাই যেন বদলে গিয়েছিল। সুলতানার হাতের চা ছলকে পড়লো পিরিচে, মিতুল মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তিনি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। কতদিন আগের কথা, অথচ মনে হয় এইতো সেদিন।
এতক্ষনে ঘরের আধারের সাথে তার চোখ মানিয়ে নিয়েছে। এখন তিনি সবকিছুই দেখতে পারছেন। জিরো পাওয়ারের বাতির নীলাভ আলোর কুয়াশার মধ্যে প্রতিটি জিনিষই অন্যরকম মনে হচ্ছে। দেওয়ালের পাশের ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতে প্রতিফলিত হচ্ছে আলো। এটি তাদের বিয়ের উপহার। মনে আছে বিয়ের সময় তিনি ভীষন আপত্তি করেছিলেন জিনিসপত্র দেয়া নিয়ে। সরাসরি বলেছিলেন,"আমার সামর্থ্য থাকলে সবই হবে। যৌতুক নেবনা।"
শুধু শ্বাশুড়ী হাত ধরে বলেছিলেন, "বাবা, তোমার সব কথা মানছি, শুধু তুমি এই ড্রেসিং টেবিলের বেলায় আপত্তি করোনা। সুলতানা খুব সাজতে পছন্দ করে, এটা ওর নাম করেই বানিয়েছি। তোমার যদি ডিজাইন পছন্দ না হয়, তাহলে অবশ্য অন্য কথা।"
তিনি সেদিন সে কথা ফেলতে পারেননি। ক্রমে ক্রমে ড্রেসিং টেবিলটা তাদের সংসারের একটা অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে গিয়েছে। সুলতানা বহুবার পালটাতে চেয়েছে, কিন্তু তিনিই বলেছেন, "থাকুক না, আমার কাছে ভালই লাগে।"
পুরনো চিন্তাটা আবার ফিরে এল। কোনদিন যা হয়নি, আজকে সেটা হলো কেন? কেন এই গভীর রাতে তার ঘুম ভাংলো? কেন আজকে তিনি স্মৃতির ধূলিধূসর চিলেকোঠার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছেন? এই সুদীর্ঘ জীবনে অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এসেছেন তিনি, কত আনন্দ, কত বিষাদ। মেয়ে তুলির যেদিন বিয়ে হলো, সেদিন গোপনে কতবার কেঁদেছিলেন, গভীর বেদনায় বিদ্ধ হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে রাতের ঘুম তার ব্যাহত হয়নি। পরদিন সুলতানা বলেছিলেন,"তোমার বুকে আল্লাহ কোন মায়া-দয়া দেয় নাই। মেয়েটা কোথায় কার সংসারে চলে গেল, আর তুমি দিব্যি নাক ডেকে ঘুমালে।"
যেদিন পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার খবর নিয়ে মাহমুদ তাকে সালাম করতে এসেছিলো, সেদিনও রাতে তার ভাল ঘুম হয়েছিল। অথচ, এই পৃথিবীতে সে রাতে তার মতো সুখী ব্যক্তি আর কেউ ছিলনা। অবাক হয়ে বারবার সেদিন তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এতবড় হয়ে গেছে মাহমুদ! মাথার চুল এখনো তো সেই আগের মতোই এলোমেলো, নত চোখে লাজুক দৃষ্টি। সৃষ্টিকর্তাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
মাহমুদ খবরটা দিয়ে চুপ করে সামনে বসেছিল। তার সামনে কেউই খুব একটা কথা বলেনা কখনো। দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়মই চলে আসছে। তার রাশভারী চেহারার সামনে কেউই কখনো সহজ হতে পারেনি। তিনিও একই ভাবে চিরকাল কঠিন একটা দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন নিজেকে। আদালতে আসামীদের সাথে গম্ভীরতার অভিনয় করতে করতে নিজের অজান্তে কখন যেন সেটাই আসল চেহারা হয়ে গিয়েছে। নিজের অনুভূতির অংশীদারীত্ব দিতে হয়নি কাউকে, কেউ নিতেও আসেনি। সুলতানাও আস্তে আস্তে সন্তান-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বহুবছর আগে ছাত্রাবস্থায় পড়া একটা কবিতার লাইন মনে পড়লো তার,
"পুরুষ নামের অর্থ ভীষন একা
বটের চারা পুরনো কার্নিশে "
হয়তো তাই সত্যি। একাকীত্ব নিয়ে তাঁর অবশ্য কোন নালিশ নেই। মনে হয় এইই ভাল, সংসারের নানান খুচরো জিনিষপত্র নিয়ে কখনোই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। নিজের কাজ নিয়েই মেতে ছিলেন সারা জীবন। মামলার পর মামলা, শুনানীর পর শুনানী। আইনজীবির পেশাটাও এই কারণেই তার পছন্দ। তার মত কাজপাগলা মানুষের জন্য উপযুক্ত পেশা। ছুটির দিনেও মক্কেল সাজিয়ে বসেছেন চেম্বারে। সুলতানা মাঝে মাঝে বলেছে বিশ্রাম নিতে, তিনি সে কথায় হেসেছেন মনে মনে।
কাজই তার জন্যে বিশ্রাম। বিনা কাজে বসে থাকবার মত কষ্টকর জিনিস তার কাছে আর কিছু নেই। তার শ্রমের মুল্যও তিনি পেয়েছেন, সাফল্য এসেছে সাড়ম্বরে। ছোট এই মফস্বল শহরে তিনি একজন মানী ব্যক্তিত্ব। আলী আসগর সাহেবের নাম সবাই জানে। কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রকল্পেও তিনি জড়িত ছিলেন। ল' কলেজে পড়িয়েছেন নামমাত্র বেতনে। "পরকে করলি আপনরে তুই, আপন করলি পর।" ছেলেবেলায় শোনা শুকুর আলী বয়াতীর গান নতুন অর্থ নিয়ে সত্যি হয়েছে তার জীবনে।
আলী আসগর সাহেব এবার বিছানা থেকে উঠলেন। এই নিস্তব্ধ রাতে হঠাত্ কেন তার ঘুম ভাংলো, এই রহস্যের সমাধান তিনি এখনো করতে পারেননি। কিছু কি ঘটেছে কোথাও, কিছু কি ঘটবে?
সুলতানার দিকে তাকালেন তিনি একবার। সে এখনো নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। গায়ের পাতলা চাদরটা সরে গয়েছে একপাশে, মাথাটা একটু কাত হয়ে আছে। এমনভাবে আগে কোনদিন তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাননি। আজ তাকিয়ে একটু মায়া অনুভব করলেন। তিনি কি অবিচার করেছেন সুলতানার প্রতি? ছেলেমেয়েদের প্রতি? কাজের ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে তিনি কি এড়িয়ে গেছেন সবাইকে? আজ কি তাই এই গভীর রাতে একমাত্র একাকীত্ব ছাড়া আর কোন সংগী নেই তার?
হঠাত্ করেই তিনি একটু অবাক হলেন নিজের প্রতি। নিজেকে তিনি চিরদিনই কঠোর এবং অনুশাসনপ্রিয় বলে ভেবে এসেছেন। তার জীবনে আবেগের কোন স্থান কখনোই ছিলনা। এইসব কথা আজকে মনে হচ্ছে কেন তার? আজ রাতে যার ঘুম ভাংলো সে মানুষটিকে বড় অচেনা লাগছে। শহরের বিখ্যাত ক্রিমিন্যাল ল'ইয়ার আলী আসগর সাহেবের উপর আজ কি তাহলে কোন কিছু ভর করলো? জানালার বাইরের রাস্তার মত সরল এবং একাকী জীবন কেটেছে তার। আজ সে জীবনকে বড় আঁকাবাঁকা মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে অনেক ভুলে ভরা ছিল সে জীবন।
আবার মিতুলের কথা মনে পড়লো তার। মনে পড়লো সেদিন নতমুখে তার প্রস্থানের কথা। সেবার শ্বশুরবাড়ী থেকে ফিরে আসবার কিছুদিন পরই মিতুলের বলাড ক্যানসার ধরা পড়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ মামলা সামলে তার যেতে কয়েকদিন দেরী হয়েছিল। হাসপাতালে মিতুলকে দেখে চোখে পানি এসেছিল তার। মহাব্যাধি নিষ্ঠুর থাবায় তার জীবনীশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকা মিতুলকে চেনাই যাচ্ছিল না।
বিকেলের রোদের লালচে আলো পড়েছিল তার বিষাদময় মুখে। আশ্চর্য্য- মিতুল সেই অবস্থায়ও ঠাট্টা করেছিল, "আপনার নাক ডাকা কমেছে দুলাভাই?"
"তুমি কথা বলোনা মিতুল।"
"কেন দুলাভাই? ভয় পাচ্ছেন যে আজকেও আমি আপনাকে নিয়ে ঠাট্টা করবো? বেশী কথা বলবো? না, আমি আজকে বেশী কথা বলবোনা। আর বললেও আমি জানি আজকে কেউ আমাকে বকবেনা। কি ঠিক বলিনি?"
পাশে দাঁড়ানো সুলতানা চোখে আঁচলচাপা দিয়েছিল। তিনি কোন কথা বলতে পারেননি। কি অপরাধ করেছিল এই মেয়েটি ?
"আপনার নাক ডাকাটা শোনা হলোনা দুলাভাই। বড় ইচ্ছে ছিল।"
"কেন শোনা হবেনা মিতুল? আগে ভাল হয়ে নাও। আমার শ্রেষ্ঠ নাক ডাকাটা তো আমি তোমার জন্য জমিয়ে রেখেছি। এ কয়দিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে মহা প্র্যাকটিস করেছি। তোমার আপাও শোনেনি এই নাসিকা ধ্বনি। এই শব্দ একবার শুনলে তুমি আর জীবনে ভুলতে পারবেনা। এ হচ্ছে ক্ল্যাসিক্যাল নাক ডাকা । একদম ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ স্ট্যান্ডার্ডের।"
মিতুল সে কথায় খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। "আপনি খুব মজার মানুষ দুলাভাই।"
তিনদিন পর ফজরের আজান শুনতে শুনতে মিতুল মারা গেল। "আস্ সালাতু খাইরুম মিনান্ নাউম।" নিদ্রা হইতে নামাজ উত্তম। পবিত্র প্রত্যুষে সবাই জেগে উঠে দেখলো মিতুল ঘুমিয়ে গেছে। চিরকালের জন্যে।
আলী আসগর সাহেব আবার বিছানায় এসে বসলেন। নিস্পলকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন সুলতানার মুখের দিকে। বুকের মধ্যে কি যেন আড়মোড়া ভাংছে। তিনি ভাল বুঝতে পারলেন না। দুঃখময় একটি গানের সুর যেন বাজছে কোথাও। গোলাপের পাঁপড়ির মত আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে একটি যন্ত্রণা বুকের বাঁ দিকে। ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে।
আলী আসগর সাহেব উপরের দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন,"তুমি কি আমাকে ডাকছো ঈশ্বর?" ব্যথায় তার চোখে পানি এলো।
সুলতানার গালে তিনি সন্তর্পনে হাত রাখলেন। কি নরম স্পর্শ। প্রচন্ড যন্ত্রণার মধ্যেও তার হঠাত্ হাসি পেল। এতদিন পর এই প্রথম তিনি চুরি করে স্ত্রীর মুখস্পর্শ করলেন। আজ তার বড় ভালবাসতে ইচ্ছে করছে।
তিনি আস্তে আস্তে ডাকলেন," সুলতানা, সুলতানা।"
সুলতানা ধড়মড় করে জেগে উঠলেন। মুখের উপর স্বামীর যন্ত্রণাক্ত চেহারা দেখে আতংকে চেঁচিয়ে বললেন,"কি হয়েছে?"
আলী আসগর সাহেব ফিস ফিস করে বললেন," ওদের খবর দাও। আমার শরীর ভাল লাগছেনা।"
সুলতানা চিত্কার করে কেঁদে ফেললেন।
মন্তব্য
অনেকদিন আগে লেখাটি শুরু করেছিলাম। কয়েকটি পর্ব এখানে পোস্ট করে দেখি আপনাদের কেমন লাগছে। উত্সাহ পেলে সামনে এগোবো। না পেলে ঘ্যাচাং!
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
ঘ্যাচাং এর মত অলুক্ষণে কথা মুখেও আনবেন না...
ভাল লাগছে... চলুক...
=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
LoVe is like heaven but it hurts like HeLL
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
চালায়া যান গুরু...
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
এত চমত্কার আপনার লেখার ভঙ্গি! দারুন লাগলো। আসগর সাহেবের স্মৃতিচারনের সময় আমিও তার সাথে সাথে মনে হচ্ছিলো সব মানুষ,সব মুহূর্ত গুলোকে স্পস্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।খুব ভাল লাগলো।কোন জটিলতা নেই।আরাম করে পড়া যায়।মিতুলের জন্য কেমন জানি খারাপ লাগার আর কষ্টের একটা অনুভূতি ভেতরে কাজ করছে।
আপনি অতি অবশ্যই চালিয়ে যাবেন উপ্ন্যাশ টা।
এই অনুরোধ রইল।
--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
একটানে পড়লাম। ভালো লাগলো।
আমারও একই কথা। ঘ্যাচাং এর চিন্তা বাদ দিয়ে চালিয়ে যান।
আগামীবার আপনার বই চাইই চাই
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
কোনও ভাবাভাবির দরকার নেই। চলুক উপন্যাসের পর্ব..
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করবো ।
আপনাদের সবার সুচিন্তিত (?) মতামত পড়িলাম । তাহাতে সম্মুখে অগ্রসর হইবার পরামর্শই প্রতীয়মান। মনে রাখিবেন যে কাহাকেও বৃক্ষে তুলিয়া মই কাড়িয়া লওয়া উচিত্ কর্ম নয়। আমি বোকাসোকা মানুষ, তাই আপনাদের উপদেশ মোতাবেক আরও কিছু পর্ব পোস্ট করিব ভবিষ্যতে। আশাকরি আপনাদেরকে আমার সহযাত্রীরূপে পাইবো।
এই পর্বটি পড়িবার জন্য ধন্যবাদ জানাই।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
জাহিদ ভাই পরীক্ষার পর তাড়ায়ে তাড়ায়ে পড়ার জন্য এই লেখাটা রেখে দিলাম। কালকেই আরেকটা পর্ব ছাড়েন। তাহলে একসাথে দুইটা পরে সুখ নেয়া যাবে...
পড়ছি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
- জোশ। পরের পর্বের আশায়- আইজুদ্দী
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন