অণুগল্প-৩। আয়ে না বালাম।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৪/২০০৮ - ১০:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিকেল চারটে কুড়ি। আর দশ মিনিট বাকী।

গলিটার শেষে জুম্মনের চা-বাখরখানির দোকান। বাপ কোহিনূর কারিগরের হাতে গড়া দোকান। এই দোকানের বাখরখানির খ্যাতি বহু পুরানো। আছে কুখ্যাতিও। দোকানটির ঠিক উলটোদিকেই শহরের বেশ্যাপল্লীটি। লোকেরা বলে নটীপাড়া।

কোহিনূর কারিগরের আমলে রাত হলেই শহরের নামকরা লোকেরা এসে ভিড় জমাতেন এই নটীপাড়ায়। তাদের জন্যে খাঞ্চা ভরে বাখরখানি পাঠাতে হোত ভিতরে, সাথে কেটলীভর্তি চা। বখশিসের টাকা গুনতে গুনতে বাচ্চা জুম্মনের হাত ব্যথা হয়ে যেত।
এখন নটীরাই বড়লোকদের বাড়ীতে যায়। গোটা শহরই এখন একটা বেশ্যাখানা।

ঘ্যাঁচ করে সাদা গাড়ীটা দোকানের সামনে দাঁড়ায়। তাহলে এখন সাড়ে চারটে বাজে। প্রতি শুক্রবার বিকেলে এই জিনিসই হয়ে আসছে গত আট-নয় মাস ধরে।

গাড়ী থেকে নামেন একজন দীর্ঘকায় মানুষ। বয়েস পঞ্চাশ এর উপর হবে। মাথা নীচু করে ভদ্রলোক সোজা কোণার টেবিলে গিয়ে বসেন। যা বলার সেটা তিনি প্রথম দিনেই বলেছিলেন। আধাঘন্টা পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে বাখরখানি আর চা খাবেন তিনি। তারপর নিঃশব্দে চলে যাবেন।

টেবিলে পড়ে থাকবে একটা চকচকে পাঁচশো টাকার নোট।

"সা-রে-গা-মা।"
সহসা ভেসে আসে একটি সুরেলা কণ্ঠ। গলা সাধছে রত্না নটী। এতো বয়েস হয়েছে কিন্তু তার গলাটি যেন রয়ে গেছে কিশোরী বয়সের মতোই। যে জানেনা তার হয়তো মনে হবে যে কোন একটি কম বয়সী মেয়েই হয়তো গাইছে।

কার মেয়ে দেখতে হবে না? এক সময়ের সেরা বাঈজী মুক্তার মেয়ে এই রত্না। মেয়েটি মায়ের রূপ পায়নি কিন্তু পেয়েছে তার কিন্নরকণ্ঠটি।

দু হাতের উপর মুখ রেখে পাথরের মূর্তির মতো ভদ্রলোক গান শোনেন। রত্নার গলা সাধা শেষ। এখন সে গাইছে "বাবুল মোরা"। প্রতিটি শব্দের সাথে যেন বেদনায় কেঁদে উঠছে আকাশ বাতাস। কি গলা! কি অপরূপ সুরের কারুকাজ।

পকেট থেকে রুমাল বের করে ভদ্রলোক চোখ মোছেন। পরিচিত দৃশ্য, প্রতিবারই হয় এটা।
গানের পর গান। রাগের পর রাগ। বিস্তার, আলাপ, তান, মীড় সব মিলে মিশে এক হয়ে যায়।

সবশেষের গানটি ধরে এবার রত্না। "আয়ে না বালাম, ক্যা করুঁ সাজনী।"
ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলীর বিখ্যাত গান। এই গানটি রত্না সব সময় বিশেষ দরদ দিয়ে গায়। এই গান শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। পাথরের গায়েও যেন ফুটে ওঠে ফুলের বাহার।

শেষের কথা গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায় রত্না। বাপরে-কি কাজ গলায়! বিরহ যাতনা আর যেন সয়না মেয়েটির। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই গানটি শুনছে জুম্মন। তাও তার আশ মেটেনা। আহারে-কত কষ্ট রত্নার! কোন সে কঠিন হূদয় ভালবাসার লোক? মুক্তা নটীও এমনি কেঁদে কেঁদে গানটি গাইতো।

গাড়িতে বসে ভদ্রলোক সিটে গা এলিয়ে দেন। চোখ দুটো কান্নায় লাল। কিন্তু তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। চোখ বন্ধ করে তিনি এখন তার বাবার কথা চিন্তা করছেন।

মৃত্যুশয্যায় বাবা তার দুটি হাত ধরে বলেছিলেন,"আমার যাওয়ার সময় হইছে। একখান কথা কোনদিন কই নাই। আজ কই।"
ফিসফিস করে বৃদ্ধ বলেছিলেন,"তোর এক বড় বইন আছে। কোনদিন কই নাই। তার নাম রত্না। রত্না নটী। মুক্তা নটীর মাইয়া রত্না নটী।"
তিনি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। ঝরঝর করে কাঁদছিলেন বৃদ্ধ। "আমার বড় পাপ হইছে রে বাপ। মুক্তার গান শুইনা আমি দিওয়ানা হইছিলাম। আহা সে কি গলারে বাপ। তুই শুনলে বুঝতি। কিন্তু রত্না পেটে আসার পর আর ওগো কোন খবর নেই নাই। বড় গুনাহ হইছে আমার, রোজ হাশরে আমি মুখ দেখামু কেমনে?"

ভদ্রলোক রুমালে চোখ মোছেন আবারো। ফিস ফিস করে বলেন,"রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগিরা।"
"হে প্রভু, তুমি আমার পিতামাতার প্রতি করুনা বর্ষণ করো, যেমন মমতা তারা আমাকে শিশু অবস্থায় দিয়েছিল।"


মন্তব্য

স্বপ্নাহত এর ছবি

অনেক ভালো লাগলো।

এবারের গল্পে একটু অন্যরকম স্বাদ পেলাম যেন...

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

দারুন লাগলো !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পরিবর্তনশীল এর ছবি

শেষটায় এসে ভালো লাগাটা আরো বেড়ে গেল!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

নজমুল আলবাব এর ছবি

মুগ্ধতা জাগানিয়া আরেকটা গল্প

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

অতিথি লেখক এর ছবি

কোথায় যেন একটা করুণ সুর বাজছে।
থামাতে পারছি না।

--------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আয়ে না বালাম গানটার লিংকটা দিয়ে দিতেন, শুনতাম।
লেখাটা ভালো লাগানিয়া।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

জাহিদ হোসেন এর ছবি

ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের গাওয়া গানটি দিলাম। কেমন লাগবে আপনাদের জানিনা।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ভয় পাচ্ছিলাম, এই না ভদ্রলোককে রত্নার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। হয়নি, সেখানেই গল্পের আবেদন বেড়েছে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

কি আশ্চর্য্য! আমি এই ভাবনাটি নিয়ে দুরু দুরু বুকে আগাচ্ছিলাম - কখন এই ২ জন মুখোমুখি হবে। হয় নাই। ভালো লেগেছে!
ফাটাফাটি গল্প।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- লেখকের জায়গায় কি ধুসর গোধূলিরে দেখছেন নিকি যে দেখা টেখা করাইয়া একটা ভূনাখিচুরি অবস্থা রাইন্ধ্যা ফেলবো!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

জাহিদ হোসেন এর ছবি

চা-বাখরখানির কথা লিখতেই খিদে পাচ্ছিল। এখন ভুনাখিচুড়ীর কথা শুনে তো আরো অবস্থা খারাপ।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

দ্যাটস ইট? সমালোচনা কই?
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍গল্পটা ভালো লাগলো।
কিন্তু "আয়ে না বালাম" মানে কী রে ভাই? (হিন্দি/উর্দু ভাষায় আমার দখল ঈর্ষণীয় কি না!)

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

জাহিদ হোসেন এর ছবি

"আয়ে না বালাম" অর্থ খুব সম্ভতঃ "আমার প্রিয় আসছেনা" জাতীয় কিছু একটা।
ধূসর গোধুলীর অনুরোধে একটা লিংক দিয়েছি উপরে। ওখানে গেলে আসল গানটি শুনতে পাবেন, সাথে পাবেন গানট‌ির ইংরেজী অনুবাদ, গায়কের সম্পর্কে দু-চারটে তথ্য, এবং কিছু ছবি।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ফিসফিস করে বৃদ্ধ বলেছিলেন,"তোর এক বড় বইন আছে। কোনদিন কই নাই। তার নাম রত্না। রত্না নটী। মুক্তা নটীর মাইয়া রত্না নটী।"

গল্পটা এই জায়গায় শেষ করে দেন না স্যার
পরের স্পেসটুকু রেখে দেন পাঠকের চিন্তার জন্য
তাহলে গল্পটা একটা দুর্দান্ত জায়গায় পৌঁছে যাবে

জাহিদ হোসেন এর ছবি

ছেলেবেলায় হাত দেখে একজন বলেছিলেন,"হুমম, তোমার ভাগ্যরেখা শনির ক্ষেত্র অতিক্রম করেছে। খারাপ, খুবই খারাপ।"
এর মানে নাকি আমি কোথায় থামতে হবে তা জানিনে।

আপনার সাজেশনের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। দেখি চিন্তা করে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মাল্যবান এর ছবি

আমি মাহবুব লীলেনের সাথে একমত।

ফারুক হাসান এর ছবি


----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

বেশ ।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

মাল্যবান, ফারুক হাসান এবং শিমুল- আপনাদেরকে ধন্যবাদ লেখাটি পড়বার জন্য।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

শেখ জলিল এর ছবি

দারুণ লাগলো। পদ্য ছেড়ে আজকাল গদ্যের ভক্ত হয়ে যাচ্ছি।
......এরকম গল্প পড়েই কি!?

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

বলেন কি? আমি কোথায় আপনার কবিতা পড়ে ভাবছি যে এবার গদ্য-টদ্য বাদ দিয়ে দেব। এই প্রসংগে মাহবুব লীলেনের একটি কথা আমার খুবই মনে ধরেছিল। উনি বলেছিলেন একটি কবিতার লাইন কালজয়ী হয়, কিন্তু গদ্যের কোন লাইন কালজয়ী হয়না। দু একটা ছাড়া। যেমন, "পথিক-তুমি কি পথ হারাইয়াছো?"
লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।