গল্প। স্বপ্নপূরণ।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: মঙ্গল, ২২/০৪/২০০৮ - ১১:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরের মধ্যে বসেও ডেভিড ওয়াইলড ঘামতে শুরু করলেন।
তিনি সিয়াটল শহরের নামকরা হোম বিল্ডার জন এন্ডারসন এ্যান্ড এসোসিয়েট্‌স্‌ ইনকরপোরেটেড এর ডিজাইন ম্যানেজার। গত পনেরো বছর ধরে তিনি এই শহরে বহু বাড়ী তৈরী করেছেন লোকেদের পছন্দ অনুযায়ী। একতলা বাড়ী, দোতলা বাড়ী, বেসমেন্টসহ বাড়ী, সুইমিংপুল সহ বাড়ী, ক্যাসেল ডিজাইন বাড়ী, রাজপ্রাসাদের মত বাড়ী। তাদের ফার্মের তৈরী বেশ কয়েকটি ডিজাইন ভাল বাড়ীর নমুনা হিসেবে আর্কিটেকচারের ছাত্রদের সিলেবাসে আছে। এত জল ঘাঁটার পরেও আজকে খুবই ছোটখাটো একটি বাড়ীর ডিজাইন করতে গিয়ে তিনি ঘেমে যাচ্ছেন।

তার পেরেশানীর কারণ তার সামনেই বসে আছে। বাঙালী এক দম্পতির বাড়ীর ডিজাইন করছেন তিনি। আজকাল তিনি প্রাইভেট ক্লায়েন্টদের কাজ করেন না। এ জাতীয় কাজগুলো সাধারণতঃ আরো জুনিয়র আর্কিটেক্টরা করে। ফাইনাল ডিজাইন দেখে তিনি শুধু সই করেন। কিন্তু তার বর্তমান স্ত্রীর সাথে বাঙ্গালী মহিলাটির খুব ভাল বন্ধুত্ব বলে তিনি তাদের কাজটি নিজেই করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন।

এখন দেখা যাচ্ছে এ সিদ্ধান্তটি ভাল হয়নি। দম্পতিটির নানা রকম বায়না, নানা রকম পরিকল্পনা। তার মাথা ঝিমঝিম করছে, একটা এ্যাস্পিরিন খেলে ভাল হোত।

সামনে বসা দম্পতিটিও কিছুটা বিরক্ত মুখে বসে আছে। গত দেড় ঘন্টা ধরে তারা তিনজনে মিলে বাড়ীর প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করেছে। টেবিলের উপর খুলে রাখা বাড়ীর ব্লু প্রিন্টের উপর সহস্র লাল কালির কাটাকুটি। ভদ্রলোকের নাম রায়হান ইউসুফ, মহিলার ভাল নাম ডেভিড ভুলে গেছেন। তার স্ত্রী মহিলাকে মিরি বলে ডাকেন, বোধহয় এটা তার ডাকনাম।

রায়হান একটু ক্লান্ত স্বরে বললো,"মিস্টার ওয়াইলড, তোমাকে বোধহয় আমি ব্যাপারটি বোঝাতে পারছিনা। আমরা বাড়ীটি আমাদের দেশী স্টাইলে তৈরী করতে চাই। তা না হলে আমরাতো যে কোন একটা তৈরী বাড়ীই কিনতে পারতাম। কিন্তু তুমি আমাদেরকে যেসব ডিজাইন সাজেস্ট করছো সেগুলো সব আমেরিকান ডিজাইন।"

ডেভিড ওয়াইলড দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। এতক্ষন কথা চালাচালির পর আবার ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান। বাংলাদেশী ডিজাইনের বাড়ী বাড়ী করে এরা তো দেখি মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। তার কাছে বাংলাদেশী বাড়ী মানে হচ্ছে কুঁড়েঘর। কুঁড়েঘরে থাকতে যদি এত ইচ্ছে তাহলে আমেরিকাতে এলি কেন ব্যাটা? তোর দেশেই পড়ে থাকতি আর মনের সুখে কুঁড়েঘরে শুয়ে শুয়ে হাওয়া খেতিস।

কিন্তু এইসব কথা তো আর মুখে বলা যায়না। খদ্দের লক্ষ্মী, তার উপর এ হচ্ছে বৌয়ের বান্ধবী। তিন নাম্বার বৌ, বড় আদরের বৌ। তাকে চটানো যাবেনা। অতএব মেজাজ যতই খাট্টা হোকনা কেন, হাসি মুখে এদের অত্যাচার সহ্য করতে হবে।

বাড়ীর ডিজাইনটি দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি কিছুক্ষন। তারপর বললেন, "মিস্টার ইউসুফ, তোমাকে আমেরিকার একটা জিনিস বুঝতে হবে। তোমাদের দেশে লোকেরা বাড়ি বানায় সেখানে কয়েক পুরুষ ধরে থাকবার জন্যে। এখানে লোকে বাড়ী কেনে বা বানায় একটা ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে। তোমার মনে রাখা উচিত যে পাঁচ-সাত বছর পরে এই বাড়ী তোমার হয়তো আর ভাল লাগবেনা, তুমি হয়তো আর একটা বাড়ীতে মুভ করতে চাইবে। তোমাকে অন্য শহরে চলে যেতে হতে পারে। তখন তোমাকে এই বাড়ী বিক্রী করতে হবে। তোমার বাড়ী কিনতে আসবে কে? খুব সম্ভবতঃ একজন আমেরিকান। সে হয়তো তোমার বাড়ীর ডিজাইন অ্যাপ্রিসিয়েট করবে না। ফলে তোমার বাড়ীটা মার্কেটে দিনের পর দিন বসে থাকবে, বিক্রী হবেনা। তুমি নিশ্চয়ই সেটা চাওনা।
আর তাছাড়া, তুমি যে সব জিনিস তোমার বাড়ীতে চাও, তার অনেককিছুই এখানকার হাউস কোডে অ্যালাউড না। আজকে আমরা সবাই খুব ক্লান্ত, আজকে আমরা আলোচনাটা মুলতুবী রাখি। তোমরা বাড়ীর প্ল্যানটি নিয়ে ঘরে যাও। আর একবার তোমরা চিন্তা করে দ্যাখো। আগামী সপ্তাহে আমরা আবার বসতে পারি কথা বলার জন্য।"

রায়হান বিমর্ষ ভাবে উঠে দাঁড়ায়। ব্লুপ্রিন্টটি গুটাতে গুটাতে ডেভিড ওয়াইলড এবার মহিলার দিকে তাকান।
"মিসেস ইউসুফ, আমি রেবেকাকে কথা দিয়েছি যে তোমাদের জন্য আমি একটা সুন্দর বাড়ী বানিয়ে দেব। আমি চাইনা যে কয়েক বছর পরে তোমাদের কোন একটা অসুবিধা হোক। আমাদের ফার্মের নীতিই হচ্ছে আমাদের ক্লায়েন্টদেরকে আগে থেকেই সব রকমের তথ্য ব্যাখ্যা করা। যেন পরে কোন ভুল বোঝাবুঝি না হয়। আমি তোমাদের পছন্দমত বাড়ীই তৈরী করতেই আমি চাই, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি ভবিষ্যতে তোমাদের কোন সমস্যা হয় সেটাও আমার তোমাদেরকে বলে দেওয়া উচিত।"

রায়হান ব্লুপ্রিন্টটি হাত বাড়িয়ে নেয়। "তোমার সময়ের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আমি তোমাকে পরের এ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য ফোন করবো।"

তারা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ডেভিড ওয়াইলড চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। কি মহা ঝামেলার ক্লায়েন্ট রে বাবা। রেবেকাকে এর জন্য পে করতে হবে।

রায়হান কাজ করে একটা আইটি কোম্পানীতে। রায়হান অসম্ভব পরিশ্রমী এবং সত্ বলে তার বেশ কয়েকটা দ্রুত প্রমোশন হয়েছে। সব চেয়ে শেষের প্রমোশনটি পেয়ে সে এখন তার স্টোরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়েছে তিনমাস আগে। তার বাত্সরিক বেতন একলাফে তের হাজার ডলার বেড়েছে। মিরিও গত চার বছর ধরে একটা ছোট চাকরি করছে।

সর্বশেষ প্রমোশনের এক সপ্তাহ পরে একদিন রায়হান একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ফিরলো। "গুড নিউজ আছে একটা, মিরি বেগম।"
"আর একটা প্রমোশন পেলে নাকি?"
রায়হান মিটিমিটি হাসে। "গুড নিউজটা হলো যে আমরা এখন একটা বাড়ী কিনতে পারি। তোমার আমার দুজনের ইনকাম যোগ করলে আমরা ছোটখাট একটা বাড়ীর লোনের জন্য কোয়ালিফাই করি।"
বাবার উঁচু গলার স্বরে ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তারাও ছুটে এসেছে। "কি হয়েছে, কি হয়েছে?"
রায়হান তাদের কোলে তুলে আনন্দে নেচে উঠেছিল। "আমরা একটা বাড়ী কিনবো। আর এই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে থাকবোনা। তোমাদের নিজের নিজের আলাদা ঘর থাকবে।"

বাচ্চারা কিছু না বুঝেই চেঁচামেচি করে। কে কোন ঘরটি পাবে তাই নিয়েই তর্ক শুরু করে দেয়। রায়হান মিরির দিকে তাকিয়ে বলে,"আমি জানতামই না যে আমাদের মত সাধারণ লোকেরাও বাড়ী অ্যাফোর্ড করতে পারে। রিয়াল এস্টেট এজেন্ট বললো যে আমরা টু হান্ড্রেড সিক্সটি থাউজ্যান্ড ডলার পর্যন্ত লোন পেতে পারি।"

মিরির তাও বিশ্বাস হয়না। "কিন্তু আমি যে শুনি বাড়ী কিনতে একগাদা টাকা ডাউনপেমেন্ট দিতে হয়।"

"দিতে পারলে ভাল। না থাকলেও ক্ষতি নেই। আজকাল খুব কম টাকা লাগে বাড়ী কিনতে। আর এখন ইন্টারেস্ট রেট কম বলে মর্টগেজ পেমেন্টও বেশী আসবে না। সাথে একটা বড়সড় ট্যাক্স ব্রেকও পাওয়া যাবে।"

মিরি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল।

এই পর্যন্ত সব কিছু ভাল ছিল। দুদিন পরে গন্ডোগোল বাঁধালো রায়হান নিজেই। তার মাথায় ভূত ঢুকলো যে তৈরী বাড়ি কেনার চাইতে নিজের পছন্দ মত বাড়ী করাটাই ভাল। যদিও তাতে পাঁচ-ছয় মাস বেশী দেরী হবে, কিন্তু বাড়ীটা মনের মত হবে। এর সাথে যুক্ত হোল রেবেকা ওয়াইলড।

মিরি পাড়ার লাইব্রেরীতে একটা ফ্রি কম্পিউটর ক্লাসে গিয়েছিল প্রায় চার বছর আগে। সেই ক্লাসের ইনস্ট্রাকটর ছিল রেবেকা। কিভাবে যেন সেই ক্লাসের মধ্যে তাদের ভিতরে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ক্লাস শেষ হওয়ার পরেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ নষ্ট হয়নি। মিরির কাছে রায়হানের বাড়ী বানানোর ইচ্ছের কথা শুনে রেবেকা মহা উল্লসিত হোল।

"ও মিরি, ইট ইজ সাচ আ গ্রেট প্ল্যান। তুমি আর রায়হান চাইলে আমি তোমাদেরকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। আমার স্বামী ডেভিডের ফার্ম এই জাতীয় কাজই করে। ওদের কম্পানীর ডিজাইন করা বেশ কয়েকটা বাড়ী তো অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে। ডেভিড তোমাদের ড্রীম-হাউস বানিয়ে দেবে। ইউ উইল লাভ ইট।"

মিরিদের দিনাজপুরের বাড়ীটির ডিজাইন করেছিল বুড়ো রাজমিস্ত্রী তায়জুল। মিরির বাবা তাতেই খুশী। আর এখানে মিরিদের বাড়ীর ডিজাইন করবে কিনা আমেরিকার অ্যাওয়ার্ড পাওয়া আর্কিটেক্ট। মিরির ঠিক বিশ্বাস হয়নি।

রেবেকা ফোনের ওপাশ থেকে কথার ফুলঝুরি ছোটায়। "ইউ নো মিরি, ডেভিড খুবই এ্যাকোমোডেটিং আর্কিটেক্ট। ও তোমাদের পছন্দের খুবই দাম দেবে। আর একটা কথা তোমাকে আগে থেকে বলে রাখি। ডেভিড এই কাজ করার জন্য তোমাদের কাছ থেকে কিন্তু কোন পয়সা নেবেনা। এটা হচ্ছে আমাদের তরফ থেকে তোমাদের জন্য অ্যাডভান্সড হাউস-ওয়ার্মিং গিফট।"

এই সংবাদ পেয়ে রায়হানও খুশী। সে লম্বা একটা লিস্ট করে ফেললো কাগজে। বাড়ীর নানারকম বৈশিষ্ঠের তালিকা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই তালিকার জিনিস মেলাতেই টানা-হ্যাঁচড়া চলছে। বেশ কয়েকটা জমিও তারা ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে। এদের মধ্যে আধা একরের একটা প্লট রায়হানের বেশ পছন্দ হয়েছে।

ডেভিড ওয়াইলডের অফিস থেকে বার হয়ে পার্কিংলট পর্যন্ত রায়হান চুপচাপ হেঁটে গেল। গাড়ীতে ঢুকে সে বেশ শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে গাড়ীতে স্টার্ট দিল। এই তিনটি লক্ষনই মিরির পূর্ব পরিচিত। এর মানে হচ্ছে রায়হান বর্তমানে আপসেট।

ডাউনটাউন লোকে কিলবিল করছে। এখন সবার ঘরে ফেরার তাড়া। সবগুলো রাস্তায় জ্যাম, গাড়ীগুলো পিঁপড়ের গতিতে এগুচ্ছে।
"আজ বাড়ী ফিরতে অনেক সময় লাগবে।" রাস্তার লেন পরিবর্তন করতে করতে রায়হান বললো।

মিরি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। শীতকাল বলে সন্ধ্যে হয়ে গেছে আধা ঘন্টা আগে। সিয়াটলের উইন্টারটি বড় বিষন্ন। গোটা সময়টি ধরে মেঘলা থাকে আকাশ। পিট পিট করে সারাক্ষন বৃষ্টি হয়। মন খারাপ হওয়ার জন্য খুবই উত্তম ব্যবস্থা। প্রথম প্রথম বহু দুপুর মিরি একা একা কেঁদে কাটিয়েছে।

ফ্রিওয়েতে উঠতে বেশ সময় লাগলো। মিরির একটু দুশ্চিন্তা লাগছে বাচ্চাদের জন্য। আজকে তাদেরকে আর এক বাঙ্গালীর বাসায় রেখে আসা হয়েছে। মিরি রায়হানের দিকে আড়চোখে তাকালো। রায়হান এখন একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গাড়ীতে বাচ্চারা থাকলে সে সিগারেট খায়না। সিগারেট ধরানোটা একটা ভাল লক্ষন, আর মানে সে এখন স্বাভাবিক হচ্ছে।

গাড়ীর ভিতরে সিগারেটের ধোঁয়া জমতে শুরু করেছে। রায়হান জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল। মিরি এবার কথা বললো,"কি ব্যাপার, তুমি হঠাত্ এত গুম মেরে গেলে কেন?"
"শালা ডেভিডের বাচ্চার কথা শুনে মেজাজটা খাট্টা হয়ে গেল। বাড়ী বানাবো আমি আর আমাকে উপদেশ দেয় কিনা সে।"
"ডেভিড তো খারাপ কিছু বলেনি। সে তো ঠিকই বলেছে। কে জানে পাঁচ-সাত বছর পরে এই বাড়ী আমাদের বেঁচতে হতে পারে। তখনকার কথাটাও আমাদের চিন্তা করতে হবে।"
"নিজের স্বামীকে বাদ দিয়ে বান্ধবীর স্বামীর পক্ষ নিচ্ছ নাকি?"

মিরি চকিতে ফিরে তাকায় রায়হানের দিকে। তার মুখে শয়তানী মুচকি হাসি। বোঝা যাচ্ছে যে সে মিরিকে রাগানোর চেষ্টা করছে। মিরিও হাসে। সে জানে রায়হান বেশীক্ষন রাগ করে থাকতে পারে না।
"আসলে তুমি আর ডেভিড দুজনেই গোঁয়ার কিসিমের লোক। কেউ কারো জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও সরতে চাওনা। এভাবে চললে বাড়ী তৈরী করার চিন্তাটা বাদ দিতে হবে।"

রায়হান সিগারেট অ্যাশট্রেতে চেপে নিভিয়ে ফেলে। "আসলে ব্যাপারটা কি জানো মিরি, জীবনে মাঝে মাঝে কিছু কিছু জিনিস দেখে সেগুলো পেতে ইচ্ছে করে। মনে আছে বহু দিন আগের কথা। তখন আমি কেবল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। একদিন বিকেল বেলা আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। এই সময়টাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিটি গাছের নীচে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েরা বসে প্রেম করতো। সেদিন চোখে পড়লো একটি গাছের নীচে বসে আছেন একটি বয়সী যুগল।
দুজনেরই বয়েস ষাটের উপর হবে। ভদ্রলোকের পরনে দুধ-সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী, তার উপর হাল্কা বাদামী রঙ্গের শাল। মহিলা পরেছেন লাল-পেড়ে গরদের শাড়ী। তারা দুজনে বসে বাদামভাজা খাচ্ছেন আর পুটুর-পুটুর করে গল্প করছেন। মহিলাটিই হাত পা নেড়ে কথা বলছেন। ভদ্রলোক বোধহয় চুপচাপ স্বভাবের, তিনি শুধু অপলকে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনছেন। মাঝে মাঝে বাদামের খোসা ভেঙ্গে একরাশ বাদাম তুলে দিচ্ছেন মহিলার হাতে। আমার এই দৃশ্যটি যে কি ভাল লেগেছিল তা বলার মতো না। মনে হয়েছিল, আহা- আমি যদি কোনদিন ওই বয়সে ওই রকম ভাবে আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারতাম।"

মিরি হাসে। "কথা হচ্ছিল বাড়ীর ডিজাইন নিয়ে। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাদামভাজা কোথথেকে এলো?"
"এমনি ধরনের স্বপ্ন বাড়ী নিয়েও দেখেছি। বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়ানোর স্বপ্ন ছিল। তাইতো ডেভিডকে বলেছিলাম বাড়ীর ছাদের কথা, তাতে সে আমেরিকানরা কেন বাড়ী কেনে আর বাঙ্গালীরা কেন বাড়ী কেনে সেই তত্ব বোঝানো শুরু করে দিল। মেজাজ হোল খারাপ। আরে আমি বাড়ী বানাচ্ছিই তো এই কারণে যেন বাড়ীটা আমার মনের মত হয়। ঘরে ফিরলে যেন মনে হয় দেশেই আছি।"

"সেটা ভাল কথা। কিন্তু তোমাকে এই জিনিসটাও বুঝতে হবে যে এটা বাংলাদেশ না, এখানকার কাজ কারবার দেশের মতো না। তুমি কি এখানে কোন বাড়ী দেখেছো যার ছাদে উঠে কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে? এখানকার আর দশটা বাঙ্গালীও বাড়ীতে থাকে, তাদের কয়জনের বাড়ীর ডিজাইন দেশের মতো? এদের কাছে বাড়ীর ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানোটা নিছক পাগলামী ছাড়া আর কিচ্ছু না।"

"ঠিক আছে, ছাদ নাহয় বাদ দিলাম। আমি তো যা যা বলছি, তাতেই ওই ব্যাটা ডেভিড ভেটো দিচ্ছে। বুঝতে পারছি, শেষপর্যন্ত ও ভক্কিচক্কি দিয়ে আমাদেরকে আমেরিকান ডিজাইনের বাড়ীই গছাবে।"
"এটা তোমার বেশী বেশী। আমার তো মনে হয়,তুমি আর ডেভিড তোমাদের মাথাদুটো এক জায়গায় করলে আমাদের খুব সুন্দর একটা বাড়ী হবে।"
"দেখা যাক।"

সাতদিন পর দুপুর দুটোয় আবার বৈঠক বসলো। ডেভিড ওয়াইলড আজকে আর গতদিনের ভুলটি করেননি। মিটিং এর আগেই দুটো একস্ট্রা স্ট্রেংথ এ্যাসপিরিন এক গ্লাস ভদকার সাথে মেরে দিয়েছেন। সাধারণতঃ তিনি বিকেল পাঁচটার আগে মদ স্পর্শ করেননা, কিন্তু আজকের পরিস্থিতি সিরিয়াস। অবেলায় কড়া ডোজের মদ পেটে পড়ায় যদিও তার মাথা একটু ঝিমঝিম করছে, কিন্তু ভিতরে এক ধরনের তরল অনুভূতির টের পাচ্ছেন তিনি।

রায়হানও আজকে অনেক সংযত। মিরিকে সে কথা দিয়েছে যে বাড়ীর ব্যাপারে কথাবার্তা বলার সময়ে সে মাথা ঠান্ডা রাখবে।

ডেভিড ওয়াইলডই প্রথমে কথা শুরু করলেন। "মিস্টার ইউসুফ, তোমার বাড়ীর ডিজাইনটি নিয়ে আমি কালকে বসেছিলাম। আমার কাছে মনে হয় যে আমরা তোমার বেশ কয়েকটা রিকোয়েস্ট রাখতে পারবো। ইতিমধ্যেই আমি ব্লুপ্রিন্টে বেশ কিছুটা পরিবর্তন করেছি। আশাকরি তোমাদের এবারের পরিবর্তনটি ভালো লাগবে।"

রায়হান পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে। কাগজের ভাঁজ খুলে সে তার তালিকায় চোখ বুলায়। সে নরম গলায় বলে,"মিস্টার ওয়াইলড, আমি গতদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমি কয়েকদিন ধরে বাড়ীর ডিজাইন নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। তুমি আমাদেরকে বাড়ীর ভবিষ্যত ক্রেতার পছন্দের কথাটি মনে করিয়ে দেবার জন্য আমরা দুজনেই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি না বললে আমাদের মাথায় সেটা কখনোই আসতো না।"

ডেভিড ওয়াইলড সুন্দর করে হাসেন। রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বেড়ে যাওয়াতে তার বেশ খুশী খুশী লাগছে। আজকে এই দম্পতিটিকে তার আগের দিনের মতো অতটা খারাপ লাগছেনা।

"মিস্টার ইউসুফ, তুমি আমাকে ডেভিড বলে ডাকতে পারো। তোমরা আমার স্ত্রীর পরিচিত। সেসুত্রে আমরা সবাই একে অন্যের বন্ধু। আমার ইচ্ছা তোমাদের বাড়ীটা খুব সুন্দর করে তৈরী করার। তোমাদের মনের মতো না হওয়া পর্যন্ত আমি এবং আমার কোম্পানী হাজার বার ডিজাইনের পরিবর্তন করতে প্রস্তুত।"

মিরি রায়হানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। শুরুটা চমত্কার ভাবেই হয়েছে। আজকেই হয়তো বাড়ীর ডিজাইন পাকাপাকি হয়ে যাবে।
রায়হান তার তালিকার দিকে আর একবার চোখ বুলায়।

"ডেভিড, এটা সত্যি যে আমরা এখন আমেরিকায় থাকি। অনেক চিন্তা ভাবনার পর আমরা স্থির করেছি যে এখানে বসে সম্পুর্ণ বাংলাদেশী কায়দায় বাড়ী তৈরী করাটা বুদ্ধিমানের কাজ না। অতএব আমি আমার লিস্টটিকে বেশ কিছু কাটাকুটি করেছি। কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি রেখে বাদবাকী সব বাদ।"

ডেভিড ওয়াইলড মনে মনে ভুরু কোঁচকালেন। এরা আবার রেগে-টেগে যায়নি তো তার আগের দিনের কথায়।

রায়হান ডেভিডের মনের ভাব টের পায়না। সে বলে,"আমাদের লিস্টের প্রথম জিনিসটি হচ্ছে যে বাড়ীর দোতলায় একটি বারান্দা বা ব্যালকনি থাকতে হবে। এবং সেটা থাকবে আমাদের বেডরুমের সাথে।"

এটির কথা আগের মিটিং এ তোলা হয়েছিল। ডেভিড ওয়াইলড প্রশ্ন করলেন,"কেন? দোতলায় ব্যালকনি থাকতে হবে কেন?"

"বিকেল বেলায় আমি এবং আমার স্ত্রী একসাথে বসে চা খাই। কাজের স্কেজিউল এর জন্যে সবদিন এটা সম্ভব হয়না, তবে ছুটির দিনে এটি আমাদের একটি নিয়মিত এবং প্রিয় অভ্যাস। দোতলার বারান্দা থাকলে আমরা সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে চা খেতে পারবো।"

"কিন্তু তোমরা ভুলে যাচ্ছ যে তোমরা সিয়াটলে আছো। সিয়াটল ঠান্ডা আর আর্দ্র শহর। দুই-তিন মাস ছাড়া গোটা বছরেই বাইরের তাপমাত্রা বেশ কম থাকে। এত ঠান্ডার মধ্যে বারান্দায় বসে তোমাদের চা খেতে ইচ্ছে করবে না। আর তাছাড়া তোমাদের এটাও মনে রাখা উচিত এখানকার সব বাড়ীর কিচেনটি একতলায়। একতলায় চা বানিয়ে তোমরা আবার দোতলায় গিয়ে চা খাবে না। তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে বারান্দাটি বেশীর ভাগ সময়েই অব্যবহূত থাকবে। খামাখা এতখানি জায়গা নষ্ট না করে বরঞ্চ ওই জায়গাটুকু যোগ করলে তোমাদের মাস্টার বেডরুমটিকে আরো প্রশস্ত লাগবে। বাড়ীর বর্তমান ডিজাইনে কিচেনের পাশেই বেশ বড় একটা প্যাটিও দেয়া হয়েছে। বাইরে বসে চা খেতে চাইলে তোমরা সেখানে যেতে পারো।"

রায়হান থমকায়। ডেভিড যা বলেছে, সেটা সত্যি। সে এইভাবে জিনিসটি চিন্তা করেনি। "আচ্ছা, তাহলে বারান্দার আইডিয়াটা বাদ দিচ্ছি। দু নম্বর জিনিসটি হচ্ছে যে আমদের প্রত্যেকটি বাথরুমে একটি ছোট পানির হোসপাইপ লাগাতে হবে। এবং সেটি থাকবে কমোডের কাছাকাছি।"

ডেভিড ওয়াইলড এবার একটা ধাক্কা খেলেন। এ জাতীয় অনুরোধ তিনি আগে কখনো পাননি। তার মুখ থেকে হাসিটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার কি পাগলামী শুরু হোল নাকি?

তিনি বললেন,"মিস্টার ইউসুফ, তোমার অনুরোধটি আমার কাছে পরিস্কার হোলনা। প্রতিটি বাথরুমেই তো ধোয়াধুয়ির জন্য সিংক আছেই। কমোডের কাছে আলাদা একটা হোস পাইপ দিয়ে তোমরা কি করবে? এট কি তোমরা কমোড পরিস্কার করার জন্য ব্যবহার করবে?"

মিরি এবার রায়হানের দিকে তাকায়। সে এই অনুরোধের কারণটি বুঝতে পেরেছে। হাসি চাপতে গিয়ে সে খুকখুক করে কেশে ফেলে।

রায়হানকে একটু বিব্রত মনে হয়। তার গাল লাল হয়ে উঠেছে। সে বললো, "ডেভিড, আমি তোমাকে এর কারণটি ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছি না। তবে ওটি আমাদের লাগবে। আমাদের দেশের প্রতিটি বাথরুমেই কমোডের কাছাকাছি পানির একটা সোর্স থাকে।"

ডেভিড ওয়াইলড অসহায়ের মতো মিরির দিকে তাকান। মিরি এবার কথা বলে, "ডেভিড, আমরা আশা করছি আমাদের বাড়ীতে মুভ করার পরে দেশ থেকে কিছু আত্মীয়-স্বজন আমাদের এখানে বেড়াতে আসবে। আমাদের কিছু কিছু বয়স্ক আত্মীয় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে। কমোডের কাছে পানির হোসপাইপটি পেলে তারা খুব খুশী হবে।"

এই উত্তরে ডেভিড ওয়াইলড কি বুঝলেন কে জানে, তবে তিনি আর প্রশ্ন করলেননা। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, " আমি খুবই দুঃখিত। তোমাদের এই অনুরোধটিও আমি রাখতে পারবো না।"

রায়হান এই জবাবে হকচকিয়ে যায়। তার ধারণা ছিল যে এটি বেশ সহজসাধ্য অনুরোধ। "কেন? বাথরুমে একটা একস্ট্রা পানির লাইন দিতে অসুবিধা কি?"

ডেভিড ওয়াইলড ব্যাখ্যা করেন। "মিস্টার ইউসুফ, আমেরিকাতে বাড়ী তৈরী করার কিছু নিয়ম কানুন আছে। বাড়ী বানাতে গেলে তোমাকে এই সব নিয়ম মানতেই হবে।"

রায়হান তাও বুঝতে পারেনা। "সেটা বুঝলাম। কিন্তু বাথরুমের ভিতরে একটা একস্ট্রা পানির পাইপ লাগিয়ে আমি কিভাবে আইন ভাংছি তা আমার কাছে পরিস্কার হোলনা।"

ডেভিড ওয়াইলড মিষ্টি করে হাসেন। "মিস্টার ইউসুফ, আমাদের আইনে বলে যে প্রতিটি পানির আউটলেটের নীচে একটি করে পানি বেরোনোর রাস্তা থাকতে হবে। এখানকার বাড়ীর বাথরুমের ফ্লোরে কোন পানির ড্রেন থাকেনা। যদি কোন কারণে পানির আউটলেট লিক করে, তাহলে গোটা বাথরুম, এমনকি খুব খারাপ কেস হলে পুরো বাড়ীটাই পানি দিয়ে ভরে যেতে পারে। তোমাদের কথা মতো বাড়ীর ডিজাইন করলে সেই ডিজাইন সিটি কাউনসিল অ্যালাউ করবে না।"

রায়হান নাছোড়বান্দার মতো বলে,"তাহলে তুমি প্রতিটি বাথরুমের ফ্লোরে একটা করে ড্রেন লাগিয়ে দাও। তাহলেই তো আর কোন সমস্যা হবে না।"

"সেটা ঠিক। কিন্তু সমস্যা আর এক জায়গায় হবে।"
"কি সমস্যা?"
"পয়সার সমস্যা। আলাদা ফ্লোর ড্রেন লাগাতে গেলে খরচ অনেক বেশী পড়বে। তোমাদের বাজেটে কুলোবেনা।"

পয়সার টানাটানির বিষয়টা রায়হান মিরির দুর্বল জায়গা। তার উল্লেখে রায়হানের মুখ বিমর্ষ হয়ে আসে।

মিরি তাড়াতাড়ি বলে,"হোস পাইপ লাগাতে পারলে ভাল হোত, কিন্তু এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস না। আমরা বরঞ্চ লিস্টের পরের আইটেমটি দেখি।"

রায়হান হাতের কাগজে চোখ বুলিয়ে বলে,"আমার মনে হয় আর এগোনো ঠিক হবেনা। কেন যেন মনে হচ্ছে যে এই লিস্টের সবক'টি জিনিসই হয় অসম্ভব অথবা ব্যয়বহুল।"

ডেভিড ওয়াইলড আবার হাসেন। "মিস্টার ইউসুফ, তুমি মনে হয় রেগে যাচ্ছো। তুমি বরঞ্চ বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে এসো। আমি এই ফাঁকে তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলি।"

মিরি আলতো করে রায়হানের হাতে চাপ দিল। রায়হান একটী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। "আমি শান্তই আছি। সিগারেট খেতে হবেনা। লিস্টের পরের জিনিসটি হচ্ছে যে আমাদের শোবার ঘরে একটি বড় ওয়াল টু ওয়াল জানালা থাকতে হবে। জানালাটি যেন ঘরের দক্ষিন দিকে হয়। তাহলে আমাদের ঘরে জ্যোত্স্নার আলো আসবে। আমি বিছানায় শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদকে দেখতে পারবো।"

ডেভিড ওয়াইলড ডেস্কের নীচের ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখা ভদকার বোতলটির দিকে হাত বাড়ালেন।

ছ'মাস পরের কথা। সামারের রোদ ঝলমলে একটি দিন। আজ মিরিরা তাদের নতুন বাড়ীতে মুভ করছে। রায়হান একটি মুভিং সার্ভিসকে ভাড়া করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় বাঙ্গালীরা হৈহৈ করে বললো যে মুভিং সার্ভিসের কোন প্রয়োজন নেই, জিনিসপত্র টানাটানির কাজ তারা সবাই মিলেই করবে। বিনিময়ে তাদেরকে খাওয়ালেই চলবে। "কাজের বিনিময়ে খাদ্য" কর্মসূচীতে তারা বিশ্বাসী।

ট্রিপের পর ট্রিপ মালপত্র আসছে। রায়হান তাদের পুরনো বাসা থেকে জিনিসপত্র গাড়ীতে তুলে দিচ্ছে, আর এপাশে মিরি সেগুলোকে জায়গামত রাখার বন্দোবস্ত করছে। সবাই বাড়ীর প্রশংসা করছে। এত সুন্দর ডিজাইন নাকি আর হয়না।

মালপত্র আনা নেয়ার কাজ শেষ হ'তে হ'তে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। রায়হান ফোনে পিত্জা অর্ডার করেছিল। প্লেট-গ্লাস না থাকায় ন্যাপকিনে করেই পিকনিকের মত আনন্দ করে খাওয়া হোল।

অবশ্য যাবার সময়ে সবাই বলে গেল যে "কাজের বিনিময়ে খাদ্য" কর্মসূচীতে অনুমোদিত খাদ্যের তালিকায় পিত্জার নাম নেই। শুধুমাত্র মোরগ-পোলাও বা বিরিয়ানী জাতীয় খাবারকেই গোনা হয়। অত এব তাদের শ্রমের মূল্যটি আজকে আদায় হোলনা। পরে সুদ-আসলে উসুল করা হবে।

সারাদিনের পরিশ্রম এবং উত্তেজনায় সবাই ক্লান্ত। লোকজন চলে যেতেই বাচ্চারাও ঘুমাতে চলে গেল। মিরি গোসল করতে বাথরুমে ঢুকলো। রায়হান ব্যক-ইয়ার্ডের প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরালো। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়লেও তার কেন যেন ঘুম আসছেনা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাক্সগুলোর একটার উপর সে বসলো।

সন্ধ্যা নামবার পর ঠান্ডা বাতাস বইছে। রায়হানের একটু শীত-শীত লাগছে। সে গুটিশুটি মেরে সিগারেটে সুখটান দেয়।

শেষপর্যন্ত বাড়ীটি তার পরিকল্পনা মতো তৈরী হয়নি। ডেভিড ওয়াইলড এর মতো অতিদক্ষ আর্কিটেক্টও এই দুরুহ কাজটি করতে পারেননি। রায়হান বুঝতে পেরেছে যে ঈশ্বর মানুষের সব স্বপ্নকে পূর্ণ করেননা। দক্ষিনমুখী জানালা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদকে সব সময়ে ঘরে আনা যায়না। আমেরিকার সিয়াটল শহরে বসে বাংলাদেশকে শুধু বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়, তাকে বাস্তবে রূপ দেয়া বড়ই কঠিন কাজ।

কিচেনে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। মিরির বোধহয় গোসল শেষ হোল। রায়হান একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

কাঁচের স্লাইডিং ডোর সরিয়ে মিরি বাইরে এলো। "এরকম ভূতের মতো অন্ধকারে বসে আছ কেন? তোমার তো তো ঠান্ডা লেগে যাবে।"

"এমনিই বসে আছি।"

মিরি রায়হানের কাছে এলো। তার হাতে একটি পাতলা ব্ল্যাংকেট।

"এটা গায়ে দিয়ে বসো। তোমার শালটা খুঁজছিলাম, সেটা কোন বাক্সের মধ্যে আছে, খোদা জানেন।"

রায়হান ব্ল্যাংকেট গায়ে জড়িয়ে বসলো। তার এখন আরাম লাগছে। "থ্যাংক ইউ, মিরি।"

মিরিও একটি বাক্সের উপর বসলো। তার শরীর থেকে একটি সুগন্ধ আসছে। তারার আবছা আলোয় রায়হান খেয়াল করলো যে মিরি শাড়ী পরেছে। গাঢ় পাড়ের একটি সাদা শাড়ী। আমেরিকার জীবনের ঘানি টানতে গিয়ে মেয়েদের শাড়ী পরা খুব একটা হয়না।

একটু ঝুঁকে মিরি রায়হানের কোলের উপরে একটি বড় বাটি রাখলো। "এই নাও, তোমার জন্যে আনলাম।"

বাটিভর্তি চীনাবাদাম। সাধারণতঃ দোকানে যে খোসা ছাড়ানো চীনাবাদাম পাওয়া যায় সেরকম নয়। এগুলো আস্ত। রায়হান অবাক হোল, "আমি এখন বাদাম খাবোনা।"

মিরি জলতরংগের মত শব্দ করে হাসে। "তোমার খাবার জন্যে তো আমি আনিনি। তুমি শুধু খোসা ছাড়িয়ে আমাকে দেবে আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি এখানে বসে আজ সারা রাত ধরে তোমার সাথে গল্প করবো। ষাট-সত্তুর বছর পর্যন্ত আমিতো নাও বাঁচতে পারি।"

রায়হান চোখ বড় করে মিরির অপূর্ব সুন্দর মুখখানির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে টের পায় যে ধীরে ধীরে তার চোখের কোণা ভিজে আসছে।

ঈশ্বর কেবল মানুষের বড় স্বপ্নগুলোই পূর্ণ করেন।

(পুরনো গল্প। উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত "পড়শী" পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। বর্তমানের অণুগল্প আর চুনোগল্পের মাঝে এই লেখাটিকে হয়তো মহাভারতের মতো বিশালাকৃতির মনে হবে।)


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

বাহ! বাহ! দারুন লাগল ! বেশ লাগল !

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অনিন্দিতা এর ছবি

এত চমৎকার লাগল বোঝাতে পারবো না।

অয়ন এর ছবি

ভালো লাগলো।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

বাহ!

অফটপিকঃ সুনীল গাঙ্গুলির যেমন নবনী। জাহিদ হোসেনের কী তেমন মিরি? দেঁতো হাসি
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

উদ্দেশ্যহীন এর ছবি

@পরিবর্তনশীলঃ নবনী...নাকি নীরা বলতে চেয়েছিলেন??

খুবই ভাল লাগলো গল্পটা। বড় হলেও কথায় ঝুলে যায়নি। পড়ে আরাম পেলাম। 

পরিবর্তনশীল এর ছবি

বিরাট ভুল হয়ে গেছে।
তয় নবনীও একেবারে ট্র্যাকের বাইরে না। দেঁতো হাসি

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

মিরি টপিকের জবাবটা আগে দেই। এই নামটি বহুদিন আগে একটি গল্প লেখার সময়ে মাথায় আসে। কোথা থেকে পেলাম তা খোদা মালুম। আমি আলসে মানুষ। প্রতি গল্পের সময়ে আবার নতুন করে নাম কে খুঁজবে? তাই ঐ নামটিই বারবার চালিয়ে দেই। আমার গোটা দশেক গল্পের মূল নারী চরিত্রের নাম মিরি। নামের মিল থাকলেও এক গল্পের মিরির সাথে অন্য গল্পের মিরির কোন সম্পর্ক বা সাদৃশ্য নেই নামের মিলটুকু ছাড়া। ইচ্ছে আছে কোন এক দিন সবগুলো গল্পকে একসাথে করে একটা বই ছাপানোর। বইটির নাম হবে "মিরি"।

সংক্ষেপে এই হোল মিরির শানে নুজুল।

(পাদটীকা: আমার মিরি নামের মোহ শেষ হয়েছে। আজকাল যা লিখি, তার কোনকিছুতেই মিরি নামটি নেই।)
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

স্বপ্নাহত এর ছবি

আমি আলসে মানুষ।

আজকাল আলসে মানুষরা দেখি মহাভারতও লিখে। চোখ টিপি

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আমিতো তাইই জানতাম যে অকাজের লোকেরাই এইসব লেখালেখি করে থাকে। মাঝেমাঝে আলসেমীতেও একঘেঁয়েমী আসে। সেটা কাটাতেই কিছু অকাজ করা।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

অনেক বড়। কিন্তু আপনার সব গল্পে যা হয়, পড়তেই হয়। পড়তেই হলো।

অসাধারণ সুন্দর একটি গল্প!

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশী লাগছে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

ধন্যবাদ। বানান-টানান ঠিক আছে তো সব?
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

খুবই ভালো গল্প। স্কোর দিলাম অনায়াসে।
-------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

স্বপ্নাহত এর ছবি

খুব খুব ভাল্লাগছে...

এইরকম মহাভারত টাইপ কান্ড কারবার আরো পড়তে চাই হাসি

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

মহাভারত টাইপ কান্ডকারবার টাইপ করতে করতে হাত ব্যথা হয়ে যায় যে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আগুনে সমস্যা কি? আপনার হাতে পানিভর্তি লোটা তো রয়েছেই।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

রানা মেহের এর ছবি

খুব সুন্দর গল্প জাহিদ হোসেন।
তার থেকে ভালো লেগেছে এর আকার।
সময় নিয়ে পড়তে পেরেছি।
অণু গল্পের মতো টুপ করে শেষ হয়ে যায়নি।
এমন লিখুন আরো।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার মন্তব্যে রীতিমত অভিভূত হলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

Stranger এর ছবি

অসম্ভব ভাল লেগেছে ; ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।