‘দাদু, ওই গল্পটা আবার বলো।’
‘কোন গল্পটা?’
‘ওই যে ওই পূর্ণিমা রাতের গল্পটা।’
দাদু সে কথায় হাসেন। সে হাসির কোন শব্দ নেই, তবু বুঝতে পারি যে দাদু হাসছেন।
সরসর শব্দে কিছু শুকনো পাতা উড়ে যায়। গ্রামে এই এক মজা। কত রকম শব্দ শোনা যায়। কত রকম পাখির ডাক, কত রকম মানুষের গলার আওয়াজ, কত রকম জলের শব্দ। মাঝেমাঝে পুকুরের কালো জলে ঘাই দেয় কাতলা মাছ, তার শব্দ। যখনই গ্রামে আসি, প্রতিবারই বুকের মাঝে নতুন শব্দের স্টক নিয়ে ফিরে যাই।
দাদুর গলার আওয়াজটি আমার কাছে চৈত্রমাসের হুহু করে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো মনে হয়। কোথায় যেন একটি অতৃপ্তি, কোথায় যেন একটু হাহাকার। দাদুর গল্পের মতোন। আমার তাই বারবার শুনেই যেন আশ মেটেনা।
‘ও দাদু-বলোনা গল্পটা।’
‘আজ অন্য গল্প বলি?’
‘না-না, অন্য গল্প না। ওই পূর্ণিমা রাতের গল্পটা শুনবার জন্যেই গ্রামে আসি।’
‘আচ্ছা, বলছি বলছি।’
গল্পের আশে আমি নড়েচড়ে বসি। দাদু গল্প শুরু করেন।
‘তখন আমার বয়েস কত হবে? এই ধর- পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। তখন গরম কাল। সে রাতে বেজায় গরম পড়েছে, এক ফোঁটা বাতাস নেই। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি, একদম ঘুম আসছে না। শেষে বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরোলাম। দেখি- সারা আকাশ জুড়ে জ্যোৎস্না। সেকি জ্যোৎস্না, সেকি তার আলো! মনে হচ্ছে একদম দিনের মতোন চারদিক আলো হয়ে এসেছে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে পুকুরের ঘাটে বসলাম।
পুকুরের পানিও যেন স্থির হয়ে আছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, আল্লাহ তোমার রহমত বোঝা ভারী কঠিন। আকাশে মেঘ থাকলে কি আর এমন জ্যোৎস্না দেখতে পেতাম। তখন ভাবছি যে ঘর থেকে আড়বাঁশীটা এনে দু একটা তান ধরবো কিনা। তাতে অবশ্য বাপজানের বকা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।'
প্রতিবারের মতোন গল্পের এই জায়গাটিতে এসে দাদু থামেন। আমার অসহ্য লাগে।
‘ওকি? থামলে কেন? তারপর কি হোল?’
দাদু আমার আগ্রহে আগের মতোন আবার আবছা ভাবে হাসেন।
‘কতদিন আগের কথা। সব কিছু কি ঠিকঠাক মনে আছে?’
‘তুমি খালি ঝামেলা করো দাদু। তোমার সবকিছু মনে আছে।’
চৈত্র মাসের উদাসী হাওয়াটির মতো দাদুর কথা বলা শুরু হয় আবার।
‘এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হোল চাঁদের আলো যেন কমে এসেছে। আমি ভাবলাম, তবে কি আকাশে মেঘ জমেছে? ভাল করে তাকিয়ে দেখি, না আকাশে তো দিব্যি রয়েছে চাঁদ। তাহলে? তাহলে আকাশে আলো কম কম লাগছে কেন? ভাল করে তখন তাকিয়ে দেখি পুকুরের ওপাশের ঘাটে যেন নেমে এসেছে আর একটি চাঁদ। দেখি ওপারের ঘাটে বসে থাকা মেয়েটির রূপে সারা পুকুরের জল যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে।
এ কোন বাড়ীর মেয়ে গো? একি মানুষ, নাকি পরী? আমি বোকার মতো চোখ কচলাতে থাকি। এপাশে গাছের আড়ালে বসে ছিলাম বলে মেয়েটি আমাকে দেখেনি। ওপারে পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে মেয়েটি। আর এপারে তার আগুনে আমি পুড়তে থাকি।’
‘তারপর কি হোল, দাদু?’ আমি রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করি।
‘তারপর আর কি? পরদিন পুকুরের ওপারের মেয়েটিকে পুকুরের এপারে নিয়ে আসি। চিরকালের জন্যে। তোর দাদীকে আর কোনদিন ওপারে যেতে দিইনি। পূর্ণিমার চাঁদকে কি আর হাতছাড়া করতে আছে?’
আমি এবারে হেসে ফেলি। ‘দাদু তুমি এত মিথ্যে কথা বলতে পারো! দাদীর গায়ের রং তো ছিল শ্যামলা। তুমি সেখানে পূর্ণিমার চাঁদ কোথায় পেলে?’
দাদু এবারে রহস্যময় ভাবে হাসেন। ‘সব পূর্ণিমা কি আর সব চোখে ধরা দেয় দাদু!’
ভিতরবাড়ী থেকে বৌ ডাকছে। ‘কি হোল? কবর জিয়ারত করতে এতক্ষণ লাগে?’
দাদুর কবরের পাশেই দাদীর কবর। চারপাশে কতরকমের গাছপালা। একটি পূর্ণিমার চাঁদ আর তার গুণমুগ্ধ দর্শককে তারা সস্নেহে ঘিরে রেখেছে। আর কেউ যেন সে জিনিস দেখতে না পারে।
আর আছে মাঝেমাঝে হুহু করে বয়ে যাওয়া উদাসী হাহাকারময় হাওয়া। তাতে কত রকমের গল্প।
কিন্তু সব গল্প কি আর সব লোকে শুনতে পারে?
মন্তব্য
এত্ত সুইট খুব খুব খুব ভাল লাগল, এত ভালবাসা পাওয়াও ভাগ্গের ব্যাপার খুব সুন্দর লিখেছেন
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
চমতকার।
ভাল লাগছে ।
......................................................
উত্তর বাংলার অনাহারী যুবক
ভাল হইসে...
_______________
এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।
_______________
::সহজ উবুন্টু শিক্ষা::
ভাল লাগল ।
*********************************************************
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
নষ্টালজিক জগতে নিয়ে যায় ।
বিভুতিভুষনের কথা মনে পড়ে যায় ।
বিভূতিভূষণ? ছিঃ ছিঃ!
কোথায় বিভূতিভূষণ, আর কোথায় দাঁতের মাজন!
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
অনেকদিন পর অণুগল্পে হাত দিলেন জাহিদ ভাই। "কোকিল" আর এইটা, দুইটাই অসম্ভব ভাল লাগল।
নিদ্রাহীন গার্ড ভাই, বহুদিন কোন কিছু লেখা হচ্ছিল না। সেদিন গিয়েছিলাম গাড়ীর তেল-মবিল বদলাতে। যেটুকু সময় বসে থাকতে হয়েছিল, তারমধ্যেই যা মনে আসে লিখেছি। ভাবলাম অন্ততঃ অভ্যেসটা থাকুক। কেমন হোল তার বিচারের ভার তো আপনাদের উপর।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
এত সুন্দর। এত সুন্দর!!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন