তৃতীয় যাম। (প্রথম অংশ)

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০২/২০০৯ - ১১:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘প্রতিদিন, রাত্রির ঠিক তৃতীয় প্রহরে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কখনো অন্যথা হয়না এই নিয়মের। ঘুম ভেঙ্গে দেখি, এক পাগল করা চাঁদের আলো ঢুকেছে আমার ঘরে। সে এক আশ্চর্য্য জ্যোতস্না, সেই আলোয় মিশে থাকে নরম উজ্বলতা। আমি পাশ ফিরে শুই।

চাঁদের আলোয় আমার বিছানা ভেসে যায়। বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা অন্যজনের মুখে থই থই করে জ্যোতস্না। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি সেই মুখখানির দিকে।

নরম আলোয় মায়াময় মনে হয় মুখটিকে, বড় আদর করতে ইচ্ছে করে। ঠোঁটজোড়া অল্প ফাঁক হয়ে আছে, ভাল করে খেয়াল করলে তার হাসিটিকে বোঝা যায়। ছোট্ট চিবুকের তিলটিকে একটি কালো গোলাপ বলে ভুল করি। সাদা পাথরের নাকফুলটি চাঁদের আলোয় ঝলসে ওঠে। মনে হয় ----’

গোটা টেবিলটি অগোছালো। বই, খাতা, কলম, ম্যাগাজিন, টুকরো কাগজ সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা।
বেশ কদিন চিত্রা এঘরে ঢোকেনি। আজকে কি মনে করে ঘরে ঢুকেছে সে। গতসপ্তাহে রজনীগন্ধার কয়েকটা ছড়া কিনে ফুলদানিতে রেখেছিল চিত্রা। ফুল গুলো শুকিয়ে ঝরে গেছে বহু আগে, কিন্তু ফুলদানিতে ডাঁটি গুলো এখনো রয়ে গেছে টেবিলের উপর। আলনা উপচে পড়ছে কাপড়ে। বিছানায় চাদরটি এলোমেলো, বালিশটি এক কোণে অসহায়ের মত লুকিয়ে আছে।

রাগতে গিয়ে হেসে ফেলে চিত্রা। নীলুটাকে আর মানুষ করা গেলনা। সেই ছেলেবেলা থেকেই এইরকম অগোছালো। এতোটা বড় হয়েও স্বভাবটা গেল না।

চিত্রা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আজকে নীলুকে একটা কড়া রকমের বকা দিতে হবে। তাতে খুব একটা কাজ হয়তো হবে না। বড়জোর তিন-চার দিন, তারপর আবার পুরনো চেহারা ফিরে আসবে।
জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে হঠাত করে চোখে পড়েছিল নীল রঙ্গের কাগজটি। মোটা একটা ডিকশ্‌নারীর ভিতর থেকে এক কোণা উঁকি দিচ্ছিল। অন্য সময় হলে চিত্রা হয়তো খেয়ালও করতো না। আজ কি মনে হোল কে জানে। কাগজটি বের করতেই চোখে পড়লো লাইনগুলো।
পড়তে পড়তে চিত্রার হাসি পাচ্ছিল। কেননা নীলু যে ঘরে থাকে সে ঘরে কোন জানালাই নেই। নীলু এই ঘরে জ্যোতস্না পেলো কোথথেকে?

চিত্রারা দুকামরার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকে। একটা ঘরে চিত্রা আর তার স্বামী ফিরোজ থাকে। অন্য ঘরটিকে কয়েকটা সস্তা চেয়ার ফেলে ড্রইংরুম বানানো হয়েছে। নীলু যখন ঢাকায় পড়তে এলো, তখন কথা ছিল যে সে ইউনিভার্সিটির হলে বা কোন মেসে থাকবে। কিন্তু ফিরোজই জোর করে তাকে এ বাসায় নিয়ে আসে।

‘দশটা না বিশটা না, একটা মোটে শালা আমার, আর সে কিনা মেসে থাকবে? এটা কোন একটা কথা হোল?'

প্রথমে প্ল্যান ছিল যে ড্রইংরুমের এক পাশে একটা খাট পাতা হবে, এবং সেখানেই নীলু ঘুমাবে। কিন্তু সে প্ল্যানে ভেটো দিল নীলুই।
‘আমার নিজের একটা ঘর চাই, দুলাভাই। ছোট হোক অসুবিধা নাই, কিন্তু সেটা আমার ঘর।'
অতএব ছোট্ট স্টোর রুমেই নীলুর জায়গা হোল। খুউবই ছোট ঘর, তাতে কোনমতে একটা তক্তপোষ পাতা যায় কেবল। বাকী যে এক চিলতে জায়গা থাকে, তার জন্যে চিকন একটা টেবিলও যোগাড় করে ফেললো নীলু।

ক’দিন পর এসে গেল আরো স্লিম একটা আলনা। সেটাও কেমন করে যেন ঘরে ঢুকিয়ে ফেললো নীলু। ফিরোজ একদিন ঘরে ঢুকে তো অবাক।
‘শালাবাবু, তুমি তো রীতিমতো এলেমদার লোক হে।'
‘কেন? আমি কি করলাম আবার?'
‘আরে কি করোনি তাই বলো। এইটুকু এই ঘরে আগে দু বস্তা চাল আর এক বস্তা পিঁয়াজ ঢুকালেই সব জায়গা শেষ হয়ে যেতো। আর সেখানে তুমি কি ভাবে এত সব মাল-সামান ঢুকালে?'
‘আপনি বেশী বেশী বলেন দুলাভাই।'
‘তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই শালাবাবু। ইউনিভার্সিটিতে এইসব আলতু ফালতু জিনিস না পড়ে তুমি বরং আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়ে যাও। ঢাকায় এখন মালটিস্টোরীড বিলডিং বানানোর ধুম পড়েছে। অল্প জায়গার মধ্যে তুমি দারুণ সব অ্যাপার্টমেন্ট ডিজাইন করে ফেলতে পারবে।'

কে শোনে কার কথা? নীলুর পড়ার টেবিলে ক্রমাগত কবিতার বই জমে, সে আজকাল বাসায় বেশী সময় থাকে না। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে সে দাড়ি রাখে। এলোমেলো চুল ঘাড় বেয়ে নেমে যায়।

চিত্রা একদিন এসে বললো, ‘আয়- তোর চুলে বেণী করে দেই। দাড়ির সাথে ভারী মানাবে তোকে।'
নীলু হাসে। ‘আমার পিছনে লাগলি কেন? আমি তোর কোন পাকা ধানে মই দিলাম?'
‘আর কার পিছনে লাগবো বল?’
‘কেন দুলাভাই নেই? তার মাথায় বেণী কর।’
‘তোর দুলাভাইকে পাচ্ছি কোথায়? সে কদিনের জন্য টুরে ঢাকার বাইরে গেছে।’
‘একটা বাচ্চা নিয়ে ফেল তাহলে। তারপর তার মাথায় বেণী কর। বেণীতে একটা জবাফুল গুঁজে দিস।’

চিত্রা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। ছেলেবেলায় নীলুটা এতো ভীতু ছিল। যা দেখতো তাতেই সে ভয় পেতো। পিঁপড়ে দেখলে ভয় পেতো, বটের পাতা দেখলে ভয় পেতো। একবার চিত্রা তাকে চোখের পাতা উলটে ভয় দেখিয়েছিল, সেবার নীলুর জ্বর এসে গিয়েছিল। মা চিত্রাকে খুব বকেছিলেন। তখন কত ছোট ছিল নীলু। এখন সে কত বড়। এখন সে নীল কাগজে আবোলতাবোল কিসব লেখে।

বিছানার বালিশের নীচে দুটো কবিতার বই। খাটের নীচে তিনটে বই পাওয়া গেল আরো। চিত্রা বিছানার চাদর, বালিশের কাভার বদলে দেয়। টানটান করে দেয় চাদর। নীলু হয়তো এর কিছুই ধরতে পারবেনা। তার কাছে এসব অর্থহীন।

নীলু ঘরে ঢুকছিল। চিত্রাকে দেখে থেমে যায়। ‘তুই কি করছিস এখানে?’
‘আর কি? তোর জঞ্জাল সাফ করছি।’
‘জঞ্জাল কোথায়? এর সবকিছুই দরকারী। কোনকিছু ফেলে দিসনি তো?’
‘এতই যদি তোর দরকারী কাগজপত্র হয়, তাহলে সেগুলোকে যত্ন করে রাখিস না কেন?’
‘যত্ন করেই তো রাখা ছিল। তুইই তো এসে সবকিছু উল্টোপাল্টা করে দিলি।’
‘এটাও নিশ্চয়ই তোর খুব দরকারী কাগজ।’ চিত্রা বইয়ের নীচ থেকে নীল কাগজটি বের করে নীলুর হাতে দেয়।
নীলু কাগজটি মন দিয়ে পড়ে। পড়তে পড়তে সে আনমনে একটু হাসে। ‘কোথায় পেলি এটাকে? আমি খুবই খুঁজছিলাম কাগজটাকে ক’দিন আগে।’
‘এসব কে লিখেছে রে? তুই?’
নীলু বলে,‘হ্যাঁ, কেন?’
‘তুই কি আজকাল গাঁজা-টাজা খাচ্ছিস নাকি রে? এসব কি লিখেছিস? তোর এই ঘরে তো কোন জানালাই নেই। তুই এই ঘরে বসে চাঁদের আলো, জ্যোতস্না পাচ্ছিস কোথায়? আবার সেই আলোয় কার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিস লিখেছিস। সে আবার কে? লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম-ট্রেমও করছিস নাকি?‘

চিত্রার প্রশ্নের তোড়ে নীলু একটু হকচকিয়ে যায়। সাধারণতঃ চিত্রা দু এক কথার পরেই তার নিজের ঘরে চলে যায়। এত বেশি কথা বলেনা।

চিত্রা তাতে দমেনা। ‘কি, তুই কথা বলছিস না কেন? কথায় বলেনা, চোরের দশদিন আর সাধুর একদিন। ঠিক করে বলতো, তোর মতলবটা কি?’
নীলু চিত্রার কথায় হাসে। ‘তোর মাথায় পোকা আছে। কাজকাম নেইতো, খালি বসে বসে আগডুম-বাগডুম চিন্তা। শোন-আমি একটা ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর ক্লাশে ভরতি হয়েছি। তার জন্যে এই লেখাটা লিখছিলাম। আমাদের প্রত্যেককে একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখতে হবে।’
‘এই তোর অভিজ্ঞতা হোল?’
‘কেন হবে না কেন? অসুবিধা কি?’
‘অসুবিধা হচ্ছে জানালা-বিহীন ঘরে জ্যোতস্না ঢোকা নিয়ে।’
‘ও-এটা তো কোন ব্যাপারই না। তুই কি লেখাটাতে সময়টা খেয়াল করেছিস। এটা রাত্রির তৃতীয় প্রহরের ঘটনা। তৃতীয় প্রহরে কি হয় জানিস?’
চিত্রা ঠোঁট ওলটায়, মাথা নাড়ে। সে জানেনা।

নীলু সুর করে বলে,
‘পহেলা প্রহরমে সবকোই জাগে
দুসরা প্রহরমে ভোগী,
তিসরা প্রহরমে তস্কর জাগে
চৌঠা প্রহরমে যোগী।’

টিভিতে নিয়মিত হিন্দী সিরিয়াল দেখে দেখে চিত্রার ভাষাজ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অর্থ সে জানে। 'রাতের প্রথম প্রহরে সবাই জাগে। দ্বিতীয় প্রহরে জাগে ভোগবিলাসীরা। তৃতীয় প্রহরে চোর জাগে আর চতুর্থ প্রহরে উপাসনাকারীরা।'

নীলু বলে,‘রাতের তৃতীয় প্রহরে জাগে তস্কর। তস্কর কি শুধু মানুষ? তস্কর জ্যোতস্নাও হতে পারে। এই জ্যোতস্না তস্করের মত জানালা ছাড়াই আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে। এই জ্যোতস্নার আলোয় কি দেখা যায় জানিস?’

চিত্রা মাথা নাড়ে।

‘এই জ্যোতস্নার আলোয় দেখা যায় আমাদের সব গোপন জিনিস। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষজন। যারা এমনি আলোয় দেখা দেয়না। এই জ্যোতস্নায় দেখা দেয় আমাদের স্বপ্নেরা। রাত্রির তৃতীয় প্রহরে একদিন জেগে দেখিস। কত কি দেখবি তুই।’

নীলুটা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? চিত্রার নানা শেষ বয়েসে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে তখন শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হোত। নীলুও কি সেই পথে হাঁটছে?

চিত্রার মাথা ঝিম ঝিম করে। সে উঠে দাঁড়ায়। তাকে মাথায় ঠান্ডা পানি দিতে হবে।

(পরের অংশ আসছে)।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ভালো লাগছে, পরের পর্ব পড়ি।।।

তানবীরা এর ছবি

খুব সুন্দর উপস্থাপনা ।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।