সাম্প্রতিক কালের টিভিতে অনেকেই দেখেছেন পীলখানাতে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনাপ্রবাহের সংবাদ। এটা নিয়ে আমার এক বন্ধু নীচের লেখাটি পাঠিয়েছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে। তারা এ লেখা ছাপবে কিনা জানিনা। সেটি তাই এখানে দিয়ে দিলাম, তাতে অন্ততঃ কিছু সচেতন পাঠকের মনোযোগ হয়তো পাবে লেখাটি।
আমাদের স্যাটেলাইট টেলিভিশানদের সম্প্রচারের শিষ্ঠাচার
২৫শে ফেব্রুয়ারির অকল্পনীয় অচিন্তনীয় নির্মম হত্যাকান্ড আমাদের দেশে আরো একটা কালো অধ্যায় যোগ করলো। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সমগ্র দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে অপেক্ষা করছে জানার জন্য-কিভাবে কিছু সাক্ষাত শয়তান সেদিন পিলখানায় নেমে এসেছিল। যেসব পরিবার তাদের পরিজন হারিয়েছেন, তাদের দুঃখের সীমা আলোচনার ভাষা নেই, এখন যখন এই লেখাটি লিখছি, তখনো ৭২জন অফিসারের খোঁজ মেলেনি। গত দুইদিনের ঘটনা আমাদের মানবতা আর বিশ্বাসের ভিতকে আবারো নাড়া দিয়ে গেল। আর আমার জন্য এই ঘটনা বিশেষ কষ্টের, কারন আমি ব্যক্তিগতভাবে দুইজন কর্নেলকে চিনতাম, এছাড়া আমার বন্ধু চক্রের আরো দুইজন হারিয়েছে তাদের বন্ধু বা পরিজনদের। কর্নেল কাজী ইমদাদ আমার মায়ের আপন খালাত ভাই, সম্পর্কে আমার মামা হন আর কর্নেল আফতাবুল ইসলামের সাথে আমি বেইজিংয়ে ভাষা শিক্ষার কোর্স করেছিলাম এক বছরের মত সময়। একটু মন শান্ত হলে হয়তো তাদের নিয়ে লিখতে পারবো। আজ লিখতে হচ্ছে আমাদের টেলিভিশান মিডিয়া নিয়ে, না লিখলেই নয়, এটা এত গুরুত্বপুর্ন যে আমাদেরকে এটা নিয়ে ভাবতেই হবে, যদি আমরা আমাদের সভ্য সমাজ হিসাবে দাবি করতে চাই।
যখন কয়েক বছর আগে আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলি দেশে এবং পরবর্তীতে বিদেশে চালু হয় আমরা সবাই উত্ফুল্ল হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তথ্যের অবাধ প্রবাহ আর ইনফরমেশান হাইওয়ে আমাদেরকে আরো কাছাকাছি নিয়ে আসবে, ভৌগলিক দুরত্ব লাঘব করবে। কিন্তু অবাক হয়ে যাই যখন দেখি আমাদের এই চ্যানেলগুলো তথ্যের অবাধ প্রবাহের নামে এক উলঙ্গ প্রতিযোগিতায় নেমেছে, অর্ধ শিক্ষিত ক্যামেরাম্যনরা সম্প্রচারের কোড অব কনডাক্ট না মেনে মৃত মানুষের শেষ সন্মানহানি করে চলেছে আর আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এক ভয়াংকর মানসিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের চ্যানেলগুলিকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, মৃত মানুষেরও অধিকার এবং সন্মান আছে। আপনাদেরকে বুঝতে হবে কোন বিষয়টি কেমন স্পর্শকাতর এবং কোন বিষয়টি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জনগনের জন্য বিশেষ সময়ে প্রযোজ্য। সব কুত্সিত সত্যকে সবসময় ভিডিওতে দেখানো যায় না, বিশ্বের যেসমস্ত জাতি আজ নিজেদের সভ্য জাতিতে পরিনত করতে পেরেছে তারা সবসময় কুত্সিত সত্যকে যথোপযুক্তভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে, বিশেষ করে টেলিভিশান নিউজ ভিডিওয়ের ক্ষেত্রে। ২৫শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার সরাসরি ভিডিও প্রচারের সময়ে আপনারা হিতাহিত জ্ঞানশুন্যভাবে যেভাবে শহীদ সেনা অফিসারদের মৃতদেহ সারা বিশ্বে দেখিয়েছেন,সেজন্য আপনাদের সরাসরি ক্ষমা চাওয়া উচিত সেনা অফিসারদের পরিবারবর্গের কাছে এবং আপনাদের দর্শকদের কাছে।
একটা উদাহরন দেই,ঘটনার পরেরদিন যখন একজন মেজর-এর লাশ পাওয়া গেল, ভেবে দেখেছেন তার পরিবার আর বাহিনী যখন দেখল, তাদের কেমন লেগেছিল তাদের প্রিয় সন্তান নর্দমার পাশে মুখ থুবড়ে পরে আছে, একটা হলুদ রঙ্গের কাপড় (যেটা রাস্তার বিজ্ঞাপন থেকে খুলে নেয়া) দিয়ে তার নিথর শরীর ঢেকে রাখা, কয়েকজন তার পকেট হাতড়াচ্ছে আই ডি করার জন্য ? একটু ভাবুন যখন দেখালেন ম্যানহোলের ভেতর থেকে রডের হুক দিয়ে একজন অফিসারের দেহ তুলে আনা হচ্ছে,তার ছোট্ট ছেলে মেয়েরা সারা জীবন এই দৃশ্য দুঃস্বপ্নের মত দেখতে থাকবে, তারা হয়তো অসুস্থ হয়ে যেতে পারে অনেকদিনের জন্য।
অভাগা আমাদের দেশ, অভাগা এই জাতি, নইলে কেন দেখতে হবে সার্চ রেসকিউয়ের সময় পুলিশ একটা মোমবাতি নিয়ে ম্যনহোলের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে, খালি চোখে দেখা যায় সম্ভব নয়, তারপরও ডুবুরীদেরকে চেপে অক্সিজেন মাস্কসহ সেই ম্যানহোলের ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা। দেখলাম,যখন কিছু শিশু এবং মহিলা ছাড়া পেয়ে দৌড়ে গেট থেকে বের হলো, বিধ্বস্ত অবস্থায়, প্রায় ৫০ টা টিভি ক্যামেরা হুমড়ি খেয়ে পড়লো তাদের উপর, কেউ একবার ভাবতে পারলো না ওই সময় তার কিভাবে কথা বলবেন, কি বলবেন, কাদের জন্য বলবেন।
চ্যানেল, আপনাদের কিসের এত প্রতিযোগিতা- কে কত কুত্সিতভাবে মৃত মানুষ দেখাতে পারে সেই প্রতিযোগিতা ? আর কত গলা কাটা লাশ দেখাবেন, র্যবের ক্রসফায়ায়ের ডেডবডি জুম করে দেখাবেন? স্বজন হারানো পরিবার বর্গের কান্না জুম করে দেখাবেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা কিসব দেখে বড় হচ্ছে, এইসব দৃশ্য তাদের কেমন উপকার করবে? আমরা তো সাদা-কালো টেলিভিশান দেখে বড় হয়েছি, খুব তো তথ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি বলে মনে হয় না। পাঁচ মিনিট ডিলে ব্রডকাষ্টিং যদি যথাযথ ফিলটারের মাধ্যমে করা যায় আপনাদের মান বাড়বে বই কমবে না।
টিভি মিডিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা তো মৌমাছির চাকে ঢিল মারা, তবুও বলবো দয়া করে আপনাদের রিপোর্টার আর ক্যমেরাম্যানদের উপযুক্ত ট্রেনিং করান, কমনসেন্স ব্যবহার করতে শেখান। স্বাধীনতা যেমন অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন, মিডিয়া স্বাধীনতাও সেরকম যথাযথভাবে প্রয়োগ এবং রক্ষা করা কঠিন। ভারাক্রান্ত এক বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছি আমেরিকার উকিলকে বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোর সাম্প্রতিক টিভো রেকর্ডিং দেখিয়ে সম্প্রচার বন্ধের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চাচ্ছেন। আইনের শাসন যেহেতু এখানে সচল এই বিষয় হয়ত এই দেশের আদালতে উঠতে পারে। আমরা চাইব চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ না হয়ে বরং চ্যানেলগুলি দ্রুত নিজেদের শুধরে নিক।
মোশতাক শাকিল আহমেদ
ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০০৯
সিয়াটল, ওয়াশিংটন
মন্তব্য
শুধুই কি সেইসব চিত্র দেখানো? আমরা কয়দিন ধরে কি দেখছি? শোকসন্তপ্ত পরিবারকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃতদের কথা বলানো হচ্ছে। "তোমার আব্বু কি কি করতেন" ইত্যাদি।
ভেবে দেখেছেন আপনার চোখ দিয়েও কি পানি পড়ছে না এত হাহাকার দেখে। বলতে বাধ্য হচ্ছি (শহীদ ও তাদের পরিবারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে) নাটকের চেয়ে এগুলো দর্শকরা বেশি দেখে। "ট্রুথ ইজ মোর রিয়াল দ্যান ফিকশন"। কাজেই এগুলো দাও আর রেটিং বাড়াও। জনগনের অনুভূতিকেই পুঁজি করা হচ্ছে।
প্রথম দিন বিডিআরের সপক্ষে স্লোগানকে উস্কে দেয়া হয়েছিল বলে কিছু চ্যানেলের প্রতি অভিযোগ এসেছে। আমাদের চ্যানেলগুলোও কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত। তারাও সেনসেশনালিজমের আশ্রয় নেয় অপর পক্ষকে হেয় করতে।
একটি বিদেশী ব্লগার/ফটোগ্রাফার জেসিকা লিম গিয়েছিলেন বিডিআর ডিজি শাকিলের বাড়িতে ছবি তুলতে। তার বিষ্ময়কর একটি অবলোকন দেখুন:
http://panaphobia.blogspot.com/2009/02/unethical-photographers.html
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
লজ্জাস্কর ব্যাপার । কয়েকটি ক্যামেরার মালিক আমি, সেই সূত্রে নবিশ ফোটোগ্রাফার, আমার মাথা নিচু হয়ে গেলো অপমানে।
একই বিষয়ে একটা লেখা দেখলাম থার্ড আইয়ের ব্লগে। এই বিষয়গুলোকে লাইমলাইটে আনা প্রয়োজন এখনি। ব্যাপারটা কালচারের মত হয়ে গেছে। খালি বি গ্রেডের মুভির নাচ আর ধর্মানুভূতিই কি সেন্সর বোর্ডের কাঁচির আওতায় পড়ে ?
মিডিয়াগুলো আরো যে বাজে কাজটা করে তা হলো অনেক ঘটনা ঠিকঠাক পর্যবেক্ষন না করেই ততাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে টক-শো এর পসরা সাজিয়ে বসে। ঘটনার পরের দিন বা এর পরের দিন দেখলাম এক বুদ্ধিজীবী বলছেন, 'বিডিআর মৌচাকে ঢিল দিয়েছে...', আরেকজন কি প্রসঙ্গে বললেন, 'আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুকুমনি...'। পাশ থেকে উপস্থাপক শুধরে দিলেন, 'খুকুমনি নয় দিপুমনি...'। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ঠিকঠাক জানেন না বাদ দিলাম কিন্তু তাদের 'মৌচাকে ঢিল দিয়েছে জাতীয়' বিশ্লেষনের নমুনা দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
- আজকে মুন্নী সাহার একটা অনুষ্ঠান (!) দেখলাম। সেখানে তিনি পিলখানা হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারানো এক সেনা অফিসারের সহধর্মিনীকে জিজ্ঞেস করছেন, "আপনি কি মনে করেন তখন সাথে সাথে আর্মিকে 'এ্যাকশনে' যেতে দিলে আপনার স্বামীকে বাঁচানো যেতো?"
এছাড়া চ্যানেলগুলোতে প্রায়শঃই চোখে পড়ছে, কানে আসছে সেনা অফিসারদের শোকন্তপ্ত পরিবার পরিজনকে উদ্দেশ্য করে "আপনার কেমন লাগছে", "আপনি কি ভাবছেন"- টাইপের প্রশ্ন।
এ ধরণের প্রশ্ন করা সাংবাদিকদের প্রতি একটাই অনুভূতি আমার, "হোয়াট দ্য..."
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধন্যবাদ জাহিদ এবং শাকিল আপনাদের দুজনকে।
ভাই শাকিল আপনি হুবহু আমার মনের কথা গুলোই বলেছেন।
জানিনা কোন সংবাদ মাধ্যমে আপনার এ লেখাটি পাঠিয়েছেন?এরা আদৌ কি ছাপবে তা?
আপনারা সচলরা এভাবে সচল, সজাগ আর সরব হোন সমাজের সকল অসাবধানতা, অসংলগ্নতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যথেষ্ট হয়েছে আর নয়-----
বন্ধ হোক এ নির্মম প্রচারনা।
যে বীরদের নিষ্প্রান দেহ ঢাকা থাকার কথা লাল গোলাপের পাঁপড়িতে
কি দূর্ভাগা জাতি আমরা!
আমাদের বীরদের গলিত মথিত নিথর শরীর নিয়ে এ আমাদের কেমন পৈচাশিক প্রচারনা ?
(দীর্ঘশ্বাস---)
গত কয়েকদিন ধরে তাই আর টিভি দেখছিনা... প্রচন্ড মন খারাপ লাগে... শহীদ পরিবারগুলোতে সাংবাদিকরা ভীড় করছে... পরিবারের লোকদের এই ধরনের অবস্থার মধ্যে ডিস্টার্ব করছে... ভাবতে অবাক লাগে, টিভি দর্শকরা কি আসলেই ঘটনার পর শহীদদের পরিবারের মানসিক অবস্থা দেখতে চায়? আমি জানিনা... কিন্তু আমি দেখতে চাইনা...
_______________
এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।
_______________
::সহজ উবুন্টু শিক্ষা::
খুব সময়োপযোগী লেখা, এটা নিয়ে এখনি না ভাবলে আমাদের দেশের হিংস্রতা আরো বাড়বে। এমনিতেই অনেক মানুষের মনষ্যুত্ব ভোঁতা হয়ে গেছে। আরো লিখুন।
Arman
কিছুই বলার নাই। মাঝে মাঝে মানুষজন যে কী অসহ্যরকম অবিবেচক হতে পারে, টিভি মিডিয়ার কিছু সাংবাদিকের কাজকারবার দেখলে টের পাওয়া যায়।
লেখাটা খুবই ভাল লাগল।
খুবই লজ্জাজনক ছিল সে ঘটনা, আর এই প্রচার খালি টিভি তে থেমে থাকেনি, ফেসবুক, ইমেইলে ও আরো অনেকদিন যাবৎ চলেছে, আমার এক বন্ধু পত্নী তার ফুফাতো ভাইকে হারিয়েছে, তার ছবি ছিল ঐ প্যাকেজে, কাজেই আমার বন্ধুটি কয়েক জায়গায় অনুরোধ করেছিল, পরিবার পরিজনদের কথা ভেবে যেন এই প্রচার বন্ধ করা হয়, তাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করেছিল সেই ছবিদাতা
নতুন মন্তব্য করুন